Friday 4 June 2010

চাই সাংবাদিকদের ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্ম

মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর

বাংলাদেশের সাংবাদিক তথা গণমাধ্যম কর্মীদের অনেকে আজ হতাশার সাগরে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন। একের পর এক টিভি চ্যানেল ও সংবাদপত্র সরকার নানা অজুহাতে বন্ধ করে দিচ্ছে। বেকার হয়ে যাচ্ছেন শত শত সাংবাদিক ও গণমাধ্যম কর্মী। এক বিরাট অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে বহু সাংবাদিক পরিবার। আমাদের দূষিত রাজনীতির শিকার এই গণমাধ্যম কর্মীরা। সরকার ভিন্নমত, সমালোচনা সহ্য করতে পারছে না বলে টিভি চ্যানেল ও সংবাদপত্র বন্ধ করে দিচ্ছে। যদিও অজুহাত দেখানো হচ্ছে ভিন্ন কিছু। সরকার গণমাধ্যম নিয়ে সম্প্রতি যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, তার জন্য তাকে একদিন অবশ্যই খেসারত দিতে হবে।

সাংবাদিক ও গণমাধ্যম কর্মীদের এই দুর্দিনে তাদের পাশে এসে দাঁড়ানোর কথা সাংবাদিক ইউনিয়ন তথা সাংবাদিক নেতাদের। কিন্তু সাংবাদিক ইউনিয়ন তেমন জোরালো ভূমিকা নিতে পারেনি। তেমন ভূমিকা নেয়া ইউনিয়নের পক্ষে সম্ভবও নয়। কারণ পাঠক জানেন, সাংবাদিক ইউনিয়ন দু’ভাগে বিভক্ত। দুটি বড় রাজনৈতিক দলের অনুগত হিসেবে সাংবাদিক ইউনিয়ন দুটি পরিচিত। যদিও এভাবে তাদের আনুষ্ঠানিক পরিচিতি নেই। জাতীয় প্রেস ক্লাবের কমিটিও রাজনৈতিক দলের প্রভাবে প্রভাবিত। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি একটি রাজনৈতিক দলের প্রধানের উপদেষ্টা। অন্য কোন দেশে এটা সম্ভব হতো কিনা জানি না। বাংলাদেশ সব সম্ভবের দেশ।

রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রকাশ্যে সম্পৃক্ত থেকে পেশাজীবী সাংবাদিক হওয়া সম্ভব কিনা, তা বিতর্কের দাবি রাখে। কোন দলের প্রতি সমর্থন বা পক্ষপাত থাকা স্বাভাবিক। তবে দলের ক্যাডার হয়ে সাংবাদিকতা করা নৈতিক দিক থেকে কতটা সমর্থনযোগ্য, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। এমন সাংবাদিক নেতা ও সাংবাদিকরা বাংলাদেশে সাংবাদিকতা পেশাকে কালিমালিপ্ত করেছেন। সাংবাদিকদের এই অনৈক্য এবং তারা বড় কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সুবিধাভোগী হওয়ায় আজ দেশের সাংবাদিক সমাজের ওপর সরকার ও সন্ত্রাসীরা এত আঘাত করার সাহস পাচ্ছে। এ অবস্থায় সাংবাদিক ও গণমাধ্যম কর্মীদের ঐক্য ও পেশার প্রতি দায়িত্বশীলতা আবার ফিরিয়ে আনা জরুরি হয়ে পড়েছে। অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে তাতে আশংকা হয়, আরও টিভি চ্যানেল ও সংবাদপত্রের ওপর আঘাত আসতে পারে। সরকার সরাসরি আঘাত না করে পরোক্ষভাবেও আঘাত হানতে পারে। সেরকম পরিস্থিতি মোকাবেলায় সাংবাদিক ও গণমাধ্যম কর্মীদের প্রস্তুত থাকতে হবে। কিন্তু তাদের নেতৃত্ব দেবে কে? সাংবাদিকদের ইউনিয়ন তো সরকার ও দলের কাছে নতজানু। তাদের কোন স্বাধীন সত্তা নেই। এ ধরনের ইউনিয়ন দিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে কোন আন্দোলন করা খুব কঠিন।
শুধু সরকারের দমননীতি নয়, গণমাধ্যম সম্পর্কে সরকারের সুষ্ঠু নীতির অভাব, বিটিভিকে দলীয়করণ, স্বাধীন বার্তা সংস্থা, প্রেস ইন্সটিটিউট, প্রেস কাউন্সিল, জাতীয় গণমাধ্যম ইন্সটিটিউট ইত্যাদি সরকারি গণমাধ্যম সংস্থাকে কার্যকর করা, স্বাধীনভাবে সাংবাদিকদের কাজের পরিবেশ সৃষ্টি, সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত সাংবাদিকদের হত্যাকাণ্ডের বিচার ইত্যাদি নানা দাবিতে একটি ঐক্যবদ্ধ ইউনিয়নকে সোচ্চার হতে হবে। আজ গণমাধ্যম সেক্টরের চেহারা আগের মতো নেই। সংবাদপত্র, টিভি, এফএম সবখানে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে গেছে। এখন শুধু সংবাদপত্রের সাংবাদিকদের ইউনিয়ন হলে সেটা খুব কার্যকর হবে না। সাংবাদিক ও গণমাধ্যম কর্মীদের সম্মিলিত ইউনিয়ন হতে হবে। শুধু আন্দোলন করার জন্য নয়Ñ নানা গঠনমূলক কর্মসূচিতেও এ ইউনিয়ন যেন অবদান রাখতে পারে।

আমার প্রস্তাব : সংবাদপত্র, টিভি ও বেতারের সাংবাদিক, কলাকুশলী সবার একটি ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্ম হওয়া দরকার। তার নাম ‘ইউনিয়ন’ হতে হবে, এমন বাধ্যবাধকতা নেই। সেটা ‘গণমাধ্যম ফোরাম’, ‘কেন্দ্র ’ বা ‘মঞ্চ’ হতে পারে। দরকার একটা ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্ম। সাংবাদিকতা বা গণমাধ্যমে যারা নিবেদিতপ্রাণ পেশাজীবীÑ এ প্লাটফর্ম হবে কেবল তাদের জন্য। সাংবাদিকতা বা গণমাধ্যমে কাজ করে যারা রাজনৈতিক সুবিধা আদায় করতে চায়, তাদের জন্য এ ফোরাম নয়। তাদের জন্য দুটি ‘সাংবাদিক ইউনিয়ন’ তো আছেই। বড় দু’দলের এক দল ক্ষমতায় গেলে তাদের কেউ কেউ নানা সুবিধা ভোগ করতে পারবেন। সরকারের কাছ থেকে কোন সুবিধা পাওয়ার আশা যারা করবেন না, কেবল তাদের নিয়েই এ প্লাটফর্ম গঠন করতে হবে। তাদের অঙ্গীকার করতে হবে, তারা কোন রাজনৈতিক দলের সদস্য নন। কোন দল বা নেতার প্রতি তাদের আনুগত্য নেই। তারা সম্পূর্ণভাবে পেশাজীবী। যদি ভবিষ্যতে কেউ মন পরিবর্তন করে কোন দলের প্রতি ঝুঁকতে চান, তিনি এ ফোরামের সদস্য পদ ছেড়ে দেবেন। সেই স্বাধীনতা তার সবসময় থাকবে।

এভাবে একটি স্বাধীন গণমাধ্যম ফোরাম গঠন এখন সময়ের দাবি। যারা স্বাধীনভাবে ও নিষ্ঠার সঙ্গে সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলে কাজ করতে চান, তারা আমার এ প্রস্তাব নিয়ে চিন্তা করবেন আশা করি। এ উদ্যোগ বর্তমান দলকানা সাংবাদিক ইউনিয়নের বিরোধী কোন প্লাটফর্ম হবে না। বর্তমান ইউনিয়ন তাদের দলের (বা সরকারের) সেবা করে যাক। তাতে কেউ বাধা দিচ্ছে না। স্বাধীন গণমাধ্যম ফোরাম গণমাধ্যম কর্মীদের স্বার্থরক্ষায় ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে নানা কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে যাবে। গণমাধ্যম কর্মীদের ওপর ঝড়ঝাপটা এলে তারা যেন সম্মিলিতভাবে মোকাবেলা করতে পারেনÑ সেই দৃঢ়তা এ ফোরামের কাছে সবাই আশা করবে।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর :উন্নয়ন ও মিডিয়া কর্মী
[সূত্রঃ যুগান্তর, ০৪/০৬/১০]

No comments:

Post a Comment