Saturday 29 January 2011

সরকারি পরিসংখ্যান : অপরাধ এখন বেশি হচ্ছে


আলাউদ্দিন আরিফ

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ও প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শামসুল ইসলাম টুকু দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে ভালো বললেও পুলিশ সদর দফতরের পরিসংখ্যান বলছে অন্য কথা। ২০০৯ সালের তুলনায় গত বছর (২০১০) দেশে ৩৮ হাজার ৪২৬টি অপরাধ বেশি হয়েছে। পুলিশ সদর দফতর থেকে পাওয়া এই তথ্যমতে বিগত চারদলীয় জোট সরকারের শাসনামলে ২০০৫ সালের চেয়ে এ সংখ্যা ৭২ হাজার ৫০১টি বেশি এবং সেনাসমর্থিত ওয়ান ইলেভেন পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল ২০০৭ সালের চেয়ে ৩৮ হাজার ৩৩৪টি বেশি। গত বছরের তুলনায় এ বছর খুন বেড়েছে ৯৬টি। ২০০৫ সাল থেকে ৭২৩টি খুন বেশি হয়েছে।
সাবেক চারদলীয় জোট সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এয়ারভাইস মার্শাল (অব.) আলতাফ হোসেন চৌধুরী গতকাল আমার দেশকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বাস্তবে এমন খারাপ পর্যায়ে গেছে যে, এ নিয়ে মন্তব্য করার মতো অবস্থাও নেই। শুধু বিএনপি আমলেই নয়, অতীতের যে কোনো সময়ের রেকর্ড ভেঙেছে দেশের অপরাধ পরিস্থিতি। এ সরকার তাদের শাসনামলের বিগত সময়েরও সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। চলতি বছর পুলিশ সপ্তাহ চলাকালে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যে পরিসংখ্যান দেয়া হয়েছিল তাতেও দেখা গেছে, অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে ভঙ্গুর পরিস্থিতি বিরাজ করছে দেশের আইনশৃঙ্খলায়। দেশে মানবাধিকার বলে এখন আর কিছু অবশিষ্ট নেই।
বিগত ২০১০ সালে দেশে ডাকাতি ২৯১, দস্যুতা ১৩৬৬, খুন-হত্যা ৪৩১৫, দ্রুত বিচার আইনে মামলা ১৬৯২, দাঙ্গা হাঙ্গামা ৯৫০, নারী নির্যাতন ১৫১৩৪, শিশু নির্যাতন ১৪৫৬, অপহরণ ৮৮০, পুলিশের ওপর হামলা ও মারধর ৪৬২, সিঁধেল চুরি ৩১১৪, দুর্ধর্ষ চুরি ৮৫১৩, অস্ত্র ১৭০৩, বিস্ফোরক ১৮৯, মাদক ৫৬২৪৯, চোরাচালান ৯৭৭৬ ও অন্যান্য অপরাধে মামলা হয়েছে ৮৯৪৪৪টি। পুলিশ সদর দফতরে গত বছরের অক্টোবর পর্যন্ত রেকর্ড তৈরি রয়েছে। একজন পুলিশ কর্মকর্তা অপর দুই মাসের রেকর্ড দেন বিভিন্ন হিসাব করে। এসব রেকর্ডে দেখা গেছে, ২০০৯ সালের তুলনায় এবার ডাকাতির মামলা কমে বেড়েছে দস্যুতার মামলা। বিগত বছরে নারী ও শিশু নির্যাতন অতীতের যে কোনো রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। ২০১০ সালে নারী নির্যাতনের ঘটনায় আগের বছরের চেয়ে ১৩ হাজার ৯৩০টি বেশি মামলা হয়েছে। বিশেষ করে ইভটিজিং ভয়াবহ ছিল বছরজুড়েই।
বর্তমান সময়ে দেশে ডাকাতিতে একটি উদ্বেগজনক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। গ্রামে গ্রামে নয়, খোদ রাজধানী ও রাজধানীর উপকণ্ঠেই মানুষ ডাকাতি রোধে রাত জেগে পাহারা দিচ্ছে। অথচ পুলিশের রেকর্ডে বিগত ২০১০ সালে ডাকাতির একেবারেই কম। নানা জবাবদিহিতার কারণে পুলিশ ডাকাতির মামলা নিতে চায় না। ডাকাতির মামলাকে পুলিশ দস্যুতা বা চুরির মামলা হিসেবে নেয়। এ কারণে ডাকাতি ভয়ানক পরিস্থিতি তৈরি করলেও পুলিশি রেকর্ডপত্রে ডাকাতির মামলা অনেক কমেছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যত খারাপই থাকুক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে যারা থাকেন বা যারা পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ে থাকেন তারা কখনোই বিষয়টি স্বীকার করেন না। তারা সবসময় বলেন, দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যে কোনো সময়ের চেয়ে ভালো। বিগত সময়েও যারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও যেসব উপদেষ্টা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন তাদেরও ওই সময় বলতে শোনা গেছে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যে কোনো সময়ের চেয়ে ভালো। বিগত ওয়ান ইলেভেন পরবর্তী সময়ে যখন মামলা হামলা বেশি হচ্ছিল ওই সময় উপদেষ্টারা বলেছিলেন, আগে মানুষ ভয়ে পুলিশের কাছে যেতে সাহস পেত না, এখন নির্ভয়ে মামলা করতে পারছে। তাই রেকর্ডে মামলা বেশি।
পুলিশের সাবেক আইজি আবদুল কাইয়ুম গতকাল আমার দেশকে বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীরা মুখে বললেই তো আইনশৃঙ্খলার উন্নতি হয়ে যাবে না। প্রতিদিন দেশের পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর দিকে তাকালেই আইনশৃঙ্খলার অবস্থা বুঝা যায় যে দেশে আইনশৃঙ্খলা এখন ভয়াবহ সময় অতিক্রম করছে। একজন উপজেলা চেয়ারম্যানকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করা হলো। এ ঘটনায় একজন মাত্র আসামিকে গ্রেফতার করে আর কোনো তত্পরতা পুলিশের নেই।
চৌধুরী আলম নিখোঁজ হওয়ার পর নানাভাবে সরকারের কাছে আবেদন ও প্রতিবাদ জানানোর পরও সরকার কোনো ব্যাখ্যা দিচ্ছে না। ক্রসফায়ার ও মানুষ গুম হচ্ছে। যৌন ভয়াবহতা বা ইভটিজিংসহ নারী নির্যাতন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। ইভটিজিংয়ের শিকার হয়ে অনেকে আত্মহত্যা করছে। প্রতিবাদ করায় মারা পড়ছে। অথচ মানুষ পুলিশের কাছে আশ্রয় ও আদালতের কাছে বিচার পাচ্ছে না। রাজনৈতিক হয়রানির মামলা করে একের পর এক হত্যা মামলা ও দুর্বৃত্তায়নের মামলা প্রত্যাহার করে নেয়া হচ্ছে। এতে খুনের শিকার পরিবারগুলো আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ক্ষমতাসীন দলের চাঁদাবাজি টেন্ডারবাজিসহ দেশে যে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে তার উল্লেখ করে সাবেক এই আইজিপি বলেন, আমার দীর্ঘ চাকরি জীবনে কখনও এ পরিস্থিতি দেখিনি। বলতে পারেন আইনশৃঙ্খলা অবনতির নতুন এক অভিজ্ঞতা পাচ্ছি আমরা।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পুলিশ সদর দফতরের হিসাবে চারদলীয় জোট সরকারের শাসনামলে গড়ে খুন হয়েছে ৯ থেকে ১০টি করে। বর্তমানে এটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ থেকে ১২টিতে। দুঃখজনক হলেও সত্য, বিএনপি সরকারের সময় প্রথমে অপারেশন ক্লিনহার্টে ৪০ জন ও র্যাব গঠনের পর ব্যাপক হারে ক্রসফায়ার হয়। আওয়ামী লীগ নেতারা ওই সময় ক্রসফায়ার ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে জোরালো বক্তব্য দেন। কিন্তু ক্ষমতায় এসে তারা ক্রসফায়ার চালু রাখেন। আইনশৃঙ্খলার নিয়ন্ত্রণে একমাত্র ক্রসফায়ারের উপরই নির্ভর করছেন তারা। মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের রিপোর্ট অনুযায়ী গত দু’বছরে ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছে ২৮১ জন। বিএনপি সরকারের সময় বিএনপি শীর্ষ সন্ত্রাসীসহ দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী ও গডফাদারদের তালিকা করে। ২৩ সন্ত্রাসীকে ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করে। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় সন্ত্রাসীদের ধরতে কোনো পুরস্কারের ঘোষণা আসেনি।
জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ (জেএমজিবি) ও জামাআ’তুল মুজাহেদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)-এর শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতার করে। তাদের বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে এবং ওয়ান ইলেভেন পরবর্তী সরকারের সময় তাদের ফাঁসি কার্যকর হয়। চারদলীয় জোট আমলে গ্রেফতার হয়েছিলেন হরকাতুল জেহাদ নেতা মুফতি হান্নান। আওয়ামী লীগ সরকার মুফতি হান্নানের বিচারিক প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করছে না। রহস্যজনকভাবে তার মামলাগুলো নিয়েও এক ধরনের দীর্ঘসূত্রতা চলছে।
দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম এক নাজুক অবস্থাতেও গত রোববার মিরপুরে ঢাকা সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড কমিশনার শাহেদা তারেক দীপ্তির বাসায় দুর্ধর্ষ ডাকাতি হয়। তাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেন, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগের চেয়ে ভালো।
গতকাল আবার ভিন্ন কথা বলেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু। বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি হয়েছে কি-না জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শামসুল হক টুকু বলেছেন, আমরা বলছি না যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো। তবে দেশের মানুষ বলছে, বর্তমান সরকারের আমলে বিগত দুটি ঈদ, পূজা, বড়দিন উদযাপন হয়েছে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই। মাঝে মধ্যে সন্ত্রাসীরা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। তাদের প্রতিহত করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সজাগ থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, অপরাধীদের শনাক্ত করতে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছে পুলিশ, র্যাব ও গোয়েন্দারা

No comments:

Post a Comment