Monday 31 October 2011

ভারতের ট্রানজিট ফি নিয়ে দীপু মনির মিথ্যাচার : কোনো ধরনের ফি না দিয়েই ট্রানজিট নিচ্ছে ভারত বিদ্যুেকন্দ্রের চুক্তির আড়ালে পণ্য পরিবহন চলছে বাংলাদেশী ব্যবহারকারীদের সমান ঘাট ফি দিচ্ছে



বশীর আহমেদ

ট্রানজিট ও ট্রানশিপমেন্টের চার্জ বা ফি নিয়ে রীতিমত মিথ্যাচার করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি। তিনি বলেছেন, পরীক্ষামূলক ট্রানজিট ও ট্রানশিপমেন্টের জন্য প্রযোজ্য সব ধরনের চার্জ আদায় করা হচ্ছে। আমার দেশ-এর পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট দফতরের সঙ্গে যোগাযোগ ও অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যে দেখা যাচ্ছে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী অসত্য বক্তব্য দিয়েছেন। আসলে ট্রানজিটের জন্য কোনো চার্জ বা ফি আদায় করা হচ্ছে না। শুধু ল্যান্ডিং ও শিপিং চার্জ হিসেবে টনপ্রতি ৩০ টাকা নেয়া হচ্ছে। এটা বাংলাদেশী পণ্যের জন্য নির্ধারিত। গত মঙ্গলবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, পরীক্ষামূলক ট্রানজিট এবং ট্রানশিপমেন্টের মাধ্যমে যে ভারতীয় পণ্য আশুগঞ্জ বন্দর হয়ে সড়কপথে আখাউড়া সীমান্ত দিয়ে আগরতলা যাচ্ছে, সেখানে প্রযোজ্য সব চার্জ আদায় করা হচ্ছে।
এ ব্যাপারে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা রাজস্ব কর্মকর্তা মো. আবুল হোসাইন আমাদের আশুগঞ্জ প্রতিনিধি সাদেকুল ইসলাম সাচ্চুকে জানান, পরীক্ষামূলক এই ট্রানজিটের জন্য কোনো ফি বা শুল্ক আদায় করা হচ্ছে না। কারণ ত্রিপুরার পালাটানা বিদ্যুেকন্দ্রের জন্য ওডিসি পরিবহনের চুক্তির আওতায় এই পরীক্ষামূলক ট্রানজিট ও ট্রানশিপমেন্ট চলছে।
ট্রানজিটের ফি বা চার্জ নিয়ে এ অসত্য বক্তব্য সম্পর্কে জানতে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সরাসরি কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে এ ব্যাপারে মন্ত্রীর জনসংযোগ কর্মকর্তা আমার দেশকে বলেন, নৌ মন্ত্রণালয় থেকে যে তথ্য জানানো হয়েছে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেটাই বলেছেন। ট্রানজিটের ফি, সার্ভিস চার্জ, শুল্কসহ যাবতীয় বিষয় চূড়ান্ত করার দায়িত্ব জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের। এ ব্যাপারে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছ থেকে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দেয়া বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে একেক সময় একেক ধরনের বক্তব্য দেয়া হয়েছে। সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তি এবং মন্ত্রীরা বিভিন্ন সময় অসত্য এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়েছেন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় বহুল আলোচিত তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি না হওয়ায় ভারতের সঙ্গে ট্রানজিট চুক্তি হয়নি বলে জানান সরকারের প্রভাবশালী নীতিনির্ধারক কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী।
মতিয়া চৌধুরীর এ বক্তব্যের পর তিন সপ্তাহ যেতে না যেতেই হঠাত্ কয়েকদিন আগে পরীক্ষামূলক ট্রানজিটের নামে ভারতীয় পণ্য নদী ও সড়কপথে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে পরিবহন শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে তিনটি ভারতীয় পণ্যবাহী জাহাজ আশুগঞ্জ বন্দরে এসে ভিড়েছে। এসব জাহাজ থেকে পণ্য খালাসেরও কাজ চলছে এবং খালাস হওয়া পণ্য সড়কপথে আখাউড়া সীমান্ত দিয়ে আগরতলা পৌঁছানো হচ্ছে। কোনো ধরনের ফি, শুল্ক বা সার্ভিস চার্জ ছাড়া কীভাবে ভারতীয় পণ্য পরিবহন হচ্ছে, সে ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে কোনো বক্তব্য দেয়া হয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ট্রানজিটের জন্য একটি নীতিমালা তৈরি করা হচ্ছে, যেখানে ট্রানজিট ফিসহ যাবতীয় বিষয় সুনির্দিষ্ট করা হবে। সেই নীতিমালা তৈরির আগেই পরীক্ষামূলক ট্রানজিট কীভাবে শুরু হতে পারে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
গত মঙ্গলবারের সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছিলেন, পরীক্ষামূলকভাবে ভারতীয় পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য সব ধরনের চার্জ আদায় করা হচ্ছে। তবে কোন খাত থেকে কী পরিমাণ চার্জ আদায় করা হচ্ছে, সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য দিতে পারেননি তিনি।
এছাড়া বাংলাদেশী জাহাজগুলো পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে সরকারের দেয়া নানা সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে থাকে। বিশেষ করে জ্বালানি তেলের ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা ভর্তুকি দেয়া হয়। ভারতীয় পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে এ সুবিধা দেয়া হচ্ছে কি না, সে ব্যাপারেও কিছু জানাতে পারেননি পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এ বক্তব্যের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য আমার দেশ-এর পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দফতরে যোগাযোগ করা হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা রাজস্ব কর্মকর্তা মো. আবুল হোসাইন এ ব্যাপারে বলেন, ট্রানজিটের পরীক্ষামূলক চালানের ভারতীয় পণ্যবাহী তিনটি জাহাজের কাগজপত্র আমাদের কাছে এসেছে। এই পণ্য পরিবহনে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহারের জন্য কোনো ফি বা চার্জ নেয়া হচ্ছে না। পালাটানা বিদ্যুেকন্দ্রের জন্য ভারী যন্ত্রপাতি বা ওডিসি পরিবহনের জন্য যে চুক্তি হয়েছিল, তার আওতায় এই পরীক্ষামূলক ট্রানজিট। এজন্য এই পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে কোনো ফি আদায় করা হচ্ছে না। তবে শুধু এমভি নীলকণ্ঠ জাহাজের ক্ষেত্রে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের গত ২৫ আগস্টের আদেশ মোতাবেক শুল্কের সমপরিমাণ টাকার ব্যাংক গ্যারান্টি বা বিল অব এন্ট্রি নেয়া হচ্ছে।
এই পরীক্ষামূলক ট্রানজিট এবং ট্রানশিপমেন্টের ব্যাপারে বিআইডব্লিউটিএ’র নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমার দেশকে বলেন, আসলে কী হচ্ছে আমরা জানি না।
ফি এবং অন্যান্য চার্জ নির্ধারণের দায়িত্ব এনবিআরের। তারা আমাদের কিছুই জানায়নি। পরীক্ষামূলক ট্রানজিটের জন্যও কী কী চার্জ প্রযোজ্য, তা নির্ধারণ করে এনবিআরের পক্ষ থেকে চিঠি দিয়ে আমাদের জানানোর কথা। কিন্তু এ ব্যাপারে আমাদের কিছুই জানানো হয়নি। এ ব্যাপারে এনবিআর চেয়ারম্যান ড. নাসির উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে চেষ্টা করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি। বারবার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ এবং মেসেজ পাঠিয়েও তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
পরীক্ষামূলক এই ট্রানজিটের আওতায় ভারতীয় পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে শুধু ল্যান্ডিং ও শিপিং চার্জ নেয়া হচ্ছে। এই চার্জ বাংলাদেশী পণ্যের জন্য নির্ধারিত টনপ্রতি মাত্র ৩০ টাকা হারে আদায় করা হচ্ছে। বিআইডব্লিউটিএ’র একজন উপ-পরিচালক (বন্দর) আমার দেশকে এ প্রসঙ্গে বলেন, আসলে কোনো নীতিমালা হয়নি। তাই বিদেশি পণ্যের জন্য চার্জের পরিমাণ কত হবে, তা আমরা জানি না। বাংলাদেশের পণ্যের জন্য যা নির্ধারিত আছে, তা-ই নেয়া হয়। এছাড়া আর কিছু করার নেই। ট্রানজিট নিয়ে সরকার শুরু থেকেই ছল-চাতুরীর আশ্রয় নিয়েছে। প্রথমে বলা হয়েছে, ট্রানজিটের মাধ্যমে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা আসবে। বিভিন্ন সময়ে অসত্য তথ্য দিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়েছে। ড. মনমোহন সিং ঢাকা আসার আগে প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী বলেছিলেন, ট্রানজিটের জন্য কোনো ধরনের চুক্তি বা প্রটোকল সই করার প্রয়োজন নেই। কারণ ১৯৭২ সালেই ট্রানজিট চুক্তি হয়েছে। সেই চুক্তি অনুযায়ীই ভারত ট্রানজিট সুবিধা ব্যবহার করতে পারবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি তখন বলেছিলেন, ট্রানজিটের জন্য একাধিক প্রটোকল সই করতে হবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এখন আবার বলছেন, ১৯৭২ সালেই ভারতকে ট্রানজিট দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান বলেছিলেন, ভারতের কাছে ট্রানজিট ফি চাওয়া অসভ্যতা। সরকার আসলে ভারতকে ফ্রি ট্রানজিট দিতেই যেন তত্পর

No comments:

Post a Comment