Saturday 10 April 2010

১৯৭২-৭৫-এর রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র

১৯৭২-৭৫-এর রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র
একথা দেশের সকল মানুষেরই জানা বিষয় যে, স্বাধীনতা-পরবর্তী অসংখ্য রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের সঙ্গে ইসলামপন্থী দল তথা ধর্মভিত্তিক রাজনীতির কোন সম্পর্ক ছিলনা। কি শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা আর কি জিয়াউর রহমান, জেনারেল মঞ্জুর, খালেদ মোশাররফ কিংবা কর্ণেল তাহের এঁরা কিভাবে নিহত হয়েছেন দেশবাসীর তা জানা। কারাগারে চার নেতার হত্যাকান্ডের ঘটনা ? শেখ মুজিবের বিখ্যাত উচ্চারণ : ‘কোথায় সিরাজ শিকদার’Ñএর সিরাজ হত্যাকান্ড? এভাবে চেনা-অচেনা বহু সামরিক, অসামরিক ও রাজনৈতিক নেতা-কর্মী নিহত হয়েছেন। কিন্তু এসবের সাথে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের কোন সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। অথচ সবচেয়ে বেশী প্রতিহিংসার শিকার হয়েছে ইসলামপন্থীরাই। এ যেন প্রবাদের সেই ‘কেষ্ট ব্যাটাই চোর।’ এ বিষয়ে একটি সংক্ষিপ্ত টাইমলাইন দেয়া গেল :-
>১৯৭২ সালের জানুয়ারী মাসে ঢাকার প্রকাশ্য রাজপথ থেকে সশস্ত্র ব্যক্তিরা স্টুয়ার্ড মুজিবকে তুলে নিয়ে হত্যা করে। প্রায় কাছাকাছি সময়েই হত্যা করা হয় নরসিংদীর বীর মুক্তিযোদ্ধা নেভাল সিরাজকে। নেভাল সিরাজ ছিলেন ভাসানী ন্যাপের লোক এবং নরসিংদী অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান নেতা। একদিন বিকেলে গুপ্তঘাতকের গুলিতে তিনি নিহত হলেন। তবে গুপ্তঘাতক কারা তা একেবারে অজানা ছিলোনা। তারা ছিলো স্থানীয় মুজিব বাহিনীর লোকজন। স্বাধীনতার ঊষালগ্নেই এইভাবে শুরু হলো হত্যার রাজনীতি।
>১৯৭২ সালের ৯ই জুন সিরাজগঞ্জে শাহজাদপুর কলেজের ১৮নং কক্ষে ব্রাশ ফায়ার করে জাসদ কর্মী কোরবানসহ ৭জনকে হত্যা করা হয়।
>সে বছরই ২৪ জুলাই মুজিববাদীরা অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত হয়ে পল্টন ময়দানে আসম রবের নেতৃত্বাধীন ছাত্রলীগের সমাবেশে হামলা চালালে আসম রবসহ শতাধিক আহত হয়।
>১০ই অক্টোবর ঢাকার নবাবগঞ্জে কেন্দ্রীয় জাসদ নেতা সিদ্দিক মাস্টারকে শাসক দলের গোপন বাহিনী স্টেনগানের ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে।
>একই বছর ১৮ই জুলাই খুলনা জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি বাবর শেখকে আওয়ামী লীগ এমপির বাড়িতে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়।
>১৯৭৩ সালের ২৭শে মে নরসিংদীতে জাসদের মিছিলে গুলি চালিয়ে থানা জাসদ নেতা আলাউদ্দীনসহ ১০জনকে হত্যা করা হয়।
>এ বছরই গাইবান্ধার কালিবাড়িতে সদর থানা জাসদ সভাপতি সুজা (বীরবিক্রম)কে প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি করে মারা হয়।
>১০ই আগস্ট বরিশালে জাসদের মিছিলে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয় জাসদ ছাত্রলীগের ৩ নেতাকে।
>একই বছর পাবনার ঈশ্বরদী এয়ারপোর্ট থেকে অপহরণ করে সিরাজগঞ্জের জাসদ নেতা আবদুস সালামকে এসিড দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়।
>অক্টোবরে পাবনায় রক্ষীবাহিনী পিটিয়ে খুন করে জাসদ কর্মী আশফাক, ফারুক, মাসুদ ও সিদ্দিকুর রহমানকে।
>একই মাসেই রাজশাহীর বাগমারা থানায় একই দলের সাধারণ সম্পাদক মনিরকে তার ছোট ভাইসহ হত্যা করা হয়।
>২১শে সেপ্টেম্বর বগুড়ার রহমান নগর মোড়ে মুজিববাদীরা ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে জাসদ ছাত্রলীগের ৩ নেতা রুনু, রশিদ ও তোতাকে।
>সে বছরই সাতক্ষীরা জেলা জাসদের সাধারণ সম্পাদক আবদুল লতিফকে খুন করে মুজিববাদীরা।
১৯৭৩ সালে হত্যালীলায় নতুন মাত্রা যোগ হয় রাজধানীতে।
>১লা জানুয়ারী ঢাকায় ভিয়েৎনামে মার্কিন হামলার প্রতিবাদে মস্কোপন্থী ছাত্র ইউনিয়ন বিক্ষোভ মিছিল বের করলে গুলীতে মতিউল ও কাদেরুল নামে দু’জন নিহত হয়। রাজপথে গুলী করে মানুষ হত্যার জন্য পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীকে দায়ী করা হতো, স্বাধীন বাংলাদেশে তারই পুনরাবৃত্তি করে মুজিব সরকার।
>সে বছর ৬ই সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের সামনে মুশতাক, আজাদ ও শহীদসহ ৪ রাজনৈতিক কর্মীকে গুলি করে হত্যা করে মুজিববাদীরা।
>১৬ই সেপ্টেম্বর ঢাকার নবাবগঞ্জে রক্ষীবাহিনীর সহায়তায় বাবলু, রবি ও সম্পদসহ জাসদ ছাত্রলীগের ৭জন নেতা-কর্মীকে শত শত লোকের সামনে গুলি করে মারে মুজিববাদীরা।
>৬ই অক্টোবর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের জিএস জাসদ ছাত্রলীগ নেতা রোকনকে খুন করা হয়।
>১৯৭৪ সালের ৪ঠা এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসিন হলের টিভি রুমে একই সঙ্গে ৭জন ছাত্রকে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করা হয়। যা দেশব্যাপী তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করে। শিক্ষাঙ্গনে বড় মাত্রার সন্ত্রাসের প্রথম ঘটনা ছিল এই হত্যাকান্ড। মুজিববাদী ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে এই হত্যাকান্ড ঘটে। নিহতরা হলো কোহিনুর, ইদ্রিস, জিন্নাহ, হোসেন, এবাদ, মাসুদ ও কোহেল।
>’৭৪ সালের ৩রা ফেব্র“য়ারী জাসদের কেন্দ্রীয় সহ সভাপতি ও জাসদ নেতা কাজী আরেফ আহমেদের শ্বশুর এ্যাডভোকেট মোশাররফ হোসেন মুজিববাদীদের গুলিতে খুন হন।
>‘৭৫সালের ২রা জানুয়ারী বন্দী অবস্থায় সাভারে ঠান্ডা মাথায় গুলি মারা হয় সিরাজ শিকদারকে। হত্যার পর শেখ মুজিব হুঙ্কার দিয়ে ঘোষণা করেন, ‘কোথায় সিরাজ শিকদার ?’
>৯ই জানুয়ারী নোয়াখালীর জাসদের অন্যতম নেতা ইঞ্জিনিয়ার নজির আহমদকে হত্যা করা হয়।
১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত দেশ ছিল কার্যতঃ রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের এক উর্বর ভুমি। আর এসব হত্যাযজ্ঞের তালিকা প্রকৃত সংখ্যার তুলনায় খুবই সামান্য। এর শিকার দলগুলোর দাবী অনুযায়ী এই সংখ্যা অর্ধ লক্ষাধিক। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, এসব ঘটনার সঙ্গে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির সম্পৃক্ততার কোন সুযোগ ছিলনা। তা ছিল ধর্মনিরপেক্ষবাদী ও সমাজতন্ত্রীদের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও ক্ষমতার লড়াইয়ের ফসল।
দেশের রাজনীতিকে উল্টেপাল্টে দেবার মতো হত্যার ঘটনা প্রথম সংঘটিত হয় ১৯৭৫ সালে। ১৫ই আগস্ট নিহত হন প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবর রহমান ও তাঁর সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তি শেখ ফজলুল হক মণি ও আবদুর রব সেরনিয়াবাতসহ তাঁদের পরিবারের সদস্যবর্গ। সেই বছরেই ক্যু-পাল্টা ক্যু-তে নিহত হন খালেদ মোশাররফ। কারাগারে হত্যা করা হয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর এবং এএইচএম কামারুজ্জামানকে। ষড়যন্ত্রের অভিযোগে বিচার করে ১৯৭৬ সালে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয় কর্ণেল তাহেরের।
১৯৮১ সালের ৩০শে মে চট্টগ্রামে বিপথগামী সেনাসদস্যদের হাতে নিহত হন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। এই হত্যাকান্ডকে কেউ শেখ মুজিব হত্যার পাল্টা ঘটনা হিসেবে দেখেন, আবার কেউ এর সঙ্গে এরশাদের ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সম্পৃক্ত করার প্রয়াস পান। জিয়া হত্যার পরপরই জেনারেল মঞ্জুরসহ কয়েকজন সামরিক অফিসারও মারা যান। কিন্তু এতোসব হত্যাকান্ডের সঙ্গে ইসলামপন্থী রাজনীতির কোন সম্পর্ক নির্দেশ করা যায়নি।
১৯৮২ সালে সামরিক আইন জারির পর এরশাদ সরকারের ৯ বছরেও বেশ কিছু রাজনৈতিক হত্যাকান্ড ঘটে। ১৯৮৪ সালের এপ্রিলে যশোরের পত্রিকা সম্পাদক গোলাম মাজেদকে কারাগারে দীর্ঘ নির্যাতন করা হয়। তিনি মুক্তির এক সপ্তাহের মধ্যে মারা যান। এরপর বিভিন্ন সময়ে হত্যাকান্ডের শিকার হন শ্রমিক নেতা আবদুর রহমান ও তাজুল ইসলাম, আওয়ামী লীগ নেতা ময়েজউদ্দীন, ডা. শামসুল হক মিলন, ছাত্রনেতা শাজাহান সিরাজ, রউফুন বসুনিয়া, সেলিম, দেলোয়ার, জাফর, জয়নাল, দিপালী সাহা, নুর হোসেন, তিতাসসহ বহুসংখ্যক নেতা-কর্মী। ১৯৮৩ সালের ১৪ ও ১৫ই ফেব্র“য়ারী এবং ২৮শে নবেম্বর তৎকালীন সরকারের নির্দেশে কত মানুষকে গুলি করে হত্যা করা হয় তার কোন সঠিক পরিসংখ্যান আজো পাওয়া যায়নি।
অন্যদিকে, ১৯৯১ সাল থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ২ হাজারের বেশী ছাত্র-সংঘর্ষ ঘটে। এসব ঘটনায় নিহত হয় ১২০ জনের মত, আহত হয় প্রায় ১০ হাজার। এগুলোর বেশীর ভাগই ঘটে বাম ও ধর্মনিরপেক্ষবাদীদের হাতে। প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠনকে ক্যাম্পাস থেকে উৎখাত করতে কিংবা নিজ দলের মধ্যে ব্যক্তিগত ও আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে অথবা ঠিকাদারীর সঙ্গে জড়িয়ে তারা সংঘাতে লিপ্ত হয়। ‘বাংলাদেশে সন্ত্রাস, রাজনীতি ও অন্যান্য প্রসঙ্গ’ শীর্ষক গ্রন্থে ড. নজরুল ইসলাম ১৯৯১ সালের একটি পরিসংখ্যানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘর্ষের বিবরণ দিতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন, ‘বিএনপি সমর্থিত ছাত্রদলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের হিসেবে ৪টি, আ’লীগ সমর্থিত ছাত্রলীগের সঙ্গে ১০টি এবং এককভাবে ১৫টি সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটায়। অন্যদিকে আ’লীগ সমর্থিত ছাত্রলীগ ১৯৯১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫৫টি সন্ত্রাসী ঘটনার সঙ্গে যুক্ত ছিল। এর মধ্যে ১০টি ছিল ছাত্রদলের সঙ্গে, ৮টি অভ্যন্তরীণ কোন্দল, ৪টি জাসদ ছাত্রলীগের সঙ্গে এবং ৩৩টি বিচ্ছিন্নভাবে ছাত্রলীগ ঘটিয়েছে। জাসদ ছাত্রলীগ ৫টি সন্ত্রাসী ঘটনায় যুক্ত।
দেশে গত কয়েক বছরে বেশ ক’জন সাংবাদিক নিহত ও আহত হন সন্ত্রাসীদের হাতে। এঁদের মধ্যে রয়েছেন খুলনার পত্রিকা সম্পাদক হুমায়ুন কবীর বালু, সাংবাদিক মানিক সাহা, শেখ বেলাল উদ্দীন, হারুনুর রশীদ, নহর আলী ও শুকুর হোসেন। যশোরে নিহত হন সাংবাদিক শামছুর রহমান কেবল, পত্রিকা সম্পাদক সাইফুল আলম মুকুল, সাতক্ষীরার পত্রিকা সম্পাদক স.ম. আলাউদ্দীন, ঝিনাইদহের আরেক পত্রিকা সম্পাদক ইলিয়াস হোসেন দিলীপ, চট্টগ্রামের কামাল হাসান প্রমুখ। ২০০৩ সালের অক্টোবরে ফেনীর সাংবাদিক (বর্তমানে ঢাকায় প্রথম আলোয় কর্মরত) টিপু সুলতানকে আওয়ামী লীগের এমপি জয়নাল হাজারী বাহিনীর নির্যাতন ও হাত-পা ভেঙ্গে দেয়ার ঘটনা দেশে ব্যাপক আলোড়ন তোলে।
এই দীর্ঘ তালিকার হত্যাকান্ডের সঙ্গে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির কোন সম্পর্ক নির্দেশ করতে পারেনি কেউ। শুধু হাওয়ায় গদা ঘোরানো হয়েছে, আর সত্যকে মিথ্যা এবং মিথ্যাকে সত্য বলে চালানোর প্রয়াস নিয়েছে ধর্মবিরোধী ষড়যন্ত্রী মহল।

No comments:

Post a Comment