Monday, 2 January 2012

ফিরে দেখা ১৯৭৫ : প্রথম আলোচিত ক্রসফায়ার সিরাজ সিকদার হত্যা









জাকির হোসেন
সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার—১৯৭৫ সালের ইংরেজি নববর্ষের দ্বিতীয় দিন। এইদিন রাতে (২ জানুয়ারি) রাতে ‘পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি’র প্রধান নেতা সিরাজুল হক সিকদার ওরফে সিরাজ সিকদার তত্কালীন সরকারের নিরাপত্তাবাহিনীর হাতে নির্মমভাবে হত্যার শিকার হন। এর আগের দিন অর্থাত্ ১৯৭৫ সালে ১ জানুয়ারি চট্টগ্রামে গ্রেফতার হন সিরাজ সিকদার। এ দিনই তাকে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আনা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে তত্কালীন শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারের আমলে প্রথম আলোচিত ক্রসফায়ারের এই ঘটনার বিবরণ পুলিশের প্রেসনোটের উদ্ধৃতি দিয়ে ছাপা হয় সেই সময়ের বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায়। প্রতিবেদনে বলা হয়, সিরাজ শিকদার গ্রেফতার হওয়ার পর তার পার্টি-কর্মীদের কয়েকটি গোপন আস্তানা এবং তাদের বেআইনি অস্ত্র ও গোলাবারুদ রাখার স্থানে পুলিশকে নিয়ে যেতে রাজি হন। সে অনুযায়ী ২ জানুয়ারি রাতে একটি পুলিশ ভ্যানে তাকে ওইসব আস্তানায় নিয়ে যাওয়ার সময় তিনি সাভারের তালবাগ এলাকায় ভ্যান থেকে লাফিয়ে পালানোর চেষ্টা করেন। এ সময় পুলিশ গুলিবর্ষণ করলে তত্ক্ষণাত্ ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। এ ব্যাপারে সাভার থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
অন্যদিকে সিরাজ শিকদার হত্যাকাণ্ডের প্রায় ১৭ বছর পর ১৯৯২ সালের ৪ জুন সিরাজ সিকদার পরিষদের সভাপতি শেখ মহিউদ্দিন আহমদ ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের (সিএমএম) আদালতে মামলা দায়ের করেন। সিরাজ সিকদারকে গ্রেপ্তার ও হত্যার বিবরণ দিয়ে এ মামলার আর্জিতে বলা হয়, ২ জানুয়ারি সন্ধ্যায় পুলিশ ও রক্ষীবাহিনীর বিশেষ স্কোয়াডের অনুগত সদস্যরা গণভবনে মরহুম শেখ মুজিবের কাছে সিরাজ সিকদারকে হাত ও চোখ বাঁধা অবস্থায় নিয়ে যায়। সেখানে শেখ মুজিবের সঙ্গে তার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মরহুম ক্যাপ্টেন (অব.) মনসুর আলীসহ আসামিরা, শেখ মুজিবের ছেলে মরহুম শেখ কামাল এবং ভাগ্নে মরহুম শেখ মনি উপস্থিত ছিলেন। সে সময় আসামি মাহবুব উদ্দিন তার রিভলবারের বাঁট দিয়ে মাথায় আঘাত করলে সিরাজ সিকদার মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। শেখ কামাল রাগের মাথায় গুলি করলে সিরাজ সিকদারের হাতে লাগে। এর পর শেখ মুজিব, মনসুর আলী এবং আসামিরা সিরাজ সিকদারকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন এবং মাহবুব উদ্দিন আহমদ নির্দেশ দেন। মাহবুব উদ্দিন আহমদ অন্য আসামিদের সঙ্গে বন্দি সিরাজ সিকদারকে শেরে বাংলানগর রক্ষীবাহিনীর সদর দফতরে নিয়ে যান। সেখানে তার ওপর আরও নির্যাতন চালানো হয় এবং ২ জানুয়ারি আসামিদের উপস্থিতিতে রাত ১১টার দিকে রক্ষীবাহিনীর সদর দফতরেই সিরাজ সিকদারকে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরে বিশেষ স্কোয়াডের সদস্যরা পূর্বপরিকল্পনা মতো বন্দি অবস্থায় নিহত সিরাজ সিকদারের লাশ সাভারের তালবাগ এলাকা হয়ে সাভার থানায় নিয়ে যায় এবং সাভার থানা পুলিশ পরের দিন ময়নাতদন্তের জন্য লাশ মর্গে প্রেরণ করে।
অর্থাত্ পুলিশের প্রেসনোট এবং সিএমএম আদালতে দায়ের করা মামলায় সিরাজ সিকদার হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে দু’রকম তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এ হত্যাকাণ্ড বিষয়ে তত্কালীন সরকারপ্রধান শেখ মুজিবুর রহমান দম্ভের সঙ্গে বলেছিলেন, ‘কোথায় আজ সেই সিরাজ সিকদার’। মুজিব সরকারের আমলে ক্রসফায়ারে সিরাজ সিকদারকে বিচার বহির্ভূতভাবে হত্যা এবং তাকে নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের ওই উক্তি দেশের রাজনীতিতে নানা সমালোচনা ও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। দেশবরেণ্য বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিক ও সাংবাদিকরা তাদের লেখায় সিরাজ সিকদার হত্যাকাণ্ডকে শেখ মুজিবুর রহমানের একটি অমার্জনীয় অপরাধ হিসেবে অভিহিত করেন। প্রয়াত বুদ্ধিজীবী ড. আহমদ শরীফ ‘বিপ্লবী বীর সিরাজ সিকদার প্রসঙ্গে’ শিরোনামে এক লেখায় বলেন, ‘সিরাজ সিকদার আজ আর কোনো ব্যক্তির নাম নয়। সিরাজ সিকদার একটি সংকল্পের, একটি সংগ্রামের, একটি আদর্শের, একটি লক্ষ্যের ও একটি ইতিহাসের অধ্যায়ের নাম। এ মানবতাবাদী সাম্যবাদী নেতাকে হাতে পেয়ে যেদিন প্রচণ্ড প্রতাপ শঙ্কিত সরকার বিনা বিচারে খুন করল, সেদিন ভীতসন্ত্রস্ত আমরা তার জন্য প্রকাশ্যে আহা শব্দটি উচ্চারণ করতেও সাহস পাইনি। সে গ্লানিবোধ এখনও কাঁটার মতো বুকে বিধে।’
বিশিষ্ট রাজনীতিক মাহমুদুর রহমান মান্না ‘খবরের কাগজ’-এ প্রকাশিত একটি নিবন্ধে লেখেন, ‘সিরাজ সিকদার একজন অসাধারণ যোগ্যতাসম্পন্ন সংগঠক ছিলেন। আমি যদ্দূর জানি, একথা তার ঘোর সমালোচকরাও স্বীকার করেছেন। সিরাজ সিকদারের মৃত্যুর ঘটনাটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে— ইতিহাসের একটি বর্বরতম ঘটনা। আমরা মধ্যযুগ কিংবা হিটলার মুসোলিনির আমলে এ ধরনের বর্বরতম ঘটনার নিদর্শন পাই। বুর্জোয়া যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের কথা বলে থাকে আজকাল, এমনকি আমাদের দেশেও, তাতে সিরাজ সিকদার অপরাধ করে থাকলেও তার বিচার পাবার দাবি তো উপেক্ষিত হতে পারে না। সিরাজ সিকদার যে বিচারবঞ্চিত হয়েছিলেন, সরকারি প্রেসনোটে তখন যা উল্লেখ করা হয়েছিল (জিপ থেকে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার গুলিতে তিনি নিহত হন) তা যে বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না। একথা যারা এ প্রেসনোট নিয়েছিলেন তারাও স্বীকার করবেন। আর সব চেয়ে ন্যক্কারজনক হলো তত্কালীন সংসদে প্রধানমন্ত্রীর উল্লসিত আস্ফাালন— কোথায় আজ সিরাজ সিকদার?’
সিরাজ সিকদারের মৃত্যুর পর পুলিশের প্রেসনোটের উদ্ধৃতি দিয়ে ১৯৭৫ সালের ৩ ও ৪ জানুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাক যথাক্রমে ‘গ্রেফতারের পর পলায়নকালে পুলিশের গুলিতে সিরাজ সিকদার নিহত’ এবং ‘সিরাজ সিকদারের লাশ দাফন’ শিরোনামে দুটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদন দুটি এবং ৯২ সালে দায়ের করা সিরাজ সিকদার হত্যা মামলার আংশিক বিবরণী তুলে ধরা হলো :
গ্রেফতারের পর পলায়নকালে
পুলিশের গুলিতে সিরাজ
সিকদার নিহত
গতকাল (বৃহস্পতিবার) শেষ রাত্রিতে প্রাপ্ত পুলিশের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয় যে, ‘পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি’ নামে পরিচিত একটি গুপ্ত চরমপন্থী দলের প্রধান সিরাজুল হক সিকদার ওরফে সিরাজ সিকদারকে পুলিশ ১লা জানুয়ারি চট্টগ্রামে গ্রেফতার করেন। একই দিন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাহাকে ঢাকা পাঠানো হয়। জিজ্ঞাসাবাদের সময় তিনি স্বীকারোক্তিমূলক এক বিবৃতি দেন এবং তাহার পার্টি কর্মীদের কয়েকটি গোপন আস্তানা এবং তাহাদের বেআইনি অস্ত্র ও গোলাবারুদ রাখার স্থানে পুলিশকে লইয়া যাইতে রাজী হন। সেইভাবে ২রা জানুয়ারি রাত্রে একটি পুলিশ ভ্যানে করিয়া তাহাকে ওইসব আস্তানার দিকে পুলিশ দল কর্তৃক লইয়া যাইবার সময় তিনি সাভারের কাছে ভ্যান হইতে লাফাইয়া পড়িয়া পলায়ন করিতে চেষ্টা করেন। তাহার পলায়ন রোধ করার জন্য পুলিশ দল গুলিবর্ষণ করিলে তত্ক্ষণাত্ ঘটনাস্থলেই তাহার মৃত্যু হয়। এ ব্যাপারে সাভারে একটি মামলা দায়ের করা হইয়াছে।
“এখানে উল্লেখ করা যায় যে, সিরাজ সিকদার তাহার গুপ্ত দলে একদল দুর্বৃত্ত সংগ্রহ করিয়া তাহাদের সাহায্যে হিংস্র কার্যকলাপ, গুপ্তহত্যা, থানার উপর হামলা, বন অফিস, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ইত্যাদির উপর হামলা, ব্যাংক, হাটবাজার লুট, লঞ্চ ট্রেন ডাকাতি, রেললাইন তুলিয়া ফেলার দরুন গুরুতর ট্রেন দুর্ঘটনা, লোকজনের কাছ হইতে জোর করিয়া অর্থ আদায়ের মতো কার্যকলাপের মাধ্যমে দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা বিঘ্নিত করিয়া আসিতেছিলেন। (দৈনিক ইত্তেফাক, ৩ জানুয়ারি ১৯৭৫)
সিরাজ সিকদারের লাশ দাফন
(ইত্তেফাক রিপোর্ট)
নিহত সিরাজ সিকদারের লাশ গতকাল (শুক্রবার) তাঁহার পিতা জনাব আবদুর রাজ্জাক সিকদার কর্তৃক শনাক্তকরণের পরে সন্ধ্যায় মোহাম্মদপুর গোরস্তানে দাফন করা হইয়াছে। গতকাল সকাল সোয়া ১১টার দিকে তাঁহার লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে ময়নাতদন্ত করা হয়।
পুলিশের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয় : “সিরাজুল হক সিকদার ওরফে সিরাজ সিকদারকে গত ১লা জানুয়ারি চট্টগ্রাম হইতে গ্রেফতার করিয়া ঐদিনই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ঢাকায় আনা হয় এবং তাঁহার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী গত ২রা জানুয়ারি রাত্রে একটি পুলিশের ভ্যানে তাঁহাকে তাঁহার দলের লোকদের একটি গোপন আস্তানার দিকে লইয়া যাওয়ার সময় তিনি পালায়নোর চেষ্টা চালাইলে পুলিশ গুলি চালায় এবং জনাব সিকদার ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করেন।” এই ঘটনা রাত সাড়ে ১১টার দিকে সাভারের তালবাগ এলাকায় ঘটে বলিয়া জানা গিয়াছে।
রাত ৩টায় দিকে জনাব সিকদারের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে প্রেরণ করা হয়। গতকাল শুক্রবার সকাল সোয়া ১১টার দিকে ময়নাতদন্ত হয়। তাঁহার শরীরে ৫টি বুলেটের চিহ্ন পাওয়া গিয়াছে। ৪টা বুলেট দেহ ভেদ করিয়াছে। একটি বুলেট ফুসফুসের ভিতরে পাওয়া গিয়াছে। তাঁহার পরনে ক্রিম রংয়ের টেট্রনের প্যান্ট ও গায়ে সাদা টেট্রনের শার্ট ছিল এবং বাম হাতে হাতকড়া দেখা যায়।
অপরাহ্ন ২টার সময় সিরাজ সিকদারের পিতা জনাব আবদুর রাজ্জাক সিকদার, মরহুমের কয়েক ভাই ও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন হাসপাতালে মর্গে উপস্থিত হন। বেলা সোয়া ২টার সময় জনাব রাজ্জাক শিকদার তাঁহার পুত্রের লাশ শনাক্ত করেন। লাশ সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত কড়া পুলিশ প্রহরায় লালবাগ থানায় ছিল। সন্ধ্যায় মোহাম্মদপুর গোরস্তানে নিহত সিরাজ সিকদারের লাশ পুলিশ প্রহরায় তাঁহার পিতা ও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন দাফন করেন বলিয়া পুলিশের পক্ষ হইতে বলা হইয়াছে। জনাব আবদুর রাজ্জাক সিকদার ও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের বক্তব্য অনুযায়ী সিরাজ সিকদারের বয়স ছিল প্রায় তিরিশ বছর। তিনি পিতার ৬ পুত্র ও ২ কন্যার মধ্যে দ্বিতীয় সন্তান ছিলেন। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন সময়ে ১৯৬৬ সালে তিনি তত্কালীন শেরেবাংলা হল ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৬৭ সালের দিকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বিএসসি পাস করার পর ১৯৬৮ সালের প্রথমদিকে মাস দেড়েক সিএন্ডবিতে প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করেন। ইহার পর তিনি তেজগাঁওয়ের পলিটেকনিক টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে লেকচারার হিসেবে প্রায় এক বছর চাকরি করেন। ১৯৬৯ সালের মার্চ মাসের পর হইতে পরিবারের সহিত তাহার সম্পর্কচ্ছেদ ঘটে।
তিনি ১৯৬৬ সালে রওশান আরা বেগমের সহিত পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। তাহার দুই ছেলে এবং এক মেয়ে আছে। মেয়েটির নাম শিখা (৭), আর একটি ছেলের নাম শুভ্র।
সিরাজ সিকদারের বড় ভাইও একজন প্রকৌশলী ছিলেন। তিনি পাক সেনাদের হাতে নিহত হন। তাঁহার ছোট অপর এক ভাইও প্রকৌশলী। অপর ভাইয়েরা লেখাপড়া করিতেছেন। এক বোন চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ে ভাস্কর্য নিয়ে অধ্যয়ন করিতেছেন। বৃদ্ধ পিতা জনাব আবদুর রাজ্জাক সিকদার বর্তমানে অবসর গ্রহণের পূর্বে ছুটিতে রহিয়াছেন। তাহার মাতাও জীবিত আছেন। (দৈনিক ইত্তেফাক, ৪ জানুয়ারি ১৯৭৫)।
সিরাজ সিকদার হত্যা মামলার বিবরণী
১৯৯২ সালের ৪ জুন সিরাজ সিকদারকে হত্যার দায়ে অতিসম্প্রতি প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ ও মোহাম্মদ নাসিমসহ সাতজনকে আসামি করে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের (সিএমএম) আদালতে মামলা দায়ের করা হয়। সিরাজ সিকদার পরিষদের সভাপতি শেখ মহিউদ্দিন আহমদ বাদী হয়ে এই মামলা করেন। মামলার আসামিরা হলেন : ১. সাবেক পুলিশ সুপার মাহবুব উদ্দিন আহমেদ, ২. আবদুর রাজ্জাক এমপি, ৩. তোফায়েল আহমেদ এমপি, ৪. সাবেক আইজিপি ই এ চৌধুরী, ৫. সাবেক রক্ষীবাহিনীর মহাপরিচালক কর্নেল (অব.) নুরুজ্জামান, ৭. মোহাম্মদ নাসিম এমপি গং। আসামিদের বিরুদ্ধে ৩০২ ও ১০৯ নম্বর ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।
আর্জিতে বলা হয়, আসামিরা মরহুম শেখ মুজিবের সহচর ও অধীনস্থ কর্মী থেকে শেখ মুজিবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ও গোপন শলা-পরামর্শে অংশগ্রহণ করতেন এবং ১নং থেকে ৬নং আসামি তত্কালীন সময়ে সরকারের উচ্চপদে থেকে অন্য ঘনিষ্ঠ সহচরদের সঙ্গে শেখ মুজিবের সিরাজ সিকদার হত্যার নীলনকশায় অংশগ্রহণ করেন। তারা এ লক্ষ্যে সর্বহারা পার্টির বিভিন্ন কর্মীকে হত্যা, গুম, গ্রেফতার, নির্যাতন ও হয়রানি করতে থাকেন। সিরাজ সিকদারকে গ্রেফতার ও হত্যার বিবরণ দিয়ে আর্জিতে বলা হয়, মরহুম শেখ মুজিব ও উল্লিখিত আসামিরা তাঁদের অন্য সহযোগীদের সাহচর্যে সর্বহারা পার্টির মধ্যে সরকারের চর নিয়োগ করেন। এদের মধ্যে ই এ চৌধুরীর একজন নিকটাত্মীয়কেও চর হিসেবে নিয়োগ করা হয়। এভাবে ১৯৭৫ সালের ১ জানুয়ারি চট্টগ্রামের নিউমার্কেট এলাকা থেকে অন্য একজনসহ সিরাজ সিকদারকে গ্রেফতার করে ওই দিনই বিমানে করে ঢাকায় আনা হয়। ঢাকার পুরনো বিমানবন্দরে নামিয়ে বিশেষ গাড়িতে করে বন্দিদের পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের মালিবাগ অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সিরাজ সিকদারকে আলাদা করে তাঁর ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। ২ জানুয়ারি সন্ধ্যায় পুলিশ ও রক্ষীবাহিনীর বিশেষ স্কোয়াডের অনুগত সদস্যরা গণভবনে মরহুম শেখ মুজিবের কাছে সিরাজ সিকদারকে হাত ও চোখ বাঁধা অবস্থায় নিয়ে যায়। সেখানে শেখ মুজিবের সঙ্গে তাঁর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মরহুম ক্যাপ্টেন (অব.) মনসুর আলীসহ আসামিরা, শেখ মুজিবের পুত্র মরহুম শেখ কামাল এবং ভাগ্নে মরহুম শেখ মনি উপস্থিত ছিলেন। আর্জিতে আরও বলা হয়, প্রথম দর্শনেই শেখ মুজিব সিরাজ সিকদারকে গালাগাল শুরু করেন। সিরাজ এর প্রতিবাদ করলে শেখ মুজিবসহ উপস্থিত সবাই তাঁর উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। সিরাজ সে অবস্থায়ও শেখ মুজিবের পুত্র কর্তৃক সাধিত ব্যাংক ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপকর্ম, ভারতীয় সেবাদাসত্ব না করার, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য শেখ মুজিবের কাছে দাবি জানালে শেখ মুজিব আরও উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। সে সময় ১নং আসামি মাহবুব উদ্দিন তাঁর রিভলবারের বাঁট দিয়ে মাথায় আঘাত করলে সিরাজ সিকদার মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। শেখ কামাল রাগের মাথায় গুলি করলে সিরাজ সিকদারের হাতে লাগে। ওই সময় সব আসামি শেখ মুজিবের উপস্থিতিতেই তাঁর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে কিল, ঘুষি, লাথি মারতে মারতে তাঁকে অজ্ঞান করে ফেলেন। এরপর শেখ মুজিব, মনসুর আলী এবং ২ থেকে ৭নং আসামি সিরাজ সিকদারকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন এবং ১নং আসামিকে নির্দেশ দেন। ১নং আসামি মাহবুব উদ্দিন আহমদ আসামিদের সঙ্গে বন্দি সিরাজ সিকদারকে শেরে বাংলানগর রক্ষীবাহিনীর সদর দফতরে নিয়ে যান। এর পর তাঁর ওপর আরও নির্যাতন চালানো হয়। অবশেষে ২ জানুয়ারি আসামিদের উপস্থিতিতে রাত ১১টার দিকে রক্ষীবাহিনীর সদর দফতরেই সিরাজ সিকদারকে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরে ১নং আসামির সঙ্গে বিশেষ স্কোয়াডের সদস্যরা পূর্বপরিকল্পনা মতো বন্দি অবস্থায় নিহত সিরাজ সিকদারের লাশ সাভারের তালবাগ এলাকা হয়ে সাভার থানায় নিয়ে যায় এবং সাভার থানা পুলিশ পরের দিন ময়নাতদন্তের জন্য লাশ মর্গে প্রেরণ করে।

Saturday, 31 December 2011

শেখ হাসিনা ও তার মন্ত্রীদের খিস্তি-খেউড়












স্টাফ রিপোর্টার
বচনে জুড়ি নেই ক্ষমতাসীন সরকারের কর্তাব্যক্তিদের। সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিত্ব থেকে শুরু করে নিম্ন পর্যায় পর্যন্ত সবাই এ বিষয়ে যেন সিদ্ধহস্ত। বিশেষ করে বিরোধী দলের প্রতি আক্রমণাত্মক বক্তব্যে তাদের তুলনা হয় না। পাশাপাশি তারা গণমাধ্যম ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর প্রতিও বিষোদগার করেন। তাদের বক্তব্য বেশিরভাগ সময় রাজনৈতিক শিষ্টাচার ভেদ করে অশ্লীলতার পর্যায়ে চলে যায়। নতুন নতুন শব্দ চয়নের মাধ্যমে ছন্দ মিলিয়ে তারা বিরোধী দলকে আক্রমণ করেন। সরকারের পাশাপাশি ক্ষমতাসীন দলের নেতারাও সমান তালে বিরোধী দলকে ঘায়েল করে এসব অশালীন বক্তব্য দেন। এমন বক্তব্যের ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা চ্যাম্পিয়ন। তার বহুল আলোচিত বক্তব্য—‘একটির বদলে দশটি লাশ ফেলা হবে।’ এছাড়া ১০ টাকা কেজি চাল ও ঘরে ঘরে চাকরি দেয়ার বহুল আলোচিত বক্তব্যটি শেখ হাসিনাই দিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে দেয়া এসব বক্তব্যের আংশিক পাঠকদের সামনে তুলে ধরা হলো—
গত ৩০ নভেম্বর সংসদের একাদশতম অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা বিভক্তিকরণে বিরোধিতাকারী বুদ্ধিজীবীদের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বলেন, জনগণের সেবা নিশ্চিত করতে ঢাকা সিটিকে দু’ভাগ করা হয়েছে। দু’ভাগ নয়, আমাদের ঠাকা থাকলে ঢাকা চার ভাগ করতাম। একই দিনে তিনি বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার দুই ছেলেকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে বলেন, আমার সন্তানরা লেখাপড়া শিখে মানুষ হয়েছে। রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে টাকা নিয়ে উনার (বেগম জিয়ার) ছেলেদের একজন ‘মানি লন্ডারিংয়ে’ মাস্টার্স করেছে, আরেকজন ‘ড্রাগে’ করেছে ডিগ্রি পাস।
ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত বিভিন্ন চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সম্পর্কে ভারত সফর শেষে দেশে ফিরে ২০১০ সালে ১৬ জানুয়ারি এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নির্বাচনে জনগণ আমাদের যে হারে ভোট দিয়েছে তাতে ভারতের সঙ্গে সমঝোতা-চুক্তি করতেই পারি। নির্বাচন এলেই মহলবিশেষের ভারতবিরোধী ক্যাম্পেইন চলে। এটা তাদের স্বভাবজাত হয়ে গেছে, চাইলেও আর বদলানো যাবে না।
জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তন করে হযরত শাহজালাল (র.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর করার পক্ষে যুক্তি দিয়ে ২০১০ এর ১৯ ফেব্রুয়ারি এক অনুষ্ঠানে বিএনপির প্রতি ইঙ্গিত করে শেখ হাসিনা বলেন, অতীত থেকে যারা শিক্ষা নেয়নি, তাদের শেখানোর প্রয়োজন রয়েছে। তাদের শিক্ষা দিতেই জিয়ার নাম বদল হয়েছে। তারা একবারও ভাবেনি, নাম বদলের খেলা ভালো হবে না। ভাবেনি তাদেরও খারাপ দিন আসতে পারে। আমরা দু’-একটা নাম পরিবর্তন করাতেই এত জ্বালা। তাদের করা আড়াইশ’ প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করা হলে কেমন লাগবে? ২০১০ সালের বুদ্ধিজীবী দিবসের আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, মিথ্যা বলা বিএনপির অভ্যাস।
বিএনপি-জামায়াত জোটের কমিশন খাওয়ার কারণে দেশে নতুন কোনো বিদ্যুত্ কেন্দ্র স্থাপিত হয়নি অভিযোগ করে ২৩ মে ২০১০ এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের কমিশন খাওয়ার কোনো নিয়ত নেই। আগে কমিশন খাইওনি, আগামীতেও খাব না। আমাদের কমিশন খাওয়ার প্রয়োজনও নেই। ৩০ আগস্ট ২০১০ তারিখে বিএনপির প্রতি ইঙ্গিত করে শেখ হাসিনা বলেন, ওরা জালিয়াত, দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন। দেশের মানুষের সুখ-শান্তি তাদের ভালো লাগে না।
২০১০ সালে ছাত্রলীগ আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘নিজের গ্রুপ শক্তিশালী করতে গিয়ে ছাত্রলীগে যারা ছাত্রদল ও শিবির কর্মীদের ঢুকিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। যারা অপরাধ করবে তাদের কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।’
গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী তার মন্ত্রিপরিষদ সদস্যদের সতর্ক করে দিয়ে বলেন, সরকারের দুই বছর চলে যাচ্ছে, এখন থেকে ভাটার টান লাগবে। সরকারকে অনেক প্রতিকূলতা মোকাবিলা করতে হবে। মানুষ সরকারের কাজের মূল্যায়ন করবে। জানতে চাইবে কোন মন্ত্রণালয় ভালো করেছে, কোন মন্ত্রণালয় খারাপ করেছে।
এ বছরের ৯ জানুয়ারি শেখ হাসিনা রংপুরে গিয়ে বলেন, রংপুরের বউ হিসেবেও তো একটা দায়িত্ব আছে। তাই আপনাদের উন্নয়নের সব দায়িত্ব আমি নিয়ে নিচ্ছি। ৩ ফেব্রুয়ারি বলেন, ১০ টাকা কেজি চালের কথা এবার নয়, ’৯৬ সালে বলেছিলাম। ১ মে তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার সঙ্গে আমাকে এক পাল্লায় মাপবেন না। ১৩ অক্টোবর শেখ হাসিনা বলেন, মহাজোট সরকারের উন্নয়ন দেখে খালেদা জিয়া পাগল হয়ে গেছেন। ২৫ আগস্ট বলেন, দেশে জিনিসপত্রের দাম এখনও কম। ২৭ নভেম্বর বলেন, খালেদা জিয়া ঘোমটা খুলে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ নিয়েছেন।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১০ এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও বর্তমান যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বর্তমান সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের কঠোর সমালোচনা করে বলেন, মন্ত্রীদের দুর্নীতি নিয়ে আজ কথা উঠেছে। এমপি-মন্ত্রীদের মনে রাখতে হবে, নিজেদের দিন বদল করতে আপনাদের পাঠানো হয়নি, ১৬ কোটি মানুষের ভাগ্য বদলানোই হচ্ছে আপনাদের কাজ। ওই বছরের ডিসেম্বরে ওবায়দুল কাদের বর্তমান মন্ত্রিপরিষদ সদস্যদের দিয়ে ‘দিন বদল’ সম্ভব নয় মন্তব্য করে বলেন, অফিসে অফিসে প্রসাধনীর মতো কম্পিউটার সাজিয়ে রাখলেই দিন বদল হয় না। যারা দিন বদলের কথা বলে মুখে ফেনা তুলছেন তাদের মন-মানসিকতাই এখনও বদলায়নি। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দেয়া সরকারের প্রশাসনিক কাজ এনালগ পদ্ধতিতে চলছে।
মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়ার পর কাদের নিজের দায়িত্বকে চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে বলেন, ঢেউ না থাকলে নদী কিসের? ঢেউয়ের মধ্যে সাঁতার কাটাই চ্যালেঞ্জ। আর কোনো চ্যালেঞ্জই অনতিক্রমযোগ্য নয়। এরপর অন্য এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, পথ অনেক, পেট্রল কম। গত ২৭ নভেম্বর তিনি বলেন, আওয়ামী লীগে এমন পাতলা ঈমানের লোক নেই যে বিএনপি ডাকলেই সাড়া দেবে।
৩০ নভেম্বর ২০১০ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ও বর্তমান রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, বিরোধী দলে থাকতে আমরাও কোনো খুঁত বের করেই বলেছি, সংসদে যাব না। এর আগে এক অনুষ্ঠানে সুরঞ্জিত সেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদকে তাচ্ছিল্য করে বলেন, সে (ব্যারিস্টার মওদুদ) একজন সফল জোকার। তার মতো বহুরূপী আমি আর দেখিনি। অপর এক অনুষ্ঠানে সুরঞ্জিত সেন বলেন, বাঘে ধরলে বাঘে ছাড়ে, কিন্তু শেখ হাসিনা ধরলে ছাড়ে না। রেলের সমস্যা সমাধান বিষয়ে নতুন রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত : কোন অন্ধকারে কালো বেড়ালটি কীভাবে লুকিয়ে রয়েছে তা খুঁজে দেখতে চাই।
২০১০ সালের আগস্টে এক অনুষ্ঠানে কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী বিরোধী দলের উদ্দেশে বলেন, দিনের আলোতেই ভারতের সঙ্গে ঋণ সহায়তা চুক্তি হয়েছে। এ নিয়ে কোনো লুকোচুরি হয়নি। সারা বিশ্বের গণমাধ্যমে এ চুক্তির বিষয় প্রকাশিত হয়েছে। তাই অযথা এ নিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করে লাভ হবে না। আর কেউ ফুঁ দিলে সরকার উড়ে যাবে না বা পতন হবে না।
৭ মে ২০১০ এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে পারি, এরশাদ জিয়ার হত্যাকারী। বেগম খালেদা জিয়া তার কাছ থেকে বাড়ি এবং ছেলেদের ভরণ-পোষণের টাকা নিয়ে আঁতাত কাকে বলে তার প্রমাণ দিয়েছেন।
সরকারের বিরুদ্ধে লন্ডনভিত্তিক ম্যাগাজিনে সংবাদ প্রকাশ হওয়ার পর গত ১৩ আগস্ট মতিয়া চৌধুরী বলেন, সাপ্তাহিক ইকনোমিস্ট জঙ্গিবাদের টাকায় রিপোর্ট করছে। গত ১৩ মে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগই ধর্মীয় শিক্ষাকে শিক্ষানীতিতে বাধ্যতামূলক করেছে। ঈমান-আমান ঠিক রেখে বর্তমান সরকার কাজ করে যাচ্ছে বলেই দেশের উন্নয়ন হচ্ছে। ২ জুলাই তিনি বলেন, চোরাচালান রোধে ইউরিয়া সারের দাম বাড়ানো হয়েছে।
২০১০ সালের ২১ এপ্রিল এক অনুষ্ঠানে বিরোধীদলীয় নেত্রী ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে ‘যুদ্ধপরাধের সহযোগী’ আখ্যায়িত করে সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী বলেন, মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানের জেনারেল জানজুয়ার সঙ্গে বেগম জিয়া সেনাক্যাম্পে থেকে মুক্তিযোদ্ধা হত্যার পরিকল্পনায় ছিলেন। সেই অপরাধে তার বিচার হবে। রাজাকারের নেত্রী বেগম জিয়াকে রুখতে হবে।
সরকারের সমালোচনা করে সংবাদ পরিবেশনে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে ২৫ মে ২০১০ এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেন, নেতাদের চাঁদাবাজি হেডলাইন না করে যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টির বিষয়কে হেডলাইন করুন।
৮ জানুয়ারি ২০১০ সংবাদ ব্রিফিংয়ে সংসদ অধিবেশনকে ‘সার্কাস’ হিসেবে আখ্যায়িত করে আশরাফুল ইসলাম বলেন, বিরোধী দল সংসদের সব কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করছে এবং বেতন-ভাতাসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছে। তারা কেবল আসছে না সেই সম্মেলনে (সংসদ অধিবেশনে) যেখানে শুধু ‘সার্কাস’ হয়।
বিরোধী দলের ‘দেশ বিক্রি’র অভিযোগ খণ্ডন করে অপর এক সংবাদ সম্মেলনে আশরাফ বলেন, এটা বেগম জিয়া ও বিএনপি-জামায়াত জোটের একটি মেনিয়া, নিরাময়ের অযোগ্য ‘ক্রনিক ডিজিজ’। দেশ কি ছেলের হাতের মোয়া নাকি শাড়ি-গয়না যে ইচ্ছে করলেই তা বিক্রি করা যায়। তারা কথায় কথায় আমাদের বিরুদ্ধে দেশ বিক্রির ধোয়া তোলেন। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিসর্জন এবং নতজানুতার ভাঙা রেকর্ড বাজান। পার্বত্য শান্তি চুক্তির সময় তিনি বলেছিলেন, ফেনী পর্যন্ত নাকি ভারত নিয়ে যাবে। সেই ফেনী থেকে তিনি বর্তমানের কোন দেশের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।
২৭ মে এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী মাহাবুবউল আলম হানিফ বলেন, এমন কোনো ইসলামবিরোধী কাজ নেই যা বেগম জিয়া করেন না। তিনি এক ওয়াক্ত নামাজও পড়েন না। অথচ নিজামী-আমিনীরা তাকে ইসলামের পক্ষের নেত্রী দাবি করেন। তিনি দলীয় সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধর্মপ্রাণ মানুষ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, শেখ হাসিনা ইসলামের নিয়মনীতি মেনে চলেন। যত ব্যস্তই থাকুন, প্রতিদিন নামাজ আদায় ও নিয়মিত কোরআন তেলাওয়াত করেন।
৫ অক্টোবর ২০১০ এক অনুষ্ঠানে মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, আওয়ামী লীগ বাকশালের চিন্তা-চেতনা ও দর্শনকে আমরা এখনও ধারণ করে। সব দলকে সঙ্গে নিয়ে একটি প্লাটফর্মের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধভাবে বাকশালের চিন্তা-চেতনাকে কাজে লাগিয়ে আমরা মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে কাজ করতে চাই।
গত ২৬ অক্টোবর হানিফ বলেন, জামায়াত-শিবির কর্মী যাদের বয়স ৪০ বছরের কম তারা রাজাকার-আলবদর ছিল না, তারা যুদ্ধাপরাধও করেনি। ২৭ সেপ্টেম্বর তিনি বলেন, পিকেটারের বুকে পুলিশের বুটের ছবিতে সরকারের অর্জন ম্লান হবে না।
২০১০ সালের ৭ মে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা মোহাম্মদ নাসিম ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, ছাত্রলীগের নামে যা ঘটছে তা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। এদের কর্মকাণ্ডে মাথা হেঁট হয়ে যায়। জয়কালী মন্দিরে চুরি প্রসঙ্গে গত ২ ফেব্রুয়ারি তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধের বিচার বাধাগ্রস্ত করতে মন্দিরে চুরি হয়েছে।
২৯ মে ২০১০ এক অনুষ্ঠানে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে ‘পাকিস্তানের চর’ মুক্তিযোদ্ধা বলে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম। তিনি বলেন, আমার এ বক্তব্যকে যদি কেউ খণ্ডন করতে চান, মিথ্যা প্রমাণ করতে পারেন তবে প্রকাশ্যে আমার সঙ্গে টকশো, আলোচনা বা বিতর্কে আসতে পারেন।
বিরোধী দলের আহূত হরতালের প্রেক্ষাপটে ৩০ নভেম্বর ২০১০ বিরোধী দলের প্রতি হুশিয়ারি উচ্চারণ করে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবীর নানক বলেন, জনজীবন স্বাভাবিক রাখতে হরতাল প্রত্যাহার করে নিন। নইলে ১ টাকার বিনিময়ে গুলশানের ৩৩ শতাংশ বাড়িটিও খালেদা জিয়াকে ছাড়তে হবে। সেখানে ছিন্নমূলদের বসবাসের ব্যবস্থা করা হবে।
গত ২৫ ডিসেম্বর ২০০৯ তারিখে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন বলেন, সন্ত্রাসী-জঙ্গি-চাঁদাবাজ-টেন্ডারবাজরা গর্তে ঢুকলেও বের করে আনা হবে। এজন্য আমি জীবনবাজি রেখে হলেও দায়িত্ব পালন করব। ২০ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমই বেড়েছে। দাম বৃদ্ধি দেশের মানুষ সাদরেই গ্রহণ করছে। ৬ অক্টোবর তিনি বলেন, ১০ বছরের মধ্যে দেশের আইন-শৃঙ্খলা এখন সবচেয়ে ভালো ।
ট্রানজিট ফি সম্পর্কে ১২ অক্টোবর ২০১১ তারিখে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান বলেন, আমাদের লোকজন অভিজ্ঞ না হওয়া পর্যন্ত ভারত থেকে ফি নেয়া হবে না। এ বছরের ২০ জানুয়ারি তিনি বলেন, শেয়ারবাজারে ধসের জন্য মাথা ঘামানোর কোনো কারণ নেই। কারণ, কতগুলো লোক যদি অর্থনীতিতে অবদান না রেখে লাভবান হতে চায়, তাদের কষ্টে আমার হৃদয় কাঁদে না।
মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফর প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী বলেন, এই সফরে প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে যেসব চুক্তি হতে যাচ্ছে, তাতে বাংলাদেশ অনেক লাভবান হবে। তবে ভারত এই চুক্তির সুফল বেশি পাবে।
গত ১৭ নভেম্বর সরকারদলীয় সংসদ সদস্য শওকত মোমেন শাহজাহান মুক্তিযুদ্ধকালীন কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীকে উদ্দেশ করে বলেন, কাদের সিদ্দিকী একজন যুদ্ধাপরাধী। তার বিচার হওয়া উচিত।
অশিক্ষিতদের ড্রাইভিং লাইন্সেস দেয়ার পক্ষে যুক্তি দিয়ে ১৬ সেপ্টেম্বর নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ড্রাইভারও ফাইভ পাস।
স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. ক্যাপ্টেন (অব.) মুজিবর রহমান ফকির গত ১০ মে এক অনুষ্ঠানে বলেন, কমিউনিটি হেলথ প্রোভাইডার পদে আমরা আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ এবং সমমনাদেরই নিয়োগ দেব। বিএনপি বা অন্য মতের কাউকে নিয়োগ দিলে ওই প্রকল্পটি বন্ধ করে দেয়া হবে। গত ৪ মে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান বিচার ব্যবস্থা স্বর্ণযুগে প্রবেশ করেছে।
http://www.amardeshonline.com/pages/details/2011/12/17/122522

Friday, 9 December 2011

বর্বরতা এবং আওয়ামী লীগের গণতন্ত্র!!

শাহ আহমদ রেজা

যথেষ্ট সংযমী নেত্রী বলেই আওয়ামী লীগ সম্পর্কে বলতে গিয়ে বেগম খালেদা জিয়া শুধু বর্বর শব্দটির মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকেছেন। কিন্তু এতেই গায়ে জ্বালা ধরে গেছে দলটির নেতাদের। অন্যদিকে সত্য কিন্তু অনেক ভয়ঙ্কর। বর্বরতা এবং নিষ্ঠুরতা কাকে বলে তা জানার জন্য ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরানো যেতে পারে। সে ইতিহাসে জানা যাবে গণতন্ত্রের প্রশ্নে আওয়ামী লীগের মনোভাব সম্পর্কেও।
প্রথমে একটি উদাহরণ। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা এবং ১৯৫৭ সালের জুলাই পর্যন্ত সভাপতি ছিলেন মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। তখন আওয়ামী লীগের প্রধান কর্মসূচি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের জন্য স্বায়ত্তশাসন আদায় করা। দাবিটি আদায়ের লক্ষ্য নিয়ে অবিভক্ত বাংলার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও কৃষক-শ্রমিক পার্টির নেতা ‘শেরে বাংলা’ আবুল কাশেম ফজলুল হকের সঙ্গে যুক্তফ্রন্ট গঠন করেছিলেন মওলনা ভাসানী। হক-ভাসানীর পাশাপাশি তৃতীয় প্রধান নেতা ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানকেন্দ্রিক আওয়ামী লীগের নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বেই ১৯৫৪ সালে আওয়ামী লীগ শেরে বাংলার সঙ্গে যৌথভাবে পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষমতায় গিয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন শেরে বাংলা ফজলুল হক। কিন্তু ষড়যন্ত্রের রাজনীতি গণতন্ত্রের সম্ভাবনাকে নস্যাত্ করেছিল। ৯২-এর ‘ক’ ধারার আড়ালে জারি হয়েছিল জরুরি অবস্থা। দ্বিতীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছিল ১৯৫৬ সালে। সেবার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন আতাউর রহমান খান। সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানসহ দলের অন্য নেতারাও মন্ত্রিত্ব পেয়েছিলেন। একই সময়ে অর্থাত্ ১৯৫৬ সালের সেপ্টেম্বরে পাকিস্তানের কেন্দ্রেও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গিয়েছিল। মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি হিসেবে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরই তিনি পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে পরিপন্থী অবস্থানে চলে গিয়েছিলেন। শহীদ সোহরাওয়ার্দী এমনকি একথা পর্যন্ত ঘোষণা করেছিলেন যে, পূর্ব পাকিস্তান নাকি ৯৮ শতাংশ স্বায়ত্তশাসন পেয়ে গেছে! এর প্রতিবাদে এবং স্বায়ত্তশাসন আদায় ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার প্রশ্নে মওলানা ভাসানী ‘আসসালামু আলাইকুম’-এর জন্য বিখ্যাত কাগমারী সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন। সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে সংঘাতের পরিণতিতে মওলানা ভাসানীকে তাঁর নিজের গড়ে তোলা আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে গিয়ে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠন করতে হয়েছিল। ওই দিনগুলোতে শেখ মুজিবুর রহমান কিন্তু মওলানা ভাসানীর তথা পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে ভূমিকা পালন করেননি। শুধু তা-ই নয়, ১৯৫৭ সালের ২৫ ও ২৬ জুলাই পুরনো ঢাকার ‘রূপমহল’ সিনেমা হলে যখন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রতিষ্ঠাকালীন অধিবেশন চলছিল তখন শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী গুণ্ডারা হামলা চালিয়ে অধিবেশনকে বাধাগ্রস্ত করেছিল। প্রথমদিন পাল্টা প্রতিরোধে পিছিয়ে গেলেও দ্বিতীয় দফা হামলা চালানো হয়েছিল পল্টন ময়দানের সমাবেশে। সেদিনও শেখ মুজিবই গুণ্ডাদের নেতৃত্বে ছিলেন। তার নেতৃত্বে আওয়ামী গুণ্ডারা মওলানা ভাসানীর এবং খান আবদুল গাফফার খানসহ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত নেতাদের অনেকেরই মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিল। ইট-পাটকেলের ঢিল শুধু নয়, লাঠির আঘাতও সহ্য করতে হয়েছিল মওলানা ভাসানীকে। ফলে পল্টন ময়দানের সমাবেশ অনেকাংশে ভণ্ডুল হয়ে গিয়েছিল। এই একটি ঘটনাই প্রমাণ করে, গুণ্ডামি করার এবং সন্ত্রাসী হামলা চালানোর শিক্ষাটাও উত্তরাধিকার হিসেবেই পেয়েছে বর্তমান আওয়ামী লীগ।
পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগের এই গুণ্ডামি ও বর্বরতা দিন দিন শুধু আরও মারাত্মক হয়েছে। পাকিস্তান যুগে মওলানা ভাসানীর ন্যাপ ছাড়া অন্য কোনো রাজনৈতিক দলই বিশেষ করে পল্টন ময়দানে বাধাহীনভাবে সমাবেশ করতে পারেনি। প্রতিটি সমাবেশে ঝাঁপিয়ে পড়েছে আওয়ামী গুণ্ডারা। বাংলাদেশ হওয়ার পর দলটির বর্বরতা সীমা ছাড়িয়ে গেছে। মিছিল সমাবেশে হামলা তো চালিয়েছেই, ব্যক্তিগত পর্যায়েও অনেককে জখম ও খুন করেছে আওয়ামী গুণ্ডা-সন্ত্রাসীরা। পুলিশ এবং রক্ষীবাহিনীকেও দলীয় কর্মীর মতো ব্যবহার করেছেন নেতারা। ভাসানী ন্যাপ এবং জাসদের অনেক নেতাকেই আওয়ামী গুণ্ডা-সন্ত্রাসীদের হামলার শিকার হতে হয়েছে। ন্যক্কারজনক সে বর্বরতা এখনও চালাচ্ছে দলটি।
প্রসঙ্গক্রমে গণতন্ত্রের প্রশ্নে আওয়ামী লীগের মনোভাব ও কৌশল সম্পর্কে বলা দরকার। ১৯৫০-এর দশকে শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন দলটি স্বায়ত্তশাসনের তো বটেই, গণতন্ত্রেরও বিরুদ্ধে ভূমিকা পালন করেছে। এরপর এসেছে ১৯৬০-এর দশক। এখন গালগল্প শোনানো হলেও সত্য হচ্ছে, গণতন্ত্রের জন্য কোনো আন্দোলনেই আওয়ামী লীগ যথাযথ ভূমিকা পালন করেনি। দলটি বরং প্রতারণাপূর্ণ কৌশলের মাধ্যমে অন্যের সাফল্যকে দখল করেছে। একটি উদাহরণ হিসেবে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের কথা উল্লেখ করা যায়। শেখ মুজিব ১৯৬৬ সালের মে থেকে বন্দি থাকায় আওয়ামী লীগের অবস্থা তখন ছিল শোচনীয়। যুক্তফ্রন্টের ২১ দফাকে ছয়টি ভাগে আলাদা করে শেখ মুজিব তার ছয় দফা পেশ করেছিলেন ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে। ছয় দফার প্রশ্নেই ১৯৬৭ সালে আওয়ামী লীগ দ্বিখণ্ডিত হয়েছিল। শেখ মুজিব ছিলেন ‘ছয় দফাপন্থী’ আওয়ামী লীগের সভাপতি, অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খানের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল ‘পিডিএমপন্থী’ আওয়ামী লীগ। ‘ছয় দফাপন্থী’ আওয়ামী লীগের অবস্থা সে সময় এতটাই খারাপ ছিল যে, শেখ মুজিবকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় প্রধান আসামি বানানোর পরও দলটির পক্ষ থেকে আন্দোলন গড়ে তোলা দূরের কথা, ওয়ার্কিং কমিটির এক প্রস্তাবে বরং তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়ার জন্য ‘আবেদন’ জানানো হয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে শুরু হওয়া গণঅভ্যুত্থানে যোগ দেয়ার পরিবর্তে ‘ছয় দফাপন্থী’ আওয়ামী লীগ গিয়ে এমন এক জোট ‘ড্যাক’ বা ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটির সদস্য হয়েছিল, যার আহ্বায়ক ছিলেন শেখ মুজিবের প্রত্যক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বী এবং ‘পিডিএমপন্থী’ আওয়ামী লীগের সভাপতি নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান। ‘ড্যাক’-এর আট দফায় স্বায়ত্তশাসন শব্দটি পর্যন্ত ছিল না এবং শেখ মুজিবের মুক্তি চাওয়া হলেও তার নামের আগে-পরে ছিল ওয়ালী খান এবং জুলফিকার আলী ভুট্টোর নাম। ‘ড্যাক’-এর মধ্যে ছিল জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম পার্টি ও কাউন্সিল মুসলিম লীগসহ পশ্চিম পাকিস্তানকেন্দ্রিক দলগুলো। উল্লেখ্য, মওলানা ভাসানী ‘ড্যাক’-এর সঙ্গে যুক্ত হননি। কিন্তু বাঙালির জন্য সংগ্রামের কৃতিত্ব দখলকারী দল ‘ছয় দফাপন্থী’ আওয়ামী লীগ ‘ড্যাক’-এ গিয়েছিল।
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সূচনা করেছিলেন মওলানা ভাসানী। ১৯৬৮ সালের ডিসেম্বরে তিনি ‘ঘেরাও’ নামের এক নতুন ধরনের আন্দোলন শুরু করেন, ৪ ডিসেম্বর তাঁর নেতৃত্বে ছাত্র-জনতা পল্টন ময়দানের সমাবেশ থেকে গিয়ে গভর্নর হাউস (বর্তমান বঙ্গভবন) ঘেরাও করে। পুলিশের গুলিতে আন্দোলনকারীদের মৃত্যু ও সরকারি দমন-নির্যাতনের প্রতিবাদে মওলানা ভাসানী পরপর দু’দিন হরতালের ডাক দিয়েছিলেন। তাঁর এই ঘেরাও আন্দোলনের পথ ধরেই ১৯৬৯ সালের জানুয়ারিতে ঘোষিত হয়েছিল ছাত্র সমাজের ১১ দফা, আর ১১ দফাভিত্তিক গণঅভ্যুত্থানেই মুক্তি পেয়েছিলেন শেখ মুজিবসহ রাজনৈতিক বন্দিরা। কিন্তু প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দিয়ে আন্দোলনকে বিভ্রান্ত এবং শেষ পর্যন্ত ভণ্ডুল করেছিলেন শেখ মুজিব। যে ১১ দফার ভিত্তিতে তিনি মুক্তি পেয়েছিলেন, সে ১১ দফাকে পরিত্যাগ করে নিজের ছয় দফাকে প্রতিষ্ঠিত করার মধ্য দিয়েও তিনি নিজের মনোভাব ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।
শেখ হাসিনাও পিতাকেই অনুসরণ করে চলেছেন। জনগণের সঙ্গে তো বটেই, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও আওয়ামী লীগ সব সময় প্রতারণামূলক কৌশল অবলম্বন করেছে। প্রতিটি উপলক্ষে প্রমাণিত হয়েছে, গণতন্ত্র বা জনগণের অধিকার আদায়ের আড়ালে ক্ষমতায় যাওয়ার এবং দলগত স্বার্থ উদ্ধার করার বাইরে আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্যের মধ্যে আর কিছু নেই। উদাহরণ দেয়ার জন্য বাকশালী শাসনের পতন-উত্তরকালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোর দিকে দৃষ্টি ফেরানো যায়। প্রতিটি নির্বাচনে অংশ নেয়ার প্রক্রিয়াতেই আওয়ামী লীগ কোনো না কোনোভাবে প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে। ১৯৭৯ সালের সংসদ নির্বাচনের কথা উল্লেখ করা যাক। আবদুল মালেক উকিল তখন সভাপতি। আওয়ামী লীগ সেবার নির্বাচনে অংশ নেয়ার পূর্বশর্ত হিসেবে সেনাবাহিনী থেকে জেনারেল জিয়াউর রহমানের পদত্যাগ এবং ১৯৭৪ সালে নিজেদেরই পাস করা চতুর্থ সংশোধনী বাতিলসহ চারটি প্রধান দাবি তুলে ধরেছিল। নেতারা জনগণকে বোঝাতে চেয়েছিলেন, চার দফা পূরণ না করা হলে তারা নির্বাচনে অংশ নেবেন না। অন্যদিকে কোনো একটি দাবি পূরণ করা দূরে থাকুক, মেনে নেয়ার আশ্বাস পর্যন্ত দেয়নি জিয়ার সরকার। তা সত্ত্বেও ১৯৭৯-এর ১৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নিয়েছিল।
১৯৮১ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নেয়ার প্রক্রিয়াতেও আওয়ামী লীগ ন্যক্কারজনক প্রতারণা করেছিল। নির্বাচনের তারিখ পেছানো, জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার, রাজবন্দিদের মুক্তি এবং ভোটার তালিকা সংশোধনের দাবি ছিল চার দফায়। কিন্তু শুধু নির্বাচনের তারিখ পেছানোর দাবিটি পূরণ করাতেই নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল আওয়ামী লীগ। বড় কথা, নির্বাচনে অংশ নেয়ার আগে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে হত্যার অভিযোগে ফিল্ড জেনারেল কোর্ট মার্শালের বিচারে মৃত্যু দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত ১২ জন সামরিক অফিসারের সঙ্গে গুরুতর প্রতারণা করেছিল।
আওয়ামী লীগের প্রতারণার ধারাবাহিকতায় আরও একটি দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছিল ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে। তারও আগে বিএনপির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগ এরশাদের অবৈধ অভ্যুত্থানকে সমর্থন জানিয়েছিল। সামরিক শাসনের পরবর্তী নয় বছরে নানা কৌশলে এরশাদকে রক্ষাও করেছে আওয়ামী লীগ। বিস্তারিত বর্ণনায় না গিয়ে ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচন সম্পর্কে এটুকু উল্লেখ করাই যথেষ্ট যে, ২১ মার্চ গভীর রাতে নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণার একদিন আগেও শেখ হাসিনা বলেছিলেন, চলমান আন্দোলনকে পাশ কাটিয়ে যারা স্বৈরাচারের নির্বাচনে অংশ নেবে, তাদের ‘জাতীয় বেঈমান’ হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। কিন্তু নিজেই নিজের সে ঘোষণার উল্টো কাজ করেছিলেন শেখ হাসিনা। প্রকাশ্য রাজনীতিতে নানান পূর্বশর্ত জুড়ে দেয়ার পাশাপাশি এভাবেই নির্বাচনে গেছে আওয়ামী লীগ। দলটির উদ্দেশ্য এবং কৌশলগত বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, দলীয় স্বার্থ উদ্ধারের প্রয়োজনে অন্যদের ব্যবহার করা এবং কাজ ‘উদ্ধার’ হয়ে গেলে পাশ কাটিয়ে চলা—কখনও একেবারে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া।
ধারণা দেয়ার জন্য এখানে কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করা যায়। ১৯৮৬ সালে ১৫ দলে ভাঙন ঘটিয়ে এবং আন্দোলনের প্রধান সহযোগী সাত দলীয় জোটের সঙ্গে প্রতারণা করে রাতারাতি তিনি নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। গভীর রাতে এমন এক সময়ে শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছিলেন, যখন চাইলেও খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন সাত দলীয় জোটের পক্ষে নির্বাচনে অংশ নেয়া সম্ভব হতো না। শেখ হাসিনার এই পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছিল, তিনি আসলে অন্যদের সাফল্য একাই ভোগ-দখল করতে চেয়েছিলেন। জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগ না করে সামরিক শাসক এরশাদকে টিকিয়ে রাখার প্রচেষ্টার মধ্যে রয়েছে প্রতারণার আরও একটি উদাহরণ। সেবার, ১৯৮৭ সালের নভেম্বরে আন্দোলন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল, যখন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা পদত্যাগ করলে জেনারেল এরশাদের পতন ঘটত। জামায়াতের এমপিরা আগেই পদত্যাগ করেছিলেন, আওয়ামী লীগের এমপিরাও নেত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু আজ দেই, কাল দেই করে শেখ হাসিনা পদত্যাগপত্রগুলো জমা দেননি। ফলে জেনারেল এরশাদ শুধু টিকেই যাননি, সংসদের বিলুপ্তি ঘটানোর মাধ্যমে নিজের ক্ষমতা দেখানোরও সুযোগ পেয়েছিলেন।
আওয়ামী লীগ সম্পর্কে ধারণা স্পষ্ট করার জন্য খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন প্রথম বিএনপি সরকারের আমলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে পরিচালিত আন্দোলনের কথাও স্মরণ করা যেতে পারে। সঙ্গী বামপন্থীরা তো বটেই, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীসহ অন্য সব বিরোধী দলও এতে অংশ নিয়েছে, কিন্তু আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে কোনো দলকেই সামান্য ছাড় দেয়নি। শুধু তা-ই নয়, সরকার গঠনের সুযোগ পাওয়ার পরও দলটি আন্দোলনের সহযোগী ও কথিত মুক্তিযুদ্ধপন্থী কোনো দলের কোনো নেতাকে মন্ত্রী বানায়নি। অর্থাত্ আওয়ামী লীগ বাম ও কথিত মুক্তিযুদ্ধপন্থীদের শুধু ব্যবহারই করেছিল।
পরবর্তীকালেও আওয়ামী লীগ প্রতারণা ও ঐক্যের অভিনয় থেকে সরে আসেনি। ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় নির্বাচনকে সামনে রেখে দলটি মহাজোট গঠন করেছে। নামসর্বস্ব কয়েকটি দলের সঙ্গে হাত মেলানোয় বুঝতে বাকি থাকেনি যে, জোট না করে আওয়ামী লীগের কোনো উপায় ছিল না। এর কারণ, সরকার বিরোধিতার নামে একদিকে তিনি দেশে-বিদেশে বাংলাদেশ বিরোধী ভয়ঙ্কর প্রচারণা চালিয়েছেন, অন্যদিকে জনগণের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট কোনো একটি বিষয়েই তাকে কখনও আন্দোলন করার বিশ্বাসযোগ্য উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। জনগণকে বিপদের মধ্যে ফেলে বিদেশে পাড়ি জমানোর নজিরও শেখ হাসিনা বার বার স্থাপন করেছেন। এজন্যই জনগণও তার আহ্বানে সাড়া দেয়নি। একই কারণে আওয়ামী লীগকে কয়েকটি নামসর্বস্ব দলের সঙ্গে জোট গঠন করতে হয়েছিল। এই প্রক্রিয়ায় সর্বশেষ পর্যায়েও আওয়ামী লীগ তার বৈশিষ্ট্য ও স্বভাব অনুযায়ী এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। লগি-বৈঠার ধারাবাহিকতায় নিজেদের ‘নিয়ে আসা’ সরকারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে দলটি। গণতন্ত্রের ব্যাপারে এতটাই সততা আওয়ামী লীগের—বিশেষ করে নেত্রী শেখ হাসিনার!

Tuesday, 29 November 2011

মদপানে মৃত ছাত্রলীগ নেতার প্রতিকৃতি স্থাপনের প্রতিবাদ কুয়েট শিক্ষকদের তিন দিন ক্লাস বর্জন

সংগ্রাম ডেস্ক : নগরীর ফুলবাড়ীগেট এলাকায় অবস্থিত খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ কুয়েট শাখার সভাপতির প্রতিকৃতি স্থাপন করার প্রতিবাদে কুয়েট শিক্ষকরা তিন দিন ক্লাস বর্জন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
গতকাল সোমবার শিক্ষক সমিতি নতুন কর্মসূচি ঘোষণায় এ সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। নতুন কর্মসূচিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষক আজ মঙ্গলবার থেকে তিনদিন এ কর্মসূচি পালন করবেন।
কুয়েট শিক্ষক সমিতির ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রফেসর ড. মো. মাসুদ গতকাল সোমবার দুপুর ১২টায় জানান, মদপানে মারা যাওয়া শিক্ষার্থীর প্রতিকৃতি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে স্থাপনকে আমরা নিন্দা জানাই। বিধি বর্হিভূতভাবে স্থাপিত এ প্রতিকৃতি অপসারণের জন্য আমরা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে গত রোববার পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছিলাম। এ নিয়ে আমরা কর্মসূচিও পালন করেছি। কর্মসূচি চলাকালেই প্রতিকৃতিটি উন্মোচণ করা হয়েছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ সে সময়ের মধ্যে প্রতিকৃতিটি অপসারণ করেননি। তাই নতুন কর্মসূচি দিতে বাধ্য হয়েছি। নতুন কর্মসূচিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষক মঙ্গলবার থেকে তিনদিন শ্রেণীকক্ষে কোনো রকম পাঠদান করবেন না।
গত বছরের ২২ নবেম্বর কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারায় এক বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়ে অতিরিক্ত মদপান করে এ কে এম আহসান উল্লাহ ভূঁইয়া মেহেদী মারা যান। তিনি কুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের ছাত্র ও কুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। তারই স্মৃতি রক্ষার জন্য সম্পূর্ণ বেআইনী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালার বাইরে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিশালাকৃতির এক প্রতিকৃতি স্থাপন করা হয়। যা গত বুধবার খুলনা সিটি মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক আনুষ্ঠানিক উন্মোচণ করেন।
মদপান করে যে শিক্ষার্থী মারা গেছে তার স্মৃতি রক্ষার নামে ক্যাম্পাসে চলতি বছর অক্টোবর মাসের শেষদিকে ক্যাম্পাসের খান জাহান আলী হলের সামনে তার একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয়। ফলকটি স্থাপনের পর থেকে কুয়েটের শিক্ষকরা প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠেন।

Wednesday, 23 November 2011

আত্মীয় রাহুগ্রাসে পিএসসি


আসাদুজ্জামান সাগর

ক্ষমতাসীনদের আত্মীয়কুলের রাহুগ্রাসে বন্দি এখন সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। প্রতিষ্ঠানটিতে চলছে ব্যাপক আত্মীয়করণ। বড় পদ, ছোট পদ—সব ক্ষেত্রেই স্বজনদের ছড়াছড়ি। প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, উপদেষ্টা ও এমপিসহ সরকারি দলের প্রভাবশালীদের আত্মীয় এবং অনুগতরা ছাড়া এ সংস্থায় এখন অন্য কারও ঠাঁই নেই। কমিশনে বর্তমানে ১৪ সদস্যের ১৩ জনই দলীয় অনুগত ও প্রভাবশালীদের আত্মীয়। সরাসরি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িত ও জনতা মঞ্চের রূপকারও আছেন কয়েকজন। পিএসসির সদস্য হয়েও সর্বেসর্বার আসনে আছেন আওয়ামী যুবলীগের বর্তমান কমিটির আন্তর্জাতিক সম্পাদক ড. এমরান কবির চৌধুরী। তত্ত্বাবধায়ক সময়ে নিয়োগ পাওয়া চেয়ারম্যানসহ সরকার সমর্থক বাদে অন্যরা প্রচণ্ড চাপ এবং কোণঠাসা হয়ে আছেন। দাবড়ে বেড়াচ্ছেন সরকার সমর্থকরা।
সংবিধানের ১৩৭ থেকে ১৩৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নিয়োগ রাষ্ট্রপতি দিলেও তাতে অনানুষ্ঠানিক নির্দেশনা আসে সরকারের নির্বাহী বিভাগ ও সরকারি দল থেকেই। নিয়োগের পর তাদের নিয়ন্ত্রণ করা হয় অদৃশ্য কোনো শক্তিবলয় থেকেই। অথচ হাইকোর্টের রুলিং অনুযায়ী এসব ব্যক্তির কোনো নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ নেই।
প্রতিষ্ঠানটির এমন দুরবস্থায় চরম হতাশা ব্যক্ত করেছেন বিজ্ঞজনরা। বিশিষ্ট সমাজচিন্তক, অর্থনীতিবিদ ও গবেষক সাবেক কেবিনেট সচিব ড. আকবর আলি খান বলেছেন, পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সুনাম ছিল তা আমি কখনোই শুনিনি। কমিশনে দলীয় ও আত্মীয়করণ, সেই ঊনবিংশ শতাব্দীর পরীক্ষা পদ্ধতি, ৪০ বছর আগের কারিকুলাম, চাকরির নিয়োগ দুর্নীতি প্রশাসনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পিএসসিতে আগের সরকারগুলোও দলীয়করণ করেছে। তবে বর্তমান সরকার যেভাবে একে দলীয়করণ ও আত্মীয়করণ করছে, তাকে নগ্নই বলা যায়। তিনি বলেন, কমিশনের সদস্যদের নিয়োগের যোগ্যতা, দক্ষতা, নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতার কোনো মাপকাঠি সংবিধানে নেই। সরকার ইচ্ছা করলেই নিয়ম ও আইন করে দিতে পারে; কিন্তু কোনো সরকারই তা করেনি।
কে কার আত্মীয় এবং দলীয় : পিএসসিতে পূর্ণ প্যানেলের ১৫ সদস্যের মধ্যে বর্তমানে ১৪ জন রয়েছেন। সংশ্লিষ্ট পিএসসি সূত্র এবং অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এসব সদস্যের মধ্যে ১৩ জনই আত্মীয় ও দলীয় অনুগত। সদস্যের জ্যেষ্ঠতার দিক থেকে ষষ্ঠ অবস্থানে রয়েছেন অধ্যাপক রাশিদা বেগম। তিনি স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানকের বড় বোন। ২০০৯ সালের ২৩ মার্চ তিনি পিএসসিতে যোগদান করেন। এর আগে তিনি গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন।
মোহাম্মদ হোসেন সেরনিয়াবাত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য ও সাবেক চিফ হুইপ আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর চাচাতো ভাই। আর আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ হচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই। ২০০৯ সালের ৯ এপ্রিল সেরনিয়াবাত পিএসসিতে যোগদান করেন। এর আগে তিনি প্রশাসনের ভুতাপেক্ষ যুগ্ম-সচিব ছিলেন। মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান ক্রয়সংক্রান্ত দুর্নীতি মামলার আসামি ছিলেন সেরনিয়াবাত। ২০০১ সালে দুর্নীতি দমন ব্যুরো এ মামলা করেছিল। বর্তমান সরকারের সময় তিনি সে মামলা থেকে খালাস পান।
অধ্যাপক এমরান কবির চৌধুরী যুবলীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক। ২০০৯ সালের ১৫ এপ্রিল তিনি যোগদান করেন। এর আগে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। নিয়োগ পাওয়ার পর তিনি বিসিএস পরীক্ষা ও নিয়োগ দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। টাকা নিয়ে চাকরি না দেয়ার অভিযোগে সম্প্রতি তার বাসায় হামলাও করেছিল ছাত্রলীগ।
পিএসসির আরেক সদস্য এ টি আহমেদুল হক চৌধুরী। কথিত আছে, তিনি ১৯৯৬ সালে সচিবালয়ের সামনে জনতার মঞ্চের অন্যতম রূপকার ছিলেন। ২০০৯ সালের ২৩ জুন যোগদান করেন। এর আগে তিনি অতিরিক্ত আইজিপি ছিলেন। ২০১০ সালের এপ্রিল মাসে পিএসসির চেয়ারম্যান ড. সা’দত হোসাইনকে পদ থেকে সরিয়ে দিতে তার নেতৃত্বে ষড়যন্ত্র হয়েছিল। তিনি এজন্য রাষ্ট্রপতির কাছে ‘কর্ম কমিশনে স্থবিরতা’ শীর্ষক চিঠি দিয়েছিলেন।
সৈয়দ হাসিনুর রহমান সাবেক প্রভাবশালী আমলা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের আপন ভাগ্নে। ২০০৯ সালের ২৯ জুলাই যোগদান করেন। এর আগে তিনি অতিরিক্ত সচিব ছিলেন।
ইকরাম আহমেদ সংরক্ষিত মহিলা আসনে আওয়ামী লীগ এমপি তারানা হালিমের বোনজামাই। ২০০৯ সালের ২৯ জুলাই তিনি যোগদান করেন। এর আগে তিনি অতিরিক্ত সচিব ছিলেন।
অধ্যাপক ডা. ফরিদা আদিব খানম আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরের আপন ভাগ্নি। তিনিও ২০০৯ সালের ২৯ জুলাই যোগদান করেন।
আওয়ামী লীগের অনুগত আরেক পিএসসি সদস্য মুহম্মদ লিয়াকত আলী খান। কথিত আছে, তিনি ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগ এবং জনতার মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ২০০৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর যোগদান করেন। এর আগে তিনি কারা মহাপরিদর্শক ছিলেন।
মো. ওয়াজেদ আলী খান প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ আত্মীয় বলে পরিচিত। ২০১০ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর তিনি যোগদান করেন। এর আগে তিনি অতিরিক্ত সচিব ছিলেন।
ড. ফখরুদ্দীন-মইন উ আহমেদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় নিয়োগ পাওয়া বাকিদের ব্যাপারেও দলীয় ও আত্মীয়করণের অভিযোগ রয়েছে। মো. নুরুন নবী আওয়ামী লীগের অনুগত এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল বলে পরিচিতি রয়েছে। অধ্যাপক সুরাইয়া বেগম পিএসসি চেয়ারম্যান ড. সা’দত হোসাইনের কাছের লোক বলে ওই প্রতিষ্ঠানে পরিচিতি আছে। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবিদুর রেজা খান সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদের ঘনিষ্ঠ। এহসান শামীম পিএসসি চেয়ারম্যান ড. সা’দত হোসাইনের দূরসম্পর্কীয় আত্মীয় বলে পরিচিত। এছাড়া কমিশনের সচিব চৌধুরী মো. বাবুল হাসান সরকারের অনুগত হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। জানা যায়, গোপালগঞ্জ কোটায় তিনি কমিশনের সচিব হন।
কোণঠাসা বর্তমান চেয়ারম্যান ও তার অনুগতরা : আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর নানা কারণে কোণঠাসা বর্তমান চেয়ারম্যান ও তার অনুগতরা। দলীয় নিয়োগ, ২০০ নম্বরের ভাইভা পরীক্ষা, কোটা পদ্ধতি সংস্কার—এসব বিষয়ে সরকার এবং কমিশনের মধ্যে দ্বিমত হয়। পরীক্ষা, প্রশ্ন পদ্ধতি, খাতা মূল্যায়ন, মান উন্নয়নে কমিশনের উদ্যোগের বিরোধিতা করছে সরকার অনুগত সদস্যরা। এছাড়া সরকার সমর্থিত সদস্যদের বিরুদ্ধে পারস্পরিক যোগসাজশে বিসিএস ভাইভা বোর্ডে দলীয় অনুগতদের কিংবা লেনদেনের বিনিময়ে বেশি নম্বর দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। আর এসব কারণে চেয়ারম্যান সা’দত হোসাইন তাদের জন্য কাঁটা হয়ে দাঁড়ান। তাকে সরিয়ে দিতে একাধিকবার ষড়যন্ত্র করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ২০১০ সালের এপ্রিল মাসে চেয়ারম্যানকে সরিয়ে দিতে এ টি আহমেদুল হক চৌধুরী রাষ্ট্রপতির কাছে ‘কর্ম কমিশনে স্থবিরতা’ শীর্ষক চিঠি দিয়েছিলেন।
এছাড়া কমিশনের সচিব চৌধুরী মো. বাবুল হাসান একটি প্রভাব বলয় তৈরি করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। কমিশন একটি স্বতন্ত্র সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও তিনি সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নে উঠেপড়ে লেগেছেন। কমিশনের মান উন্নয়নে বিভিন্ন উদ্যোগ নিলেও তাতে বাধা সৃষ্টি করছেন তিনি।
সরকার সমর্থকদের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে একটি বাস্তব কেস স্টাডি হয়। সূত্র জানায়, সম্প্রতি ৩০তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফলাফলে ২ হাজার ৩৬৭ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়। এর মধ্যে জেনারেল ক্যাডারে এক প্রার্থী খাদ্য ক্যাডার পেয়েছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সূত্র জানায়, ওই প্রার্থী লিখিত পরীক্ষার ফলাফলে ৬৮৫ নম্বর অবস্থানে ছিলেন। এ টি আহমেদুল হক চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত ভাইভা বোর্ডে তাকে ২০০ নম্বরের মধ্যে ১৭৮ নম্বর দেয়া হয়। এত বেশি নম্বর দেয়ায় ওই প্রার্থী মেধাতালিকায় এগিয়ে গিয়ে খাদ্য ক্যাডার পেয়েছেন। অন্যদিকে ভিন্নমতের প্রার্থী অনুমান করতে পারলে তাদের নম্বর কমিয়ে দেয়া এবং মানসিক হেনস্তার অভিযোগ ওঠে। এছাড়া সম্প্রতি প্রশ্নপত্র এবং খাতা মূল্যায়নের মান উন্নত করতে কমিশন চেয়ারম্যান উদ্যোগ নিলেও তা নিয়ে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। সূত্র জানায়, সদস্য মোহাম্মদ হোসেন সেরনিয়াবাত এর বিরোধিতা করে বিভিন্ন যুক্তি উপস্থাপন করছেন।
নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ নিয়ে দৌড়ঝাঁপ : কে হচ্ছেন পিএসসির নতুন চেয়ারম্যান, তা এখনও স্পষ্ট না হলেও সরকারের পছন্দের ব্যক্তি যে ওই পদে আসছেন তাতে সন্দেহ নেই। গুঞ্জন রয়েছে, সদ্যবিদায়ী কেবিনেট সচিব আবদুল আজিজকে পিএসসি চেয়ারম্যান করা হতে পারে। দৌড়ে পিছিয়ে থাকলেও পিএসসি’র সদস্য মোহাম্মদ সেরনিয়াবাত ওই পদে বসতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন বলে জানা গেছে। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভিসি অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশীদ, ঢাবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন, ঢাবি সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামানের নামও শোনা যাচ্ছে।
নামেমাত্র সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান : ১৯৭২ সালে গঠিত পিএসসি একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। সংবিধানের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে কর্ম কমিশনের কথা বলা হয়েছে। ১৩৭ থেকে ১৪০ অনুচ্ছেদে পিএসসি’র গঠন, চেয়ারম্যান ও সদস্য নিয়োগ, পদের মেয়াদ এবং কমিশনের দায়িত্ব বর্ণিত আছে। ১৩৮(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়, ‘প্রত্যেক সরকারি কর্ম কমিশনের সভাপতি ও অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হইবেন।’ ১৩৮(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়, ‘সংসদ কর্তৃক প্রণীত যে কোন আইন-সাপেক্ষে কোন সরকারি কর্মকমিশনের সভাপতি ও অন্যান্য সদস্যের কর্মের শর্তাবলী রাষ্ট্রপতির আদেশের দ্বারা যেরূপ নির্ধারণ করিবেন, সেইরূপ হইবে। এছাড়া ১৩৯ (১), (২), (৩) ও (৪) অনুচ্ছেদে কর্মকমিশনের সভাপতি বা অন্য কোন সদস্য তাহার দায়িত্ব গ্রহণের বয়স, মেয়াদ, অপসারণ সম্পর্কে বলা হয়েছে। ১৪০(১) অনুচ্ছেদে কমিশনের দায়িত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘১৪৭ অনুচ্ছেদে কমিশনের সভাপতি ও সদস্যদের পারিশ্রমিক, বিশেষ অধিকার ও কর্মের অন্যান্য শর্তের এমন কোন তারতম্য করা যাবে না যা তাদের পক্ষে অসুবিধাজনক হতে পারে। ১৪৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তারা শপথ গ্রহণের মাধ্যমে দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হন। এছাড়া হাইকোর্টের রুলিং অনুযায়ী এসব ব্যক্তির কোন নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ নেই।’
সংবিধান এই কমিশনকে স্বতন্ত্র সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা দিলেও বাস্তবে মর্যাদা অনেক নিচে। কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নিয়োগে সততা, নিরপেক্ষতা, স্বচ্ছতা ও যোগ্যতার মাপকাঠি কী হবে, সে সম্পর্কে সংবিধানে কিছুই বলা হয়নি। সংবিধানে সভাপতি ও সদস্যদের পারিশ্রমিক, বিশেষ অধিকার ও কর্মের অন্যান্য শর্তের এমন কোনো তারতম্য করা যাবে না—বলা হলেও তার কোনো বাস্তবায়ন নেই। মর্যাদার দিক থেকে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশন, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে (বিমক) পিএসসি’র চেয়ে উচ্চমর্যাদা দেয়া হয়েছে।
কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্য রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত করেন—সংবিধানে এমন কথা বলা হলেও বাস্তবে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রণালয়ের পরামর্শেই নিয়োগ হয়ে থাকে। কমিশনের সদস্য নিয়োগে কোনো নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ নেই বলা হলেও বাস্তবে তার মিল নেই। সরকারের নির্বাহী বিভাগের মন্ত্রী, এমপি, উপদেষ্টা, সচিব কিংবা দলীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরাই নিয়োগে প্রভাব বিস্তার ও নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন।
এসব বিষয়ে ড. আকবর আলি খান আমার দেশ-কে বলেন, কমিশনের সদস্যদের নিয়োগের যোগ্যতা, দক্ষতা, নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতার কোনো মাপকাঠি সংবিধানে নেই। সংবিধানের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের ১৩৭, ১৩৮ এবং ১৩৯ অনুচ্ছেদে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নিয়োগ এবং বয়সের কথা বলা হলেও নিয়োগ মাপকাঠির বিস্তারিত কিছু নেই। কমিশন প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত কোনো সরকারই তা করেনি। অথচ ইচ্ছা করলেই সরকারের পক্ষে এটা করা সম্ভব এবং এতে প্রতিষ্ঠানটির সুনাম ও মর্যাদাও প্রতিষ্ঠা হবে।
চেয়ারম্যানের বক্তব্য : পিএসসি’র চেয়ারম্যান ড. সা’দত হোসাইন বলেন, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হলেও বাস্তবে এটি একটি ন্যারো-বেজড লো-প্রফাইলের প্রতিষ্ঠান। আমাদের চেয়ে অন্য অনেক সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা বেশি। এখানে নিয়োগের কোনো মাপকাঠি না থাকায় রাস্তা থেকে একজনকে ধরে নিয়ে বসালেও তা আইনবহির্ভূত হয় না। তিনি বলেন, আমাদের সদস্যরা নতুন স্কেলে বেতন পর্যন্ত পাচ্ছেন না।
পিএসসিতে দলীয় সদস্য নিয়োগ সম্পর্কে তিনি বলেন, এটি আমার এখতিয়ারবহির্ভূত। পিএসসি কোনো সদস্যকে নিয়োগ দেয় না। সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ।

ক্ষমতাসীনদের কোন্দলে বাড়ছে খুন



নাছির উদ্দিন শোয়েব
চাঞ্চল্যকর খুনের আসামিকেও গ্রেফতার করা হচ্ছে না। ঘুরে বেড়াচ্ছে পুলিশের নাকের ডগায়। এমনকি উল্টো বাদীপক্ষকেও হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। বাড়িঘরে হামলাও চালানো হচ্ছে। বাদী ও ভুক্তভোগীরা মামলা করেও পড়ছেন বিপাকে। মামলার এজাহারভুক্ত আসামি হলেও এসব আসামিকে কেন গ্রেফতার করা হচ্ছে না? পুলিশ নাগালে পেয়েও কেন ধরছে না? এসব প্রশ্নের জবাবে পুলিশেরই ঊর্ধ্বতন কেউ কেউ বলছেন, যারা আসামি তারা অত্যন্ত ক্ষমতাশালী। দলের লোক খুন হলেও একই দলের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থাকায় চিহ্নিত আসামিদের গ্রেফতার করা যাচ্ছে না। এক্ষেত্রে পুলিশ অনেকটা নিরুপায় বলেও মন্তব্য করেছেন একাধিক কর্মকর্তা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত ১১ দিনেও গ্রেফতার হয়নি নরসিংদীর জনপ্রিয় মেয়র লোকমান হোসেন হত্যার আসামিরা। এ ঘটনায় ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন রাজুর ভাইসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীসহ কয়েকজনকে আসামি করে থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন লোকমানের ভাই। কিন্তু আসামিরা গ্রেফতার তো হয়ইনি; বরং লোকমানের বাড়িতে পুলিশের উপস্থিতিতেই হামলা ও বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে তারা। পরিবারটি এখন চরম নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েছে। কিন্তু এ ঘটনায় কোনো সংশ্লিষ্টতা না থাকলেও বিএনপি নেতা খায়রুল কবির খোকনকে তাত্ক্ষণিকভাবে গ্রেফতার করে পুলিশ। অথচ বাদীপক্ষ মামলার এজাহারেও তার নাম উল্লেখ করেনি। এমনকি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে খোকনের জড়িত থাকার ব্যাপারে কোনো মৌখিক অভিযোগও করা হয়নি। পুলিশ কোনো কারণ ছাড়াই তাকে গ্রেফতার করে রিমান্ডের জন্য আবেদন করে আদালতে। আদালত তাকে জামিন দিলেও ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করা পুলিশ অন্য একটি মামলায় তাকে আটক দেখিয়ে হয়রানি করছে বলে খোকনের পরিবার অভিযোগ করেছে। প্রকৃত আসামিদের গ্রেফতার না করে ভিন্নমতের নেতাদের হয়রানি করে খুনিদের উত্সাহ বাড়িয়ে দিয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। অত্যুত্সাহে হত্যাকারী চক্র লোকমানের বাড়িতে হামলা-বোমাবাজি করছে মহানন্দে। অভিযোগ আছে, ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের হাতে দলীয় লোক খুন হলেও পুলিশ এসব হত্যা মামলা আগ্রহ নিয়ে তদন্ত করছে না। আসামিরা দলীয় লোক হওয়ায় পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে না। খুন করেও পার পেয়ে যাচ্ছে তারা।
প্রসঙ্গত, গত ৩১ অক্টোবর রাতে নরসিংদীর আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে দুর্বৃত্তরা গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করে জনপ্রিয় পৌর মেয়র লোকমান হোসেনকে। সন্ধ্যার পরে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে বসে মিটিং করার সময় সন্ত্রাসীরা সেখানে ঢুকে লোকমান হোসেনকে লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি চালায়। এতে তিনি গুরুতর আহত হলে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হয়। সেখানে তিনি মারা যান।
মানবাধিকার সংস্থা অধিকার-এর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের ৩৪ মাসে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে আওয়ামী লীগের ৯৪ জন নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন। এ সময় আহত হয়েছেন আরও প্রায় ১৫ হাজার নেতাকর্মী। অনুসন্ধানে দেখা গেছে আধিপত্য বিস্তার, টেন্ডারবাজি, ভাগ-বাটোয়ারা ও ক্ষমতার দ্বন্দ্বের জেরে এসব হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। এসব হত্যাকাণ্ডের কোনোটিরই কিনারা হয়নি। বেশিরভাগ আসামিই আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের লোক। তাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গা বাঁচিয়ে চলছে। আলোচিত হত্যা মামলা হলেও এ ধরনের বহু মামলার তদন্ত ঝুলে আছে। দু-একটি ছাড়া বেশিরভাগ মামলার বাদীপক্ষও সোচ্চার না থাকায় মামলাগুলো হিমাগারে পড়ে আছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন প্রায় সময়ই বলে থাকেন, ‘সন্ত্রাসী সে যে দলেরই হোক, তাকে ছাড় দেয়া হবে না’, কিন্তু নিজের দলের লোকের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হচ্ছে। এমনকি লোকমান হোসেন হত্যার পরও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, দ্রুত আসামিদের গ্রেফতার করা হবে। মন্ত্রীর আস্ফাালন কোনো কাজে আসছে না। জিডিতে তার ‘নির্দেশনা’র হম্বিতম্বি ফলাও করে দেখানো হলেও কেউ তা মানছে না।
অধিকারের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে গত অক্টোবর পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর অভ্যন্তরীণ কোন্দলে কমপক্ষে ৯৪ জন নিহত হয়েছে, আহত কমপক্ষে ১৫ হাজার। কোন্দলে গত বছর মারা গেছেন ৫২ জন, আহত হয়েছেন ৮ হাজার ৫০০ জন। এর আগের বছর কোন্দলে আওয়ামী লীগের ৩৮ জন খুন হয়েছেন। চলতি বছর জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ সংঘাতে নিহত হয়েছেন ১৬ জন। আহত হয়েছেন তিন হাজার ২০৮ জন।
তবে থেমে নেই ক্ষমতাসীনদের অভ্যন্তরীণ সংঘাত-সংঘর্ষ। চলতি মাসেই নিহত হলেন দুই জনপ্রতিনিধি। এ হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ছে। ভাংচুর করা হয়েছে যানবাহন এবং মানুষের ঘরবড়ি। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, মাদক ব্যবসা, এলাকার নিয়ন্ত্রণ, আধিপত্য বিস্তার, স্থানীয় নির্বাচন, ব্যক্তিগত ও দলীয় রেষারেষির কারণে এসব খুনের ঘটনা ঘটে।
গত ১৪ জানুয়ারি আগারগাঁওয়ে ৪১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফজলুল হক খুন হন। এ ঘটনার এক সপ্তাহ আগে দুর্বৃত্তদের গুলিতে আহত হন একই ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগের সভাপতি হাজি নূর মোহাম্মদ। তিনি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর আত্মীয়স্বজনরা অভিযোগ করেছিলেন, অভ্যন্তরীণ বিরোধের কারণে খুন হয়েছেন ফজলুল হক। নূর মোহাম্মদকে গুলি করার ঘটনায় ফজলুল হক গ্রুপের হাত রয়েছে মনে করে দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধ চরমে ওঠে। প্রতিশোধ নিতে গিয়েই ফজলুকে হত্যা করা হয়।
গত বছর ৭ অক্টোবর রাজধানীর মগবাজারে টেন্ডার বিরোধে ছাত্রলীগ ক্যাডারদের হামলায় খুন হয় যুবলীগ নেতা ইউসুফ আলী সরদার। এর আগে সংসদ ভবন এলাকায় ভোলা-৩ আসনের এমপি নুরুন্নবী চৌধুরী শাওনের পিস্তলের গুলিতে খুন হন যুবলীগ নেতা ইব্রাহীম আহমেদ। এ ঘটনার এখন পর্যন্ত কোনো কিনারা হয়নি। এ মামলায়, মাজহারুল ইসলাম মিঠু, গোলাম মোস্তফা শিমুল ও শাওনের গানম্যান দেলোয়ার হোসেন ও গাড়িচালক কামাল হোসেন কালাকে গ্রেফতার করা হলেও একজন ছাড়া বাকি আসামিরা বর্তমানে জামিনে মুক্ত।
গত বছর ১২ ফেব্রুয়ারি রাতে ক্যান্টনমেন্ট থানা ছাত্রলীগের সভাপতি এবিএম ফারুক হোসেন খুন হন। আত্মীয়স্বজনরা অভিযোগ করেন, ছাত্রলীগের প্রতিপক্ষের একটি গ্রুপ ফারুককে গুলি করেছে। এলাকায় মাদক ব্যবসা নিয়ে বিরোধে এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। কিন্তু এ হত্যা মামলায় দলীয় কোনো ক্যাডার গ্রেফতার হয়নি। একই বছরের ২৬ জুলাই চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে রাজধানীর কাফরুলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মাহবুব ও তার দলবল ১৪ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের নেতা গিয়াস উদ্দিন গেসুকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। এ ঘটনায় পুলিশ মাহবুবকে গ্রেফতার করেছিল। পরে সে জামিনে বেরিয়ে আসে। অভিযোগ রয়েছে, চাঁদাবাজির ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে গেসুকে খুন করা হয়েছিল। মোহাম্মদপুর এলাকায় ক্যাবল ব্যবসার নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে পিটিয়ে হত্যা করা হয় থানা ছাত্র লীগের সহ-সভাপতি জামাল উদ্দিন ওরফে কুতু বাবুকে। মোহাম্মদপুরের মাদক ব্যবসা, ডিশ লাইনের ব্যবসা, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গ্রুপের সঙ্গে বিরোধের জের ধরে ক্ষমতাসীন দলের প্রতিপক্ষের ক্যাডাররা কুতুকে হত্যা করেছিল বলে ওই সময় কুতুর স্বজনরা অভিযোগ করেন। এছাড়া ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফজলে রাব্বি হলে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। এতে আবুল কালাম আসাদ নামে এক ছাত্রলীগ নেতা নিহত হয়। নিহত আসাদ ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের একাংশের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ওই সংঘর্ষে আহত হয়েছিল প্রায় ৫০ জন। এ ঘটনায়ও প্রকৃত খুনি গ্রেফতার হয়নি।

Monday, 31 October 2011

ভারতের ট্রানজিট ফি নিয়ে দীপু মনির মিথ্যাচার : কোনো ধরনের ফি না দিয়েই ট্রানজিট নিচ্ছে ভারত বিদ্যুেকন্দ্রের চুক্তির আড়ালে পণ্য পরিবহন চলছে বাংলাদেশী ব্যবহারকারীদের সমান ঘাট ফি দিচ্ছে



বশীর আহমেদ

ট্রানজিট ও ট্রানশিপমেন্টের চার্জ বা ফি নিয়ে রীতিমত মিথ্যাচার করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি। তিনি বলেছেন, পরীক্ষামূলক ট্রানজিট ও ট্রানশিপমেন্টের জন্য প্রযোজ্য সব ধরনের চার্জ আদায় করা হচ্ছে। আমার দেশ-এর পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট দফতরের সঙ্গে যোগাযোগ ও অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যে দেখা যাচ্ছে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী অসত্য বক্তব্য দিয়েছেন। আসলে ট্রানজিটের জন্য কোনো চার্জ বা ফি আদায় করা হচ্ছে না। শুধু ল্যান্ডিং ও শিপিং চার্জ হিসেবে টনপ্রতি ৩০ টাকা নেয়া হচ্ছে। এটা বাংলাদেশী পণ্যের জন্য নির্ধারিত। গত মঙ্গলবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, পরীক্ষামূলক ট্রানজিট এবং ট্রানশিপমেন্টের মাধ্যমে যে ভারতীয় পণ্য আশুগঞ্জ বন্দর হয়ে সড়কপথে আখাউড়া সীমান্ত দিয়ে আগরতলা যাচ্ছে, সেখানে প্রযোজ্য সব চার্জ আদায় করা হচ্ছে।
এ ব্যাপারে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা রাজস্ব কর্মকর্তা মো. আবুল হোসাইন আমাদের আশুগঞ্জ প্রতিনিধি সাদেকুল ইসলাম সাচ্চুকে জানান, পরীক্ষামূলক এই ট্রানজিটের জন্য কোনো ফি বা শুল্ক আদায় করা হচ্ছে না। কারণ ত্রিপুরার পালাটানা বিদ্যুেকন্দ্রের জন্য ওডিসি পরিবহনের চুক্তির আওতায় এই পরীক্ষামূলক ট্রানজিট ও ট্রানশিপমেন্ট চলছে।
ট্রানজিটের ফি বা চার্জ নিয়ে এ অসত্য বক্তব্য সম্পর্কে জানতে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সরাসরি কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে এ ব্যাপারে মন্ত্রীর জনসংযোগ কর্মকর্তা আমার দেশকে বলেন, নৌ মন্ত্রণালয় থেকে যে তথ্য জানানো হয়েছে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেটাই বলেছেন। ট্রানজিটের ফি, সার্ভিস চার্জ, শুল্কসহ যাবতীয় বিষয় চূড়ান্ত করার দায়িত্ব জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের। এ ব্যাপারে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছ থেকে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দেয়া বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে একেক সময় একেক ধরনের বক্তব্য দেয়া হয়েছে। সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তি এবং মন্ত্রীরা বিভিন্ন সময় অসত্য এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়েছেন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় বহুল আলোচিত তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি না হওয়ায় ভারতের সঙ্গে ট্রানজিট চুক্তি হয়নি বলে জানান সরকারের প্রভাবশালী নীতিনির্ধারক কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী।
মতিয়া চৌধুরীর এ বক্তব্যের পর তিন সপ্তাহ যেতে না যেতেই হঠাত্ কয়েকদিন আগে পরীক্ষামূলক ট্রানজিটের নামে ভারতীয় পণ্য নদী ও সড়কপথে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে পরিবহন শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে তিনটি ভারতীয় পণ্যবাহী জাহাজ আশুগঞ্জ বন্দরে এসে ভিড়েছে। এসব জাহাজ থেকে পণ্য খালাসেরও কাজ চলছে এবং খালাস হওয়া পণ্য সড়কপথে আখাউড়া সীমান্ত দিয়ে আগরতলা পৌঁছানো হচ্ছে। কোনো ধরনের ফি, শুল্ক বা সার্ভিস চার্জ ছাড়া কীভাবে ভারতীয় পণ্য পরিবহন হচ্ছে, সে ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে কোনো বক্তব্য দেয়া হয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ট্রানজিটের জন্য একটি নীতিমালা তৈরি করা হচ্ছে, যেখানে ট্রানজিট ফিসহ যাবতীয় বিষয় সুনির্দিষ্ট করা হবে। সেই নীতিমালা তৈরির আগেই পরীক্ষামূলক ট্রানজিট কীভাবে শুরু হতে পারে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
গত মঙ্গলবারের সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছিলেন, পরীক্ষামূলকভাবে ভারতীয় পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য সব ধরনের চার্জ আদায় করা হচ্ছে। তবে কোন খাত থেকে কী পরিমাণ চার্জ আদায় করা হচ্ছে, সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য দিতে পারেননি তিনি।
এছাড়া বাংলাদেশী জাহাজগুলো পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে সরকারের দেয়া নানা সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে থাকে। বিশেষ করে জ্বালানি তেলের ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা ভর্তুকি দেয়া হয়। ভারতীয় পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে এ সুবিধা দেয়া হচ্ছে কি না, সে ব্যাপারেও কিছু জানাতে পারেননি পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এ বক্তব্যের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য আমার দেশ-এর পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দফতরে যোগাযোগ করা হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা রাজস্ব কর্মকর্তা মো. আবুল হোসাইন এ ব্যাপারে বলেন, ট্রানজিটের পরীক্ষামূলক চালানের ভারতীয় পণ্যবাহী তিনটি জাহাজের কাগজপত্র আমাদের কাছে এসেছে। এই পণ্য পরিবহনে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহারের জন্য কোনো ফি বা চার্জ নেয়া হচ্ছে না। পালাটানা বিদ্যুেকন্দ্রের জন্য ভারী যন্ত্রপাতি বা ওডিসি পরিবহনের জন্য যে চুক্তি হয়েছিল, তার আওতায় এই পরীক্ষামূলক ট্রানজিট। এজন্য এই পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে কোনো ফি আদায় করা হচ্ছে না। তবে শুধু এমভি নীলকণ্ঠ জাহাজের ক্ষেত্রে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের গত ২৫ আগস্টের আদেশ মোতাবেক শুল্কের সমপরিমাণ টাকার ব্যাংক গ্যারান্টি বা বিল অব এন্ট্রি নেয়া হচ্ছে।
এই পরীক্ষামূলক ট্রানজিট এবং ট্রানশিপমেন্টের ব্যাপারে বিআইডব্লিউটিএ’র নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমার দেশকে বলেন, আসলে কী হচ্ছে আমরা জানি না।
ফি এবং অন্যান্য চার্জ নির্ধারণের দায়িত্ব এনবিআরের। তারা আমাদের কিছুই জানায়নি। পরীক্ষামূলক ট্রানজিটের জন্যও কী কী চার্জ প্রযোজ্য, তা নির্ধারণ করে এনবিআরের পক্ষ থেকে চিঠি দিয়ে আমাদের জানানোর কথা। কিন্তু এ ব্যাপারে আমাদের কিছুই জানানো হয়নি। এ ব্যাপারে এনবিআর চেয়ারম্যান ড. নাসির উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে চেষ্টা করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি। বারবার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ এবং মেসেজ পাঠিয়েও তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
পরীক্ষামূলক এই ট্রানজিটের আওতায় ভারতীয় পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে শুধু ল্যান্ডিং ও শিপিং চার্জ নেয়া হচ্ছে। এই চার্জ বাংলাদেশী পণ্যের জন্য নির্ধারিত টনপ্রতি মাত্র ৩০ টাকা হারে আদায় করা হচ্ছে। বিআইডব্লিউটিএ’র একজন উপ-পরিচালক (বন্দর) আমার দেশকে এ প্রসঙ্গে বলেন, আসলে কোনো নীতিমালা হয়নি। তাই বিদেশি পণ্যের জন্য চার্জের পরিমাণ কত হবে, তা আমরা জানি না। বাংলাদেশের পণ্যের জন্য যা নির্ধারিত আছে, তা-ই নেয়া হয়। এছাড়া আর কিছু করার নেই। ট্রানজিট নিয়ে সরকার শুরু থেকেই ছল-চাতুরীর আশ্রয় নিয়েছে। প্রথমে বলা হয়েছে, ট্রানজিটের মাধ্যমে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা আসবে। বিভিন্ন সময়ে অসত্য তথ্য দিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়েছে। ড. মনমোহন সিং ঢাকা আসার আগে প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী বলেছিলেন, ট্রানজিটের জন্য কোনো ধরনের চুক্তি বা প্রটোকল সই করার প্রয়োজন নেই। কারণ ১৯৭২ সালেই ট্রানজিট চুক্তি হয়েছে। সেই চুক্তি অনুযায়ীই ভারত ট্রানজিট সুবিধা ব্যবহার করতে পারবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি তখন বলেছিলেন, ট্রানজিটের জন্য একাধিক প্রটোকল সই করতে হবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এখন আবার বলছেন, ১৯৭২ সালেই ভারতকে ট্রানজিট দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান বলেছিলেন, ভারতের কাছে ট্রানজিট ফি চাওয়া অসভ্যতা। সরকার আসলে ভারতকে ফ্রি ট্রানজিট দিতেই যেন তত্পর