Wednesday 31 March 2010

সরকারের ইশারায় চলছে দুদক : সরকারের কারও বিরুদ্ধে হুট করে কিছু করা ঠিক হবে না : চেয়ারম্যান



অলিউল্লাহ নোমান
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বিরোধী দলকে দলনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আইনে স্বাধীন বলা হলেও সরকারের নিয়ন্ত্রণ ও ইশারায় পরিচালিত হচ্ছে দুদক। বর্তমান সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং বিভাগের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও দুদক নীরব। এ প্রসঙ্গে দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমানের মন্তব্য হচ্ছে, সরকারের কারও বিরুদ্ধে হুট করে কিছু করা ঠিক হবে না। কাউকে জোর করে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চাই না। বিনা টেন্ডারে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের ৩৭০ কোটি টাকার কাজ বিদেশি কোম্পানিকে বরাদ্দ দেয়া, মত্স্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রীর বিরুদ্ধে অধীনস্থ পরিদফতরে ডিজির দুর্নীতির অভিযোগ, নিয়ম লঙ্ঘন করে সরকারি প্রতিষ্ঠানের গাড়ি ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের ব্যবহার—এর কিছুই দুদকের নোটিশে নেই।
দুদক চেয়ারম্যানের ভাষায় সরকারের কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ দুদকে নেই। তবে সুনির্দিষ্ট তথ্যভিত্তিক অভিযোগ পেলে তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখবেন। গত মঙ্গলবার সেগুন বাগিচায় তার কার্যালয়ে আমার দেশ-এর সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি এই অভিমত ব্যক্ত করেন।
এদিকে দুদক বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াসহ বিরোধী দলের অনেক নেতার বিরুদ্ধে একের পর এক অনুসন্ধান, তদন্ত, মামলা দায়ের ও চার্জশিট দিয়ে চলছে। বিরোধী দলের নেতাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা যেসব মামলা হাইকোর্ট বিভাগ ও আপিল বিভাগের নির্দেশে স্থগিত আছে সেগুলো পুনরায় শুনানির উদ্যোগও নিয়েছে দুদক। নতুন করে বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ভৈরব সেতু নির্মাণে অনিয়মের কথিত অভিযোগের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য বার বার চিঠি দিচ্ছে দুদক। জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের প্রথম সারির নেতা ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এমকে আনোয়ার, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী, বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, বিএনপি নেতা হাফিজ ইব্রাহিমসহ অনেকের বিরুদ্ধে দুদক বিভিন্ন বিষয়ে তদন্ত করছে। দুদকের তদন্ত-অনুসন্ধান থেকে বাদ নেই দৈনিক আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানও। তার বিরুদ্ধেও বেনামি অভিযোগের ভিত্তিতে দুদক অনুসন্ধান করছে।
দুদকের বর্তমান চেয়ারম্যান গোলাম রহমান দায়িত্ব গ্রহণের আগে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে বর্তমান সরকার কর্তৃক নিয়োগ পান। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় তিনি প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সচিব ছিলেন। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বর্তমান পদে নিয়োগ লাভের পর ২০০৯ সালে ৪৭৫টি মামলার চার্জশিট দেয়া হয়েছে। নতুন মামলা দায়ের করা হয়েছে ২৩৪টি। এই চার্জশিট দাখিলের মধ্যে রয়েছে বেগম খালেদা জিয়া ও তার বড় ছেলে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা, আরাফাত রহমান কোকোর বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং মামলা, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বাবু গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা, তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের কথিত অভিযোগে দায়ের করা মামলাসহ বিরোধী দলের অনেক নেতার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা। গত ১৩ মাসে সরকারের অনেক মন্ত্রী ও উপদেষ্টার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হলেও দুদক নীরব। পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত এসব অভিযোগ আমলে না নিলেও বেনামি অভিযোগ আমলে নিয়ে সরকারের সমালোচনাকারীদের নানাভাবে হয়রানি করছে দুদক।
দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলছেন সরকারের মন্ত্রী ও এমপি কারও বিরুদ্ধে দুদকের কোনো অভিযোগ নেই। অভিযোগের ভিত্তিতে দুদক তদন্ত-অনুসন্ধান চালায় বলে জানান দুদক চেয়ারম্যান। গত মঙ্গলবার বিকালে দুদক কার্যালয়ে চেয়ারম্যানের দফতরে আমার দেশ-এর প্রশ্নের জবাবে গোলাম রহমান বলেন, বিরোধী দল থেকে দুর্নীতির অভিযোগ শুধু মিডিয়ায় বললেই চলবে না। ঢালাওভাবে দুর্নীতির অভিযোগ করলেই হবে না। সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্তসহ দুদকের কাছে সরকারের কোনো মন্ত্রী বা কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ পেশ করা হলে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা হবে। তবে সরকারের কারও বিরুদ্ধে হুট করে কিছু করা ঠিক হবে না। কাউকে জোর করে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতেও চাই না। দুদক শুধু বিরোধী দলের সদস্যদের বিরুদ্ধে তদন্ত-অনুসন্ধান ও মামলা দায়ের করছে এই অভিযোগ সত্য নয় উল্লেখ করে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, এটি হলে ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীর হাইকোর্ট বিভাগে মামলায় জয়ী হওয়ার পর দুদক আপিল করত না। দুদকের মামলায় আদালতে আপত্তির কারণে সরকারি দলের নেতা ডা. এইচবিএম ইকবালকে কারাগারে যেতে হয়েছে। কিন্তু এগুলো হচ্ছে জরুরি অবস্থার সরকারের সময়ে দায়ের করা মামলা। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর দুদক সরকারি দলের কারও বিরুদ্ধে মামলা করেছে এমন নজির তিনি দেখাতে পারেননি।
বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়েছিল, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার লক্ষ্যে দুর্নীতি দমন কমিশনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে শক্তিশালী করা হবে। বর্তমান তদন্ত-অনুসন্ধান ও মামলা দায়েরের প্রেক্ষিতে দুদক সরকারের একটি আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে গোলাম রহমান বলেন, দুদক আইন সংশোধনীর জন্য সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছিল এতে অনেক জায়গায় আপত্তি দেয়া হয়েছে। সরকারের প্রস্তাবিত সংশোধনীগুলোর আপত্তিকর জায়গাগুলোতে দুদকের নিজস্ব অভিমত দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, আশা করছি কেবিনেটে এই অভিমতগুলোসহ আইনের খসড়া সংশোধনীর প্রস্তাবনাটি উপস্থাপন করা হবে। এছাড়া দুদক নিজে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা রাখে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, দুদকে যারা আসেন তারা জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে নয়, সরকারের মনোনীত ব্যক্তি হিসেবে দুদকে নিয়োগ পান। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে জাতীয় সংসদে প্রণীত আইনের দ্বারাই দুদক পরিচালিত হয় বলে উল্লেখ করেন দুদক চেয়ারম্যান।
দুদক প্রাপ্ত অভিযোগের ভিত্তিতে বিরোধী দলের নেতাদের বিরুদ্ধে তদন্ত-অনুসন্ধান এবং সম্পদের হিসাব চাইছে। কিন্তু বর্তমান সরকারি দলের নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়েছিল প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্য এবং সংসদ সদস্য ও তাদের পরিবারের সদস্যদের সম্পদের হিসাব ও আয়ের উত্স প্রতি বছর জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে। সরকারি দল আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের এই প্রতিশ্রুতির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, সরকারের মন্ত্রী, এমপিদের সম্পদের হিসাব চাওয়ার এখতিয়ার দুদকের নেই। এই প্রতিশ্রুতির বিষয়ে ভালো জবাব দিতে পারবেন সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও সরকারির দলের সাধারণ সম্পাদক। তাদের জিজ্ঞাসা করুন। অথবা নির্বাচনী ইশতেহারে প্রকাশিত প্রতিশ্রুতির বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের করণীয় কিছু থাকলে তারা করতে পারেন বলে উল্লেখ করেন দুদক চেয়ারম্যান।
অপর দিকে দুদকের সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, বিশেষ একটি গোয়েন্দা সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী দুদক এখনও তদন্ত-অনুসন্ধান এবং মামলা দায়েরের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। মইন উ আহমদের নিয়ন্ত্রিত জরুরি অবস্থার সরকারের সময়ও দুদক চলত তাদের ইশারা এবং নির্দেশে। সূত্রটি জানায়, দুদকের অভিযোগের মূল ভিত্তি হচ্ছে একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে প্রাপ্ত নির্দেশনা।

http://www.amardeshonline.com/pages/details/2010/04/01/25335

No comments:

Post a Comment