Saturday 29 January 2011

যে মৃত্যু বন্ধুত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করে


ড. তা রে ক শা ম সু র রে হ মা ন

ফেলানি এ দেশের আলোবাতাসে বেড়ে ওঠা এক কিশোরীর নাম। ঝুলে ছিল লাশ হয়ে, কাঁটাতারের বেড়ায়। ১৪ বছরের ফেলানির বিয়ের পিঁড়িতে বসার কথা ছিল পরদিন। কিন্তু বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ি আর যাওয়া হলো না ফেলানির। লাশ হয়ে ঝুলে থাকল কয়েক ঘণ্টা। ৮ জানুয়ারিতে লাল পায়জামা পরা লাশ হয়ে ঝুলে থাকা ফেলানির ছবি দৈনিক নয়া দিগন্তে যারা দেখেছেন, তাদের হৃদয় কতটুকু হাহাকার করে উঠেছিল, আমি বলতে পারব না। কিন্তু আমার চোখে পানি এসেছিল। আমি কেঁদেছি। কেঁদেছি ফেলানির জন্য, আমার মেয়ের মতো যার বয়স। ফেলানি এক টুকরো বাংলাদেশ। বিএসএফের গুলিতে প্রাণ দিয়েছিল ফেলানি। ওই পাটনা কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ি গ্রামের। অনন্তপুর বিএসএফ ক্যাম্পের সেনারা গুলি করে মেরেছিল ফেলানিকে। ঘটনা ভোর সোয়া ৬টার। ফেলানিরা কাজ করত দিল্লিতে। বাবা ছিলেন নির্মাণকর্মী। মেয়ের বিয়ে ঠিক করে বাবা মেয়েকে নিয়ে দেশে এসেছিলেন। বাবা কাঁটাতার পার হতে পারলেও মেয়ে ফেলানির জামা আটকে গিয়েছিল কাঁটাতারের বেড়ায়। বাবার করার কিছুই ছিল না। কাঁটাতারের বেড়ায় আটকে থাকা ফেলানিকে পাখির মতো গুলি করে মেরেছিল বিএসএফের সৈন্যরা। আধঘণ্টা পানি পানি করে চিত্কার করেছিল ফেলানি। কেউ আসেনি। ৩০ ঘণ্টা পর ফেলানির লাশ ফেরত দিয়েছিল বিএসএফ। এভাবেই ছোট্ট ফেলানিকে গুলি করে মেরে ‘বন্ধুত্বের’ প্রতিদান দিল ভারতের বিএসএফ। এর চেয়ে আর ‘বন্ধুত্বের’ প্রতিদান কী হতে পারে! আমরা কি এই বন্ধুত্ব চেয়েছি?
গেল বছর প্রধানমন্ত্রী ভারত সফর করলেন। সেখানেও বিএসএফের হত্যাকাণ্ডের প্রসঙ্গটি উঠেছিল। ভারতের প্রধানমন্ত্রী আশ্বাসও দিয়েছিলেন এ ধরনের হত্যাকাণ্ড আর ঘটবে না। দুই দেশের সীমান্তরক্ষীদের উচ্চপর্যায়ের বৈঠকেও প্রসঙ্গটি উঠেছে বারবার। সেখানেও বলা হয়েছে— এ ধরনের ঘটনা আর ঘটবে না। কিন্তু ঘটছে। বারে বারে ঘটছে। গেল বছর বিএসএফের হাতে কতজন বাংলাদেশী মারা গেছে এই পরিসংখ্যান আমাদের কাছে আছে। পত্রপত্রিকায় এই পরিসংখ্যান বেরও হয়েছে। কিন্তু বিএসএফ কর্তৃক এই ‘গণহত্যা’ বন্ধ হয়নি। তাহলে ভারতের নেতারা যে আশ্বাস দেন, তা কি লোক দেখানো আশ্বাস দিয়ে নিজেদের স্বার্থ আদায় করে নেয়া?
ফেলানির ঝুলে থাকা লাশের ছবি দেখে আমি মনে করেছিলাম আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা এর প্রতিবাদ করবেন। নিদেনপক্ষে ভারতীয় হাইকমিশনারকে সেগুনবাগিচায় তলব করবেন। না, কিছুই ঘটেনি। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কোনো সমবেদনার বক্তব্যও আমরা পেলাম না পত্রপত্রিকায়। না, ফেলানি কোনো ভিআইপি ছিল না। তাই ক্ষমতাবানদের দৃষ্টি আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হয়েছিল ফেলানি। অথচ এই ফেলানি, ফেলানির বাবারা, চাচারা ভোট দেন। সরকার গঠিত হয়। এরপর ভোটারদের প্রতি আর কারও দায়বদ্ধতা যেন থাকে না।
বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্ব এখন ওই কাঁটাতারের বেড়ার মতোই প্রশ্ন চিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় ট্রানজিট চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। বাংলাদেশে এই ট্রানজিট নিয়ে বিতর্ক থাকলেও সরকার ওই চুক্তিটি স্বাক্ষর করেছে। আমার ধারণা ছিল ট্রানজিট চুক্তির বিষয়টি নিয়ে সংসদে আলোচনা হবে, যাতে করে আমরা বিস্তারিত জানতে পারব। কিন্তু সেটা হয়নি। ভারত আর্থিক সুবিধা দিয়েছে। তাও দেয়া হয়েছে শুধু ট্রানজিটের অবকাঠামোগত সুবিধার জন্য। এতে লাভটা ষোলআনা ভারতেরই। বাংলাদেশ এতে লাভবান হবে না। ভারতের পানিসম্পদ সচিব এসেছিলেন বাংলাদেশে। বৈঠক করলেন আমাদের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিবের সঙ্গে। আমার বন্ধু পানিসম্পদ সচিব বিবিসির বাংলা বিভাগকে বললেন, একটি অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তিতে জেআরসির বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে। তিনি জানালেন চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয় মন্ত্রিপর্যায়ের বৈঠকে। কিন্তু বিবিসির ওই অনুষ্ঠানেই শুনলাম পশ্চিমাদের পানিসম্পদমন্ত্রীর আপত্তির কথা। তিনি জানালেন অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তির ব্যাপারে তিনি কিছুই জানেন না। এই চুক্তিতে পশ্চিমবঙ্গ একটি অংশ—কথাটাও তিনি জানিয়ে দিলেন। তাহলে কোনটাকে আমরা সত্য বলে ধরে নেব? বাংলাদেশের জন্য তিস্তার পানিচুক্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বারবার বাংলাদেশ একটি চুক্তির কথা বলে আসছে। এবারও কি চুক্তির আশপাশ দিয়ে আমাদের অন্ধকারে রাখা হলো? আমাদের প্রাপ্য তাহলে কী? আমরা গঙ্গার পানিচুক্তি করেছিলাম পদ্মায় পানি পাব বলে। সেই পদ্মা এখন মরা খাল। পানি নেই। সংবাদপত্রগুলো আমাদের জানাচ্ছে চুক্তি অনুযায়ী যে পানি পাওয়ার কথা, সেই পরিমাণ পানি আমরা গত ক’বছর ধরেই পাচ্ছি না। এর প্রতিবাদ আমরা কার কাছে করব? বাংলাদেশ তো শুধু দিয়েই যাচ্ছে। প্রতিদানে পাচ্ছি কী? ফেলানির লাশ!
বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে। আমরা ভারত থেকে আমদানি করি বেশি, রফতানি করি কম। অথচ বাংলাদেশী পণ্যের যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে ভারতে। কিন্তু ট্যারিফ, প্যারাট্যারিফ, নেগেটিভ লিস্টের জন্য আটকে আছে বাংলাদেশী পণ্য। বাংলাদেশী পণ্য ভারতের বাজারে প্রবেশ করতে পারছে না। বাংলাদেশ বড় ধরনের ‘জ্বালানি ফাঁদ’-এ পড়তে যাচ্ছে। বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে। বিদ্যুত্ উত্পাদিত হচ্ছে না। আঞ্চলিক ভিত্তিতে জলবিদ্যুত্ প্রকল্প হাতে নিয়ে বাংলাদেশের বিদ্যুতের ঘাটতি মেটানো সম্ভব। অর্থাত্ নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ ও ভারতের সঙ্গে জলবিদ্যুত্ প্রকল্প হাতে নেয়া যায়। কিন্তু ভারত তা চায় না। ভারত চায় দ্বিপাক্ষিকতা। দ্বিপাক্ষিকভাবে (ভারত-ভুটান, ভারত-নেপাল) ভারত তার বিদ্যুত্ ঘাটতি কাটিয়ে উঠছে। ভারত বাংলাদেশে বিদ্যুত্ বিক্রি করবে। এ ধরনের একটি সিদ্ধান্ত হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর ভারতে সফরের সময়। কিন্তু বাংলাদেশী একজন বিশেষজ্ঞ বললেন ভিন্ন কথা। বললেন, ভারত কোনদিনই বিদ্যুত্ বিক্রি করতে পারবে না। জলবিদ্যুত্ উত্পাদনে আপেক্ষিকতায় ভারত রাজি নয়। অথচ ট্রানজিটের ব্যাপারে ভারত ‘কানেকটিভিটি’ বা বহুমুখী যোগাযোগের যুক্তি দেখিয়েছে। আর আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাতেই খুশি। তার মুখ দিয়েও বেরুচ্ছে ‘কানেকটিভিটি’র কথা। বিশ্বায়নের যুগে ‘কানেকটিভিটি’কে গুরুত্ব দেয়া হয়। এটা বাস্তব। কিন্তু কানেকটিভিটি তো একপক্ষীয় হয়ে যাচ্ছে। আমরা কি ভুটান ও নেপালে যাওয়ার ট্রানজিট পাচ্ছি? বলা হয়েছিল বাংলাদেশ যে ‘ট্রানজিট ফি’ পাবে, তা দিয়ে ভারতের সঙ্গে তার বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে পারবে। কিন্তু ভারত এখন বলছে, তারা কোনো ‘ট্রানজিট ফি’ দেবে না। আমরা ভারতকে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করতে দিতেও রাজি হয়েছি। অথচ বাংলাদেশী পণ্যের রফতানি, বিশেষ করে তৈরি পোশাক রফতানি করতেই চট্টগ্রাম বন্দর হিমশিম খাচ্ছে। শ্রমিক অসন্তোষের কারণে পোশাক রফতানিকারকদের মাঝেমধ্যে কার্গো বিমানও ব্যবহার করতে হচ্ছে। এমনই এক পরিস্থিতিতে ভারতীয় কার্গো হ্যান্ডলিং করতে দিলে চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? বাংলাদেশে অবস্থানরত অনেক ভারতীয় সন্ত্রাসীকে এরই মধ্যে আমরা ভারতীয়দের হাতে তুলে দিয়েছি। কিন্তু ভারতে অবস্থানরত একজন বাংলাদেশী সন্ত্রাসীকেও কি ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশের হাতে তুলে দিয়েছে? টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে আমাদের যে শঙ্কা, তা এখনও দূর হয়নি। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ভারত এমন কিছু করবে না, যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়। বক্তব্যটি নিঃসন্দেহে ভালো। কিন্তু বাস্তবতা কী বলে? গেল সপ্তাহেও আসামে এই বাঁধের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয়েছে। আর এর ছবি বাংলাদেশী পত্রপত্রিকায় ছাপাও হয়েছে। অর্থাত্ এটা স্পষ্ট যে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়নি। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী যা বলেছিলেন, তা কথার কথা। সীমান্ত এখনও চিহ্নিত হয়নি। তিন বিঘা করিডোরের ওপর দিয়ে একটি ফ্লাইওভার নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল দিল্লি। সেই প্রস্তাবও কার্যকর করেনি ভারত। তাহলে ব্যাপারটা কী গড়াচ্ছে? ভারত যা চাইছে, তাই তারা পাচ্ছে বা আদায় করে নিচ্ছে। আর আমাদের প্রতিশ্রুতি দেয়া হচ্ছে। সেই প্রতিশ্রুতি কোনোদিনই বাস্তবায়ন করছে না ভারত। একজন ফেলানির হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে আবারও প্রমাণিত হলো ভারত তার কথা রাখেনি। এ ক্ষেত্রে সরকারের দুর্বলতা লক্ষ্য করার মতো। ফেলানির হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সরকার প্রতিবাদ তো দূরের কথা, কোনো মন্ত্রী, এমপি পর্যন্ত দুঃখ প্রকাশ করেননি। গেল মাসে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল যে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে মানবাধিকার পরিস্থিতি গাজা-ইসরাইল সীমান্তের চেয়েও ভয়াবহ। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনির দৃষ্টি এতে আকৃষ্ট হয়েছিল কি না জানি না। কিন্তু আমার মনে হয়েছে, আমাদের জাতীয় স্বার্থ ক্ষুণ্ন হচ্ছে। সমমর্যাদাভিত্তিক যে সম্পর্ক গড়ে ওঠার কথা, তাতে ব্যত্যয় ঘটেছে। আমরা সমমর্যাদা পাচ্ছি না। ফেলানির মৃত্যু এ কথাটা আবার প্রমাণ করল। আমাদের পররাষ্ট্র নীতির ব্যর্থতা এখানেই যে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের প্রশ্নে আমরা সেই সমমর্যাদাভিত্তিক সম্পর্ক নিশ্চিত করতে পারছি না।
লেখক : রাজনৈতিক বিশেষ
জ্ঞ

সিরাজ সিকদার হত্যার পরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিই এখনও চালানো হচ্ছে



আলাউদ্দিন আরিফ

র্যাব-পুলিশের প্রেস বিজ্ঞপ্তি থেকে ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার বা বন্দুকযুদ্ধ নামে বিচারবহির্ভূত হত্যার যে বিবরণ দেয়া হয় তার প্রথমটি পাওয়া গেছে ১৯৭৫ সালের ২ জানুয়ারি। পুলিশের দেয়া ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, ‘পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি’ নামে পরিচিত একটি গুপ্ত চরমপন্থী দলের প্রধান সিরাজুল হক সিকদার ওরফে সিরাজ সিকদারকে পুলিশ ১ জানুয়ারি চট্টগ্রাম থেকে গ্রেফতার করে। একই দিন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে ঢাকা পাঠানো হয়। জিজ্ঞাসাবাদের সময় তিনি স্বীকারোক্তিমূলক এক বিবৃতি দেন। এতে তার পার্টি কর্মীদের কয়েকটি গোপন আস্তানা এবং তাদের বেআইনি অস্ত্র ও গোলাবারুদ রাখার স্থানে পুলিশকে নিয়ে যেতে রাজি হন। সেভাবে ২রা জানুয়ারি রাতে একটি পুলিশ ভ্যানে করে তাকে ওইসব আস্তানার দিকে পুলিশ দল নিয়ে যাওয়ার সময় তিনি সাভারের কাছে ভ্যান থেকে লাফিয়ে পড়ে পালানোর চেষ্টা করেন। তার পলায়ন রোধ করার জন্য পুলিশ দল গুলিবর্ষণ করলে তাত্ক্ষণিক ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। এ ব্যাপারে সাভারে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। ’
‘উল্লেখ যে, সিরাজ সিকদার তার গুপ্ত দলে একদল দুর্বৃত্ত সংগ্রহ করে তাদের সাহায্যে হিংস্র কার্যকলাপ, গুপ্তহত্যা, থানার উপর হামলা, বন অফিস, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ইত্যাদির উপর হামলা, ব্যাংক-হাটবাজার লুট, লঞ্চ-ট্রেনে ডাকাতি, রেললাইন তুলে ফেলার দরুন গুরুতর ট্রেন দুর্ঘটনা, লোকজনের কাছ হইতে জোর করে অর্থ আদায়ের মত কার্যকলাপের মাধ্যমে দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা বিঘ্নিত করে আসছিল।’ এই বিজ্ঞপ্তিরই অনুসরণে এখন তৈরি হচ্ছে র্যাব ও পুলিশের প্রেস বিজ্ঞপ্তি।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০০৫ সালের ৩০ মে পল্লবীতে পুলিশের ক্রসফায়ারে সাইদুল নামে এক সন্ত্রাসী মারা যায়। প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে র্যাব সাজায়, ৩০ মে রাতে সাভারের আমিনবাজার এলাকা থেকে দুই সহযোগীসহ সাইদুলকে গ্রেফতার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে সে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেয়। রাতে তাকে নিয়ে পল্লবীর বিভিন্ন এলাকায় অস্ত্র, মাদক উদ্ধার ও অপর সহযোগীদের অভিযানে নামে। রাত ৩টার সময় পুলিশ পল্লবীর শহীদবাগ কালাপানি এলাকার সাগুপ্তা হাউজিং প্রজেক্টের মাঠের কাছে গেলে সাইদুলকে ছিনিয়ে নেয়ার জন্য তার সহযোগী সন্ত্রাসীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। পুলিশও পাল্টা গুলি করে। গোলাগুলি চলাকালে পালিয়ে যাওয়ার সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই সাইদুল মারা যায়। শীর্ষ সন্ত্রাসী সাইদের নামে জোড়াখুনসহ তিনটি হত্যা মামলা আছে।
একই দিন র্যাব-৩-এর ক্রসফায়ারে সুমন নামে এক যুবক মারা যায়। পরদিন র্যাবের দেয়া বিজ্ঞপ্তিতে ঘটনার বিবরণ ছিল এই রকম—র্যাব-৩-এর একটি দল রামপুরার বনশ্রী প্রজেক্টে কতিপয় সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনার খবরে টহল দিতে আসে। সেখানে এক যুবককে আটক করার পর তার সহযোগীরা র্যাবকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। র্যাবও পাল্টা গুলি করে। উভয়পক্ষের মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ বন্দুকযুদ্ধ হয়। সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যাওয়ার পর ঘটনাস্থলে এক যুবকের লাশ পড়ে থাকতে দেখা য়ায়। পরে খিলগাঁও থানা পুলিশ এসে তার লাশ শনাক্ত করে। ঘটনাস্থল থেকে দুই রাউন্ড গুলিভর্তি একটি রিভলবার উদ্ধার করেছে। সে সবুজবাগ থানার তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী। তারা নামে সবুজবাগ থানায় হত্যা মামলাসহ একাধিক মামলা রয়েছে। সে খিলগাঁও ভূঁইয়াপাড়ার ফজলু হত্যা, গোড়ান শাহী মসজিদের পাশে বেলায়েত নামের এক ব্যক্তিকে জবাই করে হত্যা, গার্মেন্টস শ্রমিক হালিমা ধর্ষণ, স্কুলছাত্রী তামান্নাকে কুপিয়ে জখম, গোড়ান টেম্পু স্ট্যান্ডের ডিশ ব্যবসা দখল এবং চাঁদাবাজিসহ বেশ কিছু অভিযোগ রয়েছে। দীর্ঘ দিন থেকে তার অপকর্ম চলে আসলেও এলাকাবাসী তার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস পায়নি। এ ব্যাপারে খিলগাঁও থানায় একটি মামলা হয়েছে। যদিও ওই সময় সুমনের স্বজনরা দাবি করে, সে স্থানীয় যুবলীগের কর্মী। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে সে ক্রসফায়ারের শিকার হয়েছে।
র্যাব গঠনের পর থেকে বেশ কিছু প্রেস বিজ্ঞপ্তি পর্যালোচনা করে যে চিত্র পাওয়া যায়, তা হচ্ছে—‘আটককৃত ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। তাকে নিয়ে অস্ত্র উদ্ধার ও সহযোগীদের গ্রেফতারের জন্য অভিযানে নামে। এ সময় প্রতিপক্ষের সন্ত্রাসীরা র্যাব বা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি করে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাও পাল্টা গুলি করে। পালানোর সময় আটক ব্যক্তি ক্রসফায়ারে পড়ে মারা গেছেন। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট থানায় মামলা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে এই মামলা রয়েছে .........। তবে মাঝে মাঝে ক্রসফায়ারের স্থলে বন্দুকযুদ্ধ বা এনকাউন্টারের উল্লেখ থাকে। কখনও সন্ত্রাসীকে আগেই ধরার বিষয়টি স্বীকার করা হয়, কখনও করা হয় না। বলা হয়, র্যাব বা পুলিশের দল অভিযানে গেলে সন্ত্রাসীরা গুলি করে। তারাও পাল্টা গুলি করলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সন্ত্রাসীদের বা র্যাবের গুলিতে মৃত্যু হয়েছে বলে প্রচার করা হয়।
স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম ক্রসফায়ার নয়, বরং রাজনৈতিক দলের প্রধান হিসেবে প্রথম বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন সিরাজ সিকদার। কেউ কেউ বলেন, এটাই ছিল সরকার কর্তৃক ঘোষিত প্রথম ক্রসফায়ার। পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নেতা ছিলেন প্রকৌশলী সিরাজুল হক ওরফে সিরাজ সিকদার। ১৯৭৫ সালের ২ জানুয়ারি পুলিশি অভিযানে ক্রসফায়ারে পড়ে নিহত হয়েছিলেন তিনি। সিরাজ সিকদার নিহত হওয়ার পরবর্তী সংখ্যায় ইংরেজি সাপ্তাহিক হলিডে ৩-এর পাতায় আট কলামে হেডলাইন করেছিল দঝরত্ধল ংরশফবত্ শরষষফ রহ ঢ়ড়ষরপব ধপঃরড়হ.্থ
পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টির অস্থায়ী পরিচালনা কমিটির (অপক) সাবেক সম্পাদক কমরেড রইসউদ্দিন আরিফ আমার দেশের সঙ্গে এক সাক্ষাত্কারে বলেন, সিরাজ সিকদার বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার পর তত্কালীন সরকার প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান দম্ভের সঙ্গে বলেছিলেন, ‘কোথায় আজ সেই সিরাজ সিকদার’। তার লেখা ‘আন্ডারগ্রাউন্ড জীবন সমগ্র’ ও ‘রাজনীতি, হত্যা ও বিভ্রান্ত জাতি’ বই দু’টিতে সেই বর্ণনা দিয়েছেন।
রইসউদ্দিন আরিফ বলেন, সিরাজ সিকদারের আগেও তাদের দলসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলের অনেক নেতাকর্মী ক্রসফায়ারে বা পুলিশি হেফাজতে মারা গিয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশ সেগুলো প্রেসনোট বা প্রেসবিজ্ঞপ্তি দিয়ে স্বীকার করেনি। বলা যায়, রাজনৈতিক দলের প্রধান ব্যক্তি হিসেবে সিরাজ সিকদার প্রথম নিহত হয়েছিলেন।
কমরেড রইসউদ্দিন আরিফ আরও বলেন, ’৭২ থেকে ’৭৫ সাল পর্যন্ত রক্ষীবাহিনীসহ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় তাদের দলের নেতাকর্মী খুন হতে থাকে। ওই সময় সর্বহারা দলের লোকজনও বসে ছিল না। তারাও কাউন্টার অ্যাকশনে যান। তার বর্ণনা মতে, ওই সময় রক্ষীবাহিনী ও মুজিববাদীরা তাদের ১০ জন হত্যা করলে সর্বহারা দলের লোকজন রক্ষীবাহিনী বা আওয়ামী লীগের ১০ জন না পারলেও ৫ জনকে হত্যা করেছিল।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ধারাবাহিকতায় সিরাজ সিকদার নিহত হওয়ার ঘটনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, পরবর্তীতে র্যাব বা পুলিশের প্রেসবিজ্ঞপ্তিতে প্রায় একই রকম বিবরণ দেখা যায়। এসব বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে বৈধতা দেয়া হচ্ছে। বলা হয় যে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা আত্মরক্ষার্থে গুলি করে, এতে ক্রসফায়ারে পড়ে সন্ত্রাসীরা মারা পড়ে।
পর্যবেক্ষণে বলা যায়, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার গুলিতে প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোনো না কোনো অঞ্চলে লোকজন মারা যাচ্ছে। প্রায় ঘটনায়ই বলা হয়, সন্ত্রাসীরা র্যাব-পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। কিন্তু এসব গুলিতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজনের মৃত্যু হওয়ার রেকর্ড পাওয়া যায় না। আর এই সূত্র দিয়েই বৈধতা দেয়া হয় বিচারবহির্ভূত হত্যার।
সিরাজ সিকদারের বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হওয়া প্রসঙ্গে বর্তমানে আওয়ামী লীগ নেতা মাহমুদুর রহমান মান্নার লেখা ‘খবরের কাগজ’-এ প্রকাশিত হয়। লেখাটি ২ জানুয়রি ১৯৯৯ সালে দৈনিক ইনকিলাবে পুনঃপ্রকাশিত হয়। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘সিরাজ সিকদার একজন অসাধারণ যোগ্যতাসম্পন্ন সংগঠক ছিলেন। আমি যদ্দূর জানি, এ কথা তার ঘোর সমালোচকরাও স্বীকার করেছেন। সিরাজ সিকদারের মৃত্যুর ঘটনাটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ইতিহাসের একটি বর্বরতম ঘটনা। আমরা মধ্যযুগ কিংবা হিটলার মুসোলিনির আমলে এ ধরনের বর্বরতম ঘটনার নিদর্শন পাই। বুর্জোয়া যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের কথা বলে থাকে আজকাল, এমনকি আমাদের দেশেও, তাতে সিরাজ সিকদার অপরাধ করে থাকলেও তার বিচার পাবার দাবিতো উপেক্ষিত হতে পারে না। সিরাজ সিকদার যে বিচারবঞ্চিত হয়েছিলেন, সরকারি প্রেসনোটে তখন যা উল্লেখ করা হয়েছিল (জিপ থেকে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার গুলিতে তিনি নিহত হন), তা যে বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না সে কথা যারা এ প্রেসনোট দিয়েছিলেন তারাও স্বীকার করবেন। আর সবচেয়ে ন্যক্কারজনক হলো, তত্কালীন সংসদে প্রধানমন্ত্রীর উল্লসিত আস্ফাালন— কোথায় আজ সিরাজ সিকদার?’
লেখক আহমদ শরীফ ‘সেই গ্লানিবোধ কাঁটার মতো বুকে বেঁধে’ শীর্ষক লেখায় বলেন, .. ‘এ মানবতাবাদী সাম্যবাদী নেতাকে হাতে পেয়ে যেদিন প্রচণ্ড প্রতাপে শঙ্কিত সরকার বিনা বিচারে খুন করলো সেদিন ভীতসন্ত্রস্ত আমরা আহা শব্দটিও উচ্চারণ করতে সাহস পাইনি। সেই গ্লানিবোধ এখনো কাঁটার মতো বুকে বিঁধে।

রক্ষীবাহিনীর নৃশংসতা মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানিয়েছিল



আলাউদ্দিন আরিফ

স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যা-কাণ্ডের প্রচলনের পর থেকে ব্যাপকসংখ্যক মানুষ এই নির্মমতার শিকার হয়। ১৯৭২ সাল থেকে ’৭৫ সাল পর্যন্ত রক্ষীবাহিনীসহ বিভিন্ন বাহিনীর নৃশংসতা মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানিয়েছিল। নির্যাতনে ২৭ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল বলে বিভিন্ন পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে। এছাড়াও ওই সময় রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয় ১৯ হাজার মানুষ। গুম ও খুন হয় এক লাখ। পিটিয়ে মারা হয় ৭ হাজার মানুষকে। জেলখানায় হেফাজতে থাকা অবস্থায় মারা যায় ৯ হাজার মানুষ।
লেখক, সাংবাদিক আহমেদ মূসা লিখেছেন, ‘আওয়ামী লীগ শাসনামলে যেসব প্রকাশ্য ও গোপন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ সরকার ও তার নীতির বিরোধিতা করেছে, ওইসব দলের মতে, সে আমলে ২৫ হাজার ভিন্ন মতাবলম্বীকে হত্যা করেছে আওয়ামী লীগ। এ হতভাগাদের হত্যা করা হয়েছে চরম নিষ্ঠুরতা ও নৃশংসতার মধ্য দিয়ে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ওই সময় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী জাতীয় রক্ষীবাহিনীর নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। তাদের মধ্যে জাতীয় কৃষক লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা নবাবগঞ্জ হাইস্কুলের শিক্ষক সিদ্দিকুর রহমান খান (সিদ্দিক মাস্টার) খুন হন ’৭২ সালের ১০ অক্টোবর। ’৭৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর রক্ষীবাহিনীর হাতে শত শত লোকের সামনে খুন হন জাসদ ছাত্রলীগ নেতা বুবলু, রবি, এবাদত আলী, মোতালেব, কালু ও সম্পদসহ অনেকে। রক্ষিবাহিনীর হাতে খুন হওয়া জাসদ কর্মীদের মধ্যে ছিলেন সিটি কলেজ ছাত্র সংসদের জিএস জাহাঙ্গীর, গণবাহিনীর দারাজ, মূয়র, আসাদ, মাসুদ হারুন, জাহাঙ্গীরনগরের শাহ বোরহান উদ্দিন রোকন, বুয়েটের নিখিল চন্দ্র সাহা, নরসিংদীর জাসদ নেতা আলাউদ্দিন, গাজীপুরের আক্রাম, জয়নাল, সামসু, বাদল, আনোয়ার, মানিকগঞ্জের সাহাদাত হোসেন বাদল, দেলোয়ার হোসেন হারাজ, আবদুল আউয়াল নাজু, নাজিম, জামালপুরের পেট্রোল, গিয়াসউদ্দিন মাস্টার, নেত্রকোনার আবদুর রশিদ, হাছু মিয়া, ময়মনসিংহের মাসুদুজ্জামান, আবদুল জাব্বার, মাদারীপুরের জাহাঙ্গীর, সাদাম, আলী হোসেন, মফিজুর, ফরিদপুরের কামালুজ্জামান, আবদুল হাকিম, রাজশাহীর মনিরুদ্দীন আহমদ, সালাম মাস্টার, রফিক উদ্দিন আহমেদ সেলিম, বগুড়ার আতা, রঞ্জু, মানিক দাশগুপ্ত, তোতা, রানা (কর্নেল) খলিল, রাজ্জাক (কক), নাটোরের নাসির উদ্দিন, পাবনার আসফাকুর রহমান কালসহ অনেকে। এভাবে সারাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা।
মওলানা ভাসানীর সাপ্তাহিক হক কথায় ২৬ মে ১৯৭২ সালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, ‘একটি বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থার বিশেষ প্রোগ্রামে এ দেশে কাজ করে যাচ্ছে। তাদের হিসাব হলো, বাংলাদেশে সোয়া লক্ষ বামপন্থী কর্মীকে হত্যা করতে হবে। তা না হলে শোষণের হাতিয়ার মজবুত করা যাবে না।’
রক্ষীবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ ছিল খুবই নির্মম ও ভয়াবহ। তারা বাবার সামনে ছেলেকে গুলি করে হত্যার পর বাবার ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন চালিয়ে ছেলের গলা কেটে দিতে বাধ্য করে। তাদের উক্তি ছিল ‘নিজহাতে তোর ছেলের গলাকেটে দে, ফুটবল খেলব তার মাথা দিয়ে’। লেখক আহমেদ মূসা তার ‘ইতিহাসের কাঠগড়ায় আওয়ামী লীগ’ বইয়ের উত্সর্গনামায় মুজিববাদী ঘাতক বাহিনীর অবর্ণনীয় নির্যাতনের শিকার বাজিতপুরের ইকুরটিয়া গ্রামের বৃদ্ধ কৃষক আবদুল আলীর অভিজ্ঞতার বর্ণনা তুলে ধরে লিখেছেন, ‘... ঐখানে আমাকে (আবদুুল আলী) ও আমার ছেলে রশিদকে হাত-পা বেঁধে তারা খুব মারলো। রশিদকে আমার চোখের সামনে গুলী করলো। ঢলে পড়লো বাপ আমার। একটা কসাই আমার হাতে একটা কুড়াল দিয়ে বলল, তোর নিজের হাতে ছেলের গলা কেটে দে, ফুটবল খেলবো তার মাথা দিয়ে। আমার মুখে রা নেই। না দিলে বলল তারা, তোরও রেহাই নেই। কিন্তু আমি কি তা পারি? আমি যে বাপ। একটানা দেড় ঘণ্টা মারার পর আমার বুকে ও পিঠে বন্দুক ধরলো। শেষে নিজের হাতে কেটে দিলাম ছেলের মাথা। আল্লাহ কি সহ্য করবে?’
স্বাধীন বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যার এক ভয়ঙ্কর তথ্য জানা যায় মাসুদুল হক রচিত ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং সিআইএ’ গ্রন্থে। ওই গ্রন্থের ১০৬ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ‘১৯৭২ সালে একদিকে তিনি (মুজিব) সকল মুক্তিযোদ্ধাকে অস্ত্র জমা দেয়ার নির্দেশ দেন, অপরদিকে আবদুর রাজ্জাক ও সিরাজুল আলম খানকে অস্ত্র জমা দিতে বারণ করলেন। শেখ মুজিবের ওই নিষেধ সম্পর্কে আবদুর রাজ্জাক বলেন, সিরাজুল আলম খান আর আমাকে ডেকেই বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, সব অস্ত্র জমা দিও না। যেগুলো রাখার দরকার সেগুলো রেখে দাও। কারণ, সমাজ বিপ্লব করতে হবে। প্রতি বিপ্লবীদের উত্খাত করতে হবে, সমাজতন্ত্রের দিকে এগুতে হবে। এটা আমাদের পরিষ্কারভাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন।’ মুজিব আমলে এসব হত্যাকাণ্ড যে পুরোপুরি রাষ্ট্রীয় মদতে হয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
সাপ্তাহিক হক কথার ২ জুন ১৯৭২ সংখ্যায় লেখা হয়েছে, ‘ঢাকা জেলার (বর্তমানে নরসিংদী জেলা ) মনোহরদী থানার পাটুলী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ কর্মকর্তারা দলীয় কর্মীদের সহযোগিতায় সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত শত্রুতা সাধনের উদ্দেশ্যে একজন মুক্তিযোদ্ধাকে জীবন্ত কবর দিয়াছে। এই অপরাধে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করিয়া নারায়ণগঞ্জ থানায় চালান দিলে জনৈক এমসিএ হস্তক্ষেপ করিয়া এই নরঘাতকটিকে মুক্ত করিয়াছেন।’
ময়মনসিংহে ১৫শ’ কিশোরকে হত্যার বর্ণনা দেন লেখক আহমেদ মূসা। ইতিহাসের কাঠগড়ায় আওয়ামী লীগ বইটিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘...রক্ষীবাহিনী গত জানুয়ারীতে এক ময়মনসিংহ জেলাতেই অন্তত ১ হাজার ৫শ’ কিশোরকে হত্যা করেছে। এদের অনেকেই সিরাজ সিকদারের পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টি (ইবিসিপি)-এর সদস্য ছিল। অন্যদের মার্কসবাদী ও লেনিনবাদী দলের প্রতি সহানুভূতিশীল বলে সন্দেহ করা হয়েছিল। এমনকি অনেক যুবক যারা রাজনীতিতে ততটা সক্রিয় ছিল না, তারাও এই অভিযানে প্রাণ হারিয়েছেন’।
ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরোর সাবেক সদস্য ও বর্তমানে সিপিবি নেতা হায়দার আকবর খান রনো ‘বাম রাজনীতি : সংকট ও সমস্যা বইতে লিখেছেন, ‘মুজিববাদীদের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো সন্ত্রাসের রাজনীতি, প্রকাশ্য হত্যা, গুপ্ত হত্যা, গুণ্ডামি। এগুলো ছিল খুবই সাধারণ ব্যাপার। রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পগুলো ছিল হত্যাযজ্ঞের আখড়া। যশোরের কালীগঞ্জ থেকে রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্প উঠে গেলে সেখানে গণকবর আবিষ্কৃত হয়েছিল। যাতে ৬০টি কঙ্কাল পাওয়া যায়। টঙ্গী থানার সামনে মেশিনগান স্থাপন করে শ্রমিক কলোনির ওপর নির্বিচারে গুলী চালানো হলো। শতাধিক নিহত হলেন।’
৩১ আগস্ট ১৯৭২ সালে কমিউনিস্ট পার্টি সভাপতিমণ্ডলী কর্তৃক ঢাকায় আহূত ‘ব্যর্থ-অযোগ্য দেউলিয়া সরকারের পদত্যাগ চাই’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে আইনশৃংখলা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, দেশে লুটতরাজ, রাহাজানি, পাইকারি হারে ডাকাতি ও রাজনৈতিক গুপ্তহত্যার ব্যাপকতা বেড়ে চলেছে। লাল বাহিনী নামক একটি বেসরকারি বাহিনী সংগঠিত করে ক্ষমতাসীন দল শিল্প শ্রমিকদের জীবন বিপদসঙ্কুল করে তুলেছে। এদের সশস্ত্র ফ্যাসিবাদী হামলায় এযাবত্ শত শত শিল্প-শ্রমিক শহীদ হয়েছেন’।
রক্ষীবাহিনীর নির্যাতন সম্পর্কে শরিয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার কার্তিকপুরের অরুণা সেনের একটি প্রতিবেদন ছাপা হয় সাপ্তাহিক হলিডের ১৭ মার্চ ১৯৭৪ সংখ্যায়। এছাড়াও মাসিক সংস্কৃতি পত্রিকার ১৯৭৪ এর মে-জুন সংখ্যায় তার একটি বিবৃতি ছাপা হয়েছে। এতে তিনি নড়িয়া ও ডামুঢ্যা ক্যাম্পসহ কয়েকটি ক্যাম্পে রক্ষীবাহিনীর নির্যাতন ও মানুষ হত্যার লোমহর্ষক বর্ণনা দেন। অরুনা সেন বিবৃতিতে বলেন, ‘১৭ আশ্বিন রক্ষিবাহিনীর লোকেরা তাদের গ্রামে প্রথম হামলা করে। গ্রামের লোককে মারধর করে তাকে ও লক্ষ্মণ সেন নামে এক কলেজ ছাত্রকে ধরে নিয়ে যায়। তারা অরুনার স্বামী শান্ডি সেন ও পুত্র চঞ্চলের অবস্থান জানতে চায়। তাদেরকে মারধর করে ছেড়ে দেয়। এর কিছুদিন পর ৩ ফেব্রুয়ারি রাতে রক্ষীবাহিনীর বিশাল একটি দল তাদের গ্রাম ঘিরে ফেলে। আওয়ামী লীগের থানা সম্পাদক হোসেন খাঁর নেতৃত্বে গ্রামের বালক ও পুরুষ লোকদের এনে হাজির করে। তারা কলিমদ্দি ও মোস্তফাসহ ২০ জন হিন্দু যুবককে ধরে নিয়ে যায়। অরুণা সেন নিজে এবং রীনা ও হনুফা নামে তিন মহিলাকে বর্বর নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে বলেন, বিপ্লব, মতি ও কৃষি ব্যাংকের পিয়ন আলতাফকে পিটিয়ে মেরে জল্লাদ গর্ব করে বলে ‘দেখ এখনও হাতে রক্ত লেগে আছে।’ আলতাফকে মারা হয় পিটিয়ে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় দোতলার ছাদ থেকে ফেলে। ৯ ফেব্রুয়ারি শীতের মধ্যে হনুফা, রীনা ও অরুণা সেনসহ কয়েকজনকে দিনভর পানিতে রেখে মারধর করা হয়। তাদের মধ্যে করিম মারধরে মারা গেছে। অপর একটি ছেলেকেও মেরে ফেলার কথা উল্লেখ করেন অরুণা। টানা কয়েকদিন নির্যাতনের পর ১৯ ফেব্রুয়ারি ডামুঢ্যা রক্ষীবাহিনী ক্যাম্পে নেয়া হয় অরুণা সেন ও রীনাকে। কলিমদ্দি, মোস্তফা, গোবিন্দ ও হরিপদকে রেখে দেয়। রক্ষীবাহিনী বলছিল তাদের মেরে ফেলা হবে। অরুণা সেন বের হয়ে আসার পর চারটি গুলির আওয়াজ শোনা যায়। ডামুঢ্যা ক্যাম্প থেকে তাকে নেয়া হয় মাদারীপুর ক্যাম্পে। শেষ রাতে নেয়া হয় ঢাকায়।

সরকারি পরিসংখ্যান : অপরাধ এখন বেশি হচ্ছে


আলাউদ্দিন আরিফ

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ও প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শামসুল ইসলাম টুকু দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে ভালো বললেও পুলিশ সদর দফতরের পরিসংখ্যান বলছে অন্য কথা। ২০০৯ সালের তুলনায় গত বছর (২০১০) দেশে ৩৮ হাজার ৪২৬টি অপরাধ বেশি হয়েছে। পুলিশ সদর দফতর থেকে পাওয়া এই তথ্যমতে বিগত চারদলীয় জোট সরকারের শাসনামলে ২০০৫ সালের চেয়ে এ সংখ্যা ৭২ হাজার ৫০১টি বেশি এবং সেনাসমর্থিত ওয়ান ইলেভেন পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল ২০০৭ সালের চেয়ে ৩৮ হাজার ৩৩৪টি বেশি। গত বছরের তুলনায় এ বছর খুন বেড়েছে ৯৬টি। ২০০৫ সাল থেকে ৭২৩টি খুন বেশি হয়েছে।
সাবেক চারদলীয় জোট সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এয়ারভাইস মার্শাল (অব.) আলতাফ হোসেন চৌধুরী গতকাল আমার দেশকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বাস্তবে এমন খারাপ পর্যায়ে গেছে যে, এ নিয়ে মন্তব্য করার মতো অবস্থাও নেই। শুধু বিএনপি আমলেই নয়, অতীতের যে কোনো সময়ের রেকর্ড ভেঙেছে দেশের অপরাধ পরিস্থিতি। এ সরকার তাদের শাসনামলের বিগত সময়েরও সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। চলতি বছর পুলিশ সপ্তাহ চলাকালে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যে পরিসংখ্যান দেয়া হয়েছিল তাতেও দেখা গেছে, অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে ভঙ্গুর পরিস্থিতি বিরাজ করছে দেশের আইনশৃঙ্খলায়। দেশে মানবাধিকার বলে এখন আর কিছু অবশিষ্ট নেই।
বিগত ২০১০ সালে দেশে ডাকাতি ২৯১, দস্যুতা ১৩৬৬, খুন-হত্যা ৪৩১৫, দ্রুত বিচার আইনে মামলা ১৬৯২, দাঙ্গা হাঙ্গামা ৯৫০, নারী নির্যাতন ১৫১৩৪, শিশু নির্যাতন ১৪৫৬, অপহরণ ৮৮০, পুলিশের ওপর হামলা ও মারধর ৪৬২, সিঁধেল চুরি ৩১১৪, দুর্ধর্ষ চুরি ৮৫১৩, অস্ত্র ১৭০৩, বিস্ফোরক ১৮৯, মাদক ৫৬২৪৯, চোরাচালান ৯৭৭৬ ও অন্যান্য অপরাধে মামলা হয়েছে ৮৯৪৪৪টি। পুলিশ সদর দফতরে গত বছরের অক্টোবর পর্যন্ত রেকর্ড তৈরি রয়েছে। একজন পুলিশ কর্মকর্তা অপর দুই মাসের রেকর্ড দেন বিভিন্ন হিসাব করে। এসব রেকর্ডে দেখা গেছে, ২০০৯ সালের তুলনায় এবার ডাকাতির মামলা কমে বেড়েছে দস্যুতার মামলা। বিগত বছরে নারী ও শিশু নির্যাতন অতীতের যে কোনো রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। ২০১০ সালে নারী নির্যাতনের ঘটনায় আগের বছরের চেয়ে ১৩ হাজার ৯৩০টি বেশি মামলা হয়েছে। বিশেষ করে ইভটিজিং ভয়াবহ ছিল বছরজুড়েই।
বর্তমান সময়ে দেশে ডাকাতিতে একটি উদ্বেগজনক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। গ্রামে গ্রামে নয়, খোদ রাজধানী ও রাজধানীর উপকণ্ঠেই মানুষ ডাকাতি রোধে রাত জেগে পাহারা দিচ্ছে। অথচ পুলিশের রেকর্ডে বিগত ২০১০ সালে ডাকাতির একেবারেই কম। নানা জবাবদিহিতার কারণে পুলিশ ডাকাতির মামলা নিতে চায় না। ডাকাতির মামলাকে পুলিশ দস্যুতা বা চুরির মামলা হিসেবে নেয়। এ কারণে ডাকাতি ভয়ানক পরিস্থিতি তৈরি করলেও পুলিশি রেকর্ডপত্রে ডাকাতির মামলা অনেক কমেছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যত খারাপই থাকুক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে যারা থাকেন বা যারা পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ে থাকেন তারা কখনোই বিষয়টি স্বীকার করেন না। তারা সবসময় বলেন, দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যে কোনো সময়ের চেয়ে ভালো। বিগত সময়েও যারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও যেসব উপদেষ্টা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন তাদেরও ওই সময় বলতে শোনা গেছে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যে কোনো সময়ের চেয়ে ভালো। বিগত ওয়ান ইলেভেন পরবর্তী সময়ে যখন মামলা হামলা বেশি হচ্ছিল ওই সময় উপদেষ্টারা বলেছিলেন, আগে মানুষ ভয়ে পুলিশের কাছে যেতে সাহস পেত না, এখন নির্ভয়ে মামলা করতে পারছে। তাই রেকর্ডে মামলা বেশি।
পুলিশের সাবেক আইজি আবদুল কাইয়ুম গতকাল আমার দেশকে বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীরা মুখে বললেই তো আইনশৃঙ্খলার উন্নতি হয়ে যাবে না। প্রতিদিন দেশের পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর দিকে তাকালেই আইনশৃঙ্খলার অবস্থা বুঝা যায় যে দেশে আইনশৃঙ্খলা এখন ভয়াবহ সময় অতিক্রম করছে। একজন উপজেলা চেয়ারম্যানকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করা হলো। এ ঘটনায় একজন মাত্র আসামিকে গ্রেফতার করে আর কোনো তত্পরতা পুলিশের নেই।
চৌধুরী আলম নিখোঁজ হওয়ার পর নানাভাবে সরকারের কাছে আবেদন ও প্রতিবাদ জানানোর পরও সরকার কোনো ব্যাখ্যা দিচ্ছে না। ক্রসফায়ার ও মানুষ গুম হচ্ছে। যৌন ভয়াবহতা বা ইভটিজিংসহ নারী নির্যাতন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। ইভটিজিংয়ের শিকার হয়ে অনেকে আত্মহত্যা করছে। প্রতিবাদ করায় মারা পড়ছে। অথচ মানুষ পুলিশের কাছে আশ্রয় ও আদালতের কাছে বিচার পাচ্ছে না। রাজনৈতিক হয়রানির মামলা করে একের পর এক হত্যা মামলা ও দুর্বৃত্তায়নের মামলা প্রত্যাহার করে নেয়া হচ্ছে। এতে খুনের শিকার পরিবারগুলো আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ক্ষমতাসীন দলের চাঁদাবাজি টেন্ডারবাজিসহ দেশে যে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে তার উল্লেখ করে সাবেক এই আইজিপি বলেন, আমার দীর্ঘ চাকরি জীবনে কখনও এ পরিস্থিতি দেখিনি। বলতে পারেন আইনশৃঙ্খলা অবনতির নতুন এক অভিজ্ঞতা পাচ্ছি আমরা।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পুলিশ সদর দফতরের হিসাবে চারদলীয় জোট সরকারের শাসনামলে গড়ে খুন হয়েছে ৯ থেকে ১০টি করে। বর্তমানে এটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ থেকে ১২টিতে। দুঃখজনক হলেও সত্য, বিএনপি সরকারের সময় প্রথমে অপারেশন ক্লিনহার্টে ৪০ জন ও র্যাব গঠনের পর ব্যাপক হারে ক্রসফায়ার হয়। আওয়ামী লীগ নেতারা ওই সময় ক্রসফায়ার ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে জোরালো বক্তব্য দেন। কিন্তু ক্ষমতায় এসে তারা ক্রসফায়ার চালু রাখেন। আইনশৃঙ্খলার নিয়ন্ত্রণে একমাত্র ক্রসফায়ারের উপরই নির্ভর করছেন তারা। মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের রিপোর্ট অনুযায়ী গত দু’বছরে ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছে ২৮১ জন। বিএনপি সরকারের সময় বিএনপি শীর্ষ সন্ত্রাসীসহ দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী ও গডফাদারদের তালিকা করে। ২৩ সন্ত্রাসীকে ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করে। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় সন্ত্রাসীদের ধরতে কোনো পুরস্কারের ঘোষণা আসেনি।
জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ (জেএমজিবি) ও জামাআ’তুল মুজাহেদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)-এর শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতার করে। তাদের বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে এবং ওয়ান ইলেভেন পরবর্তী সরকারের সময় তাদের ফাঁসি কার্যকর হয়। চারদলীয় জোট আমলে গ্রেফতার হয়েছিলেন হরকাতুল জেহাদ নেতা মুফতি হান্নান। আওয়ামী লীগ সরকার মুফতি হান্নানের বিচারিক প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করছে না। রহস্যজনকভাবে তার মামলাগুলো নিয়েও এক ধরনের দীর্ঘসূত্রতা চলছে।
দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম এক নাজুক অবস্থাতেও গত রোববার মিরপুরে ঢাকা সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড কমিশনার শাহেদা তারেক দীপ্তির বাসায় দুর্ধর্ষ ডাকাতি হয়। তাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেন, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগের চেয়ে ভালো।
গতকাল আবার ভিন্ন কথা বলেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু। বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি হয়েছে কি-না জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শামসুল হক টুকু বলেছেন, আমরা বলছি না যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো। তবে দেশের মানুষ বলছে, বর্তমান সরকারের আমলে বিগত দুটি ঈদ, পূজা, বড়দিন উদযাপন হয়েছে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই। মাঝে মধ্যে সন্ত্রাসীরা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। তাদের প্রতিহত করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সজাগ থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, অপরাধীদের শনাক্ত করতে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছে পুলিশ, র্যাব ও গোয়েন্দারা

Friday 7 January 2011

ভারতীয় ভাষ্যকারের মন্তব্য : দু’বছরে তেমন সাফল্য নেই শেখ হাসিনা সরকারের

স্টাফ রিপোর্টার

শেখ হাসিনা তার দুই বছরের শাসনামলে তেমন কোনো সাফল্য অর্জন করতে পারেননি। ফলে আগামীতে যে কারও ক্ষমতায় আসার সুযোগ আছে। দিল্লি থেকে প্রকাশিত ‘দ্য পাইওনিয়ার’ পত্রিকার একটি কলামে ভাষ্যকার অশোক কে মেহতা এ মন্তব্য করেছেন। তিনি আরও লিখেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছেন। বিরোধী দল পেয়েছে হাতে গোনা কয়েকটি আসন, কিন্তু নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোটের এই বিপর্যয় প্রমাণ করে না যে তাদের যুগের অবসান হয়ে গেছে। ভাষ্যে মেহতা বাংলাদেশের সেনাবাহিনী সম্পর্কে নানা রকম মন্তব্য করে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের বিষয়টি তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে অর্ধেকেরও বেশি সময় ধরে সেনাবাহিনী প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের ভাগ্য নির্ধারণে ভূমিকা রেখেছে। শেখ হাসিনা বিডিআর বিদ্রোহকে কঠোরভাবে দমন করেছেন। পিলখানা হত্যাকাণ্ডকে একাত্তরের গণহত্যার সঙ্গে তুলনা চলে। ক্ষমতাসীন সরকার ৭-৮ হাজার বিডিআর সদস্যের বিচার করছে। নিরাপত্তা বাহিনীতে সংস্কার চলছে। এরই মধ্যে নিরাপত্তা দলটির (বিডিআর) নাম পাল্টানো হয়েছে। তিনি বলেন, গোয়েন্দা বিভাগগুলোর সাফল্য এবং সন্ত্রাস দমনে ২০০৪ সালে র্যাব গঠন ছিল উল্লেখ করার মতো বিষয়। এরপর থেকে অর্থাত্ ২০০৫ সাল থেকে হরকাতুল জিহাদ এবং জেএমবির মতো দলের পক্ষ থেকে সন্ত্রাসী হামলা চালানো সম্ভব হয়নি। এইসব দল এখন নেতাহীন হয়ে গেছে। কিন্তু আশঙ্কা করা হচ্ছে বর্তমান সরকার র্যাবকে ভেঙে দিতে পারে। কারণ খালেদা জিয়ার শাসনামলে র্যাব গঠিত হয়।
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক বিষয়ে তিনি লিখেন, নিরাপত্তা খাতে ভারতের সঙ্গে শেখ হাসিনা সরকারের উষ্ণ সম্পর্ক হচ্ছে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের একটি উল্লেখযোগ্য দিক। কারণ বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে কোনো ভারতীয় বিদ্রোহী দল তাদের তত্পরতা পরিচালনা করতে পারছে না। বাংলাদেশ সরকার ভারতের সঙ্গে সন্ত্রাসবিরোধী যে সহযোগিতা করে যাচ্ছে তা ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তবে ভারতের পক্ষ থেকে কিছু প্রশিক্ষণ ছাড়া বাংলাদেশকে সামরিক দিক থেকে অন্য সহযোগিতার বিষয়টি সবসময় উপেক্ষিত হয়েছে। গত বছর প্রথমবারের মতো আসামের জোড়ঘাটে উভয় দেশের কমান্ডো প্লাটুন যৌথ প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছে। এ বছর এই প্রশিক্ষণ কোম্পানি পর্যায়ে অনুষ্ঠিত হবে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের সেনাবাহিনী বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে। কারণ ভারতকে শত্রু রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ডিজিএফআইর সঙ্গে আইএসআইর সম্পর্ক রয়েছে বলে বাজারে গুজব আছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ শত্রু ছাড়া প্রকৃত কোনো শত্রু নেই। এই কারণে বাংলাদেশ উদারভাবে সামরিক কাজে ভূমিকা রাখতে পারে। বিশেষ করে জাতিসংঘ শান্তি বাহিনীতে দেশটির প্রায় ১০ হাজার সৈন্য আছে। যারা পেশাগত উত্কর্ষের কারণে প্রশংসা পেয়েছেন।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক বিষয়ে তিনি লিখেছেন, শেখ হাসিনার শাসনামলকে এ সম্পর্কে আরও বিকশিত করার ক্ষেত্রে সহযোগিহতা দিতে সৃষ্টিশীল কূটনীতির এটাই উপযুক্ত সময়। প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতি পর্যায়ের সফরের সুযোগ নষ্ট করা ঠিক হবে না। ভারতের অর্থনৈতিক সাফল্য দিয়ে বাংলাদেশের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া উচিত। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে উভয় দেশের জনগণের পারস্পরিক ভাব আদান-প্রদান খুব বেশি নয়। ভারত কি বিনিয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশীদের আস্থা অর্জনের উদ্যোগ নেবে?
তিনি লিখেছেন, ’৭১ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিজয় অর্জিত হলেও নতুন জন্ম নেয়া বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সঙ্গে দুঃখজনকভাবে কৌশলগত সম্পর্ক বিনির্মাণের সুযোগ হারানো হয়েছে। আর এই ব্যর্থতার কারণে বাংলাদেশের মতো একটি সম্পদ রাজনৈতিক ও নিরাপত্তার দায় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ২০০৪ সালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এটা স্বীকার করে নিয়েছেন যে পাকিস্তান, বাংলাদেশসহ সব প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ভালো নয়। এই সম্পর্ক ঝালাই করে নেয়ার সময় আবার এসেছে। কিন্তু নয়াদিল্লি এই জটিল কাজ সম্পন্ন করতে খুবই ধীরপন্থা অবলম্বন করে।

বিদায়ী বছরে রেকর্ডসংখ্যক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা : ১৩৬৭২টি দুর্ঘটনা, অধিকাংশের কারণ বৈদ্যুতিক গোলযোগ

আলাউদ্দিন আরিফ

বিদায়ী ২০১০ সাল ছিল অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহতার বছর। এ সময় সারাদেশে ১৩ হাজার ৬৭২টি অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। আগের বছরের চেয়ে এটি ১ হাজার ৪৯০টি বেশি। ২০০৯ সালে সারাদেশে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছিল ১২ হাজার ১৮২টি। এসব অগ্নিকাণ্ডের অধিকাংশ হয়েছে বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে।
বিদায়ী বছরে অগ্নিকাণ্ডের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল রাজধানীর নিমতলী ট্র্যাজেডি। ৩ জুন সন্ধ্যায় ওই অগ্নিকাণ্ডে ঘটনাস্থলে ১২৪ জন পুড়ে কয়লা হয়েছিল। হাসপাতালে মারা যান আরও প্রায় ১০ জন। নিমতলীতে অগ্নিদগ্ধ হন দু’শতাধিক মানুষ। প্রাথমিকভাবে মনে করা হয়, একটি বিয়ে অনুষ্ঠানের রান্নার আগুন থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত। পরে তদন্ত শেষে জানা যায়, রাসায়নিক দাহ্য পদার্থ থেকে আগুনের ভয়াবহতা বেড়ে যায়। আগুন কেড়ে নিয়েছে কারও কারও পুরো পরিবার। মা, স্ত্রী ও সন্তান হারিয়ে আজও অনেকে নির্বাক।
গত ১৪ ডিসেম্বর আশুলিয়ায় এফবিসিসিআই সভাপতি এ কে আজাদের মালিনাকাধীন হা-মীম গ্রুপের পোশাক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে নিহত হয়েছিলেন ৩০ জন। ২৪ ডিসেম্বর ঢাকার খিলক্ষেতে গুডনাইট কয়েল ফ্যাক্টরিতে আগুনে পুড়ে মারা যান ১০ জন। ৬ অক্টোবর রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে জুতার সলিউশন তৈরির কারখানা লিলি কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিতে আগুনে পুড়ে মারা যান ৯ জন। অবশ্য বছরব্যাপী অগ্নিকাণ্ডে কত লোকের প্রাণহানি হয়েছে, তার সঠিক হিসাব জানা যায়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রাণহানির সংখ্যা ৩শ’র বেশি। এর আগের বছর ২০০৯ সালে আগুনে প্রাণহানির সংখ্যা ছিল ২৬৯ জন।
গত কয়েক বছরের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সর্বাধিক অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হয় বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে। বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে ২০০৭ সালে ৩ হাজার ৩৩৪টি, ২০০৮ সালে ৩ হাজার ৭৬০টি, ২০০৯ সালে ৪ হাজার ৫২০টি ও ২০১০ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৪ হাজার ৯৮৫টি অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে রান্নার চুলা থেকে আগুন। চলতি বছর রান্নার চুলা থেকে ৩ হাজারের বেশি অগ্নিকাণ্ড হয়েছে। সিগারেটের টুকরো থেকে অগ্নিকাণ্ড হয়েছে প্রায় ১ হাজার ৬০০টি, শিশুদের আগুন নিয়ে খেলার কারণে প্রায় ৪০০, যন্ত্রাংশের সংঘর্ষজনিত কারণে প্রায় ৩০০, অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে প্রায় ১৭৫টি ঘটনায়।
আগুনে পোড়া রোগীদের চিকিত্সা দেয় ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিট। এ ইউনিটের প্রকল্প পরিচালক সামন্ত লাল সেন বলেন, স্বাভাবিক যেসব অগ্নিকাণ্ড হয়, ওই সময় তারা ভালো সেবা দিতে পারেন। কিন্তু নিমতলী বা হা-মীম গ্রুপের কারখানার মতো বড় অগ্নিকাণ্ডে এত বেশি রোগীকে একসঙ্গে চিকিত্সা দেয়ার মতো অবকাঠামো ও জনবল তাদের নেই। বার্ন ইউনিটের চিকিত্সকরা জানান, গত জুনে নিমতলীতে অগ্নিকাণ্ডের পর যত রোগী এসেছে, এত রোগী আর কখনও দেখেননি তারা।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সূত্র জানায়, তারা আগুন প্রতিরোধ কার্যক্রম জোরদার করেছে। বস্তি, হকার্স মার্কেট, হাটবাজার, মহানগর ও শিল্প এলাকার গুরুত্বপূর্ণ স্থানে মহড়া এবং অগ্নিপ্রতিরোধে পরামর্শ দেয়া, পোশাক শিল্পে আগুন প্রতিরোধে প্রতি মাসে ঢাকা শহরের পোশাক কারখানাগুলো পরিদর্শন, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে অগ্নিনির্বাপণ এবং প্রতিরোধ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া, কমিউনিটি ভলান্টিয়ার তৈরি করাসহ নানা ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। অগ্নিপ্রতিরোধ ও নির্বাপণে মোবাইল কোর্টও পরিচালনা করা হচ্ছে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবু নাঈম মো. শাহিদ উল্লাহ বলেন, বিগত বছরগুলোর তুলনায় বিদায়ী ২০১০ সালে সারাদেশে অগ্নিকাণ্ড, অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহতা, প্রাণ ও সম্পদহানি হয়েছে অনেক বেশি—এ কথা সত্য। তবে যে কোনো দুর্ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস খবর পাওয়ার এক মিনিটের মধ্যে স্টেশন ত্যাগ করে অগ্নিনির্বাপণ ও উদ্ধারকাজে যোগ দেয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশ বিশ্বের ঘনবসতিপূর্ণ দেশের একটি। এখানে নগরায়ন ও শিল্পায়ন দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দুর্ঘটনা ও দুর্যোগ। এসব দুর্ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে জনসাধারণের অংশগ্রহণ প্রয়োজন। সম্প্রতি বসুন্ধরা সিটির অগ্নিকাণ্ড, পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের পর অনুসন্ধান ও উদ্ধার কার্যক্রম, বেগুনবাড়ীর ভবনধস, পুরনো ঢাকার নিমতলীতে স্মরণকালের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড—সব বিষয় আরও জোরালো হয়ে সামনে এসেছে। অগ্নিনির্বাপণ ও প্রতিরোধে জনসচেতনতার পাশাপাশি বিশাল স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী তৈরি করেছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্তৃপক্ষ। মানুষের সচেতনতা এবং স্বেচ্ছাসেবকরা নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করলে আগুন দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। গত চার বছরে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ৪৩ দশমিক ৪০ শতাংশ অগ্নিকাণ্ড ফায়ার সার্ভিস পৌঁছার আগেই স্থানীয় জনসাধারণ নির্বাপণ করতে সক্ষম হয়েছে। তাই আগুন প্রতিরোধে জনসচেতনতা অনেক বেশি প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।

২০১০ সালে চাকরিচ্যুতির রেকর্ড : বিএসএমএমইউ হাসপাতালে : বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকসহ ২৪ জন চাকরিচ্যুত ২৩৬ জনের নিয়োগ অবৈধ ঘোষণা, শ্লীলতাহানি করেও স্বাচিপ সমর্থিত চিকিত্সক বহাল তবিয়তে

নেসার উদ্দিন আহাম্মদ

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে সরকার চাকরিচ্যুতির রেকর্ড গড়েছে ২০১০ সালে। আর এ চাকরিচ্যুতি থেকে অধ্যাপক, সহযোগী ও সহকারী অধ্যাপক, চিকিত্সক কর্মকর্তা, কর্মচারী কেউ বাদ পড়েননি। রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় সামান্য অজুহাতেই তাদের চাকরিচ্যুতির চিঠি ধরিয়ে দেয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়। শুধু চাকরিচ্যুতই নয়, ঘটেছে অনারারি মহিলা চিকিত্সকের শ্লীলতাহানিও। ঘটনার হোতা স্বাচিপ সমর্থিত চিকিত্সক হওয়ার কারণে আজও তার বিচার হয়নি। এমনকি তিনি চাকরিও হারাননি। হাসপাতালে ভাংচুরের ঘটনাও ঘটিয়েছে সরকারদলীয় স্বাচিপ চিকিত্সকরা। কারণ তারা অ্যাডহক ভিত্তিতে নিয়োগ পাননি। হাসপাতালের প্রাপ্তির মধ্যে রয়েছে ১৬৩ কোটি টাকা মূল্যের জায়গার দখল বুঝে পাওয়া। রেসিডেন্সি প্রোগ্রামে ১৪৭ জন চিকিত্সক যোগদান। গত বছর বিএসএমএমইউতে আলোচিত ঘটনাগুলোর মধ্যে ছিল—
ডেন্টালের ৪ সহকারী শিক্ষককে চাকরিচ্যুতির নোটিশ : বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষ গত ১৮ সেপ্টেম্বর ডেন্টাল ফ্যাকাল্টির ৪ সহকারী অধ্যাপক কনজারভেটিভ ডেন্টিস্ট্রি অ্যান্ড এন্থোডনটিক্স বিভাগের ডা. এ কে এম বাশার, প্রন্থোডনটিক্স বিভাগের ডা. মাসুদুর রহমান, ওরাল অ্যান্ড ম্যাক্সিলোফিসিয়াল সার্জারি বিভাগের ডা. মাহমুদা আখতার ও ডা. সাখাওয়াত্ হোসেনকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেন ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১০ সালের মধ্যে এমএস বিষয়ের ডিগ্রি এবং বিএমডিসির স্বীকৃতির কপি জমা দিতে না পারলে ১ অক্টোবর ২০১০ সাল থেকে তাদের চাকরি বাতিল বলে গণ্য হবে। চিঠি পেয়ে ৩০ সেপ্টেম্বর ওই ৪ সহকারী অধ্যাপক হাইকোর্টের বিচারপতি মামনুন রাহমান এবং বিচারপতি সৈয়দা আফসার জাহানের ডিভিশন বেঞ্চে রিট পিটিশন করলে নির্দেশটি ৪ সপ্তাহের জন্য স্থগিত করে বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষকে শোকজ করা হয়। একই সঙ্গে গত ৩১ আগস্ট ওই ৪ সহকারী অধ্যাপকের বেতন-ভাতা বন্ধের আদেশটিও স্থগিত করা হয়। পরে চাকরি বাতিলের আদেশটি আরও এক বছরের জন্য স্থগিত করা হয়।
বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকসহ ২৪ জন চাকরিচ্যুত : গত ২২ ডিসেম্বর বিএসএমএমইউ হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকসহ ২৪ জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়। একই সঙ্গে পদাবনতি দেয়া হয় ১৭ জনকে। চিকিত্সকদের অনেকেই অভিযোগ করেছেন, আদালতের আদেশ অমান্য করে এই চাকরিচ্যুতির নোটিশ দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। আর ওইদিন সকালে চিকিত্সকরা হাসপাতালে গিয়ে জানতে পারেন তাদের চাকরি নেই। যাদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছে তাদের মধ্যে ৩ জন অধ্যাপক, ১৩ জন সহযোগী অধ্যাপক, ৮ জন সহকারী অধ্যাপক এবং ৪ জন কর্মকর্তা। যাদের পদাবনতি দেয়া হয়েছে তাদের মধ্যে ৩ জন অধ্যাপক, ৫ জন সহযোগী অধ্যাপক এবং ৫ জন কর্মকর্তা। ওইদিন বিকালে চাকরিচ্যুতি ও পদাবনতির চিঠি পাওয়া চিকিত্সক কর্মকর্তারা জতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে বর্তমান ভিসি অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্তকে অবিলম্বে অপসারণের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে দাবি জানান। একটি রাজনৈতিক দলের পৃষ্ঠপোষকতার কারণে বর্তমান ভিসি জোট সরকারের আমলে চাকরি পাওয়া চিকিত্সকদের একের পর এক চাকরিচ্যুত করছে বলে অভিযোগও করা হয়। তবে ভিসি অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত বলেন, আমি চাকরিচ্যুতির পক্ষে ছিলাম না।
২৩৬ জনের নিয়োগ অবৈধ ঘোষণা : বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষ আদালতে পরিপূর্ণ তথ্য উপস্থাপন না করায় গত ১৪ ডিসেম্বর বিএসএমএমইউ হাসপাতালের ২৩৬ জন চিকিত্সকের নিয়োগ অবৈধ ঘোষণা করেন আদালত। এমনি অভিযোগ করেন ক্ষতিগ্রস্ত চিকিত্সকরা। তারা বলেন, রহস্যজনক কারণে মামলার বাদীর আবেদনের সঙ্গে কোনোরকম দ্বিমত পোষণ করেনি বিবাদী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এরই প্রতিবাদে গত ২০ ডিসেম্বর বিএসএমএমইউ হাসপাতালের প্রধান ফটকের সামনে ক্ষতিগ্রস্ত চিকিত্সক ও তাদের পরিবারের সদস্যরা মানববন্ধন করে। ওইদিনই চিকিত্সকের নিয়োগ অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেয়া রায় ৬ সপ্তাহের জন্য স্থগিত করে আপিল বিভাগের চেম্বার জজ। চিকিত্সকরা হাইকোর্টের রায় স্থগিতের আবেদন করলে চেম্বার জজ বিচারপতি এসকে ২০ ডিসেম্বর এ আদেশ দেন।
৩৪ জন কর্মচারীকে অব্যাহতি : অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত ভিসি হওয়ার পর হাসপাতালে জোট সরকারের আমলে দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে নিয়োগ পাওয়া ২৪১ জন কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত করার পদক্ষেপ নেয়া হয় বলে অভিযোগ করেন কর্মচারীরা। ২০০৯ সালের অক্টোবর থেকে ২০১০ সালের মার্চ পর্যন্ত ৩৪ জন কর্মচারীকে সামান্য অজুহাতে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে, কর্মচারীদের ওই শূন্য পদে আওয়ামী লীগ সমর্থিত লোকজনকে নিয়োগ দেয়ার জন্যই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এ পদক্ষেপ নেয়। আর গত ৩ মার্চ চাকরি হারানোর দুশ্চিন্তায় হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী মো. হাফিজ উদ্দিন (৩৫) ভবনের ৯ তলা থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছেন বলে জানা যায়।
আ.লীগ সমর্থিত অধ্যাপকের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ : আওয়ামী লীগ সমর্থক স্বাধীনতা চিকিত্সক পরিষদের (স্বাচিপ) বিএসএমএমইউ শাখার প্রভাবশালী নেতা চর্ম ও যৌন বিভাগের অধ্যাপক ডা. আগা মাসুদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে গত বছর মে মাসে তারই চিকিত্সক ছাত্রীর শ্লীলতাহানির অভিযোগ ওঠে। হাসপাতালের অনারারি চিকিত্সক ওই ছাত্রী অভিযোগ করেন, অধ্যাপক আগা মাসুদ চৌধুরী তাকে কক্ষে নিয়ে শ্লীলতাহানির চেষ্টা চালান। তিনি কোনোরকমে নিজের ইজ্জত রক্ষা করে কাঁদতে কাঁদতে কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসেন। ওই ছাত্রী হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বিচার দাবি করেন। প্রাথমিকভাবে ঘটনা সত্য বলে প্রমাণ পাওয়ার পর এ বিষয়ে অধ্যাপক নূরজাহান বেগমকে প্রধান করে ৪ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এর কয়েকদিন পরে ৪ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি বাদ দিয়ে নতুন কমিটি করার কথা জানান কর্তৃপক্ষ। এ ব্যাপারে বিএসএমএমইউর প্রক্টর ডা. এএসএম জাকারিয়া আমার দেশকে জানান, শ্লীলতাহানির ঘটনা তদন্তে সুপ্রিমকোর্টের একটি নির্দেশনা পেয়েছেন তারা।
৩ শিক্ষকের কক্ষে স্বাচিপের হামলা : গত ৩১ মে বিএসএমএমইউর তিন শিক্ষকের কক্ষ ব্যাপক ভাংচুর হয়। আওয়ামী লীগ সমর্থিত চিকিত্সক সংগঠন স্বাধীনতা চিকিত্সক পরিষদের (স্বাচিপ) একাংশ অর্থাত্ বঞ্চিতরা এ হামলা চালায়। সূত্র জানায়, অ্যাডহক ভিত্তিতে ৪ হাজার চিকিত্সক নিয়োগে তারা কেউ নিয়োগ পাননি। এ তথ্য জানার পর স্বাচিপের ওই গ্রুপটি ওইদিন হাসপাতালে অতর্কিত হামলা চালায়। যাদের কক্ষে হামলা চালানো হয় তারা হলেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ, যুগ্ম মহাসচিব ডা. আবদুল আজিজ ও স্বাচিপের মহাসচিব অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান।
স্বাস্থ্যমন্ত্রীর অনুষ্ঠানে তুমুল হট্টগোল : গত ২৭ এপ্রিল বিএসএমএমইউতে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর অনুষ্ঠানস্থলে সংর্ঘষে জড়িয়ে পড়েন চিকিত্সক, আনসার ও ড্রাইভার। ওই ঘটনায় কমপক্ষে ১০ জন আহত হয়। আহতদের মধ্যে ৪ আনসার ও ২ ড্রাইভারকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ডা. মিলন হলে বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল প্রাকটিশনার অ্যাসোসিয়েশন নির্বাচন-২০১০ উপলক্ষে আয়োজিত এক আলোচনা অনুষ্ঠান চলছিল। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধ্যাপক ডা. আফম রুহুল হক।
১৬ সিসিটিভি স্থাপন : গত ৯ আগস্ট হাসপাতালের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে গুরুত্বপূর্ণ ১৬টি স্থাপনায় ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা (সিসিটিভি) স্থাপন করা হয়। নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারের জন্য সিসিটিভির পাশাপাশি ওয়াকিটকি সেটেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে।
দাঁত তুলতে গিয়ে রোগীর মৃত্যু : গত ২৯ মে হাসপাতালের ডেন্টাল বিভাগে জরুরি চিকিত্সা ব্যবস্থা না থাকায় দাঁত তুলতে গিয়ে হালিমা বেগম (৪৫) নামে এক রোগীর মৃত্যু হয়। রোগীর স্বজনদের অভিযোগ, গুরুতর রোগীদের হাসপাতালে এক বিভাগ থেকে অন্য বিভাগে নেয়ার ট্রলি না থাকা এবং চিকিত্সকের গাফিলতির কারণে হালিমা বেগম মারা গেছেন। এ অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে।
কিডনি ট্রান্সপ্লান্টের পর রোগীর মৃত্যু : গত মে মাসে হাসপাতালের কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করার পর সাফিন (৩২) নামে এক রোগীর মৃত্যু হয়। অপারেশনের সাড়ে ৫ ঘণ্টা পর তিনি মারা যান। কিডনিদাতা তার ছোট বোন রোকেয়া বেগম (৩০) বিএসএমএমইউ হাসপাতালে চিকিত্সাধীন থাকায় স্বজনরা সাফিনের মৃত্যুর ব্যাপারে কিছু বলতে অস্বীকৃতি জানান। হাসপাতাল থেকে অভিযোগ পাওয়া যায়, যে চিকিত্সক ওই রোগীর কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করেন তার এ বিষয়ে কোনো অভিজ্ঞতা নেই। নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রথম বোর্ডে তিনি বাদ পড়েন। কিন্তু সরকার সমর্থক হওয়ায় কর্তৃপক্ষ দ্বিতীয় বোর্ড গঠন করে কোনো প্রতিযোগিতা না রেখে তাকে নিয়োগ দেয়।
চালু হলো অর্থোপেডিকের জরুরি বিভাগ : গত ১ ফেব্রুয়ারি বিএসএমএমইউতে চালু হয় অর্থোপেডিকের জরুরি বিভাগ। হাত-পা ভেঙে যাওয়া রোগীরা সরাসরি বিএসএমএমইউতে চিকিত্সা নিতে পারছেন। এই জরুরি বিভাগ উদ্বোধনকালে স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধ্যাপক ডা. আফম রুহুল হক সাংবাদিকদের বলেন, আগামী দুই-তিন মাসের মধ্যে দেশের জেলা পর্যায়ের সব হাসপাতালে অর্থোপেডিক চিকিত্সা দেয়ার জন্য যন্ত্রপাতি পাঠানো হবে। যাতে করে রোগীদের দুর্ভোগ পোহাতে না হয়। কারণ দেশে বর্তমানে দুর্ঘটনার সংখ্যা বেড়ে গেছে।
নিয়োগ বাতিলে সংসদীয় কমিটির সুপারিশ : গত এপ্রিলে বিএসএমএমইউর ৩০১ চিকিত্সক ও ১২ কর্মকর্তার নিয়োগ বাতিলের সুপারিশ করেছে জাতীয় সংসদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কিমিটি। শুধু তাই নয়, তাদের যারা চাকরি দিয়েছেন সেই নির্বাচনী বোর্ডের সভাপতি, সদস্য ও সদস্য সচিবের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণেরও সুপারিশ করা হয়। ওইদিন জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত কমিটির অষ্টম বৈঠকে এ সুপারিশ করা হয়।
রেসিডেন্সি প্রোগ্রাম চালু : গত ৬ মার্চে বিএসএমএমইউ হাসপাতালে রেসিডেন্সি প্রোগ্রাম চালু করা হয়। এ প্রোগ্রামে ১৪৭ চিকিত্সক যোগদান করেন। রেসিডেন্সি প্রোগ্রামের আওতায় বিভিন্ন কোর্সে ভর্তি হওয়া বেসরকারি চিকিত্সকরা প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা ও সরকারি চিকিত্সকরা প্রতি মাসে পূর্ণ সরকারি বেতন পাবেন বলে ঘোষণা দেন ভিসি অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত।
ওটি টেবিল থেকে রোগী ফেরত : ২০১০ সালের ৭ জানুয়ারি বিএসএমএমইউ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের রোগী হোসনে আরা বেগমের অপারেশন করা হয়নি। তাকে অপারেশন টেবিল থেকে ওয়ার্ডে ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হয়। যদিও ২৬ দিন পর তিনি ওই অপারেশনের তারিখ পান। হাসপাতালের ওটি সূত্রমতে, অ্যানেস্থেসিয়া বিভাগের চেয়ারম্যানের নির্দেশে ওই রোগীর অপারেশন হয়নি। এ ব্যাপারে রেজিস্ট্রার বরাবর একটি অভিযোগপত্র দেয়া হয়। রোগীর অপারেশন করতে প্রায় পৌনে ১ ঘণ্টা পর অ্যানেস্থেসিয়া বিভাগের অ্যানেস্থেটিস্ট অপারেশন থিয়েটারে আসেন। তিনি ওটিতে ঢুকে অ্যানেস্থেসিয়া দেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকেন। সংশ্লিষ্ট সার্জনও ওটির ড্রেস পরে ওটিতে ঢোকার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ঠিক তখন ওটি ইনচার্জ চিকিত্সকদের গিয়ে বলেন, অ্যানেস্থেসিয়া বিভাগের চেয়ারম্যানের নির্দেশে ওটি বন্ধ করে দিয়েছেন। রোগীকে ৪ ঘণ্টা পর ওয়ার্ডে পাঠানো হয়।
কৃত্রিম হাঁটু প্রতিস্থাপন চিকিত্সা : গত ২২ ফেব্রুয়ারি বিএসএমএমইউ হাসপাতালে কৃত্রিম হাঁটু প্রতিস্থাপন চিকিত্সা শুরু হয়। ওইদিন নূরুল ইসলাম নামে এক রোগীর বাম পায়ের হাঁটুতে কৃত্রিম হাঁটু প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল। বিএসএমএমইউতে কৃত্রিম হাঁটু প্রতিস্থাপন এটাই প্রথম বলে অর্থোপেডিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. আবু জাফর চৌধুরী দাবি করেন।
জায়গার দখল বুঝে পায় বিএসএমএমইউ : গত ৯ ডিসেম্বর বিএসএমএমইউ হাসপাতালের কেবিন ব্লকের উত্তর পাশে সরকারি মূল্যে ১৬৩ কোটি টাকার ৩ দশমিক ৮৩ একর জায়গার বরাদ্দ ও দখল বুঝে পায় বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষ। সূত্রমতে, রাজধানীর শাহবাগে ওই জায়গাটি বেক্সিমকো গ্রুপের অবৈধ দখলে ছিল। ওইদিন দুপুরে সরকারের পক্ষ থেকে এ জমি আনুষ্ঠানিকভাবে বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষের কাছে বুঝিয়ে দেয়া হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতিতে জমির দখল বুঝিয়ে দেন ঢাকা জেলা প্রশাসনের পক্ষে আরডিসি আবুল বাশার মো. ফখরুজ্জামান। জায়গা বুঝে পাওয়ায় হাসপাতালকে ১৫০০ শয্যায় উন্নীত করাসহ সম্প্রসারণ করা সম্ভব হবে। বিএসএমএমইউ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে ওই জমির বরাদ্দ পেতে সরকার নির্ধারিত মোট মূল্যের ১০ শতাংশ হারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ১৬ কোটি ৩৯ লাখ ৩৮ হাজার ৯ টাকা দেয়া হয়।
বিএসএমএমইউতে ভিত্তিপ্রস্তর : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালকে সেন্টার অব এক্সিলেন্সে রূপান্তরিত করার জন্য উন্নয়ন বাজেট থেকে ৪৮৫ দশমিক ১৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এ উন্নয়ন বাজেটের আওতায় পূর্ণাঙ্গ ইমার্জেন্সি কমপ্লেক্স, আউটডোর কমপ্লেক্স, অপারেশন থিয়েটার (ওটি) কমপ্লেক্স, নার্সিং ইনস্টিটিউট, আন্তর্জাতিক মানসম্মত মেডিকেল কলেজ ও মেডিকেল কনভেনশন সেন্টার প্রতিষ্ঠার জন্য অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে। আর মধ্যে ওটি কমপ্লেক্সের উদ্বোধন ও আউটডোর কমপ্লেক্সের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে গত ২৬ ডিসেম্বর বিএসএমএমইউতে আসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।