Thursday 25 March 2010

একই ধরনের ঘটনায় দুই নীতি : বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বলতে এখন কিছু নেই : বিশিষ্ট আইনজীবীদের মন্তব্য

স্টাফ রিপোর্টার
একই ঘটনায় আদালতে দুই ধরনের সিদ্ধান্ত। একই ধরনের মামলা কারওটা গ্রহণ করা হয়, আবার কারওটা খারিজ করে দেয়া হয়। একই ধরনের ঘটনায় কারও মামলায় বিবাদীর বিরুদ্ধে সমন, এমনকি ওয়ারেন্টও জারি করা হয়। কারও মামলা গ্রহণ না করে সরাসরি খারিজ করে দেয়া হয়। সংক্ষুব্ধ বা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি না হওয়ায় গত বুধবার সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর দায়ের করা একটি মামলা গ্রহণ করা হয়নি। ম্যাজিস্ট্রেট আদালত সরাসরি মামলাটি খারিজ করে দিয়েছেন। অন্যদিকে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি না হওয়া সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ নেতাদের দায়ের করা একের পর এক মামলা গ্রহণ করছেন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। বর্তমান সরকারের উপদেষ্টা তৌফিক-ই-এলাহি চৌধুরী ও প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের দুর্নীতির অভিযোগ প্রকাশ করায় আওয়ামী লীগ নেতাদের দায়ের করা ২৪টি মামলা গ্রহণ করেছেন বিভিন্ন জেলার জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। একই ঘটনায় পৃথকভাবে আওয়ামী লীগ নেতারা বিভিন্ন জেলায় মামলাগুলো দায়ের করেন। বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নাল আবদিন ফারুক প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিরুদ্ধে ভিওআইপি ব্যবসায় জড়িত থাকার অভিযোগ প্রকাশ করায় তার বিরুদ্ধেও এরই মধ্যে ১২টির বেশি মামলা দায়ের করেছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। দুটি মামলায় ওয়ারেন্ট ইস্যু করা হয়েছে জয়নাল আবদিন ফারুকের বিরুদ্ধে। বাকি মামলাগুলোতে আদালত সমন জারি করেছেন।
আমার দেশ সম্পাদকের বিরুদ্ধেও একটি মামলায় ওয়ারেন্ট ইস্যু করেছিলেন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। বাকি ২৩ মামলায় সমন জারি করা হয়।
সরকারের একজন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে বক্তব্য দেয়ায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি শওকত মাহমুদের বিরুদ্ধেও দুটি পৃথক মামলা দায়ের করেছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। ম্যাজিস্ট্রেট আদালত মামলা দুটি গ্রহণ করে সমন ইস্যু করেছেন।
আইনজীবীরা বলছেন, জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের এ ঘটনা প্রমাণ করছে আইনের শাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বলতে যা বোঝায় তা এখন নেই। সরকারের ইচ্ছায়ই যে আদালতগুলো চলছে এসব ঘটনায়—সেটাই প্রকাশ পাচ্ছে।
এক সাবেক জেলা ও দায়রা জজ বর্তমানে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী এ প্রসঙ্গে আমার দেশকে বলেন, মানহানি মামলা কেবল ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি দায়ের করতে পারেন। ক্ষতিগ্রস্ত বা সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি না হয়ে অন্য কেউ মানহানি মামলা দায়ের করলে সেটা গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু ফৌজদারি আইনে আমলযোগ্য অপরাধে কেউ থানায় এজাহার অথবা আদালতে নালিশি দরখাস্ত করার এখতিয়ার রাখেন। কারণ কোনো ফৌজদারি ঘটনা কারও সামনে ঘটলে সেটা থানা অথবা আদালতে না জানালে সেই ব্যক্তি অপরাধী বলে গণ্য হবেন। তিনি বলেন, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী সাবেক রাষ্ট্রপতি, সাবেক প্রধান উপদেষ্টা ও সাবেক সেনাপ্রধানসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে যে মামলাটি দায়ের করেছিলেন, সেটা সরাসরি ফৌজদারি অপরাধ। কারণ প্রধানমন্ত্রী নিজেই পবিত্র সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছেন, তাকে জরুরি অবস্থার সময় খাদ্যে বিষক্রিয়ার মাধ্যমে স্লো পয়জন দেয়া হয়েছিল। এটি একটি ফৌজদারি অপরাধের ঘটনা। হত্যা প্রচেষ্টার অপরাধে ফৌজদারি ও দণ্ডবিধি আইনে বিচার্য বিষয়। তিনি বলেন, এ ধরনের অপরাধের ঘটনা জানার পর যিনি মামলা করা থেকে বিরত থাকবেন, তিনি আইন লঙ্ঘন করছেন। তিনি বলেন, দেশের ফৌজদারি আইন অনুযায়ী খুনের ঘটনা বা খুন করার চেষ্টার ঘটনা কারও সামনে ঘটলে সেই ব্যক্তি মামলা দায়েরের এখতিয়ার রাখেন। প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে তাকে হত্যা প্রচেষ্টার ঘটনাটি প্রকাশ করেছেন। এ ঘটনায় তিনি নিজে মামলা দায়ের না করলেও যে কোনো ব্যক্তি মামলা দায়ের করার এখতিয়ার রাখেন। কারণ এ অপরাধ দেশের আইনশৃঙ্খলার সঙ্গে সরাসরি জড়িত। তিনি বলেন, আমলযোগ্য অপরাধ কেউ জানার পরও যদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে না জানিয়ে থাকেন—সেটাই একটা অপরাধ। কারণ যেখানে সরকার প্রধান নিজে অ্যাফেক্টেড সেখানে প্রতিটি নাগরিক অ্যাফেক্টেড। এ ঘটনায় সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী কেন, যে কোনো নাগরিক মামলা দায়ের করতে পারেন।
অন্যদিকে মানহানি মামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের স্বার্থের বিষয় জড়িত। সুতরাং যিনি ক্ষতিগ্রস্ত বা সংক্ষুব্ধ হবেন, তিনিই কেবল মানহানি মামলা দায়ের করতে পারেন। অন্য কেউ করলে সেটা গ্রহণযোগ্য নয়।
সাবেক আইনমন্ত্রী ও সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি আমার দেশকে বলেন, আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান ও বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নাল আবদিন ফারুকের বিরুদ্ধে একের পর এক মানহানি মামলা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতগুলো গ্রহণ করছেন। শুধু গ্রহণই করেননি, যে মামলায় ওয়ারেন্ট দেয়ার বিধান নেই, সেই মামলায় ওয়ারেন্ট দিচ্ছেন। আবার সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর দায়ের করা মামলাও খারিজ করে দিচ্ছেন আদালত। এসব ঘটনা প্রমাণ করে, আইনের শাসন এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বলতে যা বোঝায় সেটা দেশে নেই। সরকারের ইচ্ছায় আদালত চলছে—এটাই এসব ঘটনার মাধ্যমে দেশবাসীর সামনে প্রকাশ পাচ্ছে। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, আদালতের এ ধরনের দ্বৈত ও বৈষম্যমূলক নীতি অব্যাহত থাকলে আইনের শাসন ও মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত হবে। আদালত সরকারের আজ্ঞাবহ হিসেবে প্রমাণিত হলে বিচার বিভাগের ওপর থেকে মানুষের আস্থা চলে যাবে। এমনটি হলে দেশে অরাজকতা তৈরি হবে। তিনি বলেন, বিচারকদের উচিত আইন অনুযায়ী বিচার বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত দেয়া।
সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল-হকের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটার একটাই উত্তর, আইন কোনো দেশে দুই ধরনের হতে পারে না। আইন সবার জন্য এক ধরনের হবে। একই আইনের দুই ধরনের প্রয়োগ হলে বিচারব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা থাকবে না।

http://www.amardeshonline.com/pages/details/2010/03/26/24484

No comments:

Post a Comment