Thursday 22 April 2010

দুদক হচ্ছে নিধিরাম সর্দার



শরীফুল ইসলাম | সমকাল ২৩ এপ্রিল ২০১০
অবশেষে দুর্নীতি দমন কমিশন ঢাল-তলোয়ারবিহীন নিধিরাম সর্দারে পরিণত হচ্ছে। দুদক আইন-২০০৪ যেভাবে সংশোধন হচ্ছে, তাতে এ সংস্থাটির স্বাধীনতা খুব সামান্যই থাকছে। সংশোধিত আইনে কমিশনের সব কার্যক্রমে সরকারের নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। এই আইন অনুযায়ী প্রত্যেকটি কাজে কমিশনকে রাষ্ট্রপতির কাছে দায়ী থাকতে হবে। পাশাপাশি সরকারি কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা করতে হলে সরকারের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। বিদ্যমান আইনে কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রমাণ পেলে দুদক যে কারও বিরুদ্ধে মামলা করতে পারত। আইনটি সংশোধন হলে সেই স্বাধীনতা আর থাকবে না। দুদক আইন-২০০৪ সংশোধনের একটি খসড়া তৈরি করা হয়েছে। আগামী সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার বৈঠকে এই খসড়া অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে বলে সরকারের দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে। দুদক চেয়ারম্যান অনেক আগে থেকেই এ রকম আশঙ্কা প্রকাশ করছিলেন। তিনি অভিযোগ করেছিলেন, দুদকের নখ-দাঁত ছেঁটে ফেলা হচ্ছে। এটি না করার জন্য সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে যোগাযোগও করেছিলেন তিনি। অনুরোধ করেছিলেন যাতে দুদকের ক্ষমতা ও স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া না হয়। এই অনুরোধে কোনো কাজ হয়নি। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এতে সমাজে দুর্নীতি আরও বেড়ে যাবে। এ ব্যাপারে টিআইবির সাবেক চেয়ারম্যান মোজাফফর আহমেদ বলেন, দুদকের সব কাজ রাষ্ট্রপতির কাছে দায়বদ্ধ রাখার বিধান রেখে আইন সংশোধন করা হলে এটা একটি অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। রাজনৈতিক প্রভাবে প্রতিষ্ঠানটি প্রভাবিত হবে। এতে প্রতিষ্ঠানটির স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হবে। দেশে দুর্নীতিও চরমভাবে বাড়বে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান সমকালকে বলেন, দুদক আইন সংশোধনের ব্যাপারে এখনও কিছুই হয়নি। মন্ত্রিসভায় পাঠালে হয়তো সেটা নীতিগত অনুমোদনের জন্য পাঠানো হচ্ছে। নীতিগত অনুমোদনই শেষ কথা নয়। দুদকের স্বাধীনতা হরণ করা হচ্ছে_ এ কথা মানতে নারাজ মন্ত্রিপরিষদ সচিব আবদুল আজিজ। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি সমকালকে বলেন, দুদককে শক্তিশালী করতেই এই আইন সংশোধন করা হচ্ছে। বিদ্যমান আইনে কয়েকটি বিষয় অস্পষ্ট ছিল। সংশোধনের মাধ্যমে এটা দূর করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে সংশোধনী আইনের খসড়া তৈরি করা হয়েছে। আগামী মন্ত্রিসভার বৈঠকে এটা অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হতে পারে। জানা গেছে, সরকার দুর্নীতি দমন কমিশনকে একটি শক্তিশালী, গণমুখী, জবাবদিহি প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করতে দুদক আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেয়। এই লক্ষ্যে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের
একজন অতিরিক্ত সচিবকে প্রধান করে আইন সংশোধনে সুপারিশ করতে একটি কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটি ছয়টি বৈঠক করে আইন সংশোধনের সুপারিশ করে। এই আইনের কিছু ধারা সংশোধনে কমিশন দ্বিমত পোষণ করে। কমিশনের দ্বিমতের পরও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে সংশোধনী আইনের খসড়া তৈরি করা হয়েছে। এটা চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভার বৈঠকে উপস্থাপন করা হচ্ছে।
সংশোধিত আইনে কমিশনের বার্ষিক প্রতিবেদন রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করার সুপারিশ করা হয়েছে। পরে এটা জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করার বিধান রাখার প্রস্তাব করা হয়। পাশাপাশি কমিশনের যে কোনো কাজের দায় এবং কমিশনারদের জবাবদিহিতা রাষ্ট্রপতির কাছে রাখার বিধান করা হয়েছে। এক্ষেত্রে যুক্তি দেখানো হয়েছে, বিগত সময়ে কমিশন অন্যায়ভাবে অনেক কাজ করেছে। কারও কাছে জবাবদিহিতা না থাকার কারণে দুদক এগুলো করতে পেরেছে। এখন রাষ্ট্রপতির কাছে দায়ী থাকলে কমিশন স্বেচ্ছায় এ ধরনের কাজ আর করতে পারবে না।
সংশোধনী খসড়া মতে, সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনভাবে কমিশন আর মামলা করতে পারবে না। সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে হলে সরকারের অনুমতি গ্রহণের বিধান চালুর প্রস্তাব করা হয়েছে।
সংশোধিত আইনে দুদকের নিম্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কার্যক্রম সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবে না। এক্ষেত্রে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, সরকারের সর্বোচ্চ কোনো কর্মকর্তার কাজ সম্পর্কে শুধু দুদকের সমমানের কর্মকর্তাই অনুসন্ধান বা জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবেন।
সংশোধিত আইনে কমিশনের সঙ্গে দেশি-বিদেশি সংস্থার বিভিন্ন ধরনের চুক্তি করার ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। বিদ্যমান আইন অনুযায়ী কমিশন তাদের প্রয়োজনে দেশি বা বিদেশি সংস্থার সঙ্গে যে কোনো চুক্তি করতে পারে। সংশোধিত আইনে এই সুযোগ থাকছে না। কমিশনের সচিব নিয়োগের ক্ষেত্রে সংশোধিত আইনে কমিশনের ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে।
খসড়া আইনে কমিশনের পূর্বে স্বশাসিত শব্দটি বাদ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এক্ষেত্রে যুক্তি দেখানো হয়েছে, স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান নিজের আয় থেকে ব্যয় নির্বাহ করে থাকে। দুদকের নিজস্ব কোনো আয় নেই। এ প্রতিষ্ঠানটি সরকারের অর্থ দিয়েই চলে। তাই প্রতিষ্ঠানটি স্বশাসিত হবে না। কোনো সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান তাদের গোপন তথ্যাদি কমিশনকে না দিলে এক্ষেত্রে কমিশন তাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে পারবে না। সংশোধিত আইনে কমিশনের মামলা কমিশনের পাশাপাশি পুলিশের মাধ্যমে তদন্ত করার বিধান রাখা হয়েছে।

No comments:

Post a Comment