Wednesday 10 March 2010

আইনি হাতের বেআইনি মার!: থানার হেফাজতে বন্দির মৃত্যু

পারভেজ খান, Kalerkantho, ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৭ ফাল্গুন ১৪১৬, ২৪ রবিউল আউয়াল ১৪৩১, ১১ মার্চ ২০১০
ঢাকার রমনা থানার হেফাজতে গত মঙ্গলবার জাকির নামে এক বন্দি মারা যাওয়ার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগের ঘটনা। মতিঝিল থানার পুলিশ মোটরসাইকেল আরোহী এক যুবককে ধরে থানায় নিয়ে হাজতে আটকে রাখে। তাঁর কাছে দাবি করা হয় ২৫ হাজার টাকা। অভিযোগ, যুবকের মোটরসাইকেল একটি প্রাইভেটকারকে আঘাত করে খানিকটা ক্ষতি করেছে। ওই প্রাইভেটকারটিও পুলিশ থানায় নিয়ে যায়। মালিককে মামলা করতে বলে। কিন্তু মালিক পুলিশের মনোভাব আঁচ করতে পেরে মামলা না করে থানা থেকে চলে যান। যাওয়ার আগে নিছক দুর্ঘটনা মেনে নিয়ে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেন মোটরসাইকেলচালককে।
ভদ্রলোক চলে গেলেও পুলিশ নাছোড়বান্দা। যুবককে টাকা দিতেই হবে। দুই ঘণ্টা সময় আর শ্রম নষ্ট করেছে পুলিশের। যুবকও নাছোড়বান্দা। তিনি কোনো টাকা দেবেন না। ব্যস। চটে যান থানার সেকেন্ড অফিসারসহ তিন পুলিশ সদস্য। বেধড়ক মারধর করা হয় যুবককে। মাটিতে ফেলে বুট দিয়ে থেঁতলানো হয় শরীর। থানার ভেতরে হাজতে পুরে লাঠি দিয়ে তুলোপেটা করা হয় আরেক দফা। শেষে পুলিশের হাত-পা ধরে কান্নাকাটি করে প্রাণভিক্ষা চান যুবক। খবর পেয়ে যুবকের এক পরিচিত পুলিশ সদস্যও থানায় আসেন। তিনি পল্টন থানার এসআই। শেষ পর্যন্ত তাঁর অনুরোধে এবং নগদ আট হাজার টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়া হয় যুবককে। যুবক এখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। কথা বলতে ও শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তাঁর।
এ ঘটনাটি মতিঝিল থানার একটি খণ্ডচিত্র মাত্র। এ রকম ঘটনা কোন থানায় না ঘটছে! রাজধানীর যেকোনো থানার সামনে দিয়ে হেঁটে গেলে বা কিছু সময় কান পেতে থাকলে আর্তনাদ ভেসে আসতে শোনা যাবে। ডিবি বা সিআইডি পুলিশের ভেতরের খবরও এক। পুলিশের এই বেপরোয়া আচরণের কারণে থানা বা কারা হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা বেড়ে চলেছে। যাঁরা মারা যাচ্ছেন, তাঁদের পরিবার থেকে অভিযোগ তোলা হয়, পুলিশের নির্যাতনেই এই মৃত্যু ঘটেছে। কিন্তু পরে পুলিশি ও আইনি ঝামেলার ভয়ে অনেকেই মামলা করেন না। তবে অনেক সময় ঘটনাগুলো প্রচারমাধ্যমে চলে আসে। ছাপা হয়, তোলপাড় হয় কিন্তু পরিবর্তন আসে না পুলিশের ওই আচরণের। পুলিশের সাফ কথা_জিজ্ঞাসাবাদে মারধরের কোনো বিকল্প নেই। মারধর করলে টাকা আর তথ্য দুটোই সহজে মেলে। পুলিশের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেই এসব তথ্য জানা গেছে।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর হিসাব মতে, প্রতি বছর পুলিশ ও কারা হেফাজতে মারা যাচ্ছে ৭০ জন। চলতি বছরের এ পর্যন্ত মারা গেছে ১০ জন। গত ২৮ জানুয়ারি শাহবাগ থানার এক বন্দি মারা যান আদালতের এজলাস কক্ষে। এর আগে কেরানীগঞ্জ থানায় গলায় ফাঁস নিয়ে আত্দহত্যা করেন এক রিকশাচালক। দুটি মৃত্যুর ঘটনায়ই অভিযোগ ছিল পুলিশের বিরুদ্ধে। সব শেষ রমনা থানা হেফাজতে মঙ্গলবার জাকিরের মৃত্যু।
পুলিশ আইনে নেই : অথচ এই মারধরের ব্যাপারে পুলিশ আইনে স্পষ্টভাবে নিষেধাজ্ঞা আছে। মানবাধিকারকর্মী অ্যাডভোকেট এলিনা খান গতকাল বুধবার কালের কণ্ঠকে বলেন, বন্দিকে মারধরের বিন্দুমাত্র অধিকার কোনো পুলিশের নেই। বন্দির কাছ থেকে তথ্য বের করতে হবে ঘটনার সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে, প্রকাশ্যে বা গোপনে তদন্ত করে। মারধর দূরে থাক, কাউকে ভয়-ভীতিও দেখানো যাবে না। এ সবের আইনগত বিধান নেই। তিনি বলেন, সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে স্পষ্ট বলা আছে, সবাই আইনের সমান আশ্রয়ের অধিকারী। মানবাধিকার সার্বজনীন ঘোষণাপত্রের পাঁচ অনুচ্ছেদে বলা আছে, কাউকে নির্যাতন করা যাবে না কিংবা কারো প্রতি নিষ্ঠুর অমানবিক বা অবমাননাকর আচরণ করা যাবে না। কিন্তু বাস্তবে পুলিশ এর কোনোটাই মানছে না।
এলিনা খান আরো বলেন, বরং বলা যায়, পুলিশের এই আচরণের কারণে বিচার চলাকালে মামলাটির আরো ক্ষতি হয়। মামলা থেকে মূল আসামি বা অপরাধী রেহাই পেয়ে যায়।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের একজন চিকিৎসক এবং কয়েকজন কর্মচারী জানান, প্রতিদিন কম করে হলেও ২৫-৩০ জন বন্দিকে পুলিশ আহত অবস্থায় এখানে নিয়ে আসে। আসে র‌্যাব সদস্যরাও। আহতরা সবাই মারধরের শিকার। হাসপাতালে তাদের জরুরি চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। কখনো কখনো ভর্তিও করা হয়।
মারের বিকল্প নেই! : নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা এ প্রতিবেদককে বলেন, পুলিশ প্রবিধান, সংবিধান, মানবাধিকার, আইন-কানুন যাই বলুন, মারধরের কোনো বিকল্প নেই। সেটা টাকার জন্যই হোক, আর তথ্য আদায়ের জন্যই হোক। ভালো ব্যবহার করলে কোনোটাই আসবে না। তা ছাড়া জিজ্ঞাসাবাদের জন্য এখন পর্যন্ত আধুনিক কোনো ব্যবস্থা আসেনি। পুলিশ সৃষ্টির পর সেই যে হাতে লাঠি তুলে দেওয়া হয়েছে, এখনো সেই লাঠিই জিজ্ঞাসাবাদের প্রধান অস্ত্র।
পুলিশ কর্মকর্তারা আরো জানান, তাঁরা আইনগতভাবে পরিষ্কার থাকার জন্য কাউকে ধরে থানায় এনে হাজতে ঢোকানোর আগেই এক দফা ধোলাই দিয়ে নেন। এরপর থানায় জিডি করে রাখা হয় যে, গ্রেপ্তারের সময় ধস্তাধস্তি বা পালানোর চেষ্টা করতে গিয়ে সে আহত হয়েছে। অনেক সময় আসামি গণধোলাইয়ে আহত হয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়। জিডি করে বন্দিকে নেওয়া হয় কোনো সরকারি হাসপাতালে। সেখানেও তাঁকে একইভাবে নথিভুক্ত করে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে থানায় আনা হয়। এভাবেই পুলিশ রক্ষাকবচ হিসেবে তার হাতের মুঠোয় নিয়ে নেয় থানার জিডি আর চিকিৎসকের সার্টিফিকেট। এরপর বন্দিকে থানায় এনে যত খুশি পেটাও, কারো কিছু বলার নেই। মরে গেলেও সমস্যা নেই। গণধোলাই বা ধ্বস্তাধ্বস্তিতে আহত হওয়ার কথা আগেই বলা আছে। আছে চিকিৎসকের সনদ।
আহত বললেই বিপদ : পুলিশ কর্মকর্তারা বলেন, কোনো বন্দিকে থানা হেফাজত থেকে আদালতে নেওয়া হলে জেলহাজত কর্তৃপক্ষ বন্দিকে জিজ্ঞাস করে, সে অসুস্থ কি না বা তাঁর শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন আছে কি না। বন্দি আঘাতের কথা বললে তাঁকে আর আদালতে হাজির না করে চিকিৎসার জন্য পুলিশ পাহারায় হাসপাতালে পাঠানো হয়। ফলে ওই দিন আর বন্দির জামিনের কোনো সুযোগ থাকে না। বরং উল্টো সে চলে যায় আবার পুলিশ হেফাজতে। এ কারণে বন্দি অসুস্থ হলেও তা সে ভয়ে গোপন রাখে। এ কারণেই পুলিশের হাতে প্রহৃত হয়ে অনেকে কারাগারে মারা যান।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আসামিকে মারধর করা হয় রিমান্ডে নিয়ে। এ কারণে বিচারকও অনেক সময় রিমান্ডের আদেশ দিয়ে পুলিশকে মারধর না করা বা সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশ দেন। অনেক ক্ষেত্রে তো আসামিকে রিমান্ড না দিয়ে কারাফটকে এসে পুলিশকে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেন আদালত।
পেটানোর কত পদ্ধতি : পুলিশ আসামিদের সাধারণত লাঠি দিয়ে বেপরোয়া পেটায়। এর বাইরে মারধরের যেসব পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে সেগুলো হচ্ছে_ হাত-পা একসঙ্গে বেঁধে, মাঝখানে লাঠি দিয়ে বাদুড়ের মতো করে ঝুলিয়ে পায়ের তলায় লাঠিপেটা করা। আরেক ধরনের নির্যাতন পুলিশে বহুল প্রচলিত। পুলিশ এই পদ্ধতিকে ওয়াটার থেরাপি বলে। হাত-পা বেঁধে মাটিতে ফেলে বুকের ওপর পা চেপে মুখে গামছা বেঁধে তার ওপর পানি ঢালা হয়। এই নির্যাতনটি খুবই কষ্টকর। অনেক সময় বন্দিদের ২৪ ঘণ্টা চোখ বেঁধে মাটিতে ফেলে রাখা হয়। আরেকটি নির্যাতন হচ্ছে_বৈদ্যুতিক শক। এই নির্যাতনে ব্যবহার করা হয় পুরনো দিনের হাতাওয়ালা টেলিফোন সেট। এ ছাড়া হাতের আঙুলে সুঁই ফোটানো, প্লাস দিয়ে নখ উপড়ে ফেলা, পায়ুপথে গরম ডিম দেওয়া, হাত বেঁধে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখাসহ নানা কিসিমের নির্যাতন তো রয়েছেই। পুলিশের বাইরে অন্য সংস্থাগুলোর কাছে আছে বৈদ্যুতিক চেয়ারসহ আরো কিছু আধুনিক যন্ত্র। এর সবই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। অতিমাত্রায় হলে তা মৃত্যুও ডেকে আনে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সহকারী অধ্যাপক আফসার উদ্দিন ও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. ফিরোজ আহমেদ বলেন, বৈদ্যুতিক শক ও গামছা বেঁধে মুখে পানি ঢালা মানবদেহের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এতে হৃদরোগ বা ফুসফুসের রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা ৯০ শতাংশ। তাছাড়া পুলিশের এই জ্ঞান নেই যে, কোথায় আঘাত লাগলে মৃত্যু ঘটতে পারে। তাই বেপরোয়া লাঠিচার্জও অনেক সময় মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

No comments:

Post a Comment