Tuesday 28 December 2010

প্রধানমন্ত্রীকে মার্কিন সিনেটরের চিঠি : যুদ্ধাপরাধ আইনে স্বচ্ছ বিচারের বিশ্বস্বীকৃত মানদণ্ড অনুপস্থিত

স্টাফ রিপোর্টার

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচিত সিনেটর জন বুজম্যান যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ও বাংলাদেশের সংবিধান নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে একটি চিঠি লিখেছেন। গত ৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে প্রেরিত এ চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, আন্তর্জাতিক অপরাধ (আদালত) অ্যাক্ট ১৯৭৩ (ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনাল) অ্যাক্ট অব ১৯৭৩) বিষয়ে এ চিঠি লিখছি। ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় সংঘটিত অপরাধের বিচারের যে উদ্যোগ বাংলাদেশ সরকার নিয়েছে সে বিষয়ে আমার সমানুভূতি আছে। আপনার সরকার অতীতের এ অপরাধের বিচার সম্পন্ন করে যে নজির স্থাপন করার উদ্যোগ নিয়েছে তার সঙ্গে আমি একমত। সে লক্ষ্যে বিশেষ আদালত স্থাপন, বিচারক প্যানেল গঠন এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ (আদালত) অ্যাক্টকে নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ করার লক্ষ্যে বিতর্কিত কিছু ধারাও পরিবর্তন করা হয়েছে মর্মে জেনেছি আমি।
চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত স্বচ্ছ বিচারের যে মানদণ্ড রয়েছে তা বাংলাদেশের আইনটিতে অনুপস্থিত রয়েছে বলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। আইনটির বিষয়ে সবচেয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে যেসব সংস্থা থেকে সেগুলো হল—হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এশিয়া বিভাগ, দ্য ওয়ার ক্রাইমস কমিশন অব দ্য ইন্টারন্যাশনাল বার অ্যাসোসিয়েশন, দ্য ওয়ার ক্রাইমস প্রজেক্ট এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ এবং আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত অন্যান্য অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা এই আইনকে চ্যালেঞ্জ করতে পারবে না এবং এই আইনের মাধ্যমে তাদের যে সাজা প্রদান করা হবে তার বিরুদ্ধেও তারা কোনো প্রতিকার চাইতে পারবে না—বিদ্যমান সংবিধানে যাই থাকুক না কেন। এ জাতীয় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা আছে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ (আদালত) আইনে।
অন্যান্য অপরাধ আইনের ক্ষেত্রে যে নিয়ম প্রযোজ্য তা এই অ্যাক্টের ক্ষেত্রে রাখা হয়নি। এ কারণে এ আইনটির বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ করার সুযোগও রাখা হয়নি যা সংবিধানে স্বীকৃত অধিকার হরণের মাধ্যমে করা হয়েছে। আইনের চোখে সবাই সমান বলে যে মৌলিক বিধান আছে তাও এখানে খর্ব করা হয়েছে। বিচারকে আন্তর্জাতিক মানের এবং স্বচ্ছ করার জন্য এ আইনের সংশোধন খুবই জরুরি। ওই আইন এবং বিচারকে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না মর্মে যে সাংবিধানিক সুরক্ষা প্রদান করা হয়েছে তা-ই আইনটিকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নিরপেক্ষ এবং স্বচ্ছ বিচারের পরিপন্থী করে তুলেছে। অভিযুক্ত ব্যক্তির নীরব থাকা, নিজেকে নির্দোষ ঘোষণার অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে এবং সাক্ষীর দায়-দায়িত্ব সম্পর্কে কোনো কিছু বলা হয়নি আইনে। আইনটি যেহেতু যুগোস্লাভিয়া এবং রুয়ান্ডা যুদ্ধাপরাধ আদালত গঠনের (এ আদালতের ধারা আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন হিসেবে স্বীকৃত) আগে প্রণীত হয়েছে তাই ২০০২ সালে প্রণীত রোম সংবিধি অনুযায়ী আইনটি সংস্কার করা উচিত। বাংলাদেশও রোম সংবিধিতে স্বাক্ষরকারী একটি দেশ। প্রয়োজনীয় সংশোধন ছাড়া এই আইনের মাধ্যমে বিচার কাজ চালিয়ে গেলে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং বিতর্ক বাড়বে। উদাহরণস্বরূপ বর্তমান আইন অনুযায়ী যিনি সাধারণ সামরিক আদালতের বিচারক হওয়ার যোগ্য তিনি ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বা মেম্বার হতে পারবেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক বিধান অনুযায়ী সামরিক আদালতের বিচারকরা কেবল সামরিক বাহিনী সংক্রান্ত বিষয়েই বিচার করতে পারেন। উপরন্তু, এই আইনে রয়েছে ট্রাইব্যুনালের কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা যাবে না এবং অভিযুক্ত ব্যক্তি ট্রাইব্যুনালের কোনো ধারার বিরুদ্ধেও কোনো চ্যালেঞ্জ করতে পারবেন না। আমার আশঙ্কা, আইনটিকে সংশোধন করে যদি আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা না হয় তাহলে এ আইনের মাধ্যমে বিচার কাজ পরিচালনা করা হলে অভিযুক্ত ব্যক্তির মানবাধিকার রক্ষা অসম্ভব হবে। আইনটি বর্তমানে যে অবস্থায় আছে তাতে দায়মুক্তি থেকে বের হয়ে আসার যে উদ্যোগ আপনার সরকার নিয়েছে তা যেমন চাপা পড়ে যাবে তেমনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে এ বার্তা ছড়িয়ে পড়বে যে, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্যই এ আয়োজন করা হচ্ছে।
চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ মোতাবেক ধর্মীয় অনভূতিতে আঘাত করার মতো ক্ষুদ্র বিষয়ের সঙ্গে জড়িয়ে জামায়াতের প্রথম সারির বেশ কয়েকজন নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এসব অভিযোগে গ্রেফতার করে তাদেরকে যুদ্ধাপরাধ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এতে করে আইনটি রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারের বিষয়টি আবারও সামনে এসেছে। যেহেতু আপনার সরকারের প্রধান প্রতিপক্ষ দলের একনিষ্ঠ মিত্র জামায়াত। তাই জামায়াতকে ক্ষতিগ্রস্ত করার মাধ্যমে প্রধান প্রতিপক্ষকে দুর্বল করাই হলো ট্রাইব্যুনালের প্রথম কাজ। এ বিশ্বাসই সমাজে এখন বিদ্যমান। আইনটি যথাযথ সংশোধন করে এবং অভিযুক্ত ব্যক্তির জন্য একটি নিরপেক্ষ ও ভয়ভীতিমুক্ত বিচার অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আপনার সরকার ন্যায় বিচারকে সমুন্নত রাখবে এবং দায়মুক্তির সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসার উদ্যোগকে সামনে এগিয়ে নেবে বলে আশা করি। যুদ্ধাপরাধ আদালত গঠনের উদ্যোগকে আন্তর্জাতিক বিচার অঙ্গনের অনেকেই স্বাগত জানিয়েছিল। কিন্তু স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ বিচার অনুষ্ঠানে অনাগ্রহের বিষয়ে তারা সবাই উদ্বিগ্ন যে, এর মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা হতে পারে। আমি আশা করি আপনার সরকার রোম সংবিধি অনুযায়ী আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের ধারা মোতাবেক আইনটি সংশোধনের যথাযথ ব্যবস্থা নেবে। আইনটি যথোপযুক্ত সংশোধন করে প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাঠগড়ায় আনার বিষয়ে আপনার সরকার উদ্যোগ নিলে আমি সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে প্রস্তুত আছি।

No comments:

Post a Comment