Monday 7 June 2010

আমার দেশের ওপর সরকারের ফ্যাসিবাদী হামলা

বদরুদ্দীন উমর

প্রতিহিংসাপরায়ণতা কোন উচ্চ নৈতিকতার পরিচায়ক নয়। বরং তার উল্টো। বর্তমান সরকার এ উল্টো কাজটিই গদিনসিন হওয়ার পর থেকে করে আসছে এবং এখন এর ভয়াবহ রূপ প্রতিদিনই নব নব ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে। দৈনিক আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া এই প্রতিহিংসাপরায়ণতারই সর্বশেষ দৃষ্টান্ত। এর আগে চ্যানেল ওয়ান ও যমুনা টেলিভিশনের সম্প্রচারও একই রাজনৈতিক কারণে বন্ধ করা হয়েছে। এর সঙ্গে নিঃসন্দেহে ব্যক্তিগত প্রতিহিংসাপরায়ণতাও যুক্ত আছে। আমার দেশ প্রসঙ্গে ফিরে আসার আগে এ বিষয়ের উল্লেখ দরকার। বাংলাদেশের প্রখ্যাত সাংবাদিক আতাউস সামাদ ‘আমার দেশ বন্ধ করা প্রসঙ্গে কিছু কথা’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন দৈনিক কালের কণ্ঠে (৫.৬.২০১০)। এতে তিনি বলেন, ‘আমার দেশ পত্রিকা ও চ্যানেল ওয়ান সরকারের কাছ থেকে যথাযথ ও বৈধ অনুমতি নিয়ে ব্যবসা করছিল অর্থাৎ এগুলো চালু ছিল এবং যমুনা টেলিভিশন একটি অনাপত্তিপত্রের ভিত্তিতে পরীক্ষামূলক সম্প্রচার চালাচ্ছিল। এই তিনটি প্রতিষ্ঠানেরই প্রচুর মূলধন বিনিয়োগ আছে। অথচ এ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, মূলধন বিনিয়োগ করে যে ব্যবসা চালু হয়েছে, সরকার সে রকম বৈধ ব্যবসা বন্ধ করে দিচ্ছে।’ এক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার, প্রত্যেক টিভি চ্যানেলই আনুষ্ঠানিক সম্প্রচার শুরু করার আগে এই অনুমতিপত্রের ভিত্তিতেই পরীক্ষামূলক সম্প্রচার চালিয়ে থাকে। এদিক দিয়ে যমুনা টিভি কোন ব্যতিক্রম ছিল না। কাজেই বৈধভাবে ব্যবসা করলেও এই প্রচার মাধ্যমগুলোর ওপর আক্রমণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং ব্যক্তিগত প্রতিহিংসামূলক ব্যাপার ছাড়া আর কিছু নয়। একথা আর না জানা যে, বাংলাদেশে অনেক ক্ষেত্রেই সরকারি নেতানেত্রীরা রাজনৈতিক বিবেচনার বাইরেও নিছক ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে অনেক ধরনের আক্রমণ প্রতিপক্ষের ওপর করে থাকেন।

আমার দেশ বন্ধ প্রসঙ্গে ফিরে এসে বলা দরকার, এক্ষেত্রে প্রতিহিংসাপরায়ণতা সব কিছুকে অতিক্রম করে কারণ হিসেবে কাজ করেছে। আতাউস সামাদ আমার দেশের উপদেষ্টা ও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন। তাছাড়া তিনি একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি। তার লেখায় এ বিষয়ে যা পাওয়া যায়, তার কিছু উদ্ধৃতি দীর্ঘ হলেও বিষয়টি বুঝতে সহায়তা করবে। বৈধ প্রকাশক ছাড়াই আমার দেশ প্রকাশ করা হয়েছে, এটাই পত্রিকাটির বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ। এ বিষয়ে আতাউস সামাদ বলেন, ‘সরকার যেভাবে আমার দেশ পত্রিকাকে প্রকাশকবিহীন করে ফেলল, সেটা যে ইচ্ছাকৃত বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তাও পরিষ্কার। কারণ আমার দেশ পত্রিকার স্বত্বাধিকারী কোম্পানি আমার দেশ পাবলিকেশন্স লিমিটেডের পরিচালনা পর্ষদ মাহমুদুর রহমানকে ওই পত্রিকার প্রকাশক নিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেয়ার পরপরই আইন অনুসরণ করে তিনি ঢাকার ডেপুটি কমিশনারকে তা জানিয়ে সে মতে প্রকাশকের নাম পরিবর্তনের অনুরোধ করে চিঠি দেন ২০০৯ সালের ৩ সেপ্টেম্বর। অতঃপর তিনি ৫ নভেম্বর ২০০৯ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদফতরের কাছ থেকে একটি চিঠির অনুলিপি পান, যা তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে পাঠানো হয়েছিল। এ চিঠিটি ঢাকা জেলা প্রশাসক বরাবর পাঠিয়ে দেন ওই অধিদফতরের উপ-পরিচালক (নিবন্ধন) মাসুদা খাতুন। ঃ এই পত্রে সরকারের চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদফতর, ঢাকার জেলা প্রশাসনকে জানাচ্ছে, ‘ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক আমার দেশ পত্রিকাটির প্রকাশক আলহাজ মোঃ হাসমত আলীর পরিবর্তে জনাব মাহমুদুর রহমানের নাম প্রতিস্থাপন করার অনুমোদন দেয়া যেতে পারে।’ কিন্তু ঢাকার জেলা প্রকাশক তা সত্ত্বেও সেই নভেম্বর মাস থেকেই মাহমুদুর রহমানের আবেদনে সাড়া দিলেন না। সরকারের (অর্থাৎ চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদফতরের-উমর) মতামত জানার পরও তিনি সাত মাস নির্লিপ্ততা ও নিঃশব্দতা অবলম্বন করলেন! যখন উঠে বসলেন, তখন যেন হুংকার দিলেন, ‘না, মাহমুদুর রহমান প্রকাশক পদে গ্রহণযোগ্য নন, কাজেই তার আবেদন খারিজ করা হল।’ একই সঙ্গে তিনি আমার দেশ পত্রিকার প্রকাশক পদ থেকে হাসমত আলীর পদত্যাগপত্র গ্রহণ করে এ মুহূর্তে পত্রিকাটির কোন প্রকাশক নেই ঘোষণা করে তার প্রকাশনা নিষিদ্ধ করে দিলেন।

আতাউস সামাদের উপরোক্ত লেখা থেকে এই দীর্ঘ উদ্ধৃতি দেয়ার কারণ এখানে, তিনি আমার দেশ পত্রিকার সঙ্গে সম্পর্কিত একজন দায়িত্বশীল সাংবাদিক হিসেবে যা বলেছেন তা থেকেই এটা প্রমাণ হয় যে, আমার দেশকে প্রকাশকশূন্য করার দায়িত্ব মাহমুদুর রহমানের নয়। এ দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে ঢাকার জেলা প্রশাসকের। এজন্য আইন অনুযায়ী তারই শাস্তি হওয়া উচিত। কিন্তু তার কোন শাস্তি হবে না, কারণ তিনি এ অপকর্মের মূল হোতা নন। সরকারের শীর্ষতম পর্যায় থেকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ঢাকার জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে এটা কার্যকর করা হয়েছে।

আমার দেশ একটি সুপ্রতিষ্ঠিত ও বহুল প্রচারিত দৈনিক। কাজেই এই সংবাদপত্রটির ওপর এভাবে হামলা যে কোন দিক থেকেই যুক্তিসঙ্গত ও আইনসম্মত নয়, এটা যে কোন নিরপেক্ষ ও সৎ ব্যক্তির কাছেই স্পষ্ট। কিন্তু প্রতিহিংসা যেখানে এই কাজের মূল প্রণোদনা সেখানে যুক্তি, আইন ইত্যাদির স্থান নেই। প্রকৃতপক্ষে আমার দেশ-এর প্রকাশক সম্পর্কিত যা কিছু ঘটনা ঘটেছে তার থেকে স্পষ্টভাবেই বোঝা যায়, পত্রিকাটির স্বত্বাধিকারী কোম্পানি অথবা তার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিন্দুমাত্র ভিত্তি নেই। পত্রিকাটিকে প্রকাশকশূন্য দেখানোর ব্যাপারটি সম্পূর্ণভাবে সরকারি চক্রান্তের দ্বারাই ঘটানো হয়েছে। হাসমত আলীর পারিবারিক সূত্র থেকে বলা হয়েছে, যেদিন পত্রিকাটি নিষিদ্ধ করা হয় সেদিন সকালের দিকে হাসমত আলীকে তার বাড়ি থেকে গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআই তাদের অফিসে নিয়ে যায় এবং তিনি দুটি সাদা কাগজে স্বাক্ষর না দেয়া পর্যন্ত তাকে তারা ৫ ঘণ্টা সেখানে আটক রাখে। সাদা কাগজে এভাবে স্বাক্ষর নেয়ার অর্থ কী হতে পারে? এটা অনুমান করা কি ঠিক নয় যে, গোয়েন্দা সংস্থাটি আমার দেশ পত্রিকা ও তার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদককে চক্রান্তমূলকভাবে ফাঁসানোর জন্য সাদা কাগজে তাকে দিয়ে স্বাক্ষর করিয়ে নিজেদের যা প্রয়োজন সেটাই লিখে দিয়েছে?

প্রথমে আমার দেশ-এর প্রেস সিলগালা দিয়ে বন্ধ করা হয়। তারপর পত্রিকাটি বন্ধের কোন লিখিত নির্দেশ ছাড়াই পুলিশ গিয়ে তা বন্ধ করার নির্দেশ দেয়। তারপর তারা মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতারের কথা বললেন। কিন্তু গ্রেফতারের জন্য কোন ওয়ারেন্ট তাদের কাছে ছিল না। সরকার থেকে বলা হয়েছে, পুলিশকে তাদের কর্তব্য সম্পাদন করতে বাধা দেয়া অর্থাৎ মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতারে বাধা দেয়ার কারণেই তাকে গ্রেফতার করা হয়! এর থেকে অদ্ভুত ও উদ্ভট সরকারি যুক্তি আর হতে পারে? আমার দেশ বন্ধ করার ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে পত্রিকাটির কর্তৃপক্ষ নয়, সরকারই সম্পূর্ণ বেআইনি কাজ করে নিজেদের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করেছে।

আগেই বলা হয়েছে, নথিপত্র মোতাবেক আমার দেশকে প্রকাশকশূন্য করার জন্য প্রকৃতপক্ষে দায়ী হচ্ছেন ঢাকার ডিসি। কিন্তু তার কোন শান্তি হবে না। কারণ তিনি প্রশাসনে আওয়ামী ঘরানার লোক। সরকারের ইঙ্গিতেই তিনি নভেম্বর থেকে এ পর্যন্ত আমার দেশ-এর প্রকাশক পরিবর্তনের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত না নিয়ে চক্রান্তমূলকভাবে পত্রিকাটিকে হঠাৎ করে প্রকাশকশূন্য করেছেন। এর সঙ্গে এনএসআই কর্তৃক হাসমত আলীকে দিয়ে সাদা কাগজে স্বাক্ষর করিয়ে নেয়ার ব্যাপারটিও সম্পর্কিত। শেখ হাসিনা ধুয়োর মতো করে প্রায় প্রতিদিনই বলে থাকেন, কোন অপরাধী যে কোন দলেরই হোক তার মাফ নেই, তার শাস্তি হবে। তিনি যে কথাটি অনুচ্চারিত রাখেন তা হল, অপরাধী যে কোন দলের হোক তার শাস্তি হবে; শুধু আওয়ামী লীগ ঘরানার অপরাধী ছাড়া। তাদের ঘরানার ক্রিমিনালরা দিবারাত্রি চুরি, ডাকাতি, ঘুষখোরি, খুনখারাবি, রাহাজানি, প্রতারণা, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস ইত্যাদি সব রকম অপরাধ করে যাওয়া সত্ত্বেও তাদের কোন শাস্তি হয় না। অপরাধ করে ধনদৌলতের মালিক হয়ে ও শক্তি সঞ্চয় করে তারা আরও বড় বড় অপরাধ করে গেলেও তাদের শাস্তি হয় না।

সংবাদপত্র রিপোর্টে দেখা গেল, মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করার পর পুলিশ তাকে রিমান্ডে নেয়ার জন্য আদালতে আবেদন করেছে। আদালত এ ব্যাপারে শুনানির জন্য তারিখ ফেলেছেন। কিন্তু কেন? এজন্য শুনানির প্রয়োজন কেন হবে? এ আবেদন সরাসরি নাকচ করা হবে না কেন? এখন কথায় কথায় যে কোন লোককে গ্রেফতারের পর রিমান্ডে নেয়া হচ্ছে। এ প্রক্রিয়া ফখরুদ্দীনের বেনামি সামরিক সরকারের সময় চালু হয়েছিল। তারা তখন রাজনৈতিক নেতাদের রিমান্ডে নিয়ে তাদের ওপর যথেচ্ছভাবে শারীরিক ও মানসিক পীড়ন চালিয়েছিল। সেই প্রক্রিয়া এই তথাকথিত গণতান্ত্রিক সরকারের আমলেও পুরোদস্তুর বজায় আছে। আদালত নিয়মিতভাবে পুলিশের আবেদন অনুযায়ী শত শত ক্ষেত্রে গ্রেফতারকৃতদের রিমান্ডে নেয়ার আবেদন মঞ্জুর করছেন। মাহমুদুর রহমান একটি প্রতিষ্ঠিত জাতীয় দৈনিকের সম্পাদক। যদি ধরেও নেয়া যায়, প্রকাশকবিহীন অবস্থায় তিনি পত্রিকা বের করেছেন, তাহলেও এ কারণে তাকে রিমান্ডে নেয়ার প্রস্তাব কিভাবে পুলিশ করতে পারে? কিভাবেই বা আদালত তাদের এই আবেদন বিবেচনার অধীন রাখতে পারেন? হতে পারে তারা পুলিশের আবেদন অনুযায়ী মাহমুদুর রহমানকে রিমান্ডে পাঠিয়ে দেবেন। এর দ্বারা মহামান্য আদালতের মর্যাদা বৃদ্ধি অথবা গণতন্ত্রের জয়জয়কার কোনটাই হবে না। এর দ্বারা সরকারের ফ্যাসিস্ট চরিত্রই উšে§াচিত হবে।
সরকার এখন যেভাবে চলছে তাতে মনে হয়, এরা দ্রুত ১৯৭৪-৭৫ সালের আওয়ামী-বাকশালী ফ্যাসিবাদের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। তারা এখন বলছে ১৯৭২ সালের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার কথা। কিন্তু সেই সংবিধানের মূলে কুঠারাঘাত করে তাকে প্রকৃতপক্ষে উচ্ছেদ করেছিলেন কে? সেই সংবিধান পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনীর আগে যে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমেই উচ্ছেদ হয়েছিল, এটা একমাত্র আওয়ামী লীগের লোকজন ও তাদের তল্পিবাহক ছাড়া অস্বীকার করবে কে? ১৯৭৫ সালের সেই কুখ্যাত ও ফ্যাসিস্ট চতুর্থ সংশোধনীই বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার অঘোষিতভাবে কার্যকর করছে। তাদের আমলে এখন ফ্যাসিবাদের এক মহোৎসব চারদিকে শুরু হয়েছে। এই ফ্যাসিবাদ তাদের অতি দ্রুতগতিতে কোথায় নিয়ে যাবে এ বিষয়ে ভাবনার কোন সময় ও ক্ষমতা তাদের এখন নেই। তারা ক্ষমতা মদমত্ত অবস্থায় এখন এমন পরিণতির দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে, যা মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই তাদের উৎখাতকে অনিবার্য করবে।
[সূত্রঃ যুগান্তর, ০৬/০৬/১০]

No comments:

Post a Comment