Saturday 10 April 2010

বিতর্কিত বিচারপতি নিয়োগের খবরে সমালোচনা : আইনের শাসন আছে কিনা সন্দিহান আইনজীবীরা : সুপ্রিমকোর্ট বার সভাপতি

স্টাফ রিপোর্টার
সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতির বিদেশে গিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনা সভায় যোগদান, সুপ্রিমকোর্টে প্রধান বিচারপতির এজলাস ভাংচুরকারী ও খুনের মামলার আসামিকে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেয়া সংক্রান্ত সংবাদে আইনজীবীদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে হাইকোর্ট বিভাগ ও আপিল বিভাগের রায় অনুযায়ী প্রধান বিচারপতির সুপারিশই হচ্ছে অস্থায়ী নিয়োগ ও স্থায়ীকরণের ক্ষেত্রে মূল ভিত্তি। প্রধান বিচারপতি খুনের মামলার আসামি ও সুপ্রিমকোর্টে ভাঙচুরে জড়িতদের কীভাবে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করছেন—এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে আইনজীবীদের মধ্যে।
সুপ্রিমকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিনিয়র অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি আমার দেশকে বলেন, এসব ঘটনা বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করেছে। দেশে আইনের শাসন আছে কিনা, এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যেও এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। আইনের শাসন আছে কিনা, এ নিয়ে আমরা আইনজীবীরাও সন্দিহান। খুনের মামলার আসামিকে বিচারপতি নিয়োগ দেয়া হচ্ছে মর্মে সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পরপরই তড়িঘড়ি করে সেই খুনের মামলা থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নাম প্রত্যাহার করে নেয়া আইনসম্মত হয়েছে কিনা জানতে চাইলে খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, এটা সম্পূর্ণ বেআইনি হয়েছে। ফৌজদারি আইনে খুনের মামলার প্রধান আসামির নাম এভাবে তড়িঘড়ি করে প্রত্যাহার করে নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। আর এ ধরনের ব্যক্তিকে বিচারপতি বানানোর উদ্দেশ্যে খুনের মামলা থেকে তার নাম প্রত্যাহার করা হয়ে থাকলে সরকার প্রমাণ করেছে তারা আইনের শাসন চায় না। সরকারের এই আচরণ বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি ও বিচারপতি নিয়োগের স্বচ্ছতা বিনষ্ট করেছে।
সিনিয়র অ্যাডভোকেট ড. শাহদীন মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি আমার দেশকে বলেন, বিচারপতি নিয়োগে স্বচ্ছতা থাকা উচিত। যাকে উচ্চ আদালতের বিচারপতি নিয়োগ দেয়া হচ্ছে, তিনি প্রশ্নের ঊর্ধ্বে থাকলেই ভালো। খুনের মামলার আসামিকে বিচারপতি নিয়োগ দেয়া হচ্ছে—এই সংবাদ প্রকাশের পর তড়িঘড়ি করে মামলা থেকে সেদিনই তার নাম প্রত্যাহার করে নেয়া আইনসম্মত কিনা জানতে চাইলে তিনি সরাসরি উত্তর না দিয়ে বলেন, ২০ বছর আগে দায়ের করা মামলা প্রমাণ করা কঠিন। সাক্ষীরা অনেকেই তখন ঘটনার অনেক কিছু ভুলে যায়। তিনি বলেন, কমন সেন্স থেকে এটা বলা যায়—একটা মামলার জন্য কারও জীবন আটকে যাবে, এটাও মনে হয় খুব একটা ফেয়ার হবে না। তিনি বলেন, ২০ বছর আগে দায়ের করা খুনের মামলাটির কেন বিচার নিষ্পত্তি হয়নি, সেটাও দেখার বিষয় রয়েছে। বাদীপক্ষ মনে হয় ততটা তত্পর নেই। তখন তাকে জানানো হয়, চার্জ গঠনের সময় কয়েকজন আসামিকে বাদ দেয়ার বিষয় চ্যালেঞ্জ করে বাদীপক্ষের একটি রিভিশন আবেদনের প্রেক্ষিতেই হাইকোর্ট বিভাগ মামলাটির কার্যক্রম স্থগিত রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন। গত বছরের ২ জুলাই হাইকোর্ট বিভাগ নির্দেশ দিয়েছেন সবাইকে চার্জশিটভুক্ত করার জন্য এবং যাকে বিচারপতি বানানো হচ্ছে, তিনি এই মামলার প্রধান আসামি। তার বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করা হয়েছে। জবাবে শাহদিন মালিক বলেন, ২০ বছর কেন মামলাটির অগ্রগতি হয়নি, সেটাও একটা বিষয়। কারও বিরুদ্ধে মামলা থাকলে জীবন আটকে থাকতে পারে না। তখন তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয় সরকারি চাকরিজীবীদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগ উঠলে নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তিনি সাময়িক বরখাস্ত থাকেন। বিচারে নির্দোষ প্রমাণ হলেই কেবল আবার চাকরিতে যোগ দিতে পারেন। এ অবস্থায় কেউ খুনের মামলার প্রধান আসামি হলে বিচারপতি হতে পারেন কিনা জানতে চাইলে ড. শাহদীন মালিক সরাসরি কোনো জবাব দেননি।
এদিকে সুপ্রিমকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক ব্যারিস্টার বদরুদ্দোজা বাদলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, এ ধরনের নিয়োগ হলে মেনে নেয়া যায় না। সুপ্রিমকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে এই নিয়োগ প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগামীকাল সুপ্রিমকোর্ট খোলার দিনে সিনিয়র আইনজীবীদের সঙ্গে একটি বৈঠক হবে। সিনিয়র আইনজীবীরা মিলে বৈঠকে বসে কর্মসূচির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সঙ্গে বিচারপতির আলোচনা সভায় বসার বিষয়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে কোনো আবেদন জানাবেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, সিনিয়র আইনজীবীদের বৈঠকেই সব সিদ্ধান্ত হবে। তিনি বলেন, এরই মধ্যে সভাপতির সঙ্গে এসব বিষয় নিয়ে কথা হয়েছে। সভাপতি সিনিয়র আইনজীবীদের নিয়ে বৈঠকে বসে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করবেন বলে জানিয়ে দিয়েছেন।
১৯৮৮ সালের ১৭ নভেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আবদুল লতিফ হলের ছাত্র আসলাম প্রতিপক্ষের হামলায় নিহত হন। এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ১৯৮৮ সালের ১৮ এপ্রিল রাজশাহীর বোয়ালিয়া থানায় ৩০ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়। এই থানায় ১৯৮৮ সালের নভেম্বর মাসে দায়ের করা মামলাটির নং ১৪। এ মামলার প্রধান আসামি হলেন তত্কালীন জাসদ ছাত্রলীগ নেতা রুহুল কুদ্দুস বাবু। মামলার এজাহারে বলা হয়—রুহুল কুদ্দুস বাবু কিরিচ দিয়ে আসলামকে কুপিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে। পুলিশ তদন্ত শেষে ১৯৮৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ১ নং আসামি রুহুল কুদ্দুস বাবুসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। চার্জ গঠনের ওপর শুনানি শেষে আদালত বাবুসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করে। বাকি কয়েকজনকে চার্জ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। এই অব্যাহতি আদেশের বিরুদ্ধে মামলার বাদীপক্ষ হাইকোর্ট বিভাগে রিভিশন দায়ের করে। রিভিশনের শুনানি শেষে ২০০৯ সালের ২ জুলাই হাইকোর্ট বিভাগের একটি বেঞ্চ রায় দেন। রায়ে চার্জশিটভুক্ত সব আসামির বিরুদ্ধে চার্জ গঠনের জন্য নিম্ন আদালতের প্রতি নির্দেশ দেয়া হয়। এই মামলাটি বর্তমানে রাজশাহীর দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন। আসামিরা জামিনে রয়েছে বলে জানিয়েছেন মামলার সংশ্লিষ্ট আইনজীবী।
এদিকে গত বৃহস্পতিবার খুনের মামলার প্রধান আসামি বিচারপতি হচ্ছেন শিরোনামে দৈনিক আমার দেশ-এ সংবাদ প্রকাশের পর তড়িঘড়ি করে সরকার রুহুল কুদ্দুস বাবুসহ ৯ জনের নাম প্রত্যাহার করে নেয়। হত্যাকাণ্ডের মামলার এফআইআরকারী বাদীর আইনজীবীদের না জানিয়ে এবং তাদের কোনোরকমের শুনানির সুযোগ না দিয়েই সংশ্লিষ্ট পিপি রুহুল কুদ্দুস বাবুসহ ৯ জনের নাম প্রত্যাহারের জন্য আদালতের কাছে আবেদন করেন। রাজশাহীর সংশ্লিষ্ট আদালত সেই আবেদনটি বৃহস্পতিবারই গ্রহণ করেছেন। আসলামের পরিবারের আইনজীবী জানান, হাইকোর্ট থেকে আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠনের নির্দেশ থাকার পরও নাম প্রত্যাহার করার অর্থ হচ্ছে হাইকোর্ট ও দেশের প্রচলিত আইনকে অবজ্ঞা করা। তিনি বলেন, এতেই প্রমাণ করে সরকার দেশে আইনের শাসনে বিশ্বাস করে না। সরকার নিজের ইচ্ছেমত আদালতকে পরিচালিত করছে।
উল্লেখ্য, সরকার হাইকোর্ট বিভাগে আরও ১৫ বিচারপতি নিয়োগের জন্য একটি তালিকা চূড়ান্ত করেছে বলে জানা গেছে। এ তালিকায় খুনের মামলার প্রধান আসামি রুহুল কুদ্দুস বাবু, সুপ্রিমকোর্টে ভাঙচুরকারী আইনজীবী খসরুজ্জামানের নামও রয়েছে বলে জানা গেছে।
অপরদিকে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি এইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী সম্প্রতি লন্ডন সফরে গিয়ে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের নেতা, আওয়ামী বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত আবদুল গাফফার চৌধুরী ও ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবিরের সঙ্গে আলোচনা সভায় যোগ দিয়ে বিতর্কের ঝড় তুলেছেন। চারদলীয় জোট সরকারের সময় অস্থায়ী থেকে স্থায়ী বিচারপতি নিয়োগ না পাওয়ার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে তিনি রিট আবেদন করেছিলেন। এই রিট আবেদনের রায়ের আলোকে বর্তমান সরকারের আমলে তিনি স্থায়ী বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। অস্থায়ী মেয়াদ শেষে স্থায়ী বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ না পাওয়ার পর ৭ বছর নিজস্ব পেশায় ফিরে গিয়েছিলেন তিনি। তার মামলার রায়েই হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগ বলে দিয়েছে অস্থায়ী বিচারপতি নিয়োগ, স্থায়ী নিয়োগ সব ক্ষেত্রে মূল ভিত্তি হবে প্রধান বিচারপতির সুপারিশ। এখন প্রশ্ন উঠেছে—এই রায়ের আলোকে প্রধান বিচারপতির সুপারিশ অনুযায়ী নিয়োগ হচ্ছে, নাকি নিয়োগে সরকারের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটছে।

http://www.amardeshonline.com/pages/details/2010/04/10/26757

No comments:

Post a Comment