Saturday 10 April 2010

মিডিয়া সন্ত্রাসের দু-চারটা নমুনা দেখুন | ড. হোসেন খিলজী

ক. বিদেশে যাওয়া বনাম দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া

জামায়াত নেতা মীর কাশেম আলী দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। এটা ২৮ মার্চ কয়েকটি পত্রিকার অন্যতম প্রধান খবর। কোন মন্তব্য করার আগে কয়েকটি পত্রিকার কিছু অংশ থেকে কোট করা যাক।

মীর কাশেম আলী দেশ ছেড়েছেন! শীরোনামে ২৮ মার্চ প্রথম আলো লিখেছে, �জামায়াতের নির্বাহী কমিটির সদস্য ও দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশনের চেয়ারম্যান মীর কাশেম আলী বিদেশে গেছেন। গত ২৪ মার্চ সকালে তিনি কাতার এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে ঢাকা ছেড়ে যান। ইমিগ্রেশন ও গোয়েন্দা সূত্রগুলো এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া শুরুর প্রাক্কালে মীর কাশেম আলীর এই বিদেশ গমনকে সরকারি কর্তৃপক্ষ দেশ ছেড়ে যাওয়া হিসেবে দেখছেন। কারণ তাঁর বিরুদ্ধে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধ করার অভিযোগ আছে। বিমানবন্দর সূত্র জানায়, মীর কাশেম আলীর সঙ্গে তাঁর পুত্র মীর আরমান আলী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি এনামুল হকও ছিলেন। ঢাকা ত্যাগের সময় তাঁরা বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহার করেন। সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, মীর কাশেম আলী বিমানবন্দর ত্যাগ করার সময় আওয়ামী লীগের এক সাংসদ বিদেশ থেকে ফিরছিলেন। তিনি কাশেম আলী কীভাবে ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহার করে বিদেশে যাচ্ছেন, তা জানতে চাইলে হইচই শুরু হয়। এরপর বিষয়টি জানাজানি হয়। ততক্ষণে তিনি চলে গেছেন। পরে লাউঞ্জ ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ার অভিযোগে বিমানবন্দরের একজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়।�

২৮ মার্চ যুগান্তর লিখেছে, �দেশ ছেড়েছেন মীর কাশেম আলী। একাত্তরের ঘাতক হিসেবে অভিযুক্ত এবং দিগন্ত মিডিয়া কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান মীর কাশেম আলী দেশ ছেড়ে সৌদি পালিয়ে গেছেন। তিনি বুধবার কাতার এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ত্যাগ করেন। ইমিগ্রেশন সূত্রে জানা গেছে, ২৪ মার্চ কাতার এয়ার ফ্লাইট কিউআর-৩৪৫ বিমানযোগে মীর কাশেম আলী দেশ ছাড়েন। দুবাই হয়ে সৌদি আরব গেছেন এবং এখন তিনি সেখানে অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে। বিমানবন্দর সূত্র জানায়, মীর কাশেম আলীর সঙ্গে তার পুত্র মীর আরমান আলী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি এনামুল হকও ছিলেন। �

২৮ মার্চ জনকন্ঠে শংকর কুমার দে পরিবেশিত খবরে বলা হয়, �ভিআইপি লাউঞ্জ দিয়ে মীর কাশেম আলী বিদেশ গেলেন! সরকারের যুদ্ধাপরাধীদের বিদেশ যাতায়াতের ওপর নিষেধাজ্ঞার প্রতি তোয়াক্কা না করে যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলী ও কেন্দ্রীয় ছাত্র শিবিরের সাবেক সভাপতি মজিবুর রহমান মঞ্জু সৌদি আরব চলে গেছেন। সূত্র জানায়, স্বাধীনতা দিবসের দু'দিন আগে গত ২৪ মার্চে জামায়াত নেতা ও যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলী ও কেন্দ্রীয় ছাত্র শিবিরের সাবেক সভাপতি মজিবুর রহমান মঞ্জু সৌদি আরব যাওয়ার জন্য হযরত শাহ্জালাল বিমানবন্দরে যান। বিমানবন্দরে গিয়ে মীর কাসেম আলী ভিআইপি লাউঞ্জে অবস্থান নেন। তিনি যখন সৌদি আরব যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন তখন বিদেশ থেকে এসে বিমানবন্দরে অবতরণ করেন ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস এমপি। ব্যারিস্টার তাপস যুদ্ধাপরাধীদের বিদেশে যাতায়াত ও বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহারের দৃশ্য দেখে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। সিভিল এ্যাভিয়েশনের কর্মকর্তাদের ডেকে তিনি এর কৈফিয়ত চান। এই ঘটনায় তোলপাড় শুরু হয়ে যায় গোটা বিমানবন্দরে।�

২৯ মার্চ মানবজমিন লিখেছে, �তিনি বিদেশ যাওয়ার আগে বিমানবন্দরে বিশেষ সুবিধা পাওয়ার জন্য চিঠি দিয়েও অনুমতি নিয়েছেন। সিভিল এভিয়েশন সূত্র জানায়, মীর কাশেম আলী কেবল বিদেশে চলে গেছেন এমন নয়- তিনি চিঠি দিয়ে সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ভিআইপি গেইট ব্যবহার করা, ভিআইপি লাউঞ্জের পাশের লাউঞ্জও ব্যবহার করেছেন। দিগন্ত টেলিভিশনের চেয়ারম্যান হিসেবেই তিনি বিমানবন্দরে সুবিধা পাওয়ার জন্য সিভিল এভিয়েশনের সহায়তা চেয়েছিলেন। তার পক্ষ থেকে এ জন্য সিভিল এভিয়েশন অথরিটির কাছে চিঠি দেয়া হয়েছিল। ২২শে মার্চ পরিচালক, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বরাবর দেয়া ওই চিঠিতে তিনি ২৪শে মার্চ সকালে কাতার এয়ারওয়েজের ফ্লাইটে দোহা হয়ে রিয়াদ যাওয়ার কথা জানিয়েছেন। আরও জানিয়েছেন, আগামী ৮ই এপ্রিল তিনি দেশে ফিরবেন। যাওয়া-আসার সময় তাকে বিশেষ সুবিধা দেয়ার অনুরোধ জানানো হয়। ওই চিঠির প্রেক্ষিতে সিভিল এভিয়েশন অথরিটি তাকে বিশেষ সুবিধা দেয়ার ব্যবস্থা করেন। এদিকে দিগন্ত মিডিয়া কর্পোরেশনের প্রশাসন বিভাগের কর্মকর্তা মুজাহিদ বলেন, চেয়ারম্যান স্যার বিদেশ যাওয়ার আগে সব পত্রিকায় প্রেস রিলিজ পাঠিয়ে তার বিদেশ যাওয়ার খবরটি জানানো হয়েছিল। তিনি অফিসের কাজে গেছেন। পালিয়ে যাননি। তিনি পালিয়ে গেলে পত্রিকায় প্রেস রিলিজ দেয়া হতো না। এছাড়াও তিনি বিমানবন্দর দিয়ে যাচ্ছেন তা-ও আগেই জানিয়েছেন। মীর কাশেম আলী আগামী ৮ই এপ্রিল দেশে ফিরবেন।

আমাদের সময় ২৯ মার্চ লিখেছে, � গত ১৫ মাসে নানা প্রয়োজনে তিনি ইউরোপ, আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ ও মালয়েশিয়া সফর করেছেন এবং যথারীতি দেশে ফিরেও এসেছেন। �

মীর কাসেম আলীর পালিয়ে যাওয়ার খবরে তোলপাড় শীরোনামে ২৯ মার্চ সমকাল লিখেছে, �জামায়াতে ইসলামীর নির্বাহী কমিটির সদস্য ও দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশনের চেয়ারম্যান মীর কাসেম আলীর বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা নিয়ে সরকারে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। যদিও মীর কাসেমের পারিবারিক সূত্র দাবি করেছে, তিনি পালিয়ে যাননি। সপ্তাহের মধ্যে আবার ফিরে আসবেন। তার ছেলে ব্যারিস্টার মীর আরমান আলী দাবি করেছেন, বাবা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাননি। তিনি আগামী সপ্তাহেই দেশে ফিরবেন। এদিকে মীর কাসেম আলীর বিদেশ যাওয়ার কারণ জানিয়েছে তার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও পরিবার। দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশনের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, মীর কাসেম আলী কাতারভিত্তিক স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল আল-জাজিরার সঙ্গে অনুষ্ঠান বিনিময় চুক্তি করতে কাতার হয়ে সৌদি আরব গেছেন। অন্যদিকে আরমান আলী দাবি করেছেন, মীর কাসেম আলী দিগন্ত টিভি দর্শক ফোরামের সৌদি আরব শাখার সম্মেলনে যোগ দিতে সৌদি আরব গেছেন। আগামী সপ্তাহে তিনি দেশে ফিরবেন।�

নয়া দিগন্ত ৩০ মার্চ লিখেছে, �কয়েকটি পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় গত ২৮ মার্চ দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশনের নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান মীর কাসেম আলী দেশ ছেড়েছেন মর্মে প্রকাশিত একটি সংবাদের প্রতিবাদ করেছে দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশন লিমিটেড। এ তথ্য বিভ্রান্তিকর ও অসত্য। সংস্থার এক প্রতিবাদলিপিতে বলা হয়, জনাব মীর কাসেম আলী দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশন এবং তার নিজস্ব হাউজিং ও পয�টন ব্যবসার প্রয়োজনে দেশের বাইরে গেছেন। গত কয়েক মাসে এ ধরনের প্রয়োজনে তিনি ইউরোপ, আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ ও মালয়েশিয়া সফর করেছেন এবং যথারীতি দেশে ফিরেও এসেছেন। এবার সৌদি আরব ও কাতার সফরের সময় তিনি উমরাহ পালন করবেন এবং কাতারের একটি টেলিভিশন নেটওয়ার্কের সাথে দিগন্ত টেলিভিশনের অনুষ্ঠান বিনিময় সংক্রান্ত এক আলোচনায় যোগ দেবেন।�

প্রিয় পাঠক দেখুন, প্রথম আলো ও যুগান্তর লিখেছে, মীর কাশেম আলীর সঙ্গে ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি এনামুল হকও ছিলেন। আবার জনকন্ঠ লিখেছে, সঙ্গে ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি মজিবুর রহমান মঞ্জু সৌদি গেছেন। এনামুল হক আর মজিবুর রহমান মঞ্জু এক হয় কি করে! অন্যদিকে প্রথম আলো ও যুগান্তরের মতে, মীর কাশেমের সাথে আছেন তার পুত্র মীর আরমান আলীও। সমকালে রিপোর্টে দেখা যায় তার পুত্র আরমান দেশেই আছেন। তাদের কাছে তিনি প্রতিক্রিয়াও দিয়েছেন।

খ. ঢাকায় আছেন নাকি যুক্তরাজ্যে আছেন

যুদ্ধাপরাধীদের শিরোমনী জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযম বর্তমানে যুক্তরাজ্যে আছেন। খবরটি দিয়েছে দেশের প্রধান প্রত্রিকার দাবিদার প্রথম আলো ২৬ মার্চ-এ।

টিপু সুলতান পরিবেশিত খবরে ২৫ জনের বিষয়ে অনুসন্ধান শীরোনামে লেখা হয়েছে, �যুদ্ধাপরাধী হিসেবে প্রাথমিকভাবে ২৫ জনের ব্যাপারে অনুসন্ধান শুরু করেছে কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থা। সরকারের গঠিত তদন্ত কমিটিকে সহায়তা করতেই মাসখানেক ধরে গোয়েন্দারা ওই সন্দেহভাজনদের অপরাধের ব্যাপারে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের কাজ করছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান, অনুসন্ধান অব্যাহত রয়েছে, যুদ্ধাপরাধীদের এ সংখ্যা আরও বাড়বে। প্রাথমিকভাবে যে ২৫ জনের ব্যাপারে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে, তাঁদের অনেকেই জামায়াতে ইসলামীর সাবেক ও বর্তমান শীর্ষ পর্যায়ের নেতা। এ তালিকায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও দলটির সাবেক সাংসদ আবদুল আলীমের (জয়পুরহাট) নামও রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাকি ২৪ জন হচ্ছেন জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযম (বর্তমানে যুক্তরাজ্যে আছেন), জামায়াতের বর্তমান আমির মতিউর রহমান নিজামী, নায়েবে আমির মাওলানা এ কে এম ইউসুফ, মাওলানা আবদুস সুবহান ও দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লা.........�।

মানবজমিন ২৭ মার্চ প্রথম আলোর রিপোর্টটি নকল করে একই তালিকা প্রকাশ করে। এমনকি হুবহু লিখে� সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাকি ২৪ জন হচ্ছেন জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযম (বর্তমানে যুক্তরাজ্যে আছেন), জামায়াতের বর্তমান আমির মতিউর রহমান নিজামী, নায়েবে আমির মাওলানা এ কে এম ইউসুফ, মাওলানা আবদুস সুবহান ও দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লা.........�।

গোলাম আযম অসুস্থ, ঢাকায় আছেন। এটা সমকালের ২৮ মার্চের খবর। সমকাল লিখেছে, � জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযমের শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। তিনি বর্তমানে মগবাজারের কাজী অফিস গলির নিজ বাসভবনেই চিকিৎসা নিচ্ছেন। হাঁটুর ব্যথা, স্নায়বিক দুর্বলতা ও সায়াটিকা সমস্যাসহ বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছেন বলে জানা গেছে। গোলাম আযমের ব্যক্তিগত সহকারী নাজমুল হক সমকালকে এসব তথ্য জানান। গত বৃহস্পতিবার সরকার যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল ঘোষণা করেছে। যুদ্ধাপরাধের জন্য সবচেয়ে বড় অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। বিভিন্ন সময়ে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে যেসব ব্যক্তির তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে সব তালিকাতেই গোলাম আযমের নাম শীর্ষে রয়েছে। গোলাম আযম ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের আমির ছিলেন। সেই সময় তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিলেন। গোলাম আযম বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর যুক্তরাজ্যে চলে যান। নাজমুল হক জানান, গোলাম আযম বর্তমানে মগবাজারের কাজী অফিস গলির নিজ বাসভবনে অবস্থান করছেন। তিনি বার্ধক্যজনিত নানাবিধ রোগে ভুগছেন। কারও সাহায্য ছাড়া হাঁটাচলা করতে পারেন না। গোলাম আযমের পাঁচ ছেলে বিভিন্ন দেশে বসবাস করেন। তার স্ত্রী সৈয়দা আফিফা তার সঙ্গেই বসবাস করেন। গোলাম আযম বর্তমানে যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন বলে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে যে খবর পরিবেশন করা হয়েছে তা সত্য নয় বলে নাজমুল হক সমকালকে জানিয়েছেন। �

উল্লেখ, টিপু সুলতান ফেনীর জয়নাল হাজারীর ক্যাড়ারদের হাতে মার খাওয়া সেই সাংবাদিক। উনিই নাকি প্রথম আলোর অনেক অনুসন্ধানী আর এক্সক্লুসিভ খবরের সংবাদদাতা। দেশের প্রধান যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযম কোথায় আছেন, এটা জানে না আমাদের প্রধান পত্রিকা। গোলাম আযম দেশে আছেন না বিদেশে পালিয়ে আছেন এটা খোজ খবর নেওয়ার বিন্দুমাত্র প্রয়োজন বোধ করেন না এরা। দিলেন একটা এক্সক্লুসিভ রিপোর্ট করে। প্রথম আলোর অফিস থেকে গোলাম আযম দুরত্ব মনে হয় দুই কিলোর বেশী হবে না । এরাই এখন আমাদের সেরা পত্রিকা। এরাই আমাদের বিশিষ্ট অনুসন্ধানী সাংবাদিক।

গ. নাবালক যখন যুদ্ধাপরাধী

প্রতিদিন এখন পত্রিকাগুলোতে যুদ্ধাপরাধীর নিত্য নতুন তালিকা প্রকাশিত হচ্ছে। কোন প্রত্রিকার মতে সরকার যুদ্ধাপরাধীর তালিকায় আছেন ২৬ জন, কেঊ লিখেছে ৩১ জন, ৩৬ জন, ৪০ জন আবার কেউ লিখেছে ৫০ জন। ঐ সব তালিকায় যে কয়েকজনের নাম এসেছে তার মধ্যে জামায়াত নেতা রফিকুল ইসলাম খান (ঢাকা জামায়াত আমির) আর আব্দুল হাকিম (ঠাকুরগাঁও আমির) অন্যতম।

যুদ্ধাপরাধীর তালিকায় মৃত ও ওই সময়ের শিশুরা শিরোনামে আমারদেশ ২৭ মার্চ লিখেছে, �সম্প্রতি প্রকাশিত ৩৬ জনের তালিকায় ৪ থেকে ৮ বছর বয়সের তিনজন রয়েছেন। তালিকায় অন্তর্ভুক্ত জামায়াতে ইসলামীর ঢাকা মহানগর আমির মোঃ রফিকুল ইসলাম খান ১৯৬৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া উপজেলার নওকৈড় গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা মোঃ খোরশেদ আলম খান। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ শুরুর দিন তার বয়স ছিল ৪ বছর ৬ মাস। ১৯৯২ সালে তিনি এমএ পাস করেন। ওই সময়েই ছাত্রশিবিরের সভাপতির পদ থেকে অবসর নেয়ার পর তিনি জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। সরকারের কাছে সংরক্ষিত যুদ্ধাপরাধের তালিকায় তার নাম রয়েছে। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি (ঘাদানিক), সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য তথ্য সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠান ফেক্টস ফাইন্ডিংসহ বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থার দেয়া তালিকার আলোকে এরই মধ্যে সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধী হিসেবে ৩৬ জনের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। সরকারের বিভিন্ন সংস্থার উদ্ধৃতি দিয়ে সংবাদমাধ্যমগুলোও তাদের নাম প্রকাশ করেছে। এ তালিকায় খুলনার জামায়াত নেতা মিয়া গোলাম পরোয়ার ও চট্টগ্রামের মাওলানা সামসুল ইসলামসহ আরও কয়েকজনের নাম রয়েছে। ১৯৭১ সালে যাদের বয়স ছিল সর্বোচ্চ ৮-১০ বছর। আইন ও বিচার বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, সরকার ইচ্ছা করলে যে কোনো লোককে যে কোনো অপরাধের আওতায় ফেলে বিচার করতে পারে। কিন্তু সেটা নিয়ে দুদিন পরে হলেও প্রশ্ন উঠবে। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে যাদের বয়স ৩ থেকে ৫ বছর ছিল এমন শিশুদের মুক্তিযুদ্ধকালে মুজিবনগর সরকারের কর্মচারী দেখিয়ে সম্প্রতি প্রথম শ্রেণীর গেজেটেড অফিসারের চাকরি দেয়া হয়েছে। কাজেই ৩ বছরের শিশু যদি মুক্তিযোদ্ধা হতে পারে ৫ বছরের শিশু কেন রাজাকার হতে পারবে না?

যুদ্ধাপরাধীদের নামের তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে রফিকুল ইসলাম খান আমার দেশকে বলেন, যুদ্ধাপরাধের বিচার সরকারের মূল লক্ষ্য নয়। তাদের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে জামায়াতে ইসলামীসহ ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্তদের নির্মূল করা। আমার বাবা ও চাচাসহ আমাদের পরিবারের সবাই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। আমার চাচার ঘরটি ছিল মুক্তিযুদ্ধের সাব-ক্যাম্প। ওই সময় আমার বয়স ছিল মাত্র সাড়ে ৪ বছর। একটি মুক্তিযোদ্ধা পরিবারে জন্ম নিয়েও এখন জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার কারণে আমাকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে দেখানো হচ্ছে। কাজেই এটি আর বুঝতে অসুবিধা নেই, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়েই আওয়ামী লীগ জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের যুদ্ধাপরাধী হিসেবে দেখাচ্ছে। তবে সরকার যত অপচেষ্টাই করুক, অতীতের মতো সত্য প্রতিষ্ঠিত হবেই।

উল্লাপাড়া উপজেলার সলপ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল হোসেন বলেন, রফিকুল ইসলাম খানকে আমি এ কারণেই চিনি যে, তার বাবা ও চাচাসহ আমরা একত্রে যুদ্ধ করেছি। যুদ্ধের মাত্র কয়েক বছর আগে তার জন্ম হয়েছে। যুদ্ধের সময় যে শিশুটি ভালোভাবে হাঁটতেই শেখেনি তাকে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর কারণটা আমার বুঝে আসছে না। উল্লাপাড়ার বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ইসা খান বলেন, হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া এবং জোরপূর্ব মানুষকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দিয়ে তাদের ঘরবাড়ি দখলের অপরাধে যদি ৪ বছরের শিশুকে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে বিচার করা হয়, তাহলে বুঝতে হবে দেশে আইনের শাসন নেই।

ঠাকুরগাঁও জামায়াত আমির নজরদারিতে। এটা ২৯ মার্চ পত্রিকা গুলোর অন্যতম খবর। মার্চ ২৮ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, �যুদ্ধাপরাধীর তালিকায় নাম থাকায় ঠাকুরগাঁও জেলা জামায়াতের আমির আব্দুল হাকিমকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। রোববার ভোর থেকে তার শহরের বাসার আশপাশে সাদা পোশাকে গোয়েন্দা পুলিশ অবস্থান নেয়। পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট বি এম হারুন-অর-রশিদ বলেন, গোয়েন্দা সংস্থা এবং পত্র পত্রিকায় যুদ্ধাপরাধীদের তালিকায় নাম থাকায় তাকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, "তার নিরাপত্তার স্বার্থেই সেখানে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। তবে তিনি ইচ্ছা করলে বাড়ির বাইরে কাজে যেতে পারেন।"

সকালে সাংবাদিকদের কাছে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আব্দুল হাকিম দাবি করেন, ১৯৭১ সালে তার যুদ্ধাপরাধী হওয়ার কোনো অবকাশ নেই। ১৯৮৫ সালে তিনি জামায়াতে ইসলামির সঙ্গে জড়িত হন। রাজনৈতিকভাবে হয়রানি করার উদ্দেশ্যে তার নাম যুদ্ধাপরাধীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সংবাদ বিজ্ঞপ্তির সঙ্গে তিনি তার জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপিও পাঠান। বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রবীর কুমার রায় বলেন, জামায়াত নেতা হাকিমের বাড়ি এ উপজেলার জিয়াবাড়ি গ্রামে। ১৯৭১ সালে হাকিম ছিলেন কালমেঘ মাদ্রাসার ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র। �

২৯ মার্চ ভোরের কাগজের সহযোগী পত্রিকা দিনের শেষে আব্দুল হাকিমকে কোট করে লিখেছে, � তিনি ১৯৭০ সালে স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক ব্রত্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন�। অপরদিকে সমকাল, জনকন্ঠ, প্রথম আলো, যুগান্তর ঠাকুরগাঁও জামায়াত আমিরকে যুদ্ধাপরাধী্ ও গ্ববন্দি করার নিঊজটি দিলেও তার বয়স, সাংবাদিকদের কাছে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তি, জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি পাঠানো সবকিছুই চেপে যায়।

লেখকঃ গবেষক, মানবাধিকার কর্মী, ইমেইল, hossain.khilji@yahoo.com

No comments:

Post a Comment