Saturday 26 June 2010

যৌন নিপীড়নে অভিযুক্ত শিক্ষক মানবাধিকার কমিশনের সদস্য!

সোলায়মান তুষার: যৌন নিপীড়নের দায়ে বাধ্যতামূলক ছুটিতে থাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষককে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অভিযুক্ত শিক্ষক অধ্যাপক ড. গিয়াস উদ্দিন মোল্লাকে মঙ্গলবার কমিশনের সদস্য নিয়োগ দেয়া হয়। বুধবার তিনি নিয়োগপত্র হাতে পেয়েছেন। তার নিয়োগের খবরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই সমালোচনার ঝড় বইছে। সদ্য নিয়োগ পাওয়া মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমানও আশ্চর্যান্বিত হয়েছেন। একই বিভাগের মাস্টার্সের এক ছাত্রীকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে ৯ই জানুয়ারি ড. মোল্লাকে বিভাগের সব কার্যক্রম থেকে অব্যাহিত এবং বাধ্যতামূলক ছুটি দেয়া হয়। ৮ ও ৯ই জানুয়ারি মানবজমিনসহ বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় এ নিয়ে নানা প্রতিবেদন ছাপা হয়। এর বিরুদ্ধে বিভাগের মাস্টার্সের এক ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, প্রক্টর ড. কে এম সাইফুল ইসলাম খানসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। অভিযোগটি তদন্তাধীন। অবশ্য বিভাগের নেয়া সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন মোল্লা হাইকোর্টে রিট করেন। রিটের শুনানি শেষ হয়নি এখনও। এ অবস্থায় তিনি মানবাধিকার কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠানের সদস্য হিসেবে নিয়োগ পেলেন। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেছেন, এ খবরটি শোনার পর আমার নিজের কাছেই খারাপ লেগেছে। বিতর্কের ঊর্ধ্বে আছে-এমন ব্যক্তিদের নিয়োগ দেয়া উচিত ছিল। নিয়োগ দেয়ার আগে যাচাই-বাছাই করা উচিত ছিল। এ বিষয়ে ড. গিয়াসউদ্দিন মোল্লাকে প্রশ্ন করা হয়, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ থেকে মুক্তি পাননি আপনি। এ অবস্থায় আপনার পক্ষে মানবাধিকার রক্ষায় কতটা ভূমিকা রাখা সম্ভব? উত্তরে তিনি বলেন, এটি সরকারের বিষয়। সরকার আমাকে নিয়োগ দিয়েছে। তিনি আরও বলেন, আমার বিরুদ্ধে নেয়া সিদ্ধান্তটি ’৭৩-এর অধ্যাদেশবিরোধী ছিল। কোন বিভাগ এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। এ সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে আমাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়া হয়নি। ২০০৯ সালের ১৩ই নভেম্বর তার কক্ষে যৌন নিপীড়নের শিকার হন বলে ওই বিভাগের এক ছাত্রী অভিযোগ করেন। ১৯শে নভেম্বর ওই ছাত্রী ও তার মা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক শওকত আরা হোসেনসহ আরও কয়েকজনকে লিখিতভাবে জানান। ১৯৯৯ সালে একই ধরনের অভিযোগে ইউরোপের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিনকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনীর ওপর গবেষণার জন্য জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বঙ্গবন্ধু চেয়ার’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। অধ্যাপক মোল্লাকে বঙ্গবন্ধুর জীবন নিয়ে গবেষণার জন্য ১৯৯৯ সালে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো হয়। কিন্তু যৌন উৎপীড়নের অভিযোগে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। বহিষ্কারের অভিযোগটি অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন মোল্লা এর আগে অস্বীকার করেন।


ছাত্রীর অভিযোগ
অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন মোল্লার বিরুদ্ধে ওই ছাত্রীর লিখিত সে অভিযোগ হুবহু তুলে ধরা হলো-‘আমি (ছাত্রীর নাম সামাজিক নিরাপত্তার স্বার্থে গোপন রাখা হলো) রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের এমএসএস (শেষ পর্ব)-এর একজন নিয়মিত ছাত্রী। ৪০২ নম্বর কোর্স নেয়ার সুবাদে কোর্স শিক্ষক শ্রদ্ধেয় গিয়াসউদ্দিন মোল্লার সাথে নিয়মিত কুশলাদি বিনিময় হতো। ক্লাসে ভাল ৎবংঢ়ড়হংব করার কারণে স্যারের দৃষ্টি আকর্ষণ করি। এতে করে স্যারের পক্ষ থেকেই আমার সাথে যোগাযোগের সূচনা হয়। যোগাযোগের মাত্রা বাড়ে যখন স্যার কোর্সের ১০টি ঃড়ঢ়রপ-এর মধ্যে ১টি ঃড়ঢ়রপ-এর ঢ়ৎবংবহঃধঃরড়হ-এর দায়িত্ব আমাকে দেন।
ঢ়ৎবংবহঃধঃরড়হ তৈরি করার জন্য প্রয়োজনীয় বই পাওয়ার ব্যাপারে তিনি আমাকে আশ্বস্ত করেন এবং তার রুমে গিয়ে বই আনার কথা বলেন। অতঃপর আমি একদিন আমার ঢ়ৎবংবহঃধঃরড়হ সম্পর্কিত বই আনতে স্যারের রুমে যাই। আমাকে দেখে তিনি খুশি হন এবং বিভিন্ন ধরনের আলাপ-আলোচনা করেন। স্যারের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা, যে কোন ব্যাপারে স্যারকে জানানো এবং আমাকে সর্বাত্মকভাবে সাহায্য করার ব্যাপারে তিনি তার আগ্রহ প্রকাশ করেন। আমার ঢ়ৎবংবহঃধঃরড়হ-এর পর থেকে যখনই স্যারের সাথে দেখা হতো তখনই তিনি আমাকে তার রুমে যেতে বলতেন। মাস্টার্সের বিভিন্ন কোর্সের মঁরফবষরহব পাওয়ার জন্য আমি মাঝেমধ্যেই স্যারের রুমে গিয়ে কথা বলতাম। আস্তে আস্তে স্যারের কথার ধরনের পরিবর্তন লক্ষ্য করি। প্রায়ই তিনি গল্পের ছলে বিভিন্ন ধরনের কথা খোলাখুলিভাবে বলে ফেলতেন, যা শুনে আমি কিছুটা বিব্রতবোধ করলেও প্রথম দিকে ব্যাপারগুলোকে স্যারের উদারনৈতিক মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে ধরে নিই। আবার রুম থেকে বেরোনোর সময় আমার শরীরের সাথে স্যার তার নিজের শরীর লাগিয়ে দেয়ার ব্যাপারটাকেও আমি অনিচ্ছাকৃত তুচ্ছ বিষয় ভেবে গুরুত্ব দিইনি। এতে করে স্যার আস্কারা পেয়ে বসেন। এরপর স্যারের রুমে যখনই দেখা হতো তখনই বিভিন্ন আপত্তিকর কথা সরাসরি বলে দিতেন, যা আমি বিভিন্নভাবে পাশ কাটানোর চেষ্টা করতাম। আমি সুন্দরী না হওয়া সত্ত্বেও একদিন তিনি আমার সৌন্দর্যের বিস্তর প্রশংসা করলেন। ভারতীয় দূতাবাসের সড়ারব দেখার দাওয়াতে তিনি আমাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সন্ধ্যায় ছবি শুরু হওয়া এবং বাসায় ফিরতে রাত ১০টা বেজে যাবে বলে আমি অস্বীকৃতি জানালে তিনি তার নিজের গাড়িতে করে আমাকে পৌঁছে দেয়ার কথা বলেন। পরে আমি পারিবারিক অসুবিধা দেখিয়ে ব্যাপারটি সুরাহা করি। ঙপঃড়নবৎ-এর মাঝামাঝি সময় থেকে দেখা হলেই বিভিন্ন ছুতোয় আমার হাতে, পিঠে স্যার হাত দিতো, ব্যাপারটাকে আমি পিতৃস্নেহ হিসেবেই ভেবে নিতাম এবং স্যারকেও তা বোঝানোর চেষ্টা করি। সর্বোপরি স্যারের সঙ্গে দেখা হওয়াটা কিছু বিরক্তিকর মনে হলেও সীমা লঙ্ঘিত হচ্ছে এ রকমটা আমার মনে হচ্ছিল না তখন। যা হোক, ৯ই নভেম্বর আমার ১৬ নম্বর টিউটোরিয়াল গ্রুপের শিক্ষক মামুন স্যার তার টিউটোরিয়াল ক্লাসে আমাকে গধী ডবনবৎ-এর ঞযব চৎড়ঃবংঃধহঃ ঊঃযরপ ধহফ ঃযব ংঢ়রৎরঃ ড়ভ ঈধঢ়রঃধষরংস বইটি পড়ে পরের সপ্তাহে বইটির ওপর আলোচনামূলক কথা বলার কাজ দেন। ক্লাসের পরে লাইব্রেরিতে বইটি খুঁজে পেতে ব্যর্থ হই। এতে কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়ি। ১২ই নভেম্বর মোল্লা স্যারের সাথে দেখা হলে বইটির ব্যাপারে বলি এবং পরামর্শ চাই। তিনি জানালেন, তিনি নিজ কার্ড দিয়ে বইটি তুলে রাখবেন এবং পরদিন ১৩ই নভেম্বর শুক্রবার সাড়ে ৩টার দিকে স্যারের রুমে এসে বইটি নিয়ে যেতে বলেন। আমি ৩টার দিকে কলাভবনে এসে স্যারের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি জানান তিনি পরীক্ষা হলে ডিউটিতে আছেন এবং আমাকে তার রুমের সামনে অপেক্ষা করতে বলেন। সাড়ে ৩টার দিকে তিনি রুমে এসে বসলেন। আমি বইয়ের কথা বলার আগেই তিনি নানা ধরনের কথা বলা শুরু করলেন। আস্তে আস্তে কথার মান নিম্ন থেকে নিম্নতর পর্যায়ে নামতে আরম্ভ করল। তিনি আমাকে এমন সব ব্যক্তিগত কথা জিজ্ঞেস করেন যা নিশ্চিতভাবেই একজন ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের সীমা লঙ্ঘন করে। আমি এরকম চরম বিব্রতকর অবস্থায় চুপ করে থাকি। আমার নীরবতাকে হ্যাঁ বোধক মনে করে তিনি তার কথার মাত্রাকে একদমই অশালীন পর্যায়ে নিয়ে যান। রুম ত্যাগ করার উদ্দেশ্যে তখন হঠাৎ করেই আমি বইটি চাই। তিনি বইটি নিয়ে টেবিল ঘুরে এসে আমার হাতে দেন। আমি বইটি আমার হাতে নেয়ার সাথে সাথেই তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাওয়ার চেষ্টা করেন। আমি নিজেকে কোনভাবে ছাড়িয়ে নিয়ে তৎক্ষণাৎ রুম ত্যাগ করি। একজন পিতৃতুল্য শিক্ষকের কাছ থেকে এমন আচরণ পেয়ে আমি খুবই মর্মাহত। আমি এর উপযুক্ত প্রতিকার কামনা করছি। আমার মনে হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো এমন প্রতিষ্ঠানে এরকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হওয়াটা এর সম্মানকে অক্ষুণ্ন রাখবে।’

http://202.79.16.19/index.php?option=com_content&task=view&id=2895&Itemid=1

Wednesday 23 June 2010

সমাবেশ করে সাংবাদিককে পেটানোর ঘোষণা

আখাউড়া ও সরাইল (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) প্রতিনিধি | তারিখ: ২৪-০৬-২০১০


সমাবেশ করে প্রথম আলোর ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি ওয়ালিদ সিকদারকে মারার হুমকি দেওয়া হয়েছে। সমাবেশ শেষে ‘জেএমবি’ আরাফাতের নেতৃত্বে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের অর্ধশত নেতা-কর্মী ওয়ালিদ সিকদারের বাসায় গিয়ে তাঁকে খুঁজতে থাকেন। ওয়ালিদ তখন বাসায় ছিলেন না। তাঁরা পরে শহরের বিভিন্ন স্থানে তাঁর খোঁজে তল্লাশি চালান।
‘সাংসদের আপত্তিতে অতিথি করায়...’ শিরোনামে গত মঙ্গলবার প্রথম আলোয় প্রকাশিত সংবাদের প্রতিক্রিয়ায় এ ঘটনা ঘটানো হয়। সোমবার সাংসদের উপস্থিতিতে জেলা আইনজীবী সমিতির সম্প্রসারিত ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর ভেঙে ফেলেন ছাত্র ও যুবলীগের নেতা-কর্মীরা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক একান্ত সচিব রবিউল আলম ওবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীকে বিশেষ অতিথি করায় সাংসদ আপত্তি করেন এবং ক্ষুব্ধ হন। পরে নতুন ভিত্তিপ্রস্তর বানানো হয় এবং মঙ্গলবার আইন প্রতিমন্ত্রী ভবনের কাজ উদ্বোধন করেন।
ভিত্তিপ্রস্তর ভাঙার খবর প্রকাশের পর ওই দিনই স্থানীয় সাংসদ ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি লুৎফুল হাই প্রথম আলোর প্রতিনিধিকে ফোন করে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করেন। সাংসদ বলেন, ‘তুই আমার কিছু পাইলেই পত্রিকায় নিউজ করিস। অথচ কয়েক দিন আগে শহরে বিএমএর সাধারণ সম্পাদক ও যুবলীগের সহসভাপতি বাবলুর (আশিকুল আলম) মধ্যে অনেক ঘটনা ঘটছে, পুলিশ এই ঘটনা সামলাতে গুলিবর্ষণ করেছে। এই সব নিউজ তুই পিটা খাওয়ার ভয়ে পত্রিকায় না করে অনলাইনে করেছিস। আর আমার বিরুদ্ধে কিছু হলে পত্রিকায় নিউজ করিস।’ তিনি প্রথম আলোর প্রতিনিধিকে দেখে নেওয়ারও হুমকি দেন। তবে তিনি বা তাঁর পক্ষে কেউ সংবাদের কোনো লিখিত প্রতিবাদ করেননি।
এরপর গতকাল আওয়ামী লীগ এবং ছাত্র ও যুবলীগের নেতা-কর্মীরা মাবববন্ধন করেন, পত্রিকার কপিতে আগুন দেন এবং সমাবেশ করেন। সমাবেশে জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম ফেরদৌস ঘোষণা দেন, ‘রবিনকে (ওয়ালিদ সিকদারের ডাক নাম) যেখানে পাওয়া যাবে, সেখানেই পেটানো হবে।’
জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আমানুল হক ওরফে সেন্টুর সভাপতিত্বে পৌর আধুনিক সুপার মার্কেটের সামনে সমাবেশে জেলা যুবলীগের সভাপতি মাহবুবুল আলম খোকন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রথম আলোকে অবাঞ্ছিত করার হুমকি দেন।
আমানুল হক বলেন, ‘প্রথম আলোয় যে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, তার প্রতিবাদে যে মানববন্ধন হয়েছে, তাতে অন্য বক্তারা সবই বলেছেন। আমিও বলতে চাই, এমন সংবাদ প্রকাশ করলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রথম আলোকে ঢুকতে দেওয়া হবে না।’
এর আগে শহরের তোফায়েল আজম (টিএ রোড) সড়কে ১৭ আগস্ট বোমা হামলা মামলার অন্যতম আসামি শেখ মো. আরাফাত ওরফে জেএমবি আরাফাত, শহরের কান্দিপাড়ার ব্যবসায়ী শাহীন খাঁ হত্যা মামলার আসামি মো. আল-আমিনের নেতৃত্বে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা-কর্মীরা প্রথম আলোর কপিতে আগুন দেন। এ সময় প্রথম আলোর প্রতিনিধির চামড়া তুলে নেওয়া হবে বলে স্লোগান দেওয়া হয়।
জেলা আওয়ামী লীগের বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, ১২ মে প্রথম আলোয় ‘দখলের কবলে মেঘনা’ শিরোনামে একটি সচিত্র সংবাদ প্রকাশিত হয়। এর পর থেকেই সাংসদ লুৎফুল হাই প্রথম আলোর ওপর ক্ষিপ্ত হন। মঙ্গলবার ‘সাংসদের আপত্তিতে অতিথি করায়...’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হলে তিনি প্রথম আলোর প্রতিনিধিকে ফোন করে হুমকি দেন।
সংবাদটি সঠিক ছিল বলে মন্তব্য করে জেলার প্রবীণ আইনজীবী ও আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের সভাপতি হামিদুর রহমান বলেন, ‘বর্তমানে আওয়ামী লীগের যা কর্মকাণ্ড, তাতে আমি যে আওয়ামী লীগের একজন, তা বলতে ইচ্ছে করে না।’ তিনি প্রথম আলোকে সব প্রতিকূলতার মধ্যেও সত্য সংবাদ প্রকাশ করার অনুরোধ করেন।
জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও জেলা জাতীয় পার্টির সহসভাপতি হারুনুর রশিদ খান বলেন, ‘প্রথম আলোয় মঙ্গলবার প্রকাশিত সংবাদটি মার্জিত, বস্তুনিষ্ঠ এবং শতভাগ সত্য ছিল। সোমবার ঘটনা ঘটার পর সাংসদ লুৎফুল হাই সাচ্চুকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “আপনার উপস্থিতিতে এমন ঘটনা কী করে ঘটল?” তিনি এর কোনো উত্তর দেননি।’
সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও জেলা আওয়ামী লীগের পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক মোহাম্মদ নাজমুল হোসেন বলেন, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা-কর্মীরা সাংসদের সামনেই ফলকটি ভাঙেন। এ নিয়ে প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদন নিয়ে ভিন্নমত প্রকাশ করার কোনো সুযোগ নেই। যা ঘটেছে, শত শত আইনজীবীর সামনেই ঘটেছে।
জাতীয় আইনজীবী সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা জাসদের (ইনু) সভাপতি আক্তার হোসেন সাঈদ বলেন, সত্য সংবাদ সবাই মেনে নিতে পারেন না। তাই তাঁরা এসব করছেন।
জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সভাপতি সাবেক পিপি শফিকুল ইসলাম বলেন, শত শত আইনজীবীর সামনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আইনজীবী সমিতির নির্মাণাধীন সম্প্রসারিত ভবনের ভিত্তিপ্রস্তরটি যাঁরা ভেঙেছেন, তাঁরা সাংসদের সঙ্গে এসেছেন, তাঁর সামনেই ভেঙেছেন, তাঁর সঙ্গেই আইনজীবী সমিতিতে বসেছিলেন এবং তাঁর সঙ্গেই আদালত এলাকা ত্যাগ করেন। তিনি বলেন, ‘আশা করি, প্রথম আলো সত্য সংবাদ প্রকাশের পথ থেকে সরে যাবে না।’
গণতান্ত্রিক আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির জেলা সম্পাদক কাজী মাসুদ আহম্মেদ বলেন, ‘ভিত্তিপ্রস্তরটি যাঁরা ভেঙেছেন, তাঁরা লুকিয়ে-ছাপিয়ে ভাঙেননি। আর সংবাদটি বেশ কয়েকটি জাতীয় ও স্থানীয় দৈনিকেও ছাপা হয়েছিল।’
ক্ষোভ ও নিন্দা: জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক জহিরুল হক খান (বীর প্রতীক) প্রথম আলোর প্রতিনিধিকে মারতে খোঁজ করা এবং পত্রিকা পোড়ানোর ঘটনায় নিন্দা জানান। ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেসক্লাবও গত রাতে জরুরি সভা করে নিন্দা জানায়। বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতির ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আহ্বায়ক দীপক চৌধুরী এ ঘটনায় ক্ষোভ ও নিন্দা জানান।

source:http://www.prothom-alo.com/detail/date/2010-06-24/news/73371

Wednesday 16 June 2010

মাহমুদুর রহমানকে নির্যাতন কেন জাতির জন্য অশনি সঙ্কেত

সিরাজুর রহমান

ইংরেজি প্রবাদ হচ্ছে : ‘মর্নিং শোজ দ্য ডে’। বাংলা করলে অর্থ হবে ‘সকাল বেলার চেহারা দেখেই বলে দেয়া যায় দিনটা কেমন হবে’। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি একটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হয় বর্তমান সরকার। তার অল্প কিছু দিনের মধ্যেই এ কলামে আমি হুঁশিয়ারি দিয়েছিলাম : লক্ষণ-আলামত ভালো নয়; নাৎসিদের পন্থায় ডিক্টেটরি ক্ষমতা চিরস্খায়ী করার প্রয়াস চলছে।

তখন থেকেই প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর দলীয়করণ ও আত্তীকরণ শুরু হয়। দক্ষ ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের সরিয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে তুলনামূলক অনভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেয়া হয়­ বহু ক্ষেত্রেই জুনিয়র অফিসারদের পদোন্নতি দিয়ে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কর্মকর্তাও আছেন। কেউই লক্ষ না করে পারেননি যে, এসব পদোন্নতি ও নিয়োগের বেলায় প্রধান মাপকাঠি ছিল সংশ্লিষ্টরা পুরোপুরি আওয়ামী লীগের সমর্থক কি না, তারা এ সরকারকে গদিতে কায়েম রাখার সব রকম চেষ্টা করবেন কি না। সংখ্যালঘুদের বেলায় যে কার্যকারণ ছিল সেটা এই যে, ক্ষমতাশীনদের কেউ কেউ সংখ্যাগুরুর চেয়ে সংখ্যালঘুদের বেশি বিশ্বাস করেন।

প্রশাসন লক্ষ্মী ছেলের মতো বিনা প্রতিবাদে তার নীতি ও নির্দেশ মেনে চলবে নিশ্চিত করার পর সরকার দেশ থেকে রাজনৈতিক বিরোধিতা নির্মূল করার কাজ শুরু করে। বিরোধী নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে, তৃণমূলপর্যায়ের বহু নেতাকর্মীর ভূসম্পত্তি দখল কিংবা ধ্বংস করা হয়েছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি’র বহু স্খানীয় দফতর জ্বালিয়ে দেয়া কিংবা তছনছ করা হয়েছে। বিরোধী দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের ভীতি প্রদর্শন ও আতঙ্কগ্রস্ত করার কোনো চেষ্টারই ত্রুটি রাখা হয়নি। তিন দফার প্রধানমন্ত্রী এবং বর্তমানে বিরোধী দলের নেত্রী খালেদা জিয়াকে তার বাসভবন থেকে উৎখাত করার সিরিজ চেষ্টা চলছে, তার অন্যান্য সম্পত্তি বাবদও হয়রানি চলছে।

একই সাথে খালেদা জিয়া ও তার পুত্রদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা সাজানো হচ্ছে­ যদিও আওয়ামী লীগের লোকদের বিরুদ্ধে ছয় হাজারেরও বেশি দুর্নীতি ও ফৌজদারি মামলা তুলে নেয়া হয়েছে, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ১৫টি দুর্নীতির মামলাও মন্ত্রবলে অদৃশ্য হয়েছে। সাধারণ মানুষেরও বুঝতে বাকি নেই যে, খালেদাকে দেশান্তরে পাঠানো এবং তার ছেলেদের দেশে ফিরতে নিরুৎসাহিত করাই এসব মামলা ও হয়রানির উদ্দেশ্য। কারণও সুস্পষ্ট। শেখ মুজিবের দ্বারা বীরপ্রতীক উপাধিতে ভূষিত মুক্তিযোদ্ধা এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমান, তার পরিবার ও তার স্খাপিত বিএনপি দলকে মহাজোট সরকার গদি স্খায়ী করার পথের প্রধান কাঁটা মনে করে।

ত্রাস সৃষ্টি, ভীতি প্রদর্শন

রাজনৈতিক বিরোধিতা নির্মূল করার অনেকখানি দায়িত্ব ছেড়ে দেয়া হয়েছে ছাত্রলীগ, যুবলীগ এবং আওয়ামী লীগের অন্যান্য অঙ্গসংগঠনের ওপর। তারা গোড়ায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং অন্যত্র সব বিরোধিতা নির্মূল করে এখন নিজেদের মধ্যেকার বিরোধী অংশকে খতম করার কাজে হাত দিয়েছে। সরকারপ্রধান ও তার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিশেষ করে বিদেশীদের দেখানোর জন্য বারবার তাদের ‘হুঁশিয়ারি’ দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তাদের উৎসাহ ও বাহবা দেয়া হচ্ছে বলেই মনে হয়। সাহারা খাতুনের হুঁশিয়ারি গ্রাহ্য করা দূরের কথা প্রধানমন্ত্রীর হুঁশিয়ারিও তারা কর্ণপাত করছে না।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক সদস্য নিহত হয়। ঘটনার পটভূমি সম্বন্ধে কোনো তদন্ত হয়নি বলেই জানি। কিন্তু দেশের যেখানে যেখানে ছাত্রশিবিরের লোকদের পাওয়া গেছে সেখানেই তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে­ যদিও তাদের প্রায় অনেকেই ঘটনার সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্খিত ছিল না। অনেকে আবার রাজশাহী থেকে শত শত কিলোমিটার পর্যন্ত দূরে ছিল। শুধু তা-ই নয়, দেশের সব অঞ্চলে খুঁজে খুঁজে জামায়াতে ইসলামীর বহু নেতাকর্মীকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের কাউকেই বিচারে তোলা হয়নি। শুধু তাদের দলীয়কৃত পুলিশের নির্যাতনের শিকার করা হয়েছে, আটক রেখে রাজনীতির অঙ্গন থেকে তাদের সরিয়ে দেয়া হয়েছে, আর সে সুযোগে বিরোধী দলগুলোর বিরুদ্ধে কুৎসা ছড়ানো হচ্ছে। অন্য দিকে যারা দাঙ্গা করতে গিয়ে একজন সহকর্মীর হত্যার কারণ সৃষ্টি করেছিল তাদের কাউকে গ্রেফতার করার হিম্মত সরকারের হয়নি, কেননা তারা সরকারের ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী। দেশজোড়া ত্রাস সৃষ্টি করে বিরোধীদের হত-মনোবল করার এই হচ্ছে ‘টেকনিক’।

আরেকটা ইংরেজি প্রবাদ হচ্ছে : ‘ব্ল্যাক উইল টেক নো আদার হিউ’ - যার বাংলা করা হয়েছে ‘কয়লা ধুলেও ময়লা ছাড়ে না’। শেখ মুজিব অবশ্যই আদিতে গণতান্ত্রিক নেতা ছিলেন। কিন্তু তার পরিবর্তন প্রকাশ পায় ক্রমে ক্রমে। রক্ষীবাহিনী ৪০ হাজার বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে হত্যা করেছে। দুর্নীতি বিষবাষ্পের মতো দেশকে ছেয়ে ফেলে। প্রশাসনিক ব্যর্থতার কারণে চুয়াত্তরের মনন্তরে ৭০ হাজার মানুষ মারা যায়। স্বভাবতই সমালোচনা ছিল প্রতিটি মানুষের মুখে মুখে। সরকারের ডিক্টেটরি মানসিকতা সেসব সমালোচনা শুনতে রাজি ছিল না। চুয়াত্তরে জননিরাপত্তা নামে একটা কালো আইন পাস করে সমালোচনার মুখ বন্ধ করার প্রয়াস লক্ষ্য করা গেছে। তখন কোনো বেসরকারি রেডিও কিংবা টেলিভিশন ছিল না বাংলাদেশে। সেদিক থেকে সরকারের ভয়ের কারণ ছিল না। কিন্তু পত্রিকাগুলোর সমালোচনা সরকারের নীতি নির্ধারকদের আহার-নিদ্রা হারাম করে তুলেছিল।

সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ

কলমের এক টানে চারটি বাদে সব দৈনিক-সাপ্তাহিক পত্রপত্রিকার ডিক্লারেশন (প্রকাশের লাইসেন্স) বাতিল করে দেয়া হয়­ শুধু দু’খানি বাংলা এবং দু’খানি ইংরেজি পত্রিকা ছাড়া। এগুলোর মধ্যে দৈনিক বাংলা ও ইংরেজি বাংলাদেশ টাইমস আগেই সরকারের মালিকানাধীন ছিল। তার ওপর তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার দৈনিক ইত্তেফাক আর হামিদুল হক চৌধুরীর বাংলাদেশ অবজারভারও রাষ্ট্রায়ত্ত করা হয়। এরপর আর গণমাধ্যমে সমালোচনার ভয় রইল না। কিন্তু মুখে মুখে, বৈঠকখানার আড্ডায় আর পাড়ার চায়ের দোকানে সরকারের এবং সরকার প্রধানের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের দুর্নীতি ছিল বলতে গেলে একমাত্র আলোচনার বিষয়।

জ্যামাইকা থেকে ঢাকা ফেরার পথে হিথরো বিমানবন্দরে মুজিব ভাই আমাকে বলেছিলেন, নিউজপ্রিন্টের ব্ল্যাকমার্কেটিং বন্ধ করার জন্যই তিনি পত্রিকাগুলো বন্ধ করে দিয়েছেন। (লেখকের নতুন বই ‘এক জীবন এক ইতিহাস দ্রষ্টব্য, পৃষ্ঠা ২০৬)। ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতার কারণে এবং জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা বশত আমি বরাবরই বলে এবং লিখে এসেছি যে কিছুসংখ্যক অসৎ এবং দুর্বৃত্ত ব্যক্তির খপ্পরে পড়েই শেখ মুজিব এসব অন্যায় কাজ করেছিলেন। এমনকি তিনি যখন গণতান্ত্রিক সংবিধান বাতিল করে একদলীয় বাকশাল পদ্ধতি চালু করেন, আজীবন রাষ্ট্রপতি হওয়ার প্রথম ধাপ হিসেবে নিজেকে সাত বছরের জন্য রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন, তখনো আমি বলেছিলাম যে, কিছুসংখ্যক দুষ্ট লোকের পরামর্শেই সেসব তিনি করেছিলেন।

কিন্তু এখন আর সংশয়ের অবকাশ নেই যে, অতীতের অন্যায় কাজগুলোকেই নিজেদের ঐতিহ্য বলে বিবেচনা করে বর্তমান সরকার জাতির সর্বনাশ করছে। অঙ্গ সংগঠনগুলো দিয়ে রাজনৈতিক বিরোধীদের খতম করার কাজ অনেকখানি এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মুখে পূর্ববর্তী সরকারের দুর্নীতির কথা বলে বলে তারা খই ফোটাচ্ছেন। কিন্তু এ সরকারের আমলে শাসক দলকে দুর্নীতির ‘ওপেন জেনারেল লাইসেন্স’ দেয়া হয়েছে। ব্যবসায়-বাণিজ্য সবই হাতিয়ে নিয়েছে শাসক দলের লোকরা। এখন আবার নানা টালবাহানায় টেন্ডার পদ্ধতিকেও বর্জন করা হয়েছে।
সরকার অতীতের মতো মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণের কাজে পুরোপুরি মনোযোগ দিয়েছে। অবশ্য প্রক্রিয়াটা শুরু হয়েছে গোড়া থেকেই। মুখে মুখে বাকস্বাধীনতা, সংবাদের স্বাধীনতার প্রতি তারা ‘দরদের’ বয়ান দেন। কাজে কিন্তু হচ্ছে সম্পূর্ণ বিপরীত। তারা কথা বলেন কাটা জিহ্বা দিয়ে। বস্তুত এটা আরেকটা ‘টেকনিক’। অপকর্মগুলো আড়াল করতেই তারা মুখে বড় বড় কথার খই ফোটান­ যেমন দেখা গেছে মানবাধিকারের বেলায়। অ্যামনেস্টি, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ প্রমুখ মানবাধিকার সংস্খাগুলো আইনবহির্ভূত হত্যাসহ বাংলাদেশে মানবাধিকারের শোচনীয় অবমাননা সম্বন্ধে প্রায়ই বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করছে, কিন্তু সরকার বলছে কোনো মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে না।

সাংবাদিক নির্যাতন

বাংলাদেশে অন্তত শতাধিক সাংবাদিককে আওয়ামী লীগ ও তাদের অঙ্গসংগঠনগুলো হয়রানি ও নির্যাতন করেছে। মাত্র গত মঙ্গলবার (৮ জুন) যুবলীগ কর্মীরা রাজশাহীতে একজন সাংবাদিককে কুপিয়ে হত্যা করেছে। যমুনা টেলিভিশন ও চ্যানেল ওয়ান টেলিভিশন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সরকারের অনুমোদিত ব্যক্তিদের ছাড়া আর কাউকে কোনো টকশোতে ডাকা নিষিদ্ধ হয়েছে। দেশ কলিং, ইউ-টিউব, নিউজ ফন্সম বাংলাদেশ ও ফেসবুক­ এসব ব্লক বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। অবশ্য বিদেশী প্রভুদের চাপে অবশেষে ফেসবুকের ওপর নিষেধাজ্ঞা গত সপ্তাহে তুলে নেয়া হয়েছে।
কিন্তু আমার দেশ পত্রিকার বিরুদ্ধে যা যা করা হয়েছে সেটা সরকারের কুশাসনের মধ্যেও জঘন্যতম অধ্যায় হয়ে থাকবে। এ পত্রিকার এক সাংবাদিকের প্রাণনাশের চেষ্টা হয়েছে তার ওপর আক্রমণ চালিয়ে। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের ওপর ঢাকায় ও লন্ডনে আওয়ামী লীগের সমর্থকরা হামলা করেছে। অনেক জেলায় আওয়ামী লীগের কর্মীরা তার বিরুদ্ধে সিরিজ ‘মানহানির’ মামলা করেছে। সভ্য দেশের আইনে যার মানহানি করা হয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে তিনি ছাড়া আর কেউ মানহানির মামলা করতে পারেন না। কিন্তু আজকের বাংলাদেশে যে কেউ কারো বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করছে, আইনব্যবস্খা আওয়ামী লীগের খেলার পুতুল হয়ে দাঁড়িয়েছে।

গত সপ্তাহে আমার দেশ পত্রিকার প্রকাশ বন্ধ, আপিস তালাবন্ধ ও মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তার এবং পত্রিকার সব সিনিয়র সাংবাদিক ও কর্মচারীর বিরুদ্ধে ভুয়া মামলা রুজু করা হয়েছে। হাইকোর্ট তাকে রিমান্ডে না নিয়ে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের নির্দেশ দিলেও তার বিরুদ্ধে সাজানো রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা এনে মাহমুদুর রহমানকে রিমান্ডে দেয়া হয়েছে। বর্তমান সরকারের আমলে রিমান্ড কথাটা সম্পূর্ণ নতুন এবং ভয়াবহ একটা অর্থ ধারণ করেছে। রিমান্ড মানে নির্যাতন। রিম্যান্ডে গেলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি কখনো ছাড়া পাবে কি না অথবা আদৌ বেঁচে থাকবে কি না সে সন্দেহ সবার।

এত আক্রোশ কেন?

মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে আক্রোশের কারণ কী? সরকারের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ, কুশাসন, নির্যাতন প্রভৃতির সমালোচনা তার পত্রিকা এবং তিনি প্রায়ই করেছেন। সেটা অবশ্যই সাংবাদিক হিসেবে তাদের নৈতিক কর্তব্য ছিল। কিন্তু আগেই বলেছি, তারা সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না। মাহমুদুর রহমান অভিযোগ ছেপেছিলেন যে, বিনা টেন্ডারে মার্কিন তেল কোম্পানি শেভরনকে কন্ট্রাক্ট দান বাবদ কয়েক মিলিয়ন মার্কিন ডলার উৎকোচ নেয়া হয়েছে। তার পর থেকেই মাহমুদুর রহমানকে ‘খতম’ করার সুপরিকল্পিত কর্মসূচি নেয়া হয়েছে। এসব অভিযোগ নিয়ে তদন্ত হতে পারত। যদি অভিযোগগুলো অসত্য হতো তাহলে আইনানুগ ব্যবস্খা নেয়া যেত। কিন্তু তা করা হলো না। অথচ এর পর থেকে আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে নতুন নতুন মামলা হচ্ছে। এখন মনে হচ্ছে গত বছর দেশের দক্ষিণাংশে যে আইলা সামুদ্রিক ঝড় ও বন্যা হয়েছে সেটাও মাহমুদুর রহমান ঘটিয়েছেন বলে অভিযোগ হতে পারে। আর একটা অভিযোগ হচ্ছে রাষ্ট্রদ্রোহিতার। উত্তরায় তার বাড়িতে কয়েকজন সরকারি কর্মচারী উপস্খিত ছিলেন। সেটাকেই বলা হচ্ছে রাষ্ট্রদ্রোহিতা। ওই সরকারি কর্মচারীরা যে চায়ের আমন্ত্রণে, কারো কুলখানি উপলক্ষে কিংবা কবিতার আসরে সেখানে যাননি তার প্রমাণ কী? আর অভিযোগ করছে কে? যারা সচিবালয়ের কোলঘেঁষে জনতার মঞ্চ করেছিল, নির্বাচিত সরকারকে অমান্য করতে সরকারি কর্মচারীদের প্রকাশ্যে উসকানি দিচ্ছিল। রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা প্রথমেই তাদের বিরুদ্ধে করা উচিত ছিল নাকি?

রাতের আঁধারের ষড়যন্ত্র

আমার দেশ পত্রিকার মালিকানা হস্তান্তরিত হয়েছিল। মাহমুদুর রহমান গত বছরই প্রকাশকের নাম পরিবর্তনের আবেদন করেছিলেন। সে আবেদনের সুরাহা হওয়া পর্যন্ত পূববর্তী প্রকাশের নাম বহাল রাখা প্রচলিত রীতি। একদা আমিও কয়েকটি পত্রিকায় কাজ করেছি, এসব আমার জানা আছে। তাতে সরকারের আপত্তি থাকলে তারা লিখিতভাবে পত্রিকার কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিতে পারত। তার পরিবর্তে একটি গোয়েন্দা সংস্খা প্রকাশককে ছিনতাই করে নিয়ে যায়। তাকে বেশ কয়েক ঘন্টা আটক রেখে (কোন পদ্ধতিতে কে জানে?) তার কাছ থেকে মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগে স্বাক্ষর নেয়া হয়। তারপরই অনেক রাতে আমার দেশ পত্রিকার আপিসে পুলিশ যায়, মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করে এবং পত্রিকার আপিসে তালা লাগিয়ে দেয়া হয়। এমন অধৈর্যের কোনো কারণ ছিল কি? দিনের আলো পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বাধা কোথায় ছিল? বহু দেশে ও বহু সমাজে এ বিশ্বাস পোষণ করা হয় যে, রাতের আঁধারে যা করা হয় তাতে ষড়যন্ত্রের দুর্গন্ধ পরিষ্কার।

বাংলাদেশের সাংবাদিকরা ছাত্রলীগের হাতে মার খাচ্ছেন, খুন হচ্ছেন। সরকার পদে পদে তাদের নৈতিক দায়িত্ব পালনে বাধা দিচ্ছে। দুটো টেলিভিশন চ্যানেল বন্ধ হয়ে গেল, আমার দেশ পত্রিকার পাঁচ-ছয় শ’ সাংবাদিক ও কর্মচারী চাকরি হারালেন। সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র কারণে বাংলাদেশ অবজারভার পত্রিকাও বন্ধ হয়ে গেল। সব মিলিয়ে কত সাংবাদিক বেকার হলেন? আড়াই হাজার? তিন হাজার? তাদের এবং তাদের পরিবারের ভরণ-পোষণের উপায় কোথায়? তারা কি ‘কনস্ট্রাকশনের’ কাজ করতে দুবাই কিংবা মালয়েশিয়ায় যাবেন?

আর বাংলাদেশের মানুষ। একটা বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা ও মানবাধিকারের দাবিতে তারা একাত্তর সালে শেখ মুজিব ময়দান থেকে অনুপস্খিত থাকলেও স্বাধীনতার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। মাহমুদুর রহমানের মানবাধিকার আর সংবাদপত্র আমার দেশের স্বাধীনতা পদদলিত হয়েছে। মাহমুদুর রহমান তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলোর অসারতা প্রমাণের সুযোগ পাবেন না। ফখরুদ্দীন-মইন ইউ সরকারের আমলের রিমান্ড ব্যবস্খায় দীর্ঘ দিন অবর্ণনীয় নির্যাতন চালিয়ে মাহমুদুর রহমানের ওপর বর্তমান সরকারের ক্রোধের প্রতিশোধ নেয়া হবে। কিন্তু মাহমুদুর রহমানই শেষ কথা নন। একে একে সবারই মানবাধিকার ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, মতামত প্রকাশ ও সংবাদের স্বাধীনতা পদদলিত হবে। এ সরকার যত দিন ক্ষমতায় থাকবে তত দিন কারোই কোনো অধিকার নিরাপদ নয়।

কিছুকাল আগে এক প্রবন্ধে মার্টিন নায়মোলারের মনস্তাপের উদ্ধৃতি দিয়েছিলাম। নায়মোলার জার্মান নৌবাহিনীর দুর্ধর্ষ সাবমেরিন অধিনায়ক ছিলেন, পরে চিন্তাবিদ ও লেখক হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন এবং হিটলারের নাৎসিদের দ্বারা কারারুদ্ধ হন। জার্মান জাতি নিষ্ক্রিয় ছিল বলেই হিটলার তাদের স্তব্ধ করে দিতে এবং নাৎসি শাসন চালু করতে পেরেছিলেন­ এ ব্যাপারটাকে নায়মোলার বর্ণনা করেছেন এভাবে :

প্রথমে ওরা এলো কমিউনিস্টদের ধরতে, আমি প্রতিবাদ করিনি­
কেননা আমি কমিউনিস্ট ছিলাম না।
তারপর তারা সোস্যালিস্টদের ধরতে এসেছিল, আমি প্রতিবাদ করিনি­
কারণ আমি সোস্যালিস্ট ছিলাম না।
তারপর তারা এলো ট্রেড ইউনিস্টদের ধরতে, আমি প্রতিবাদ করিনি­
কারণ আমি ট্রেড ইউনিয়নপন্থী ছিলাম না।
তারপর তারা এলো ইহুদিদের ধরতে, আমি প্রতিবাদ করিনি­
কারণ আমি ইহুদি ছিলাম না।
তারপর ওরা আমাকে ধরতে এলো­
তখন আর আমার হয়ে প্রতিবাদ করার কেউ ছিল না।

মাহমুদুর রহমান একজন ব্যক্তিমাত্র নন। আজ তিনি বাংলাদেশী জাতির স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, মানবাধিকার ও সংবাদের স্বাধীনতার প্রতীক। তার অবমাননা, গ্রেফতার ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে গোটা জাতিকে এক হয়ে রুখে দাঁড়াতে হবে। না হলে কারোই কোনো অধিকার নিরাপদ নয়।
serajurrahman@btinternet.com
[সূত্রঃ নয়া দিগন্ত, ১৫/০৬/১০]

Sunday 13 June 2010

আমরা কি আশাবাদী হতে পারি?

ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী

আমরা আশাবাদী হয়েছি। জেলা প্রশাসক মহোদয় দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার ডিক্লারেশন বাতিলের জন্য যে ঠুনকো অভিযোগ এনেছিলেন এবং ওই পত্রিকার ডিক্লারেশন বাতিল করে দিয়েছিলেন তা খামখেয়ালি হিসেবেই প্রতিভাত হয়েছে। উচ্চতর আদালত তার এই খামখেয়ালিপনাকে নাকচ করে দিয়েছেন। সে রায়ের বলে দৈনিকআমার দেশ পত্রিকা শুক্রবার আবার প্রকাশিত হয়েছে।

আমরা বিচার বিভাগের কাছে ন্যায়বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে কিছুটা নিশ্চিত হতে চাইছি এবং অনেকখানি ন্যায়বিচার পেয়েছি বলেই দাবি করছি। আমরা বিশ্বাস করতে চাইছি যে, মানুষ ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা পাবে, আদালতে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে। কখনো কখনো এমন মনে হয়েছে যে, মানুষ ন্যায়বিচার পাচ্ছে কি? এ রকম প্রশ্ন উত্থাপিত না হলেই ভালো হতো। আসলে বর্তমান প্রতিহিংসা-তাড়িত সরকার এমন এক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে চাইছে যে, আদালত তাদের ইচ্ছানুকূল থাকুক। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমন মনে হয়েছে যে, আদালত পৃথক হয়েছে বটে, স্বাধীন হয়নি। কারণ নিম্ন আদালত যে মামলায় একজন আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য চার দিনের রিমান্ড আদেশ মঞ্জুর করেছেন, উচ্চ আদালত একই মামলায় অন্য আসামিদের জামিন দিয়েছেন। এ ঘটনা ঘটা বিচিত্র নয়। এটাই তো স্বাভাবিক যে, নিম্ন আদালতে ন্যায়বিচার হয়নি বলে মানুষ উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হন। সেখানে বহু ক্ষেত্রে নিম্ন আদালতের রায় উচ্চ আদালত বাতিল করে দেন। তারা নতুন রায় দেন। এই বিষয়ে আমাদের কোনো প্রশ্ন নেই, বরং এটাই স্বাভাবিক। আমাদের মনে রাখতে হবে, নিম্ন আদালত থেকে উচ্চতর আদালত পর্যন্ত যারা অভিযোগের শুনানি গ্রহণ করেন তারাও মানুষ, এবং তারাও ভুলভ্রান্তির ঊর্ধ্বে নন।

দৈনিক আমার দেশের প্রকাশনা বাতিল হলে বাংলাদেশ এবং গোটা বিশ্বে এর তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ওই পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে পুলিশ গ্রেফতার করে প্রতারণার অভিযোগে। প্রতারণাটা কী? জেলা প্রশাসক বাহাদুরের দৃষ্টিতে প্রতারণাটা হলো এই যে, পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান, যিনি প্রকাশক নন, তার নামেই পত্রিকাটি প্রকাশ করে আসছিলেন। প্রায় এক বছর আগে দৈনিকআমার দেশ পত্রিকার কর্তৃপক্ষ সরকারকে অবহিত করেছিল, পত্রিকার প্রকাশক পদত্যাগ করেছেন এবং তার স্থলে নতুন প্রকাশক কে হবেন। এখানে জেলা প্রশাসক সাহেবের দায়িত্ব ছিল পত্রিকা কর্তৃপক্ষের চিঠিটি আমলে নিয়ে জানিয়ে দেয়া যে, আমরা আপনার পত্রিকার নতুন প্রকাশকের খবর জেনেছি। সেটা জেলা প্রশাসক সাহেবের কর্তব্য। তিনি কর্তব্য কাজে অবহেলা করে নিজের দায়িত্ব এড়ানো জন্য আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ওই পত্রিকার প্রকাশক হবেন কি না এবং সেটা অনুমোদন করা যায় কি না সে বিষয়ে অনুমতি চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন। গত এক বছরেও (কিংবা তার চেয়েও কম-বেশি সময়ে) এর কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। এখানেআমার দেশ কর্তৃপক্ষ আইনের কোনো ব্যত্যয় করেননি। ১৯৭৩ সালের প্রিন্টিং প্রেসেস অ্যান্ড পাবলিকেশনস অ্যাক্ট অনুযায়ীই প্রকাশক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে যা যা করা দরকার, তারা তার সব কিছুই করেছিলেন। সরকার যেহেতু প্রথম থেকেই দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পছন্দ করেনি সেহেতু তার যতটুকু সাধ্য আছে সবটুকু দিয়ে আমার দেশকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছে।

আমার দেশ সরকারের এত বড় শত্রু হলো কেন? কারণ তারা সত্য প্রকাশে অকুণ্ঠিত থাকার চেষ্টা করেছে।আমার দেশ এক একটি সত্য প্রকাশ করেছে আর সরকার তার জবাব না দিয়ে আমার দেশের ওপর হামলে পড়েছে। সরকার হয়তো এর সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের নাম শুনেই ক্ষিপ্ত ছিল। মাহমুদুর রহমানের দোষ তেমন কিছু নয়। বিএনপি সরকারের আমলে তিনি কিছুকাল ওই সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টা হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এবং তিনি আমার দেশের সম্পাদক হিসেবে সত্য প্রকাশ করছেন। এই সরকারের কাছে সত্য বড় বিপজ্জনক। ফলে যেভাবেই হোক মাহমুদুর রহমানকে ধরা চাই।

মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলাগুলো শুধু যে তাকে হয়রানি-নাজেহাল করার জন্য এবং তার মনোবল ভেঙে দেয়ার জন্য সে বিষয়ে এখন আর কোনো সন্দেহ নেই। কারণ রিমান্ডের আগেই জেল হাজতে তার বিরুদ্ধে যে আচরণ করা হয়েছে, সে হিসেবে মানবাধিকার লঙ্ঘন এখন আর কোনো প্রশ্নবিদ্ধ বিষয় নয়। মাহমুদুর রহমান গত ১ জুন গ্রেফতার হওয়ার পর জেল হাজতে ছিলেন। কিন্তু সেখানেই তাকে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের অংশ হিসেবে সরকারি কর্তৃপক্ষ তার প্যান্ট খুলে ফেলে এবং আন্ডাওয়ার ধরে টানাটানি করতে থাকে। অর্থাৎ, একজন মানুষের যে আত্মসম্মান সরকার নিয়ন্ত্রিত বাহিনী তা ভূলুণ্ঠিত করার চেষ্টা করেছে। এ সম্পর্কে আমরা বিস্তারিত জানি না। কিন্তু একটি গণতান্ত্রিক সমাজে এই ধরনের ঘটনা কি সরকারের অপরাধমূলক কার্যক্রম নয়?

পাকিস্তান আমলেও আমরা দেখেছি, ভিন্ন ধরনের এক চিত্র। পুলিশের প্রতি ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেছি। পুলিশের ছোড়া কাঁদানে গ্যাসের শেল তাদের দিকে নিক্ষেপ করেছি। কিন্তু যখন গ্রেফতার হয়েছি, তখন তাদের কাছ থেকে কোনো দুর্ব্যবহার পাইনি। গ্রেফতার হওয়ার পর যখন আমাদের জেলখানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে তখন পুলিশ বলেছে, ভাই, আপনারা এ রকম করেন কেন, এ রকম করলে আমরা যে গ্রেফতার না করে পারি না। তারপর চালান দিতে হয়। কোর্টে হাজিরা দিতে হয়। আমাদের তো কিছু করার নেই। অনেক সময় পুলিশের ট্রাকে বসে বলতাম, আপনাদের লজ্জা করে না? আমরা তো সাধারণ মানুষের মুক্তি ও গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য লড়াই করছি। আপনারা সঙ্গী না হয়ে আমাদের গ্রেফতার করেন কেন? তারা বলত, ভাইরে, পুলিশের চাকরি, কী করব?

তাদের সেই অসহায়ত্বের সাথে বর্তমান পুলিশের অসহায়ত্বের সম্ভবত কোনো তুলনা হয় না। কারণ সেই সময়ে বাঙালি পুলিশ এ দেশের স্বাধিকার আন্দোলনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত না হলেও মানসিকভাবে একাত্ম ছিল । ’৬৯-এর অভ্যুত্থানের সময় তারা আমাদের যথাসম্ভব গ্রেফতার না করে তাদের গাড়িতে তুলে নিতেন। তারপর টাঙ্গাইল শহর থেকে মধুপুর জয়দেবপুর কোনো স্থানে ট্রাক থেকে নামিয়ে দিয়ে নিজেরা ফিরে যেতেন। আমরা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। অত রাতে সে সময় এই রুটে বাস চলাচল করত না। শুধু চলত ট্রাক। আমরা হাত দেখিয়ে ট্রাক থামাতাম। ট্রাকওয়ালারাও জানত যে, পুলিশ আমাদের এই খানে ছুড়ে ফেলে দিয়ে চলে গেছে। আমরা ট্রাকের তিরপলে ঢাকা মালামালের ওপর উঠে বসতাম। মধ্যরাতে টাঙ্গাইল নেমে পাঁচ-সাত কিলোমিটার হেঁটে পৌঁছে যেতাম যে যার গন্তব্যে। পরদিন আবারো মিছিল। আবারো স্বৈরাচারবিরোধী স্লোগান। ’৬৯-এর অভ্যুত্থানে আমি বারবার গ্রেফতার হয়েছি। আমি ১৬-১৭ বছরের তরুণ ছিলাম। তখনকার পুলিশ বাহিনী আমাকে সমীহ করেছে। কেউ আমার প্যান্ট খুলে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে দেয়ার চেষ্টা করেনি। কিন্তু বাংলাদেশে ৫৭ বছরের প্রবীণ মাহমুদুর রহমানের প্যান্ট খুলে ফেলে শেখ হাসিনার সরকার নিজেদেরই গাত্রবস্ত্র উন্মীলন করে ফেলেছে।

আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান সত্য প্রকাশে অকুণ্ঠিত। ব্যক্তিগতভাবে তিনি একজন প্রকৌশলী হলেও তার কলম ক্ষুরধার। সেই কলমের শক্তি সম্পর্কে তিনি নিজেও অভিহিত হয়েছেন অনেক পরে। সম্পাদক হিসেবে তিনি দায়িত্বশীল। তিনি সব সময়ই তার পত্রিকা আমার দেশের রিপোর্টের বস্তুনিষ্ঠতা সম্পর্কে সচেতন। ফলে সরকারের পক্ষে এ কথা কখনো বলা সম্ভব ছিল না যে, আমার দেশে প্রকাশিত রিপোর্ট মিথ্যা বা ভুল। সেই কারণে মাহমুদুর রহমানকে
শাবাশ দিতেই হয়। তিনি পেশাদার সাংবাদিক
নন, কিন্তু সাংবাদিকতার নীতিমালার
প্রতি তিনি অতিশয় বিশ্বস্ত।

তা হলে সত্যভীতু সরকার কী করবে? তাদের মাহমুদুর রহমানের মতো ব্যক্তিত্ববান সত্যভাষী সম্পাদককে আঘাত করার কোনো বিকল্প থাকে না। অতএব মাহমুদুর রহমান এখন মামলার পর মামলায় জেলে ও রিমান্ডে। কোনো সভ্য সমাজে এটা কল্পনাও করা যায় না যে, একটি বহুল প্রচারিত পত্রিকার সম্পাদককে ইতর সব যুক্তি দেখিয়ে এভাবে গ্রেফতার করা যায়। গত ১ জুন আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে সেভাবেই সরকার গ্রেফতার করেছে এবং ধারাবাহিক নির্যাতন করে যাচ্ছে। গ্রেফতারের আগে মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে সরকার একটি মামলাও দায়ের করতে পারেনি। উত্তরা ষড়যন্ত্র বলে এক ইতর ধুয়া তুলেছিল তৎকালীন পরদেশী পদলেহী সরকারের স্থানীয় প্রতিনিধিরা। বিদেশী প্রভুদের পাচাটা সে সরকার মামলা নিয়ে এক পা-ও অগ্রসর হতে পারেনি। অর্থাৎ, যা ষড়যন্ত্র নয়, তাকে ষড়যন্ত্র হিসেবে চালানোর চেষ্টা করেছিল ওই ভারবাহী সরকার। সেটা তখন প্রমাণিত হয়নি। শেখ হাসিনা আজম জে চৌধুরী বা নূর আলীর কাছ থেকে ঘুষ নিয়েছেন, এমন মামলায় তখন অনেক তুলকালাম হয়ে গেছে এবং এই বাদিরা স্বেচ্ছায় হোক আর বাধ্য হয়েই হোক শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তৎকালীন ক্যাঙ্গারু কোর্টে জানিয়েছিলেন যে, তারা শেখ হাসিনাকে ঘুষ দিয়েছেন। কেউ নগদে। কেউ চেকে। প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান জ্বালানি উপদেষ্টা ছিলেন। রাষ্ট্রীয় স্বার্থরক্ষায় তিনি সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালান। ফলে বাংলাদেশে জ্বালানি সম্পদ লুটেরারা মাহমুদুর রহমানের ওপর যথেষ্ট বিরক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু স্বীকার করতে হবে, জনাব রহমান কোনো আপস করেননি। তিনি বাংলাদেশের জ্বালানি সম্পদ রক্ষায় ব্যাপক সাফল্যের পরিচয় দেন। সেটা পছন্দ করেননি আওয়ামী লীগের পূর্বসূরি সংবিধানবিরোধী স্বৈরাচারী সরকার।

তার ওপর সরকারের বিভিন্ন প্রশ্নবিদ্ধ কার্যক্রম সম্পর্কে আমার দেশ তথ্যানুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছিল। যাতে ক্রমেই উন্মোচিত হয়ে যাচ্ছিল যে, বিডিআর বিদ্রোহের সাথে সরকার পক্ষের লোকদের কী ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। সব মিলিয়ে আমার দেশ সরকারের জন্য ক্রমেই বিরক্তিকর হয়ে উঠছিল। ধারণা করা হয় যে, এসব কারণেই সরকার মাহমুদুর রহমানকে শিক্ষা দিয়ে দেয়ার জন্য সর্বাত্মক আয়োজন করেছে। দৈনিক আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ করে ও মাহমুদুর রহমানকে কারারুদ্ধ করে সরকার যে নিকৃষ্ট নজির স্থাপন করল, তার নিন্দা হয়েছে সর্বত্র।

সরকার বারবার দাবি করে আসছিল যে, তারা পত্রিকা বন্ধ করেনি। পত্রিকা বন্ধ করেছে জেলা প্রশাসক। হাইকোর্ট যখন পত্রিকার ডিক্লারেশন বাতিল অবৈধ করলেন তখন কী বিবেচনায় সরকার চেম্বার জজ আদালতে হাই কোর্টের রায় স্থগিতের জন্য ছুটে গেল, সেটাও বোধগম্য নয়। সরকার তো কোনো দায়িত্ব নেয়নি। তা হলে সরকারের এমন কী দায় পড়ল যে, তারা পত্রিকা যাতে পুনঃপ্রকাশিত না হয় সে ব্যাপারে মরিয়া হয়ে উঠল।

তবু আমরা বলব, আদালত সরকারের খামখেয়ালির বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক রায় দিয়ে জনগণের শেষ ভরসাস্থল হিসেবে তার মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার ডিক্লারেশন বাতিল আদেশ রদ হওয়ার পর সারা দেশে, এমনকি সারা বিশ্বে ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকজন ফোন করে বা ম্যাসেজ পাঠিয়ে তাদের আনন্দের কথা জানান দিতে থাকেন। যারা অনলাইনে পত্রিকা পড়েন তারাও উল্লসিত হয়ে ওঠেন। আদালতের প্রতি আস্থা পুনর্ব্যক্ত করতে সর্বত্র মানুষ আশাবাদী হয়ে উঠতে থাকেন। এই ঘটনায় প্রমাণিত হয় যে, গণতন্ত্রের জন্য, মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য এ দেশের সাধারণ মানুষ কতটা উদগ্রীব।

কিন্তু সরকারের কোনো কোনো মহল মনে হয়, আইনের শাসনের প্রতি অত্যন্ত বীতশ্রদ্ধ। তারা যেন কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না যে উচ্চ আদালত কেন সরকারের ইচ্ছানুযায়ী রায় দিলেন না। কেন আমার দেশ পুনঃপ্রকাশিত হবে। ফলে তারা আমার দেশ পত্রিকার ছাপাখানা খুলে দেয়ার ব্যাপারে গড়িমসি করছে। শুক্রবার সকাল পর্যন্ত পত্রিকাটির ছাপাখানা তালাবদ্ধই রেখেছে পুলিশ। সম্ভবত তারা ‘ওপরের’ গ্রিন সিগনালের জন্য অপেক্ষা করছে। কারণ তারা দেখেছে, উচ্চ আদালত কোনো কোনো আসামির জামিন মঞ্জুর করলেও অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস সংশ্লিষ্ট আসামিকে জেল থেকে বের হতে দেয়নি। অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসের ক্লিয়ারেন্স ছাড়া বন্দীরা মুক্তি পাচ্ছে না। অর্থাৎ অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস হাইকোর্টের ওপরও হাইকোর্ট হয়ে বসেছে। পুলিশ যখন দেখেছে হাইকোর্টের আদেশ অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস বিলম্বিত করে দিতে পারে তখন কেন বিলম্বিত করতে পারবে না আমার দেশ পুনঃপ্রকাশের প্রক্রিয়া। সুতরাং আদালতের আদেশ নয়, সরকারি নির্দেশের অপেক্ষায় পুলিশ। মঈন-ফখর-হাসিনার এই সাড়ে তিন বছরের শাসনকালে পুলিশ সেটাই দেখেছে ও শিখেছে।

কিন্তু আমরা মনে করি, সরকারের শুভ বুদ্ধির উদয় হবে। আদালতের রায়ের প্রতি তারা শ্রদ্ধাশীল হবে। নিম্ন আদালতকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করবে না। উচ্চ আদালতের রায় যা-ই হোক, তারা মেনে নেবে। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করবে। সেটা দেশ ও জাতির জন্য যেমন কল্যাণকর, তেমনি কল্যাণকর সরকারের জন্যও।
লেখকঃ সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
(সুত্র, নয়া দিগন্ত, ১৩/০৬/২০১০)

ওয়ার্ল্ড কাপ ফুটবল ম্যাচ দেখার সহজ উপায়...

শফিক রেহমান

স্থানঃ মতিঝিল কমার্শিয়াল এলাকায় একটি আইপিএস সেলস সেন্টার।
কালঃ ১০ জুন ২০১০ সাউথ আফ্রিকায় ওয়ার্ল্ড কাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট শুরু হওয়ার আগের দিন।
চরিত্রঃ আইপিএস সেলসম্যান, ত্রিশ অনূর্ধ্ব যুবক ও যুবতী এবং একটি চেয়ারে বসা ত্রিশোর্ধ্ব হতশ্রী ব্যক্তি।

আইপিএস সেলসম্যানঃ (হাসিমুখে) ওয়েলকাম স্যার। ওয়েলকাম। বলুন, আপনাকে কি সার্ভিস আমরা দিতে পারি।
যুবকঃ ্লামওয়ালেকুম। আপনি নিশ্চয়ই জানেন আগামীকাল থেকে সাউথ আফ্রিকায় জোহানেসবার্গে সকার সিটি স্টেডিয়ামে শুরু হচ্ছে ১৯তম ওয়ার্ল্ড কাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট। এক মাসজুড়ে এই টুর্নামেন্ট চলবে। শেষ হবে ১১ জুলাইয়ে। ৬৪টি ম্যাচের এই টুর্নামেন্টের প্রতিটি ম্যাচই আমি দেখতে চাই। বলতে পারেন আমি একজন ফুটবল ফ্যানাটিক। (পাশেই দাঁড়ানো যুবতীর দিকে আঙুল দেখিয়ে লাজুক হাসিমুখে) উনি আমার গার্লফ্রেন্ড। উনি জানেন কেমন ফুটবলপাগল আমি। আমাদের বিয়ে হবে ওয়ার্ল্ড কাপের পরে। ইনশাআল্লাহ। ইতিমধ্যে উনি আমাকে নিরবচ্ছিন্নভাবে ওয়ার্ল্ড কাপ টুর্নামেন্ট দেখার জন্য একটা আইপিএস উপহার দিতে চান। কতো দাম পড়বে একটা আইপিএসের?

সেলসম্যানঃ একুশ ইঞ্চি কালার টিভি দেখা যাবে এমন একটি আইপিএসের দাম পড়বে ২৮,৯৫০ টাকা। টিভির সঙ্গে চারটি টিউবলাইট ও দুটো ফ্যানও চালাতে পারবেন।
যুবকঃ (চিন্তিত মুখে) ২৮,৯৫০ টাকা। ১২,০০০ টাকা দামের একটি একুশ ইঞ্চি কালার টিভি দেখার আইপিএস খরচ ২৮,৯৫০ টাকা। বলেন কি? এ যে দেখছি বারো হাত তেতুলের তের হাত বীচির কারবার।
সেলসম্যানঃ সরি স্যার। টিভি চালানোর জন্য এটিই সবচেয়ে কম দামি আইপিএস।
যুবকঃ বিদুøৎ চলে যাওয়ার পর এই আইপিএসে কতোক্ষণ টিভি দেখা যাবে?
সেলসম্যানঃ দুই ঘণ্টা। এক বছরের ওয়ারেন্টি পাবেন। ওয়ারেন্টির সময়ে দুই মাস অন্তর ফ্রি সার্ভিস পাবেন। তবে...
যুবকঃ তবে কি?
সেলসম্যানঃ তবে গত কয়েক মাসে, বিশেষত গত কয়েক মাসে যেভাবে লোডশেডিং এবং পাওয়ার ফেইলিওর হচ্ছে, তাতে আমাদের ওয়ারেন্টি নিরর্থক হয়ে যাচ্ছে।
যুবকঃ কেন?

সেলসম্যানঃ আইপিএস মূলত ইমার্জেন্সি সিচুয়েশন কভার করতে পারে। অর্থাৎ হঠাৎ বিদুøৎ চলে গেলে আইপিএস স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালু হয়ে যাবে। কিন্তু যখন বিদুøৎ না থাকাটা ইমার্জেন্সি সিচুয়েশন না হয়ে নরমাল সিচুয়েশন হয়­ তখন সেই পরিস্থিতি আইপিএস সামাল নাও দিতে পারে।
যুবকঃ বিষয়টি বুঝিয়ে বলুন।
সেলসম্যানঃ আইপিএসের ব্যাটারি চার্জিংয়ে কিছু সময় লাগে।
যুবকঃ কতোক্ষণ?

সেলসম্যানঃ আইপিএস যদি এক ঘণ্টা চালু থাকে এবং তারপর যদি বিদুøৎ এসে যায়, তাহলে ব্যাটারি পুরো রিচার্জ হতে দুই ঘণ্টা লাগতে পারে। এটা গড় হিসাব। তার মানে, আইপিএস দুই ঘণ্টা চালু থাকলে ব্যাটারি পুরো রিচার্জ হতে সময় লাগবে চার ঘণ্টা। মুশকিল হচ্ছে এই যে, এখন এক ঘণ্টা পরপর লোডশেডিং হচ্ছে। সুতরাং চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে বারো ঘণ্টাই যদি বিদুøৎ না থাকে তাহলে আইপিএস ব্যাটারি ফুলচার্জ সম্ভব হবে না। ক্রমেই আইপিএস ক্ষমতাহীন হয়ে পড়বে।
যুবকঃ তাহলে? তাহলে আইপিএস না কিনে একটা ছোট জেনারেটর কিনলে সমস্যার সমাধান হবে কি?
সেলসম্যানঃ না। সমাধান হবে না।
যুবকঃ কেন?

সেলসম্যানঃ দেখুন, আপনার মেইন পাওয়ার সোর্স-ই যদি ফেল করতে থাকে, তাহলে জেনারেটরেও কোনো কাজ হবে না। কারণ আপনার কেবল অপারেটরও অপারেট করতে পারবে না। তবে বিটিভি যদি ম্যাচগুলো টেলিকাস্ট করে তাহলে একটা এরিয়াল লাগিয়ে আপনি দেখতে পারবেন। এরিয়ালের দাম পড়বে হয়তো শ’পাচেক টাকা। বিটিভি টেলিকাস্ট করতে পারবে, কারণ তাদের নিজস্ব বড় জেনারেটর আছে। কিন্তু রিসিভিং এন্ড-এ আপনার পাওয়ার লাগবে। আইপিএস সেই পাওয়ার দিতে পারবে দুই ঘণ্টা অথবা তার কম। আর ছোট একটা জেনারেটর, যার দাম হতে পারে লাখ খানেক টাকা, তাতে সমস্যার আপাত সমাধান হতে পারে। কিন্তু মনে রাখবেন এসব জেনারেটর বসানোর জায়গা আপনার না-ও থাকতে পারে এবং ভুলে যাবেন না, জেনারেটর প্রচণ্ড আওয়াজ করে। তাছাড়া জেনারেটরের ডিজেল কেনার হাঙ্গামাতো রয়েইছে।
যুবকঃ (বিরক্ত মুখে) এতসব তথ্য আমাকে জানতে হবে কেন? আমার প্রবলেম হলো একটা টিভি কেনা এবং নিরবচ্ছিন্নভাবে ওয়ার্ল্ড কাপ টুর্নামেন্ট দেখা। দেশের পাওয়ার সাপ্লাই নিরবচ্ছিন্ন রাখার ডিউটি বা প্রবলেম, যাই বলুন না কেন, সেটা হচ্ছে সরকারের। ভোটাররা ভোট দিয়েছে আওয়ামী লীগকে সরকার চালানোর জন্য। এখন সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে দেশজুড়ে ভোটাররা যেন অন্তত আগামী এক মাস খেলার সময়ে নিরবচ্ছিন্ন বিদুøৎ পায়।

১৯৭৪-এ শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগের আমলে শুধু ফাইনাল ম্যাচের সরাসরি সম্প্রচার দেখেছিল বাংলাদেশের মানুষ। তারপর ১৯৭৮-এ প্রেসিডেন্ট জিয়ার আমলে দুটি সেমিফাইনাল ও ফাইনাল ম্যাচের সরাসরি সম্প্রচার দেখেছিল। ১৯৮২ থেকে জেনারেল এরশাদের আমলে বহু ম্যাচ সরাসরি সম্প্রচার দেখানোর রেওয়াজ শুরু হয় যা পাকাপোক্ত হয় ১৯৮৬ ও ১৯৯০-এ। ১৯৯৪-এ বিএনপি আমলে, ১৯৯৮-এ আওয়ামী লীগ আমলে এবং তারপর ২০০২ ও ২০০৬-এ আবার বিএনপি আমলে বহু ম্যাচ সরাসরি সম্প্রচারিত হয়। এখন বাংলাদেশের মানুষ অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে ওয়ার্ল্ড কাপের প্রায় সব ম্যাচ নিরবচ্ছিন্নভাবে দেখতে। তার প্রমাণ বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্র এখন উড়ছে ওয়ার্ল্ড কাপে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর ফ্ল্যাগ। বিশেষত ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার ফ্ল্যাগ এবং তার পরে ফ্রান্স, ইটালি, জার্মানির ও অন্য দেশগুলোর।

ফ্ল্যাগ উড়ছে টিনের বাড়ির ছাদে। টাওয়ার ব্লকের ফ্ল্যাটে। রিকশার হ্যান্ডল বারে। মোটর কারের ফ্ল্যাগ স্ট্যান্ডে, লঞ্চে, ট্রাকে, চায়ের দোকানে, মুদির দোকানে। বিভিন্ন বেসরকারি অফিসের বাইরে এবং ভেতরে। এসব ফ্ল্যাগ ছোট এ-ফোর সাইজ থেকে শুরু করে শাড়ির মতো লম্বা-চওড়া সাইজের। ছোট ফ্ল্যাগ বিক্রি হচ্ছে একশ বিশ থেকে দেড়শ টাকায়। ফুটবলপাগল মানুষ এসব কিনছে। কষ্ট করে ছাদে উঠে লাগাচ্ছে অথবা বাশের মাথায় উড়িয়ে দিচ্ছে। অতীতে ফ্ল্যাগ ওড়াতে গিয়ে একাধিক মানুষের মৃতুø হয়েছে। এ সবই হচ্ছে অত্যন্ত স্বতঃস্ফুর্তভাবে গোটা বাংলাদেশে। বাংলাদেশের চেহারাই পাল্টে গিয়েছে। সবুজ-নীল-হলুদ ব্রাজিলের ফ্ল্যাগ, আকাশি নীল-শাদা আর্জেন্টিনার ফ্ল্যাগ, লাল-কালো-শাদা জার্মানির ফ্ল্যাগ, নীল-শাদা-লাল ফ্রান্সের ফ্ল্যাগ ইত্যাদি বাংলাদেশকে এমন এক নতুন সাজে সাজিয়েছে যা দেখা যায় প্রতি চার বছর পর।
বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের জীবনটাই হচ্ছে গভীর দুঃখের কাহিনী। তাদের জীবনে আনন্দের মুহূর্ত বিরল। সেই বিরল মুহূর্তের অন্যতম হচ্ছে ওয়ার্ল্ড কাপ দেখা। তাই মাদারীপুরের পথে আড়িয়াল খা নদের পাড়ে অথবা পুকুরের মধ্যেও উড়ছে ফ্ল্যাগ। বড়লেখা মৌলভীবাজারে ছোট ফ্ল্যাগ কপালে বেধে মানুষ হাটছে। রূপগঞ্জে চলেছে টিভি কেনার ধুম। সেখানে বিক্রেতারা টিভির সঙ্গে গিফট দিচ্ছেন ফ্ল্যাগ। বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা খেলার সময়ে উৎপাদন বন্ধ রেখে খেলা দেখার আবেদন জানিয়েছেন মালিকদের কাছে।

ফুটবলপাগলদের উৎসাহ-উদ্দীপনা আরো বেড়েছে বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় ওয়ার্ল্ড কাপ বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ এবং বিভিন্ন প্রাইভেট টিভি চ্যানেলে ওয়ার্ল্ড কাপ বিষয়ে টক শো-র জন্য। দেশজুড়ে ফুটবল উত্তেজনা চরমে পৌছেছে।
এখন যদি এই মানুষরা দীর্ঘ চার বছর অপেক্ষার পর হঠাৎ ওয়ার্ল্ড কাপ খেলা দেখা থেকে বঞ্চিত হয়, তাহলে কি হবে? সরকার যতোই প্রচার করুক না কেন, বিএনপি আমলে বিদুøৎ উৎপাদনে কোনো উন্নতি হয়নি, তখন এই সব মানুষ বলবে, অনুন্নতি সত্ত্বেও আমরা তো ২০০২ ও ২০০৬-এ নিরবচ্ছিন্নভাবে ওয়ার্ল্ড কাপের ম্যাচগুলো দেখেছিলাম। মানুষ প্রশ্ন করবে এখন কেন দেখা সম্ভব হবে না? এর উত্তরে কি সরকার বলতে পারবে যে তারা গত দেড় বছরে হামলা, মামলা, জামিন, রিমান্ড, টিএফআই, ক্রসফায়ার, ফাসি, যুদ্ধাপরাধী শনাক্তকরণ ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নাম বদল নিয়ে মহা ব্যস্ত ছিল।

সেলসম্যানঃ (গলার স্বর কিছুটা নামিয়ে এনে) গত তিন দিনে সারা দেশে গ্যাস সংকট আর লোডশেডিং আরো বেড়েছে। কারণ কুমিল্লায় বাঙ্গুরা গ্যাস ফিল্ডে পাইপলাইন ফেটে গিয়েছে। এটা সারাতে আয়ারল্যান্ড থেকে এক্সপার্টদের একটি টিম বাংলাদেশে আসছে। এখান থেকে দৈনিক ১২ কোটি ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন হতো। তা কমে গিয়ে ৫ কোটি ৬০ লাখ ঘনফুটে নেমে আসে। এখন গ্যাস ফিল্ডটি একেবারেই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আর তার বিরাট প্রভাব পড়েছে দেশের পাওয়ার সাপ্লাইয়ের ওপর। গতকাল দেশে সাড়ে ৫ হাজার মেগাওয়াট বিদুøৎ চাহিদা থাকলেও উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৩,৮০০ মেগাওয়াট। সাঙ্গুরা গ্যাস ফিল্ড যে কবে নাগাদ চালু হবে সেটা কেউ বলতে পারছে না। তাই ওয়ার্ল্ড কাপ দেখার চান্স অনেকটা কমে এসেছে।

যুবক (রাগান্বিত চেহারায়)ঃ এসব গভর্নমেন্টের প্রবলেম। দিজ আর নট মাই প্রবলেমস। গভর্নমেন্টের উচিত ছিল আগেই প্রপার মেইনটেনান্স এবং নিয়মিত চেকআপের ব্যবস্থা করা। এটা ডিজিটাল সরকার নয়। এটা মামলা-হামলা-মাতাল সরকার। এই সরকারের ফোকাস অন্যখানে। ওয়ার্ল্ড কাপ ফুটবল এদের কাছে কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়। আর হবেই বা কি করে! চার নারীর এই গভর্নমেন্ট পুরুষদের খেলা বুঝবে কি করে?
সেলসম্যানঃ চার নারীর গভর্নমেন্ট?
যুবকঃ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপুমণি। বিষয়টি নিয়ে আমার গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে অনেক তর্ক হয়েছে। আমি আগে নারী মুক্তি সমর্থন করতাম। এখন আর করি না।
যুবতী (্লান হাসিমুখে)ঃ ওয়ার্ল্ড কাপ দেখতে না পারলে ও ভয়ঙ্কর কিছু করে ফেলতে পারে। সরকারের বিরুদ্ধে ও যে রকম প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে সেটা জানলে মাহমুদুর রহমানের মতো ওকে ওর অফিস থেকে আজই ধরে বেধে নিয়ে যাবে। তারপর রিমান্ড। তাই ওর খেলা দেখা নিশ্চিত করার জন্য আপনাদের দোকানে এসেছি। প্লিজ, আমাদের হেল্প করুন।

ত্রিশোর্ধ্ব হতশ্রী ব্যক্তি (চেয়ার থেকে উঠে)ঃ কেউ আপনাদের হেল্প করতে পারবে না। আপনার বয়ফ্রেন্ড যেমন ফুটবল ম্যাড, এই সরকার তেমনি মামলা ম্যানিয়াক। গত এক সপ্তাহে এই সরকার কতো জনের বিরুদ্ধে নতুন মামলা ঠুকেছে তা মন্ত্রীরাও হয়তো জানেন না। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে নতুন মামলাসহ দৈনিক আমার দেশ-এর শতাধিক সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে গণমামলা করারও ব্যবস্থা হয়েছে। এই মামলা ম্যানিয়াক সরকারের বিরুদ্ধে আপনি কি করবেন? উকিলের কাছে দৌড়াবেন। থানা-জেল-কোর্টে যাবেন। তারপর একটা মামলায় খালাস পেলে আরেকটা মামলা এরা আনবে। মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা আরো বেড়েছে।
যুবক ও যুবতী (সমস্বরে)ঃ তাহলে আমরা কি করবো? আমরা কি একেবারেই নিরুপায়?
হতশ্রী ব্যক্তিঃ না। একেবারেই যে নিরুপায়- তা নয়। আপনারা ইচ্ছা করলে ওয়ার্ল্ড কাপ চলার সময়ে লোডশেডিংয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারেন। তবে মনে রাখবেন মাহমুদুর রহমানের মতো আপনাদের বিরুদ্ধে সরকার কেস ঠুকে দিতে পারে। সরকার বলতে পারে আপনারা মতিঝিল ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।

যুবক (বিস্মিত মুখে)ঃ মতিঝিল ষড়যন্ত্র?
ব্যক্তিঃ হ্যা। এই যে মতিঝিলে আপনি আমাদের সঙ্গে সরকারের সমালোচনায় অংশ নিলেন, বিদুøতের ঘাটতি বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করলেন, এটাই তো মতিঝিল ষড়যন্ত্র নামে আখ্যায়িত হতে পারে- ঠিক উত্তরা ষড়যন্ত্রের মতোই। আর আপনি নিশ্চয়ই মৌলবাদী, ইসলামি জঙ্গি। আপনার বিরুদ্ধে দ্বিতীয় আরেকটি মামলা সরকার ঠুকে দিতে পারে আপনার জঙ্গি মনোভাবের জন্য।
যুবকঃ আমি? জঙ্গি? কিভাবে?
ব্যক্তিঃ মাহমুদুর রহমানের লেখায় কোরান-হাদিসের উদ্ধৃতি থাকে। তাই তাকে ইসলামি মৌলবাদী রূপে চিহ্নিত করা হয়েছে।
যুবকঃ কিন্তু আমি? আমি কি করেছি? আমি তো কোথাও কিছু লিখিনি।
ব্যক্তিঃ লেখেননি। কিন্তু বলেছেন।
যুবকঃ কি বলেছি আমি? কখন?

ব্যক্তিঃ এই দোকানে ঢুকেই আপনি বলেছেন ্লামওয়ালেকুম। তার কিছুক্ষণ পরে বলেছেন, আপনাদের দু’জনার বিয়ে হবে ইনশাআল্লাহ। ্লামওয়ালেকুম আর ইনশাআল্লাহ, এই দুটি শব্দই আপনার ইসলামি মৌলবাদী পরিচয় প্রতিষ্ঠায় যথেষ্ট।
যুবক (চিন্তিত মুখে)ঃ এটা কোন দেশে আমরা বাস করছি? আমাদের সমাবেশের স্বাধীনতা নেই! ধর্ম পালনের স্বাধীনতা নেই!
ব্যক্তিঃ আপনি আওয়ামী দেশে ডিজিটাল যুগে বাস করছেন। এর বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতে হবে স্বাধীনতাকামী সবাইকে। আর তার সূচনা হতে পারে আগামীকাল ওয়ার্ল্ড কাপ অনুষ্ঠানের সময় থেকে। যদি আপনি এবং আপনার জানাশোনা মানুষরা ওয়ার্ল্ড কাপ না দেখতে পারেন তাহলে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, জার্মানি, ইটালির ফ্ল্যাগের পাশেই টাঙ্গিয়ে দেবেন একটি কালো ফ্ল্যাগ। বাংলাদেশের প্রতিটি বঞ্চিত ফুটবল ফ্যান যদি কালো ফ্ল্যাগ শহরে, গ্রামে-গঞ্জে উড়িয়ে দেন তাহলে এই সরকার বুঝতে পারবে মানুষ তাদের ওপর কতোটা ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত। এছাড়া আপনার এলাকার এমপি’র কাছে আপনার প্রতিবাদ লিখে জানান। ঠিকানাঃ জাতীয় সংসদ, শেরেবাংলা নগর, ঢাকা। আর এসব প্রতিবাদ জানানোর বিষয়টি সকল পত্রিকা অফিসে ফোন করে অথবা এসএমএস-এ পাঠিয়ে দেবেন।

যুবক (সপ্রশংস চোখে)ঃ আপনি কে ভাই? কি করেন?
ব্যক্তিঃ আমিও ওয়ার্ল্ড কাপ ফুটবলপাগল মানুষ। মিডল ইস্টে কাজ করতাম। সম্প্রতি কাজ হারিয়ে ফিরে এসেছি। আমিও একটা আইপিএস কিনতে এসেছিলাম। কিন্তু দাম আমার কেনার সাধ্যের বাইরে। তাই বুঝতে পারছি না কি করবো।

হঠাৎ বাইরে একটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেল।
মানুষের চিৎকার।
হৈ চৈ।
বাইরে চিৎকারঃ আগুন! আগুন!
ট্রান্সফর্মার জ্বলে গেছে।
ফায়ার সার্ভিস ডাকো।
ফায়ার সার্ভিস। আগুন। আগুন।
সেলসম্যান (ব্যগ্র স্বরে)ঃ আপনারা এক্ষনি চলে যান। আমরা দোকান বন্ধ করে দিচ্ছি। নইলে নিমতলীর মতো আগুনে জ্বলেপুড়ে মরতে হতে পারে।
ব্যক্তি (চেয়ারে আবার বসে নির্বিকার মুখে)ঃ না। আমি যাবো না।
যুবক ও যুবতী (সমস্বরে)ঃ প্লিজ, পাগলামি করবেন না। চলুন। আমরা যাই।
পাশের অফিস ভবন থেকে চিৎকারঃ আগুন। আগুন। সবাই পালাও।
আইপিএসের দোকানে পোড়া গন্ধ ভেসে এল।
কালো ধোয়া ঢুকলো।
সেলসম্যান দ্রুত দোকান ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

যুবতীঃ প্লিজ উঠুন। প্লিজ। প্লিজ।
ব্যক্তিঃ না। ফুটবল খেলা না দেখতে পারলে আমি হয়তো সুইসাইড বমার হয়ে যাবো। ওদের কাউকে মেরে ফেলবো। তার চেয়ে এখানেই আজ আমার সুইসাইড করা ভালো।
যুবক (দ্রুত ওই ব্যক্তিটির কাছে গিয়ে হাত টেনে)ঃ আপনাকে বের হতেই হবে। জলদি আসুন। প্লিজ।

আগুনের লেলিহান শিখা আইপিএসের দোকানে ঢুকলো ...

Awami Koron Exposed by BD Minister Romesh Chandro Sen

Thursday 10 June 2010

গণমাধ্যমের জন্য বিষন্ন সময়

আতাউস সামাদ

বাংলাদেশের সংবাদপত্র ও টেলিভিশন জগৎ সম্পর্কে খুব কম করে বললেও বলতে হয়, এখানে ভয়, হতাশা আর নিরাপত্তাহীনতা বিরাজ করছে। গায়ের জোরে একটা ছুতো তৈরি করে দৈনিক আমার দেশ বìধ করে দিয়েছে সরকার। পত্রিকাটির ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে তিনটি পৃথক মামলায় সর্বমোট ১২ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন নিম্ন আদালত। গত ১ জুন ভোরে পুলিশ আমার দেশ অফিস থেকে মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে তাকে দিন-রাত কাটাতে হচ্ছে ঠিকানাবিহীনভাবে বা সদা পরিবর্তনশীল বন্দিশালা ও আদালতে। রিমান্ডে কী ঘটছে তাকে নিয়ে সেটি বাংলাদেশে আপাতত কেবলই অনুমান করে নিতে হবে। টেলিভিশনের পর্দা ও পত্রিকায় প্রকাশিত ছবিতে পুলিশবেষ্টিত মাহমুদুর রহমানকে দেখে সাড়ে তিন বছর আগে জরুরি আইনের লেবাসে যে আধা সামরিক শাসন চাপিয়ে দেয়া হয়, এক-এগারো নামে কুখ্যাত সেই অìধকার সময়ে রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীদের গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেয়ার বন্দোবস্ত করার জন্য আদালতে হাজির করার সময় টানাহেঁচড়া করে যেভাবে অত্যাচার ও হেনস্তা করা হতো­ সেসব দৃশ্য মনে পড়ছিল। সেই অসাংবিধানিক সরকারের আসুরিক অপতৎপরতার সাথে পাল্লা দেয়ার জন্য যদি বর্তমান নির্বাচিত সরকার বদ্ধপরিকর হয়ে থাকে, তবে তা হবে সার্বিকভাবে দেশ ও জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক।

আমার দেশ ও মাহমুদুর রহমান-বিষয়ক চলমান কাহিনীটির সূচনা পর্বে বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক মন্তব্য করেছিলেন, ‘ইত্তেফাক পত্রিকার বিখ্যাত সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার সঙ্গে মোনেম খান (ষাটের দশকে আইয়ুব শাসনামলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর) যে রকম ব্যবহার করেছিল, বর্তমান সরকার মাহমুদুর রহমানের সঙ্গে একই রকম আচরণ করল।’ জনাব রফিক-উল হক পতিত স্বৈরাচারীদের কথা মনে করিয়ে দেয়ায় তাকে আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। কারণ বর্তমানে যারা দেশ চালাচ্ছেন তারা সম্ভবত ১৯৭২ সালের জানুয়ারি থেকে ইতিহাসের শুরু বলে মনে করেন। তাদের কথাবার্তা থেকে মাঝে মধ্যে এমনই ধারণা জন্মায়। তবে যা সত্যি তা হলো, বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছে বেশ দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এবং সেই সংগ্রাম ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের অনেক আগ থেকেই চলে আসছিল। ব্যারিস্টার রফিক-উল হক সে কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন। তিনি যে গভর্নর মোনেম খানের কথা বলেছেন, সেই ব্যক্তির নেতা ও চাকরিদাতা ছিলেন পাকিস্তানে গণতন্ত্র উৎখাতকারী এবং এই উপমহাদেশে সামরিক শাসনের প্রবর্তক সেনাপতি আইয়ুব খান। ওই পাকিস্তানি জেনারেল পূর্ব বাংলার স্বাধিকার আন্দোলন দমন করার জন্য বঙ্গবìধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে একের পর এক রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা লাগাতে থাকলেন এবং তাকে কারারুদ্ধ করে রাখলেন। তাদের ওই সব জঘন্য কর্মকাণ্ডের জন্য আইয়ুব খান ও মোনেম খান এতই নিন্দার পাত্র হয়েছিলেন যে, তারা দেশে বা বিদেশে কোথাও মুখ দেখাতে পারতেন না। সেই সময়টা ছিল প্রথমে বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলন এবং তারপর মুক্তিযুদ্ধের সময়।

বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, তাই প্রেক্ষিত বদলেছে। তবে দু:খজনকভাবে পরিবর্তন অতটা হলো না যে আমরা নিশ্চিতভাবে ও নিশ্চিত করে বলতে পারি দেশে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রকৃতপক্ষে প্রচলিত হয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে, নির্বাচিত সরকারগুলো আমলেও আইনের শাসন, মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক রীতিনীতি মারাত্মকভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে ও হচ্ছে। আমাদের দেশের ওপর বিদেশী শক্তিগুলোর প্রভাব বিস্তার ও নানাভাবে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টাও হচ্ছে। কাজেই গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য সোচ্চার হতেই হচ্ছে। দেশের ভেতর প্রকট অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টি হওয়ায় এক দিকে লুটেরা শ্রেণী আর অন্য দিকে তাদের কৃপাধন্য সুবিধাবাদী গোষ্ঠীও আবির্ভূত হয়েছে। সত্যিকার বাকস্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা ও আইনের শাসন­ এই দুই গোষ্ঠী ও তাদের সহায়তাকারী শাসকশ্রেণীর জন্য খুবই অসুবিধাজনক। তাই দেশের যে নাগরিকরা ও প্রতিষ্ঠানগুলো নিরাপদ জীবন, নাগরিক অধিকার ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চাইবেন তাদের সাথে ওই তিন শ্রেণীর সঙ্ঘাত অনিবার্য। দৈনিক আমার দেশ ও পত্রিকাটির ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের অবস্খান প্রথমোক্তদের সাথে। আর সে জন্যই তাদের কঠিন বিপদে পড়তে হয়েছে। এই গুরুতর সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য তাদের এবং তাদের সমর্থকদের সংগ্রাম করতেই হবে। বস্তুতপক্ষে সেই আন্দোলন জারি আছে। আর যারা ক্ষমতাসীন তাদের অনুরোধ করছি গভীরভাবে চিন্তা করতে যে, তারা কি নিজেদের আইয়ুবশাহি-মোনেমশাহির সমগোত্রীয় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকতে চান?

বাংলাদেশের গণমাধ্যম জগতে ভয়, হতাশা ও নিরাপত্তাহীনতা চলছে শুরুতেই এ কথা লিখেছিলাম। স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধবাদী পত্রিকা হিসেবে এক সময় সাবেক পাকিস্তানজুড়ে খ্যাতি ছিল যে পত্রিকার, তখন যার নাম ছিল পাকিস্তান অবজারভার এবং যার বর্তমান নাম বাংলাদেশ অবজারভার, সেই খবরের কাগজটি বìধ হয়ে গেল। ১৯৬২ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত এ পত্রিকায় কাজ করতে গিয়ে জুনিয়র রিপোর্টার পদে থাকার সময়ই সাংবাদিক হিসেবে বেশ পরিচিতি পেয়েছিলাম। বার্তা সম্পাদক মূসা ভাই (এবিএম মূসা) তো ওই যুবা বয়সেই কিংবদন্তিতুল্য হয়ে গিয়েছিলেন। সদা সুবচন উচ্চারণে অভ্যস্ত; কিন্তু ইংরেজি ভাষায়, ক্ষুরধার লেখনীর অধিকারী সম্পাদক জনাব সালাম সবার শ্রদ্ধেয়, তবু নিপীড়ক মুসলিম লীগ সরকার তাকে জেলে পাঠিয়েছে। পাকিস্তান অবজারভারের দুই তরুণ সাংবাদিক শহীদুল হক ও এনায়েতুল্লাহ খান সম্পর্কে সম্মান করে কথা বলতে শুনেছি বঙ্গবìধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। পত্রিকাটির খ্যাতিমান ক্রীড়া সাংবাদিক তৌফিক আজিজ খান বর্তমানে বাংলাদেশে সর্বাধিক প্রচারিত ইংরেজি পত্রিকা ডেইলি স্টার পত্রিকার সাফল্যের একজন রূপকার। সেই বাংলাদেশ অবজারভার মালিকদের কোন্দল ও অব্যবস্খাপনার কবলে পড়ে ধুঁকতে ধুঁকতে বìধ হয়ে গেল গত মঙ্গলবার, ৮ জুন ২০১০। বìধ হওয়ার প্রক্রিয়াটি আমার কাছে অপরিচ্ছন্ন বলে মনে হচ্ছে। কর্মচারীদের অনেকেই তাদের অনেক বছরের বকেয়া বেতনের পুরোটা পাননি। অবজারভার এভাবে বìধ হয়ে যাওয়া সাংবাদিক ও সংবাদপত্রের অন্য কর্মীদের মধ্যে অনিশ্চয়তাবোধ বাড়িয়ে দিলো। আমার মতো সাবেক কর্মচারীদের মধ্যে সৃষ্টি করল তীব্র বেদনা ও দু:খবোধ। অবজারভারের আগে ভিন্ন ভিন্ন কারণে বìধ করে দেয়া হয়েছে চ্যানেল ওয়ান ও আমার দেশ। আমি এখনো মনে করি আইনি সমঝোতার মাধ্যমে চ্যানেল ওয়ান আবার চালু করা সম্ভব। আমার দেশ পত্রিকার মালিকরা আদালতে আইনি লড়াই করছেন পত্রিকাটির প্রকাশনা অব্যাহত রাখার জন্য। আমার দেশ বìধ হয়েছে সরকারের ইচ্ছায়। সরকারই ইচ্ছা করলে নিষেধাজ্ঞা (তথা ডিক্লারেশন বাতিল ঘোষণা) তুলে নিতে পারে এবং ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে মুক্তি দিতে পারে। সরকার তা করলে একটা গুমোট ও ভীতিকর পরিস্খিতি স্বাভাবিক হয়ে আসতে পারে। তবে শুনতে পাই যে, ক্ষমতার দরবারে নাকি এখন ‘এক হাত দেখিয়ে দেয়া হোক’ মানসিকতাসম্পন্ন পারিষদদের দাপট চলছে। তবে দেশবাসী এর ব্যত্যয় দেখতে পেলে আনন্দিত হবে।

আজকে (বৃহস্পতিবার) অর্থমন্ত্রী জাতীয় বাজেট ঘোষণা করবেন। তিনি জানিয়েছেন, এবারে বড় আকারের বাজেট আসছে। অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেছেন, উন্নয়নের গতি জোরদার করার জন্য সরকারকে বড় বাজেট দিতেই হবে। তবে পরিকল্পনামন্ত্রী এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার বলেছেন, এবার উন্নয়ন বাজেট বড় হওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে, এমন অনেক উন্নয়ন প্রকল্প রয়ে গেছে যেগুলোর কাজ শেষ হয়নি; কিন্তু সেগুলো সম্পন্ন করতে হবে। এ কথার একটা অর্থ হতে পারে যে, হাতে নেয়া উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়নের কাজ ঠিকমতো হয়নি। আরেকটু অগ্রসর হয়ে বলা যায়, বাজেট অর্থপূর্ণ হতে হলে সরকারকে যোগ্যতার পরিচয় দিতে হবে। এ নিয়ে কিছু কথা হয়েছে। ভবিষ্যতে যে আরো অনেক কথা শোনা যাবে, সে ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত। তবে আমাদের কথা হলো, সরকারের বাজেট যেন প্রতিটি দেশবাসীর ব্যক্তিগত বাজেট বাস্তবায়ন করতে সহায়তা করে, বিশেষ করে ছয় কোটি দরিদ্রের, যে দরিদ্ররা প্রয়োজনমতো অল্প জোটাতে পারছে না।

বিএনপি চেয়ারপারসন ও বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া গত সোমবার বিরোধী দলের বাজেট ভাবনা সবিস্তারে প্রকাশ করেছেন। আমাদের দেশের রাজনীতিতে এ রকমভাবে বড় রাজনৈতিক দলের প্রাক-বাজেট প্রস্তাব উপস্খাপন করা এই প্রথম। আমরা মনে করি দেশে গণতান্ত্রিক রীতিনীতির চর্চা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথে এটি একটি চমৎকার ও প্রশংসনীয় পদক্ষেপ। অথচ কেউ কেউ এর নিন্দা করেছেন। আমরা ওই নিন্দুকদের নিন্দা করছি এবং তাদের সম্পর্কে দেশবাসীকে সাবধান থাকতে অনুরোধ করছি।
লেখক : প্রবীণ সাংবাদিক ও কলামিস্ট
[সূত্রঃ নয়া দিগন্ত, ১০/০৬/১০]

কোথায় নয়, কী বলেছেন সেটাই গুরুত্বপূর্ণ

এমাজউদ্দীন আহমদ

মত দ্বিমত বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া গত মঙ্গলবার সংসদের বাইরে একটি বিকল্প বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেছেন। সংসদে জাতীয় বাজেট উপস্থাপনের আগে এই বিকল্প বাজেট পেশ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়েছে। এ নিয়ে দুটি লেখা ছাপা হলো।

বিরোধীদলীয় নেত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ২০১০-১১ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটকে সামনে রেখে যেসব প্রস্তাব করেছেন তা যেমন ইতিবাচক তেমনি গঠনমূলক।

সংসদীয় ব্যবস্থায় দেশ পরিচালনায় সরকার ও বিরোধী দলের যৌথ ভূমিকাই প্রত্যাশিত। যেকোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সরকার ও বিরোধী দলের মতামত প্রতিফলিত হওয়া প্রয়োজন। বাজেট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অতএব এ সম্পর্কে বিরোধী দল কিছু বলবে না তো তা হয় না।

স্বীকার করি, সংসদে বিরোধী দল তাদের প্রস্তাবনা পেশ করলে আরও ভালো হতো। কিন্তু কোনো কারণে বিরোধী দল যদি সংসদে না যায় তাহলে সে জায়গা শূন্য থাকতে পারে না। বর্তমানে সংসদে সুষ্ঠু পরিবেশ আছে তা বলা যাবে না। সেখানে যেসব অরুচিকর কথাবার্তা হয় তা পৃথিবীর কোনো সভ্য দেশে হয় না। অতএব বিরোধীদলীয় নেত্রী কোথায় বাজেট নিয়ে প্রস্তাব রেখেছেন, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, তিনি কী বলেছেন। তাঁর প্রস্তাবগুলো যুক্তিপূর্ণ হলে গ্রহণ করতে বাধা কোথায়?

যেভাবেই প্রস্তাবটি উত্থাপিত হোক না কেন, এর মাধ্যমে বিরোধী দল এক বছরের আয়-ব্যয়, উন্নয়ন ইত্যাদি সম্পর্কে তাদের মতামত রেখেছে, বেশ কিছু গঠনমূলক প্রস্তাব দিয়েছে। তারা কিন্তু সরকারের বাজেট প্রস্তাবের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়নি। বাজেট পেশের পরও তারা প্রস্তাব রাখেনি। সংসদে বাজেট পেশের আগেই তারা সরকারকে কিছু পরামর্শ দিয়েছে। সরকারের উচিত বিরোধী দলের যুক্তিসংগত প্রস্তাবগুলো আমলে নেওয়া ও গ্রহণ করা।
অনেকে বলবেন, বিরোধী দল সংবাদ সম্মেলন না করে সংসদে গিয়ে প্রস্তাবগুলো দিতে পারত। সে সুযোগ তো এখনো আছে। স্পিকার বিরোধী দলকে সংসদে আহ্বান জানাতে পারেন। সরকারি দল বলতে পারে, আপনারা প্রস্তাব দিয়েছেন, এখন সংসদে এসে আলোচনা করুন। সংসদীয় ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর প্রায় ২০ বছর চলে গেছে। কিন্তু আমরা সংসদীয় ব্যবস্থাকে কার্যকর করতে পারিনি। এ পরিস্থিতিতে বিরোধী দল কোথায় প্রস্তাবটি রেখেছে তা নিয়ে অযথা বিতর্ক না করে তাদের বক্তব্য গুড গেরেস হিসেবেই নেওয়া উচিত।

বিরোধী দল বাজেট নিয়ে রাজনৈতিক বক্তব্য দেয়নি। তারা তথ্য-প্রমাণ ও যুক্তি দিয়ে কিছু নির্দিষ্ট প্রস্তাব উত্থাপন করেছে। এগুলো রাজনৈতিক বিতর্কের বিষয় নয়। অর্থনৈতিক দিকনির্দেশনা। এসব প্রস্তাব অগ্রাহ্য করা ঠিক হবে না।

উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, বিরোধীদলীয় নেত্রী বাজেটে করের আওতা না বাড়িয়ে ব্যবস্থাপনার উন্নয়নের কথা বলেছেন, দক্ষতা বাড়ানোর কথা বলেছেন। এ ধরনের প্রস্তাব তো অর্থনীতিবিদসহ অন্যান্য পেশার মানুষও করেছেন। তাহলে বিরোধী দলের প্রস্তাবকে বাঁকা চোখে দেখার কী আছে?
শিক্ষা খাতের উন্নয়নেও তারা বেশ কিছু ভালো প্রস্তাব দিয়েছে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে এক সন্তানের পরিবারের জন্য মাসে ৫০০ টাকা প্রণোদনা ভাতা দেওয়ার কথা বলেছে। সামরিক বাহিনী, পুলিশ বাহিনী ও সরকারি কর্মকর্তাদের সম্পর্কেও বিরোধীদলীয় নেত্রী নির্দিষ্ট প্রস্তাব দিয়েছেন। পিলখানা ট্রাজেডিতে বহু দক্ষ সেনা কর্মকর্তাকে আমরা হারিয়েছি। তাঁদের স্থান পূরণ করতে হলে সেনাবাহিনীতে সুদক্ষ কর্মকর্তা নিয়োগের প্রয়োজন রয়েছে।
বিরোধীদলীয় নেত্রী দেশের সব অঞ্চলে সুষম উন্নয়নের কথা বলেছেন, প্রকল্পগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়নের ওপর যে গুরুত্ব দিয়েছেন তাকে বাঁকা চোখে দেখার সুযোগ নেই। পুলিশ বাহিনী ও সরকারি কর্মকর্তাদের দলীয়করণ না করার কথা বলেছেন। এটি যেকোনো বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষই সমর্থন করবেন।
ড. এমাজউদ্দীন আহমদ: শিক্ষাবিদ। সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


http://www.prothom-alo.com/detail/date/2010-06-10/news/69799

Monday 7 June 2010

আমার দেশ: সরকারের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা

ড. আসিফ নজরুল

৩০ মে একটি আলোচনা সভা ছিল টিভি চ্যানেলগুলো নিয়ে। চ্যানেল ওয়ান সরকার বন্ধ করেছে, যমুনা টিভির পরীক্ষামূলক সম্প্রচার বন্ধ রয়েছে। সবারই অভিমত, এগুলো কোনো সুস্থ গণতান্ত্রিক পরিবেশের পরিচায়ক নয়। তবে আলোচনাকালে আমরা একমত হলাম যে প্রিন্ট মিডিয়ার অন্তত সে দুরবস্থা নেই, সরকার চাইলেই কোনো পত্রিকা এখন আর বন্ধ করে দিতে পারবে না। আমরা তখন ভাবতে পারিনি, সরকার চাইলে আসলে সব পারে। সরকারের হাতে আইন, ক্ষমতা, পুলিশ। এসবের অপব্যবহার করে কীভাবে সরকার রাতারাতি একটি দৈনিকের কণ্ঠরোধ করতে পারে তার খুবই খারাপ একটি নজির স্থাপিত হলো ১ জুন। যে প্রক্রিয়ায় এদিন আমার দেশ বন্ধ করে দেওয়া হলো, যে অভিযোগে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হলো, যেভাবে পরে পত্রিকাটির সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে পুলিশি গ্রেপ্তারে বাধা সৃষ্টির অভিযোগে মামলা হলো তা অচিন্তনীয়, অগ্রহণযোগ্য এবং সকল অর্থে নিন্দনীয়।

আমার দেশ পত্রিকায় সরকারের মন্ত্রী এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় প্রতিবেদন ছাপানো হয়েছে। এই পত্রিকাটি সরকারের বিদেশনীতি বিশেষ করে ভারতের প্রতি ‘নতজানু’নীতির তীব্র সমালোচক। এসব প্রতিবেদন ও সমালোচনা সবই ন্যায়সংগত বা বস্তুনিষ্ঠ তা হয়তো বলা যাবে না (আরও বহু পত্রিকার ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য)। এর ফলে দেশের কোনো আইনেরও (যেমন মানহানিসংক্রান্ত দণ্ডবিধির বিধান) লঙ্ঘন হতে পারে, সে ক্ষেত্রে তার বিচার করার জন্য আদালত রয়েছেন। বিভিন্ন আদালতে মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে কয়েক ডজন মামলাও করা হয়েছে সে কারণে। অতীতেও বিভিন্ন সরকারের বিরুদ্ধে কিছু পত্রিকার অব্যাহত সমালোচনার মুখে এ রকম মামলা হয়েছে। কিন্তু সে জন্য পরিকল্পিতভাবে ব্যক্তিমালিকানাধীন কোনো পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়ার ঘটনা নব্বই-পরবর্তী সময়ে এই প্রথম।

অতীতে চার দলীয় জোট সরকার কিছু সাংবাদিক ও লেখকের প্রতি নানাভাবে তার অসহিষ্ণুতা ও কখনো কখনো নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করেছে। তখন আওয়ামী লীগ তীব্রভাবে তার প্রতিবাদ করেছে এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার প্রতি তার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছে। কিন্তু একের পর এক গণমাধ্যম দমনের পদক্ষেপ নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার এই অঙ্গীকারের বিশ্বাসযোগ্যতা ইতিমধ্যেই ধূলিসাৎ করেছে। সবচেয়ে যা ভয়াবহ, আমার দেশ পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ করে সংবাদপত্র দমনে আইনের অপব্যবহারের এক আতঙ্কজনক নজির স্থাপন করেছে।

২.
সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফ সাংবাদিকদের ইতিমধ্যে বলেছেন, আমার দেশ সরকার বন্ধ করেনি, বন্ধ করেছেন প্রকাশক! ২ জুন টিভিতে দেখলাম, এই কথা বলে তিনি তড়িঘড়ি সচিবালয়ের লিফটে ঢুকে গেছেন। তাঁর এই বক্তব্য এতই অসার এবং ঠুনকো যে এটি যেকোনো বিবেকবান মানুষকে আরও হতাশ ও বিক্ষুব্ধ করবে।

আমার দেশ প্রকাশক বন্ধ করেননি, এটি সরকারই পরিকল্পিতভাবে বন্ধ করেছে, এটি সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। গ্রেপ্তারের আগে বিভিন্ন প্রমাণসহ সংবাদ সম্মেলনে মাহমুদুর রহমানের দেওয়া তথ্য এবং বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপা হওয়া প্রতিবেদন অনুসারে, হাসমত আলীর সম্মতিক্রমে তাঁর বদলে মাহমুদুর রহমানকে আমার দেশ-এর প্রকাশক হিসেবে প্রতিস্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে আমার দেশ কর্তৃপক্ষ। সে মোতাবেক জেলা প্রশাসক অফিসে চিঠি লিখে হাসমত আলীর পদত্যাগ ও প্রকাশক হিসেবে মাহমুদুর রহমানের নাম ব্যবহারের অনুমতি চাওয়া হয়। ৫ নভেম্বর ২০০৯ চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা দপ্তরের উপপরিচালক (নিবন্ধন) স্বাক্ষরিত একটি পত্রে জেলা প্রশাসক অফিসকে জানানো হয়, প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ করায় হাসমত আলীর পরিবর্তে প্রকাশক হিসেবে মাহমুদুর রহমানের নাম প্রতিস্থাপন করার অনুমতি দেওয়া যেতে পারে। এরপর দীর্ঘদিন জেলা প্রশাসক অফিস এ বিষয়ে আর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।

জেলা প্রশাসক এই চিঠি লিখে অনুমোদন না দেওয়া পর্যন্ত প্রকাশক হিসেবে হাসমত আলীর নাম ব্যবহার করেছে আমার দেশ কর্তৃপক্ষ। ১৯৭৩ সালের দ্য প্রিন্টিং প্রেসেস অ্যান্ড পাবলিকেশন (ডিক্লারেশন অ্যান্ড রেজিস্ট্রেশন) অ্যাক্ট অনুসারে প্রকাশক হিসেবে কারও নাম না ছাপিয়ে পত্রিকা বের করা সম্পূর্ণ অবৈধ। আমার দেশ কর্তৃপক্ষের তাই মাত্র দুটো বিকল্প খোলা ছিল: ক. হাসমত আলীর বদলে মাহমুদুর রহমানের নাম প্রকাশক হিসেবে ব্যবহারের অনুমতি না দেওয়া পর্যন্ত হাসমত আলীর নামই প্রকাশক হিসেবে ছাপানো; খ. অথবা আমার দেশ পত্রিকার প্রকাশনা তত দিন পর্যন্ত বন্ধ রাখা। আমার দেশ কর্তৃপক্ষ প্রথম কাজটি করেছে। এটি যদি অপরাধ হয়ে থাকে তাহলে তার সম্পূর্ণ দায়দায়িত্ব জেলা প্রশাসক অফিস তথা সরকারের। ডিএফপি এবং এসবির অনাপত্তি থাকা সত্ত্বেও এত দিন ধরে তার আবেদনটি ঝুলিয়ে রাখা হলো কেন? কেনই বা পত্রিকা বন্ধ ও মাহমুদুর রহমানকে গ্রেপ্তারের কয়েক ঘণ্টা পরে জানানো হলো যে প্রকাশক হিসেবে মাহমুদুর রহমানের নাম ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না?
আগের প্রকাশকের পদত্যাগপত্র গ্রহণ ও প্রস্তাবিত নতুন প্রকাশকের নাম অনুমোদন না করার মানে হলো, একটি পত্রিকাকে প্রকাশকহীন করে ফেলা। প্রকাশকহীন করা মানে হলো পত্রিকাটি বন্ধ করে দেওয়াকে আইনসিদ্ধ করা। ‘দিনবদলের’ সরকারের এই অভিনব আবিষ্কার ভবিষ্যতে অন্য কোনো সরকার আরও বিভিন্নভাবে ব্যবহার করবে না এটি ভাবার কোনো কারণ নেই। কুবুদ্ধির প্রতিযোগিতায় কেউ কারও চেয়ে কম যায় না, আমাদের সরকারগুলোর ইতিহাস তো এটিই!

মাহমুদুর রহমানের গ্রেপ্তারের প্রক্রিয়াও অসুস্থ প্রতিযোগিতার জন্ম দিতে পারে এ দেশে। হাসমত আলীকে সরকারের একটি বিশেষ এজেন্সি ধরে নিয়ে গিয়ে কয়েক ঘণ্টা আটকে রেখে মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা করিয়েছে, পুলিশ সঙ্গে সঙ্গে পত্রিকার ছাপাখানা সিলগালা করেছে, পত্রিকার সম্পাদককে গ্রেপ্তারের জন্য সদলবলে পত্রিকা অফিস ঘিরে ফেলেছে। এসব যদি আমরা সমর্থনীয় ধরে নিই, তাহলে ভবিষ্যতে যেনতেনভাবে মামলা করিয়েই বিরুদ্ধ মতের যে কাউকে গ্রেপ্তার এবং পত্রিকা বন্ধের ঘটনা আমাদের মেনে নিতে হবে। তাই যদি হয়, দেশে আর যা-ই থাকুক, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, মানবাধিকার আর আইনের শাসন বলে কিছু থাকবে না।

৩.
মাহমুদুর রহমান ও আমার দেশ-এর সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সরকারি কাজে অর্থাৎ গ্রেপ্তারে বাধাদানের অভিযোগও আনা হয়েছে। মাহমুদুর রহমানকে গ্রেপ্তার করতে গেলে পত্রিকাটির সাংবাদিকেরা অফিসের প্রবেশপথ আগলে রেখেছিলেন। চাইলে এটিকে সরকারি কাজে বাধাদান হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়তো সম্ভব। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে, কোনো দেশের আইন প্রয়োগ করা হয় সে দেশের সমাজ-সংস্কৃতি অনুসারে। গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক কোষাধ্যক্ষকে কোনো একটি মামলায় মধ্যরাতে গ্রেপ্তারের জন্য শাহবাগ থানার ওসিসহ অসংখ্য পুলিশ তাঁর বাড়িতে প্রবেশ করে। খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান কোষাধ্যক্ষসহ অনেক শিক্ষক সেখানে ছুটে যান। পুলিশ একপর্যায়ে তাঁকে গ্রেপ্তার না করে চলে যায়। ওই ঘটনাকেও এক অর্থে সরকারি কাজে বাধাদান বলে আখ্যায়িত করা যায়। আমাদের দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে শীর্ষস্থানীয় নেতাদের গ্রেপ্তার করতে গেলে সমর্থকদের দ্বারা বিক্ষোভ বা তা কিছুটা বিলম্বিত করার ঘটনা ঘটেছে। তাই বলে এসব ঘটনায় সরকারি কাজে বাধাদানের কারণে ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হয়নি।

সরকার তাহলে এবার এমন খড়্গহস্ত হলো কেন আমার দেশ পত্রিকার সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে? পত্রিকাটির কয়েকজন প্রসিদ্ধ সাংবাদিকসহ অজ্ঞাতপরিচয় প্রায় ১০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করার মানে হলো, পত্রিকাটির যেকোনো সাংবাদিককে সেই মামলায় গ্রেপ্তার করার লাইসেন্স নিয়ে রাখা। শুধু চাকরিচ্যুতি নয়, আমার দেশ-এর সাংবাদিকদের তাই এখন পালিয়ে থাকতে হবে গ্রেপ্তার এড়াতে চাইলে।
এই পরিস্থিতি সংবাদকর্মী তথা সংবাদপত্রশিল্পের জন্য এক ঘোর অমানিশার ইঙ্গিতবাহী।

৪.
এসব ঘটনার ভয়াবহ পরিণতি চিন্তা করে আমরা উদ্বিগ্ন। এতে কিছু ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, শুধু তা নয়, এটি অন্য সব সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমের জন্য হুমকিস্বরূপ। বাংলাদেশে সরকারগুলো ঐতিহাসিকভাবে অদক্ষ, দুর্নীতিপরায়ণ এবং চিন্তাচেতনায় সামন্তবাদী। এর বিরুদ্ধে নাগরিক স্বার্থের শ্রেষ্ঠ রক্ষাকবচ হচ্ছে সংবাদপত্র। পত্রিকা যে চাইলেই আসলে বন্ধ করে দেওয়া যায়, এই আশঙ্কা গেড়ে বসলে সাংবাদিকতা নানাভাবে শৃঙ্খলিত হবে। সরকারগুলো আরও স্বৈরাচারী হওয়ার সুযোগ পাবে।

আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, সাংবাদিকদের সুস্পষ্ট অনৈক্যই বাংলাদেশের সরকারগুলোকে ক্রমাগত গণমাধ্যমবিরোধী ভূমিকা গ্রহণে বাড়তি সাহস জুগিয়েছে। মাহমুদুর রহমান যাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় মামলা করেছেন এবং তাঁর পত্রিকায় লিখেছেন, সেই পত্রিকাগুলোতেও আমার দেশ বন্ধের ও তাঁকে গ্রেপ্তারের প্রক্রিয়ার নিন্দা করে সম্পাদকীয় ছাপা হয়েছে। কিন্তু সাংবাদিক সমিতিগুলো এখনো ঐক্যবদ্ধভাবে এ ঘটনার প্রতিবাদ করতে পারেনি।

দলমতনির্বিশেষে সাংবাদিকনেতারা সবাই মিলে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করার পদক্ষেপ নিলে আমার দেশ (এবং চ্যানেল ওয়ান ও যমুনা টিভি) বন্ধের আদেশ এবং প্রশ্নবিদ্ধ মামলাগুলো প্রত্যাহার করা হয়তো সম্ভব। এটুকু দায়িত্ব পালনে তাঁরা যদি ঐক্যবদ্ধ হতে না পারেন, তাহলে ভবিষ্যতে আরও সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেল বন্ধ হবে। আরও সাংবাদিক কোনো না কোনো সময় অন্যায় গ্রেপ্তারের শিকার হবেন।
কোনো মুক্তবুদ্ধির মানুষের কাছে এই পরিস্থিতি কাম্য হতে পারে না।

আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
[সূত্রঃ প্রথম আলো, ০৭/০৬/১০]

আমার দেশ-এর টার্নিং পয়েন্টঃ প্রকাশনা নিষিদ্ধ

শফিক রেহমান

কিছু কাল জুড়ে শোনা যাচ্ছিল বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের কর্মসূচিতে বিদুøৎ-গ্যাস এবং পানি নয়­ যে দুটি বিষয় অগ্রাধিকার পাচ্ছে তা হলো, এক. ক্যান্টনমেন্টে যে বাড়িতে সাড়ে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে ম্যাডাম খালেদা জিয়া বসবাস করছেন, সেখান থেকে তাকে উৎখাত করা এবং দুই. দৈনিক আমার দেশ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও লেখক মাহমুদুর রহমানকে জেলে নেয়া।
চলমান বিদুøৎ-গ্যাস ও পানি সংকটের চাইতেও আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে গভীরতর সংকট হয়েছে খালেদা জিয়ার বাসস্থান এবং মাহমুদুর রহমানের দৈনিক পত্রিকা, এমনটা অনেকেই বিশ্বাস করছিলেন না। একটি বাড়ি এবং একটি পত্রিকা আওয়ামী লীগ সরকারকে এমনই দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে যে, তারা বিদুøৎ-গ্যাস ও পানির অভাব, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, কর্মসংস্থানের নিুগতি ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির মোকাবিলার বদলে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে শুধু ওই দুটি বিষয় সর্বাগ্রে মোকাবিলার জন্য? এটা বিশ্বাস করতে অনেকের কষ্ট হলেও গত সপ্তাহে মাহমুদুর রহমানকে সত্যিই জেলবন্দী করা, দৈনিক আমার দেশ-এর প্রেস গালাসিল করে দেয়া এবং আমার দেশ পত্রিকার ডিক্লারেশন বাতিল করা হয়েছে। এ সবই ঘটেছে মঙ্গলবার ১ জুন ২০১০-এর বিকেল পাচটা থেকে পরবর্তী ১১ ঘণ্টার মধ্যে।

ওই দিন দুপুর থেকেই মোবাইল ফোন ও এসএমএস-এর রিং টোনের সঙ্গে সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ছিল একটি সংবাদঃ আজ মাহমুদুর রহমান গ্রেফতার হবেন ও আমার দেশ বন্ধ হয়ে যাবে।
কেউ যদি জানতে চান এই দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার খবরটির ভিত্তিটা কি, তাহলে উত্তর আসে আমার দেশ পত্রিকার প্রকাশক ও মুদ্রাকর মোহাম্মদ হাসমত আলীকে একটি গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে আটকে রেখেছে তাদের অফিসে। তখনই আমার মনে পড়ে গেল ১৯৮৫ এবং ১৯৮৬-তে সাপ্তাহিক যায়যায়দিন নিষিদ্ধ ঘোষিত হবার পূর্ব সময়গুলো। তফাৎ এই যে, তখন বাংলাদেশে মোবাইল ফোন যুগ ছিল না। ফলে খুব কম সংখ্যক ব্যক্তিই জানতেন সরকার কিভাবে দমনপীড়ন কাজগুলো করবে। সুদীর্ঘ পচিশ বছর পরে আবার সেই প্রক্রিয়াটি কিভাবে সম্পন্ন হতে চলেছে সেটা জানার জন্য বিকেল চারটার সময়ে আমি চলে যাই কাওরানবাজারে এয়ারপোর্ট রোডের ইস্পাত ভবনের এগারো তলায় আমার দেশ-এর সম্পাদকের অফিসে।

মাহমুদুর রহমানের সাথে একাত্মতা প্রকাশের জন্য কয়েকজন সিনিয়র সাংবাদিক সেখানে উপস্থিত ছিলেন। মাহমুদুর রহমান তাদের বলেন, তিনি খবর পেয়েছেন হাসমত আলীকে একটি গোয়েন্দা সংস্থার অফিসে কয়েক ঘণ্টা আটক রাখার পর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। তবে ছেড়ে দেয়ার আগে দুটি শাদা কাগজে হাসমত আলীকে সই দিতে হয়েছে।

সাবেক এমপি মোসাদ্দেক আলী ফালুর ভাই আলহাজ্ব মোহাম্মদ হাসমত আলী আমার দেশ পত্রিকার সূচনালগ্ন থেকে প্রকাশক ও মুদ্রাকরের দায়িত্ব পালন করছিলেন। যেসব পাঠক পত্রিকা প্রকাশের আইনগত মারপ্যাচ জানেন না, তাদের এখানে জানিয়ে রাখছি, একটি পত্রিকার টাইটেল বা নামের মালিক হন পত্রিকাটির প্রকাশক ও মুদ্রাকর। এ জন্য প্রকাশের আগে স্থানীয় ডিস্ট্রিক্ট কমিশনার (ডিসি)-এর মাধ্যমে তাকে আবেদন করতে হয় সরকারের কাছে যে, তিনি একটি পত্রিকা প্রকাশে ইচ্ছুক। এরপর সেই ব্যক্তির বিভিন্ন যোগ্যতা সম্পর্কে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি) তাদের তদন্ত প্রক্রিয়া শুরু করে এবং তাদের রিপোর্ট ডিসি অফিসে পেশ করে। ওই রিপোর্ট যদি ভালো হয় অর্থাৎ সরকারের মনোঃপূত হয় তাহলে নির্ধারিত দিনে আবেদনকারীকে সশরীরে উপস্থিত হতে হয় ডিসি অফিসে। সেখানে ডিসির সামনে তাকে ফর্ম-বি নামে একটি ঘোষণাপত্রে সই করতে হয়। এই ঘোষণাপত্রে লেখা থাকেঃ
আমি, এই মর্মে আরও ঘোষণা করিতেছি যে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ অথবা বাংলাদেশ সরকারের স্বার্থের প্রতিকূলে এমন কোন অপরাধজনক বা আপত্তিকর বিষয় আমার উপরোক্ত পত্রিকায় মুদ্রণ বা প্রকাশে বিরত থাকিব এবং বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গৃহীত ১৯৭৩ সালের ছাপাখানা ও প্রকাশনা (ডিক্লারেশন ও রেজিস্ট্রেশন) আইনের নিয়মাবলী মানিয়া চলিতে বাধ্য থাকিব।
এটিকেই বলা হয় ডিক্লারেশন। এই ডিক্লারেশনের পর থেকে আবেদনকারী পত্রিকাটির নামের একক মালিক বা সোল প্রোপ্রাইটর হয়ে যান­ তিনি পত্রিকাটি প্রকাশ করুন আর নাই করুন। এই মালিকানার কোনো ভাগাভাগি বা অংশীদারিত্ব সম্ভব নয়।
দৈনিক ইত্তেফাক-এর প্রকাশনা সংকট ছিল এখানেই। দুই ভাইয়ের প্রচণ্ড বিরোধ মীমাংসার লক্ষ্যে ইত্তেফাক প্রতিষ্ঠানটির সকল সম্পদ ভাগাভাগি করা গেলেও ইত্তেফাক নাম, যা টাইটেল বা ডিক্লারেশনের ভাগাভাগি সম্ভব ছিল না। তাই সম্প্রতি আনোয়ার হোসেন মঞ্জু দশ কোটি টাকার বিনিময়ে তার বড় ভাই মইনুল হোসেনের কাছ থেকে ইত্তেফাক টাইটেলটি ফেরত নিয়েছেন এবং তিনিই এখন এককভাবে দৈনিক ইত্তেফাকের মালিক।

প্রকাশক ও মুদ্রাকরের পক্ষে যদি কোনো কারণে সেই দায়িত্ব পালন অসম্ভব হয়ে পড়ে তাহলে প্রায় একই পক্রিয়ায় তাকে আবার ডিসির সামনে সশরীরে উপস্থিত হয়ে আরেকটি ঘোষণাপত্রে (ফরম সি) সই দিয়ে তার অপারগতা জানাতে হয়। যদি পত্রিকাটির প্রকাশনা চলমান থাকে তাহলে একই প্রক্রিয়ায় পত্রিকাটির নতুন প্রকাশক ও মুদ্রাকরকে ফরম বি-তে সই করতে হয় এবং তারপর থেকে তিনিই হন নতুন মালিক।

এখানে পাঠকদের জানিয়ে রাখছি, পত্রিকার প্রকাশক ও মুদ্রাকরই নিয়োগ করেন পত্রিকার সম্পাদককে। তবে তার আগে এসবি-র ক্লিয়ারেন্স নিতে হয়। কোনো কারণে যদি সম্পাদক তার পদ ছেড়ে দেন বা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন, তাহলে তিনি একজন নতুন সম্পাদক, অথবা কোনো নতুন সম্পাদককে পাওয়া সম্ভব না হলে একজন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক নিয়োগ করে পত্রিকার প্রকাশনা চলমান রাখতে পারেন মালিক। কিন্তু ভারপ্রাপ্ত প্রকাশক ও মুদ্রাকর নিয়োগ সম্ভব নয়।

আর এখানেই সরকার সমস্যায় ফেলতে চেয়েছে মাহমুদুর রহমানকে। সরকার অভিযোগ করেছে তিনি ডিক্লারেশন সম্পর্কিত আইন মেনে চলেননি এবং তাই আমার দেশ পত্রিকার ডিক্লারেশন বাতিল করা হয়েছে।
আমার দেশ পত্রিকার প্রিন্টার্স লাইনে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক রূপে মাহমুদুর রহমানের নাম এবং প্রকাশক ও মুদ্রাকর রূপে আলহাজ্ব মোহাম্মদ হাসমত আলীর নাম ছিল।

মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার, জাপানে সিরামিকসে টেকনিকাল শিক্ষাপ্রাপ্ত মাহমুদুর রহমান মেথডিকাল ব্যক্তি ও সফল ব্যবসায়ী। তিনি সেদিন তার অফিসে আহূত প্রেস কনফারেন্সে উপস্থিত সাংবাদিকদের কাছে গত প্রায় এক বছরে এ বিষয়ে সরকারের সঙ্গে তার চলমান যোগাযোগের কথা জানান এবং প্রমাণস্বরূপ তিনি বিভিন্ন ডকুমেন্টস দেখান। তার এসব ডকুমেন্টস এবং পরবর্তীতে বিবিসিতে প্রচারিত ডিসির ইন্টারভিউ থেকে নিচের টাইমলাইনটি জানা যায়।

ডিক্লারেশন সমস্যার টাইমলাইন
২৩ সেপ্টেম্বর ২০০৪ঃ দৈনিক আমার দেশ প্রকাশিত।
আগস্ট ২০০৮ঃ মোসাদ্দেক আলী ফালু জেলে বন্দী এবং আমার দেশ পাবলিকেশন্স লিমিটেড গভীর আর্থিক সংকটে নিপতিত। মাহমুদুর রহমান ও তার কিছু পার্টনার এই সংকট মোচন করে প্রকাশনা অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে প্রাথমিক আলোচনা শুরু করেন।
১৮ সেপ্টেম্বর ২০০৮ঃ আমার দেশ পাবলিকেশন্স লিমিটেড-এর শেয়ার মালিকানা হস্তান্তর সম্পর্কিত দলিল স্বাক্ষরিত হয়।
৬ অক্টোবর ২০০৮ঃ আমার দেশ পাবলিকেশন্স লিমিটেডের নতুন চেয়ারম্যান মাহমুদুর রহমান কার্যভার গ্রহণ করেন।
১৫ মে ২০০৯ঃ আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক আতাউস সামাদ পদত্যাগ করেন।
২৬ এপ্রিল ২০০৯ঃ আমার দেশ পাবলিকেশন্স লিমিটেড একটি চিঠি দিয়ে ঢাকার ডিসিকে জানিয়ে দেয় বোর্ড অফ ডিরেকটর্সের সিদ্ধান্ত মোকাবেক চেয়ারম্যান মাহমুদুর রহমান আমার দেশের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক নিযুক্ত হয়েছেন।
১৬ জুন ২০০৯ঃ ডিসির পক্ষে ঢাকার বিশেষ পুলিশ সুপার আমার দেশ পাবলিকেশন্স লিমিটেডকে জানান যে, নিযুক্ত ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের বিষয়ে ডিসির আপত্তি নেই।
৩ সেপ্টেম্বর ২০০৯ঃ মুদ্রণালয়ের নিয়ন্ত্রক ও মুদ্রাকরের নাম বদলের জন্য আমার দেশ পাবলিকেশন্স লিমিটেড আবেদন করে ডিসির কাছে এবং আইনের বিধান অনুযায়ী এই বদলের বিষয়ে আদালতে ঘোষণাপত্র দেয়। একই সঙ্গে পত্রিকার প্রকাশক বদল করে নতুন প্রকাশকরূপে মাহমুদুর রহমানের দায়িত্ব নেয়ার বিষয়টিও ডিসিকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়।
১১ অক্টোবর ২০০৯ঃ সাবেক প্রকাশক হাসমত আলী ডিসি অফিসে গিয়ে ফর্ম সি-তে সই করে ঘোষণা দেন যে, তিনি প্রকাশকের পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন।

৪ নভেম্বর ২০০৯ঃ ডিপার্টমেন্ট অফ ফিল্মস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স (ডিএফপি বা চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদফতর) প্রকাশক বিষয়ে অনাপত্তিপত্র দেয়। ডিএফপির ডেপুটি ডিরেক্টর মাসুদা খাতুন স্বাক্ষরিত এই পত্রে বলা হয়, ‘আমার দেশ পত্রিকার প্রকাশক আলহাজ্ব মোহাম্মদ হাসমত আলীর পরিবর্তে জনাব মাহমুদুর রহমানের নাম প্রতিস্থাপন করার অনুমোদন দেয়া যেতে পারে।’
১৫ মার্চ ২০১০ঃ ঢাকার ডিসি একটি চিঠিতে আমার দেশ পাবলিকেশন লিমিটেডের কাছে জানতে চান যে, কেন এখনো দৈনিক আমার দেশের প্রিন্টার্স লাইনে প্রকাশকরূপে হাসমত আলীর নাম ছাপা হচ্ছে? উত্তরে আমার দেশ তাদের চিঠিতে জানায় যে, ৩ সেপ্টেম্বর ২০০৯-এর চিঠিতে ডিসিকে মুদ্রণালয়ের নিয়ন্ত্রক-মুদ্রাকর ও প্রকাশক বদল বিষয়ে জানানো হলেও এখনো এ বিষয়ে আপত্তি বা অনাপত্তি জানানো হয়নি। সুতরাং প্রিন্টিং প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অনুযায়ী বাধ্যবাধকতা থাকার কারণে এখনো আগের প্রকাশকের নামই প্রিন্টার্স লাইনে ছাপা হচ্ছে। একই সঙ্গে ডিসিকে আমার দেশ পাবলিকেশন লিমিটেড অনুরোধ জানায় খুব দ্রুত তাদের আবেদন নিষ্পত্তি করতে।

১ জুন ২০১০ঃ সকাল নয়টায় জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার (এনএসআই) সদস্যরা হাসমত আলীর শাহজাহানপুরের বাসা থেকে তাকে ধরে নিয়ে যান। বেলা দুইটার সময়ে হাসমত আলী দুটি কাগজে সই করার পর পাচ ঘণ্টার বন্দীদশা থেকে মুক্তি পান। হাসমত আলী জানান, এই একটি কাগজ ঢাকার ডিসিকে এবং অপর কাগজটি তেজগাও শিল্পাঞ্চল থানার ওসিকে লেখা। ওই দুটি কাগজে লেখা রয়েছে, ‘তিনি (হাসমত আলী) আমার দেশের প্রকাশক নন। তার নাম ছাপা হওয়ায় আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হোক।’
উল্লেখ্য, তেজগাও শিল্পাঞ্চলে আমার দেশ-এর ছাপাখানা অবস্থিত। কিন্তু সংবাদ সংস্থা বিডি নিউজ জানায় এনএসআইয়ের কর্মকর্তাদের কেউ হাসমত আলীকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সত্যতা স্বীকার করেননি।

এ খবর জানার সঙ্গে সঙ্গে মাহমুদুর রহমান কাওরানবাজারে অবস্থিত আমার দেশ-এর কার্যালয়ে চলে আসেন এবং অচিরেই গ্রেফতার হতে পারেন আশঙ্কা করে বিকেল পাচটায় সেখানে প্রেস কনফারেন্স ডেকে সরকারি কার্যক্রমকে পৃএম্পট (হড়প-পশহয়) করেন। অর্থাৎ আগেই তিনি তার পক্ষের বক্তব্য প্রকাশ করে দেন। এই প্রেস কনফারেন্সে একটি প্রশ্নের উত্তরে মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘সোমবার রাতে (৩১ মে) আমি শুনেছি দশ দিনের মধ্যে আমার দেশ বন্ধ করে আমাকে অ্যারেস্ট করা হবে। কিন্তু আমি একে গুজব বলে এড়িয়ে যাই। কিন্তু আজ দেখছি সেটা গুজব নয়। সে খবরই সত্য হতে যাচ্ছে।’
রাজধানীতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে মাহমুদুর রহমানের আসন্ন গ্রেফতারের সংবাদ। আমার দেশ-এর কার্যালয়ে উপস্থিত হতে থাকেন উদ্বিগ্ন রাজনৈতিক নেতাকর্মী, আইনজীবী, পেশাজীবী ও সমর্থকবৃন্দ।

রাত এগারোটায় প্রায় ৪০ জন পুলিশের একটি টিম ইস্পাত ভবনে আমার দেশ অফিসের সামনে অবস্থান নেয় এবং জোর করে অফিসে ঢোকার চেষ্টা করে। পুলিশের তেজগাও জোনের ডিসি সেইদিন সন্ধ্যার পর মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে দায়ের করা একটি মামলার কপি হাতে নিয়ে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করেন। কিন্তু তার কাছে কোনো গ্রেফতার ওয়ারেন্ট না থাকায় আমার দেশ-এ কর্মরত সাংবাদিক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা ভেতরে ঢুকতে পুলিশকে বাধা দেন। এ নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে পরবর্তী কয়েক ঘণ্টা জুড়ে চলে তীব্র বাকবিতণ্ডা এবং মাঝে মধ্যে ধাক্কাধাক্কি। এক পর্যায়ে পুলিশ ভেতরে খাবার ও পানির বোতল নিতে বাধা দেয়। কেটে দেয় অফিসের ডিশ লাইন।

ওদিকে ইস্পাত ভবনের সামনে কয়েক শ আমার দেশ সমর্থক সমবেত হয়ে বিক্ষোভ মিছিল ও স্লোগান দিতে শুরু করেন। পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য পুলিশের সংখ্যা বাড়ানো হয়।
রাত সাড়ে তিনটায় তেজগাও জোনের ডিসির নেতৃত্বে দাঙ্গা পুলিশের একটি টিম জোর করে আমার দেশ কার্যালয়ে ঢোকে এবং সাংবাদিক ও কর্মীদের ওপর লাঠিচার্জ করে। রাত চারটায় পুলিশ মাহমুদুর রহমানকে গোয়েন্দা পুলিশের গাড়িতে তুলে নিয়ে অজ্ঞাত স্থানে চলে যায়।

ওদিকে তেজগাও শিল্পাঞ্চলে আমার দেশ-এর প্রেসে পুলিশ হানা দেয়। সেই মুহূর্তে আমার দেশ-এর ২ জুন ২০১০ সংখ্যার কয়েক হাজার কপি ছাপা হয়ে গিয়েছিল। পুলিশ সেসব কপি বাজেয়াফত করে এবং আমার দেশ প্রেস গালাসিল করে দেয়। উল্লেখ্য, এই একই প্রেসে বিএনপি সমর্থক দৈনিক দিনকালও ছাপা হতো। সরকার পক্ষ থেকে জানানো হয় দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার ডিক্লারেশন বাতিল হয়ে গিয়েছে।
২ জুন ২০১০ঃ দৈনিক আমার দেশ পত্রিকা অপ্রকাশিত।
মাহমুদুর রহমানকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে সেটা জানার জন্য তার পরিবার, সাংবাদিকবৃন্দ ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা উদ্বিগ্ন ছিলেন। গুজব ছড়িয়ে পড়ে তাকে ক্যান্টনমেন্টের মধ্যে ডিজিএফআইয়ের অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অসমর্থিত সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে তাকে ক্যান্টনমেন্ট থানার হাজতে রাখা হয়েছে।
এইদিন বিকেল পৌনে পাচটায় মাহমুদুর রহমানকে দুটি মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে কড়া পাহারায় ঢাকার সিএমএম আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়।

মাহমুদুর রহমানের পক্ষে আইনজীবীরা বলেন, মাহমুদুর রহমান একজন সুশিক্ষিত ব্যক্তি। সাবেক জ্বালানি উপদেষ্টা ও একজন তুখোড় সাংবাদিক। ১/১১-এর পর দুই নেত্রীকে দেশ থেকে বিতাড়িত করার প্রচেষ্টা তিনি তার ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে রুখে দেন। ফলে দেশে গণতন্ত্র রক্ষা পায়। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করে সরকার পত্রিকাটি বন্ধ করে দেয়। ফলে পাচ শতাধিক সাংবাদিক ও কর্মচারী চাকরি হারিয়েছেন। সরকারের বিরুদ্ধে পত্রিকায় লেখার কারণেই পত্রিকা বন্ধের ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। পত্রিকার প্রকাশক পরিবর্তন বিষয়ে ২১/৮/১০ তারিখ থেকে বহুবার চেষ্টা করেও সরকারের হস্তক্ষেপের কারণে তা করা সম্ভব হয়নি। হাসমত আলীকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে তাকে দিয়ে বাধ্য করে এ মামলা করা হয়েছে। এ মামলার ধারা জামিনযোগ্য হওয়ায় সরকার ষড়যন্ত্র করে নাটক সাজিয়ে পরে পুলিশের কর্তব্যকাজে বাধাদানের কথা উল্লেখ করে অন্য মামলায় পাচ দিনের রিমান্ড চায়। তাকে রিমান্ড বাতিল করে জামিন দিলে তিনি পলাতক হবেন না।

জামিনের বিরোধিতা করে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা বলেন, মাহমুদুর রহমান আইন নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন। পুলিশকে আটক করে মারধর করেছেন। তাকে জামিন না দিয়ে রিমান্ডে দেয়া হোক।
এর মধ্যে পুলিশকে ‘মারধর ও কর্তব্য কাজে বাধা দান’ সংক্রান্ত একটি মামলায় তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাচ দিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়। শুনানি শেষে আদালত রিমান্ড ও জামিন­ উভয় আবেদনই নামঞ্জুর করেন এবং মাহমুদুর রহমানকে তিন দিনের মধ্যে জেল গেইটে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মামলা তদন্তকারীদের নির্দেশ দেন। একই আদালত হাসমত আলীর দায়ের করা প্রকাশনা বিষয়ে প্রতারণার মামলায় বিশ হাজার টাকা মুচলেকায় একজন স্থানীয় আইনজীবীর জিম্মায় মাহমুদুর রহমানের জামিন মঞ্জুর করেন।
অর্থাৎ ২ জুন রাত মাহমুদুর রহমানকে জেলে কাটাতে হয়। একটি সূত্র জানিয়েছে তাকে কোনো ডিভিশন দেয়া হয়নি।
এই দিন দেশে ও বিদেশে মাহমুদুর রহমানের অ্যারেস্ট ও আমার দেশ বন্ধ হয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। সংসদে বিএনপির এমপিরা ওয়াক আউট করেন। ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেন, ‘মানিক মিয়ার সাথে মোনায়েম খা-র সরকার যে আচরণ করেছিল, বর্তমান সরকার মাহমুদুর রহমানের সাথে একই আচরণ করেছে। ওয়ান-ইলেভেনের পর যে পরিবর্তন আশা করা হয়েছিল তা আসেনি।’

বিদেশে নিউ ইয়র্ক টাইমসে একটি দীর্ঘ রিপোর্টে এই ঘটনার তীব্র সমালোচনা করা হয়। আন্তর্জাতিক মনিটরিং সংস্থা রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স, এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন (সংক্ষেপে এএইচআরসি) এবং কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট (সংক্ষেপে সিপিজে) এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করে।
৩ জুন ২০১০ঃ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে তার কার্যালয়ে বাংলাদেশে নিযুক্ত আমেরিকান রাষ্ট্রদূত জেমস মরিয়ার্টি দেখা করেন।
মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার ও আমার দেশ-এর প্রকাশনা বন্ধ বিষয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি রুদ্ধদ্বার বৈঠক হয়, যেখানে উপস্থিত ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন, আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, পুলিশের আইজি নূর মোহাম্মদ এবং র্যাবের ডিজি হাসান মাহমুদ খন্দকার।

প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ শেখ হাসিনার সাথে আমেরিকান রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাৎকার বিষয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফিং দেয়ার সময়ে জানান, রাষ্ট্রদূতকে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, দেশের সংবাদ মাধ্যম সর্বোচ্চ স্বাধীনতা ভোগ করছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর রুদ্ধদ্বার বৈঠক বিষয়ে কোনো সরকারি বিবৃতি আসেনি। অবশ্য সে আশাও করা হয়নি।
কিন্তু জানা যায়, মাহমুদুর রহমানকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আবারও পুলিশ পাচদিনের রিমান্ডের আবেদন করেছে। এই আবেদনের প্রেক্ষিতে মাহমুদুর রহমানের উপস্থিতিতে ঢাকার মহানগর হাকিম মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম ৭ জুন সোমবার শুনানির জন্য তারিখ ধার্য করেন।

অন্যদিকে মাহমুদুর রহমানকে কারাগারে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য তেজগাও থানার সাব ইন্সপেক্টর ও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা রেজাউল ইসলাম রেজা দুপুর ১২টার দিকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে যান। কারা কর্তৃপক্ষ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মাহমুদুর রহমানকে ৭ নম্বর সেল থেকে বের করে কারা প্রশাসনের অফিসের উত্তর পাশের খোলা বারান্দায় নিয়ে যান। জিজ্ঞাসাবাদের সময় কারাগারে একজন ডেপুটি জেলার ছাড়াও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। দুপুর ১২টা ৫৫ মিনিট থেকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়ে চলে ১টা ১৩ মিনিট পর্যন্ত। জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে পুলিশ কর্মকর্তাকে মাহমুদুর রহমান পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন, আপনারা আমাকে অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করেছেন।

কারাগার সংশ্লিষ্ট সূত্র জানা যায়, মাহমুদুর রহমানের কাছে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা রেজাউল ইসলাম তেজগাও থানায় ২/৬/২০১০ তারিখে দায়ের হওয়া ২ নম্বর মামলার নথিপত্র দেখিয়ে জানতে চান, ‘আপনার উপস্থিতিতে এ মামলার এজাহারভুক্ত অন্যান্য সাংবাদিক ও অজ্ঞাত কিছু ব্যক্তি সরকারি কাজে বাধা প্রদান করেন।’ মামলায় যাদের নাম রয়েছে ওই সব সাংবাদিকের নাম, পদবি ও ঠিকানা ঠিক আছে কি না তা জানতে চাওয়া হয়।

মাহমুদুর রহমান পুলিশ কর্মকর্তাকে জানান, মামলায় যাদের নাম উল্লেখ রয়েছে তারা সবাই তার পত্রিকার সাংবাদিক। এরপর তিনি পাল্টা প্রশ্ন করে পুলিশ কর্মকর্তার কাছে জানতে চান, ‘আপনারা (পুলিশ বাহিনী) অন্যায়ভাবে অফিসের একতলা থেকে ১৫ তলা পর্যন্ত পুলিশ দিয়ে চারদিক ঘিরে আমাদের অবরুদ্ধ করে রাখেন। এক পর্যায়ে কোনো কারণ ছাড়াই সাংবাদিক ও কর্মচারীদের মারধর করেন। আবার আমাদের বিরুদ্ধেই আপনারা মামলা দিয়েছেন। মামলা তো আপনাদের বিরুদ্ধে হওয়া উচিত। আমরাই আপনাদের বিরুদ্ধে মামলা করব।’
তখন দারোগা চুপ হয়ে তার ডায়রিতে সংক্ষিপ্ত নোট লিখে কারাগার থেকে বেরিয়ে যান।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ছাড়াও আমার দেশ-এর আরো তিনজন সিনিয়র সাংবাদিকের বিরুদ্ধে পুলিশ মামলা করেছে। এরা হচ্ছেন, সৈয়দ আবদাল আহমেদ (ডেপুটি সম্পাদক), জাহেদ চৌধুরী (সিটি সম্পাদক) ও সঞ্জীব চৌধুরী (সিনিয়র সহকারী সম্পাদক)।

শেখ হাসিনার লেভেলে
কেউ কেউ বলবেন মাহমুদুর রহমান ও আমার দেশ-এর এই তিন সাংবাদিক সৌভাগ্যবান বা লাকী ফোর! কারণ ১ জুন রাতে ওপরের নির্দেশে আমার দেশ পত্রিকা অফিস হামলাকারী পুলিশ যখন খুব চাপের মুখে ছিল তখন তারা যথেষ্ট সহিষ্ণুতা ও ধৈর্য দেখিয়েছেন এবং তারা কোনো হত্যা অপরাধের মামলা এ চারজনের বিরুদ্ধে ঠুকে দেননি। ক্রসফায়ারে নিহত কোনো ব্যক্তির লাশকে পুলিশ ইউনিফর্ম পরিয়ে তারা অভিযোগ করতে পারতেন অফিসের ভেতর থেকে মাহমুদ গং গুলি করেছিলেন। যাই হোক, ‘হাসমত আলীর দায়ের করা’ প্রতারণা মামলায় জামিন মঞ্জুর হলেও পুলিশের দায়ের করা মামলায় মাহমুদুর রহমান এখনো জেলেই আছেন। সর্বশেষ সংবাদে জানা গেছে, মাহমুদুর রহমানকে জেলে ডিভিশন না দিয়ে নির্জন ঘরে স্থানান্তর করা হয়েছে বা সলিটারি কনফাইনমেন্টে রাখা হয়েছে।

বলা যেতে পারে, রাজনৈতিক হয়রানি ও নির্যাতনের ক্ষেত্রে মাহমুদুর রহমান পৌছে গেছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লেভেলে। ১ জুনের প্রেস কনফারেন্সে মাহমুদুর রহমান বলেছিলেন, ওয়ান-ইলেভেনের পরে দুটি সরকারি গোয়েন্দা সংস্থা কর্তৃক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে জোর করে স্বাক্ষরও আদায় করা অভিযোগপত্রের ভিত্তিতে তখন শেখ হাসিনাকে যেমন গ্রেফতার করেছিল ঠিক তেমনটিই এখনো হতে চলেছে। তবে ওই সময়ে মাহমুদুর রহমান জানতেন না তাকেও শেখ হাসিনার মতোই নির্জন কারাবাসে রাখা হবে। তফাৎ এই যে, শেখ হাসিনা ছিলেন নির্জন সাবজেলে বা একটি নির্জন বাড়িতে। আর মাহমুদুর রহমান আছেন জেলের একটি নির্জন ঘরে।

আমেরিকান রাষ্ট্রদূত কি বলেছেন?
প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব সংক্ষিপ্তভাবে জানিয়েছেন আমেরিকান রাষ্ট্রদূতকে কি বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু তিনি বলেননি আমেরিকান রাষ্ট্রদূত কি বলেছেন প্রধানমন্ত্রীকে। আমেরিকার শীর্ষ পত্রিকা নিউ ইয়র্ক টাইমস এবং অন্যান্য সাংবাদিক ও মানব অধিকার সংস্থাগুলোর দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানা গেছে। তারা মাহমুদুর রহমানের গ্রেফতার ও আমার দেশ বন্ধের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা করেছে। ধারণা করা যেতে পারে, আমেরিকান রাষ্ট্রদূত জেমস মরিয়ার্টি একই ধরনের প্রতিক্রিয়া প্রতিবিম্বিত করেছেন শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে। এক্ষেত্রে দুটি ফ্যাক্টর বিবেচনা করতে হয়েছে এবং হচ্ছে আমেরিকান রাষ্ট্রদূতকে।
এক. তার নিজের দেশে পত্রিকা এবং সাংবাদিক ও মানব অধিকার সংস্থাগুলো এ ঘটনার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। দুই. মাহমুদুর রহমানের লেখার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল আমেরিকান সরকার অনুসৃত কয়েকটি নীতির বিরোধিতা। সুতরাং এখন মাহমুদুর রহমানের মুক্তির পক্ষে অবস্থান না নিলে এটা মনে হতে পারে যে, আমেরিকান সরকার প্রতিশোধপরায়ণ এবং তাই তারা আওয়ামী সরকারের আমার দেশ দমনপীড়ন নীতির প্রতি সমর্থন দিচ্ছে।

মাহমুদুর রহমানের মুক্তি ও আমার দেশ পুনঃপ্রকাশের পক্ষে যদি রাষ্ট্রদূত মরিয়ার্টি অবস্থান নিয়ে থাকেন তাহলে তিনি অবশ্যই ধন্যবাদ পাবেন। তাকে মনে করিয়ে দেয়া যেতে পারে যে, বাংলাদেশে রিমান্ড এখন অমানবিক টর্চারের সমার্থক হয়ে দাড়িয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত একটি সাম্প্রতিক খবরঃ
গতকাল বিডিআর জওয়ান মাহমুদুল হাসান ও আল মুরাদকে কারাগার থেকে হাজির করে রিমান্ডে নেয়ার আবেদন করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। আদালত মাহমুদুলকে সাত দিন ও মুরাদকে তিন দিন রিমান্ডে নেয়ার পরেই মাহমুদুল বুকে হাত দিয়ে কাঠগড়ায় পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারান। আদালত তাকে হাসপাতালে ভর্তি করার নির্দেশ দেন।
মাহমুদুল হাসান এবং মাহমুদুর রহমানের মধ্যে তফাৎ আছে। অনেকেই বিশ্বাস করবেন, রিমান্ডে নেয়ার আদেশ হলেও মাহমুদুর রহমান জ্ঞান হারাবেন না।

বাস্তবতাভিত্তিক ধারণা বনাম আইন
কারণ ইতিমধ্যেই মাহমুদুর রহমান বহুবার সাহসের পরিচয় দিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে একাধিকবার বেসরকারি হামলা এবং সরকারি হামলা ও মামলা হয়েছে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি অকুতোভয়ে লড়েছেন।
বেসরকারি হামলা নাম্বার এক হয় বনানীতে নেভাল হেড কোয়ার্টার্সের সামনে। সেখানে দিনের বেলায় মোটর সাইকেলে দুই অজ্ঞাত হামলাকারী তার গাড়িতে ঢিল ছোড়ে। মাহমুদুর রহমান গাড়ি ঘুরিয়ে তাদের ফলো করেন। তারা পালিয়ে যায়। দুই. তেজগাওয়ে সাত রাস্তার মোড়ে সন্ধ্যাবেলায় তার চলমান গাড়ির ওপর ভারী হাতুড়ি ছোড়া হয়। অজ্ঞাত হামলাকারীরা পালিয়ে যায়। এরপর লন্ডনে একটি জনসমাবেশে জনৈক হামলাকারী ছুরি হাতে তাকে আক্রমণ করে এবং মাহমুদুর রহমানের সুøট ছিড়ে যায়।
সরকারি হামলা ও মামলার মধ্যে রয়েছে ঢাকা এয়াপোর্টে দুইবার মাহমুদুর রহমানকে বিদেশ যেতে বাধা দেয়া হয়। এরপর আদালতের নির্দেশ পেয়ে তিনি বিদেশে যেতে পারেন। কিন্তু বিদেশে তার ব্যবসায়িক এপয়েন্টমেন্টগুলো তিনি মিস করেন এবং এর ফলে তার ব্যবসায়িক ক্ষতি হয়। সর্বোপরি, উল্লেখিত সর্বশেষ দুটি মামলাসহ মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে সরকার মোট ৩১টি মামলা দায়ের করেছে।

সুতরাং এখন প্রধানমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব এবং আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি জেনারেল সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম যতই আইনের কথা বলুন না কেন, পাবলিক পারসেপশন (হপড়ধপহয়মসষ) হয়েছে মাহমুদুর রহমানকে ব্যক্তিগতভাবে দমনপীড়ন এবং আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ করার লক্ষ্যে সরকার সর্বশেষ মামলা দুটি দায়ের করেছে বা করিয়েছে।
তাই যারা সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় এবং লেখকের অধিকারে বিশ্বাস করেন এবং যার মধ্যে নিশ্চয়ই আমেরিকান রাষ্ট্রদূতও আছেন, তাদের সবার আশু কর্তব্য হবে মাহমুদুর রহমানকে যেন রিমান্ডে না নেয়া হয় অন্তত সে বিষয়টি নিশ্চিত করা।

ফাস্ট না স্লো পয়জনিং?

গত বছরের মে মাসে লন্ডনে বিএনপি নেতা তারেক রহমানের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। তিনি ক্রাচে ভর দিয়ে হাটতেন এবং ডান হাতের আঙ্গুলের এক্সারসাইজ করতেন। যদিও তিনি বলতে চাননি ওয়ান-ইলেভেনের পর আটক অবস্থায় তার ওপর কি টর্চার হয়েছিল তবুও আমি বিভিন্নভাবে জানতে পেরেছিলাম ঘটনার কিছু অংশ। আমি শুধু বলতে চাই কোনো মানুষকেই, তা তিনি যে দল বা মতেরই হোন না কেন, আটক অবস্থায় তারেক রহমানের মতো নির্যাতনের শিকার যেন না হতে হয়। একইভাবে আমি বলতে চাই, কোনো মানুষকেই যেন শেখ হাসিনার মতো সাবজেলে আটক অবস্থায় স্লো পয়জনিংয়ের শিকার যেন না হতে হয়।
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর শেখ হাসিনা একাধিকবার বলেছেন সাবজেলে আটক অবস্থায় তাকে স্লো পয়জনিংয়ের চেষ্টা করা হয়েছিল। তার এ কথার সমর্থন আওয়ামী লীগের কিছু নেতা ও আওয়ামী লীগ সমর্থক ডাক্তারও করেছেন। শেখ হাসিনা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্দী ছিলেন। তাই তাকে হয়তো ফাস্ট পয়জনিং নয়­ স্লো পয়জনিংয়ের চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু মাহমুদুর রহমান, যার জীবননাশের চেষ্টা ইতিমধ্যে করা হয়েছে, তিনি যদি নির্দিষ্ট ও সীমিত সময়ের জন্য রিমান্ডে থাকেন তাহলে অতি উৎসাহী সরকারি কর্মকর্তারা স্লো নয়, ফাস্ট পয়জনিংয়ের দিকে আগ্রহী হতে পারেন। আমি আশা করবো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কড়া নজর রাখবেন এবং মাহমুদুর রহমানের শারীরিক নিরাপত্তা একশ শতাংশ নিশ্চিত করবেন।

সরকারের আক্রোশের কারণ
মাহমুদুর রহমান এবং আমার দেশ-এর বিরুদ্ধে সরকারের আক্রোশের প্রধান পাচটি কারণ হলো­
এক. দৈনিক পত্রিকাটি তথ্যনির্ভর সমালোচনা করেছে এবং দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির গভীর অবনতির বিষয়ে নিয়মিত রিপোর্ট ছেপেছে। দুই. দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বিষয়ে স্ট্যাটিসটিক্স নির্ভর রিপোর্ট ছেপেছে। তিন. শেখ হাসিনার আমেরিকা প্রবাসী ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের সঙ্গে আমেরিকান তেল কম্পানি শেভরনের ব্যবসায়িক সম্পর্ক এবং সেখানে বড় দুর্নীতির অভিযোগ বিষয়ে রিপোর্ট ছেপেছে। চার. শেখ হাসিনার বেয়াই ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের পৈতৃক পরিবারের সঙ্গে রাজাকারদের সম্পৃক্ততার বিষয়ে রিপোর্ট এবং ফটো ছেপেছে। পাচ. আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলামের পৈত্রিক পরিবারের সঙ্গে হেকিমি তথা ইসলামী ব্যবসায়ের সম্পৃক্তার রিপোর্ট ছেপেছে। গোদের ওপর বিষফোড়ার মতো এসব রিপোর্টের ওপরে ছিল মাহমুদুর রহমানের লেখা নিজস্ব রাজনৈতিক কলাম।

ফলপ্রসূ কলাম
মাহমুদুর রহমানের লেখা যে ফলপ্রসূ হতে পারে সেটা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বোঝেন।
ওয়ান-ইলেভেনের পরে যে অতি অল্প কয়েকজন লেখক নিয়মিতভাবে সেনা শাসনের বিরুদ্ধে, গণতন্ত্রের পক্ষে এবং মাইনাস টু থিওরির বিরুদ্ধে অর্থাৎ শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার মুক্তির পক্ষে লিখেছিলেন তাদের অন্যতম ছিলেন মাহমুদুর রহমান। অকাট্য যুক্তি এবং কোরান শরিফের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি লিখেছিলেন সপ্তাহের পর সপ্তাহ। আজ যে শেখ হাসিনা একজন মুক্ত মানুষ তার পেছনে মাহমুদুর রহমানের অবদান আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিশ্চয়ই একজন অকৃতজ্ঞ ব্যক্তি রূপে প্রতিভাত হতে চাইবেন না। বরং তিনি তার ঋণ পরিশোধ করতে চাইলে মাহমুদুর রহমানের মুক্তির ও আমার দেশ-এর পুনঃপ্রকাশের নির্দেশ দিতে পারেন।

ভিন্ন সময়
কিন্তু সেই রকম নির্দেশ যদি প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে না আসে তাহলে কি হতে পারে? কেউ কেউ বলছেন, আওয়ামী লীগ আবার ৭৪-৭৫-এর বাকশালি সময়ে ফিরে যেতে চাইছে। সুতরাং মাহমুদুর রহমান মুক্তি পাবেন না এবং আমার দেশ পুনঃপ্রকাশিত হবে না।
এক্ষেত্রে বর্তমান সরকার যদি বিবেচনা করেন সময়টা বদলে গিয়েছে তাহলে সবারই মঙ্গল হবে।

১৯৭৪-৭৫-এ বাংলাদেশের মিডিয়ার বয়স ছিল খুবই কম। সেই সময়ে জনসাধারণ পাচটি দৈনিক পত্রিকা পড়তো­ ইত্তেফাক, সংবাদ, বাংলাদেশ অবজার্ভার, দৈনিক বাংলা ও বাংলাদেশ টাইমস। শেষোক্ত দুটি পত্রিকা ছিল সরকারি মালিকানাধীন। ১৬ জুন ১৯৭৫-এ ইত্তেফাক ও বাংলাদেশ অবজার্ভারকে সরকারি নিয়ন্ত্রণে এনে দৈনিক সংবাদসহ দেশের বাদবাকি সব সংবাদপত্র নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু তখন দৈনিক পত্রিকার সহযোগিতার ওপর নির্ভরশীল শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিল কম। এখন টেলিকমিউনিকেশন্সে মালটি-ন্যাশনাল কম্পানি থেকে শুরু করে দেশীয় খাদ্য ও পানীয় এবং প্লাস্টিক সামগ্রী প্রস্তুতকারকরা তাদের পণ্য প্রসারের এবং ল্যান্ড ডেভেলপাররা ফ্ল্যাট বিক্রির জন্য নির্ভর করেন দৈনিক পত্রিকা এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ওপর। দ্বিতীয়ত, তখন মিডিয়াতে কর্মী সংখ্যা ছিল কম। এখন অনেক বেশি। আমার দেশ পত্রিকার সাবেক ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক আতাউস সামাদ ইতিমধ্যে এ বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বলেছেন, পত্রিকাটি নিষিদ্ধ করার ফলে তিন শতাধিক কর্মচারী বেকার হয়ে যাবে। তৃতীয়ত, তখন পত্রিকার স্বাধীনতা রক্ষার ক্ষেত্রে বিশ্ব নজরদারি প্রায় ছিল না বললেই চলে। এখন স্যাটেলাইট সংযোগের ফলে এবং বিশ্ব জুড়ে সিপিজে, রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স, এএইচআরসি জাতীয় বিভিন্ন সংস্থার সদা তৎপরতার ফলে সম্পাদক নির্যাতন ও পত্রিকার স্বাধীনতা হরণ তাৎক্ষণিকভাবে জানাজানি হয়ে যায়। বিশ্ব জনমত সরকারের বিরুদ্ধে চলে যায়। সেটাই হয়েছে গত কয়েক দিনে। আওয়ামী লীগ সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা এবার দ্রুত নষ্ট হয়েছে এই কারণে যে, ক্ষমতাসীন হবার পর চ্যানেল ওয়ান টিভি এবং ফেইসবুক বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

কিছু আওয়ামী লীগ সমর্থক বলে থাকেন যে, গত জোট সরকারের আমলে অন্যায়ভাবে ইটিভিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। এ কথা সম্পূর্ণ সত্য নয়। ইটিভির বিরুদ্ধে জোট সরকার কোনো মামলা করেনি। আওয়ামী লীগ সরকারেরই আমলে মামলাটি করেছিলেন পাবলিক ইন্টারেস্টে বা জনস্বার্থে কিছু ব্যক্তি। তাদের যুক্তি ছিল আওয়ামী লীগ সরকার ইটিভিকে টেরেস্টৃয়াল সম্প্রচারের সুবিধা দিয়েছে অবৈধভাবে। আদালতের রায় এই যুক্তি মেনে নিয়েছিল। ইটিভি যদি টেরেস্টৃয়াল সম্প্রচারের একক সুবিধা ভোগ করতো তাহলে শুধু বিটিভি-ই নয়, এখনকার সব স্যাটেলাইট নির্ভর প্রাইভেট চ্যানেল খুবই অসম প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হতো। সুতরাং ইটিভি নিষিদ্ধকরণ প্রসঙ্গটি অবান্তর। ইটিভি এখন অন্য সব প্রাইভেট চ্যানেলের মতোই শুধু স্যাটেলাইটে সম্প্রচার করছে এবং বিটিভি তার দ্বিতীয় টেরেস্টৃয়াল চ্যানেলে বিটিভি ওয়ার্ল্ড নামে অনুষ্ঠান সম্প্রচার করছে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক আচরণ দূরীভূত হয়েছিল জোট সরকারের আমলে আদালত ঘোষিত রায়ে।

লেখা বনাম লেখা
সাপ্তাহিক যায়যায়দিন যখন ১৯৮৫ ও ১৯৮৬-তে নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল এবং আমাকে প্রায় ছয় বছর নির্বাসিত থাকতে হয়েছিল তখন আমি একটি বিষয় বুঝতে পারতাম না। তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, যিনি নিজেকে একজন কবি ও লেখক রূপে দাবি করতেন, কেন তিনি আমার লেখার উত্তর তার লেখাতে দিচ্ছেন না। তার শাসন আমলে অন্ততপক্ষে বারো জন সম্পাদক তার কাছ থেকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিয়েছিলেন। তাদের কেউ মন্ত্রী অথবা রাষ্ট্রদূত হয়েছিলেন। অন্ততপক্ষে সেইসব অনুগত সম্পাদকদের কেউ অথবা অনুগৃহীত লেখক ও সাংবাদিকদের মধ্যে কেউ, আমার লেখার উত্তর লেখায় দিতে পারতেন। সেটা না করে আমার পত্রিকা বন্ধ করে দিয়ে আমাকে কেন নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল সেই প্রশ্নের উত্তর আমি পাইনি।
আজ প্রায় পচিশ বছর পরে সেই একই পথে আওয়ামী লীগ সরকার এগিয়ে যাচ্ছে। অথচ, পচিশ বছর আগের তুলনায় এখন সরকার অনুগৃহীত ও উপকৃত সম্পাদক, লেখক, দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকার সংখ্যা অনেক অনেক বেশি এবং তার ওপরে চলছে সরকার সমর্থক বিভিন্ন টিভি চ্যানেল।

এদের মধ্যে কেউই পারলেন না বা পারছেন না মাহমুদুর রহমানের লেখার উত্তর লেখায় দিতে? তার কথার উত্তর কথায় দিতে?
আশ্চর্য!
খরচের খাতায় ও টার্নিং পয়েন্ট
আমেরিকার বাকপটু টিভি একজিকিউটিভ রিচার্ড বি সালান্ট এস্কোয়ার ম্যাগাজিনে দেয়া ইন্টারভিউতে বলেছিলেন,
Government plans and programmes, even government leaders are expendable. A free press and the truth can never be.
অর্থাৎ, সরকারি প্ল্যান ও কর্মসূচিগুলোকে, এমনকি সরকারের নেতাদের, খরচের খাতায় রাখা যেতে পারে। কিন্তু একটি স্বাধীন সংবাদ মিডিয়া এবং সত্যকে কখনোই খরচের খাতায় রাখা সম্ভব নয়।
রিচার্ড সালান্টের এই উক্তি বারবার সত্য প্রমাণিত হয়েছে বাংলাদেশে। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫-এ বাকশাল সরকারের পতনের পর দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সংবাদ, বাংলাদেশ অবজার্ভার প্রভৃতি তাদের স্বাধীনতা ফিরে পেয়েছিল। ১৯৯০-এ এরশাদ সরকারের পতনের পর যায়যায়দিন পুনঃপ্রকাশিত হতে পেরেছিল।

বলা বাহুল্য, দৈনিক আমার দেশও পুনঃপ্রকাশিত হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, আওয়ামী লীগ সরকারের বিদায়ের আগে না পরে? ভবিষ্যতেই এর উত্তর পাওয়া যাবে।
তবে একথা নিশ্চিতভাবে বলা যেতে পারে, ১ জুন ২০১০-এ আমার দেশ-এর ডিক্লারেশন বাতিল হয়ে যাওয়ার ঘটনাটি পত্রিকার জীবনে একটি টার্নিং পয়েন্টরূপে কাজ করবে। পুনঃপ্রকাশের পরে পত্রিকাটির সাকুêলেশন অনেক বেড়ে যাবে। বিশেষত তখন যদি মাহমুদুর রহমানের ছবি এবং আত্মপ্রচার কম থাকে বা একেবারেই না থাকে।
আর সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের জীবনেও টার্নিং পয়েন্ট হতে পারে তার বন্দিত্ব। বিএনপি নেতাদের অনুরোধে না হলেও, বিএনপি কর্মীদের দাবিতে মাহমুদুর রহমানকে সরাসরি বিএনপি রাজনীতিতে সম্মুখ সারিতে যোগ দিতে হতে পারে।
আওয়ামী লীগের জন্য সেটা হবে চরম দুঃসংবাদ। কারণ সুশিক্ষিত ও সুবক্তা, যুক্তি এবং ভক্তি উভয়বাদী, সৎ ও কর্মঠ, সাহসী ও সত্যবাদী মাহমুদুর রহমান তখন আংশিকভাবে হলেও দূর করবেন বিএনপি নেতৃত্বের দুর্বলতা।
(সুত্র, নয়া দিগন্ত, ০৬/০৬/২০১০)

আমার দেশের ওপর সরকারের ফ্যাসিবাদী হামলা

বদরুদ্দীন উমর

প্রতিহিংসাপরায়ণতা কোন উচ্চ নৈতিকতার পরিচায়ক নয়। বরং তার উল্টো। বর্তমান সরকার এ উল্টো কাজটিই গদিনসিন হওয়ার পর থেকে করে আসছে এবং এখন এর ভয়াবহ রূপ প্রতিদিনই নব নব ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে। দৈনিক আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া এই প্রতিহিংসাপরায়ণতারই সর্বশেষ দৃষ্টান্ত। এর আগে চ্যানেল ওয়ান ও যমুনা টেলিভিশনের সম্প্রচারও একই রাজনৈতিক কারণে বন্ধ করা হয়েছে। এর সঙ্গে নিঃসন্দেহে ব্যক্তিগত প্রতিহিংসাপরায়ণতাও যুক্ত আছে। আমার দেশ প্রসঙ্গে ফিরে আসার আগে এ বিষয়ের উল্লেখ দরকার। বাংলাদেশের প্রখ্যাত সাংবাদিক আতাউস সামাদ ‘আমার দেশ বন্ধ করা প্রসঙ্গে কিছু কথা’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন দৈনিক কালের কণ্ঠে (৫.৬.২০১০)। এতে তিনি বলেন, ‘আমার দেশ পত্রিকা ও চ্যানেল ওয়ান সরকারের কাছ থেকে যথাযথ ও বৈধ অনুমতি নিয়ে ব্যবসা করছিল অর্থাৎ এগুলো চালু ছিল এবং যমুনা টেলিভিশন একটি অনাপত্তিপত্রের ভিত্তিতে পরীক্ষামূলক সম্প্রচার চালাচ্ছিল। এই তিনটি প্রতিষ্ঠানেরই প্রচুর মূলধন বিনিয়োগ আছে। অথচ এ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, মূলধন বিনিয়োগ করে যে ব্যবসা চালু হয়েছে, সরকার সে রকম বৈধ ব্যবসা বন্ধ করে দিচ্ছে।’ এক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার, প্রত্যেক টিভি চ্যানেলই আনুষ্ঠানিক সম্প্রচার শুরু করার আগে এই অনুমতিপত্রের ভিত্তিতেই পরীক্ষামূলক সম্প্রচার চালিয়ে থাকে। এদিক দিয়ে যমুনা টিভি কোন ব্যতিক্রম ছিল না। কাজেই বৈধভাবে ব্যবসা করলেও এই প্রচার মাধ্যমগুলোর ওপর আক্রমণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং ব্যক্তিগত প্রতিহিংসামূলক ব্যাপার ছাড়া আর কিছু নয়। একথা আর না জানা যে, বাংলাদেশে অনেক ক্ষেত্রেই সরকারি নেতানেত্রীরা রাজনৈতিক বিবেচনার বাইরেও নিছক ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে অনেক ধরনের আক্রমণ প্রতিপক্ষের ওপর করে থাকেন।

আমার দেশ বন্ধ প্রসঙ্গে ফিরে এসে বলা দরকার, এক্ষেত্রে প্রতিহিংসাপরায়ণতা সব কিছুকে অতিক্রম করে কারণ হিসেবে কাজ করেছে। আতাউস সামাদ আমার দেশের উপদেষ্টা ও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন। তাছাড়া তিনি একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি। তার লেখায় এ বিষয়ে যা পাওয়া যায়, তার কিছু উদ্ধৃতি দীর্ঘ হলেও বিষয়টি বুঝতে সহায়তা করবে। বৈধ প্রকাশক ছাড়াই আমার দেশ প্রকাশ করা হয়েছে, এটাই পত্রিকাটির বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ। এ বিষয়ে আতাউস সামাদ বলেন, ‘সরকার যেভাবে আমার দেশ পত্রিকাকে প্রকাশকবিহীন করে ফেলল, সেটা যে ইচ্ছাকৃত বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তাও পরিষ্কার। কারণ আমার দেশ পত্রিকার স্বত্বাধিকারী কোম্পানি আমার দেশ পাবলিকেশন্স লিমিটেডের পরিচালনা পর্ষদ মাহমুদুর রহমানকে ওই পত্রিকার প্রকাশক নিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেয়ার পরপরই আইন অনুসরণ করে তিনি ঢাকার ডেপুটি কমিশনারকে তা জানিয়ে সে মতে প্রকাশকের নাম পরিবর্তনের অনুরোধ করে চিঠি দেন ২০০৯ সালের ৩ সেপ্টেম্বর। অতঃপর তিনি ৫ নভেম্বর ২০০৯ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদফতরের কাছ থেকে একটি চিঠির অনুলিপি পান, যা তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে পাঠানো হয়েছিল। এ চিঠিটি ঢাকা জেলা প্রশাসক বরাবর পাঠিয়ে দেন ওই অধিদফতরের উপ-পরিচালক (নিবন্ধন) মাসুদা খাতুন। ঃ এই পত্রে সরকারের চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদফতর, ঢাকার জেলা প্রশাসনকে জানাচ্ছে, ‘ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক আমার দেশ পত্রিকাটির প্রকাশক আলহাজ মোঃ হাসমত আলীর পরিবর্তে জনাব মাহমুদুর রহমানের নাম প্রতিস্থাপন করার অনুমোদন দেয়া যেতে পারে।’ কিন্তু ঢাকার জেলা প্রকাশক তা সত্ত্বেও সেই নভেম্বর মাস থেকেই মাহমুদুর রহমানের আবেদনে সাড়া দিলেন না। সরকারের (অর্থাৎ চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদফতরের-উমর) মতামত জানার পরও তিনি সাত মাস নির্লিপ্ততা ও নিঃশব্দতা অবলম্বন করলেন! যখন উঠে বসলেন, তখন যেন হুংকার দিলেন, ‘না, মাহমুদুর রহমান প্রকাশক পদে গ্রহণযোগ্য নন, কাজেই তার আবেদন খারিজ করা হল।’ একই সঙ্গে তিনি আমার দেশ পত্রিকার প্রকাশক পদ থেকে হাসমত আলীর পদত্যাগপত্র গ্রহণ করে এ মুহূর্তে পত্রিকাটির কোন প্রকাশক নেই ঘোষণা করে তার প্রকাশনা নিষিদ্ধ করে দিলেন।

আতাউস সামাদের উপরোক্ত লেখা থেকে এই দীর্ঘ উদ্ধৃতি দেয়ার কারণ এখানে, তিনি আমার দেশ পত্রিকার সঙ্গে সম্পর্কিত একজন দায়িত্বশীল সাংবাদিক হিসেবে যা বলেছেন তা থেকেই এটা প্রমাণ হয় যে, আমার দেশকে প্রকাশকশূন্য করার দায়িত্ব মাহমুদুর রহমানের নয়। এ দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে ঢাকার জেলা প্রশাসকের। এজন্য আইন অনুযায়ী তারই শাস্তি হওয়া উচিত। কিন্তু তার কোন শাস্তি হবে না, কারণ তিনি এ অপকর্মের মূল হোতা নন। সরকারের শীর্ষতম পর্যায় থেকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ঢাকার জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে এটা কার্যকর করা হয়েছে।

আমার দেশ একটি সুপ্রতিষ্ঠিত ও বহুল প্রচারিত দৈনিক। কাজেই এই সংবাদপত্রটির ওপর এভাবে হামলা যে কোন দিক থেকেই যুক্তিসঙ্গত ও আইনসম্মত নয়, এটা যে কোন নিরপেক্ষ ও সৎ ব্যক্তির কাছেই স্পষ্ট। কিন্তু প্রতিহিংসা যেখানে এই কাজের মূল প্রণোদনা সেখানে যুক্তি, আইন ইত্যাদির স্থান নেই। প্রকৃতপক্ষে আমার দেশ-এর প্রকাশক সম্পর্কিত যা কিছু ঘটনা ঘটেছে তার থেকে স্পষ্টভাবেই বোঝা যায়, পত্রিকাটির স্বত্বাধিকারী কোম্পানি অথবা তার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিন্দুমাত্র ভিত্তি নেই। পত্রিকাটিকে প্রকাশকশূন্য দেখানোর ব্যাপারটি সম্পূর্ণভাবে সরকারি চক্রান্তের দ্বারাই ঘটানো হয়েছে। হাসমত আলীর পারিবারিক সূত্র থেকে বলা হয়েছে, যেদিন পত্রিকাটি নিষিদ্ধ করা হয় সেদিন সকালের দিকে হাসমত আলীকে তার বাড়ি থেকে গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআই তাদের অফিসে নিয়ে যায় এবং তিনি দুটি সাদা কাগজে স্বাক্ষর না দেয়া পর্যন্ত তাকে তারা ৫ ঘণ্টা সেখানে আটক রাখে। সাদা কাগজে এভাবে স্বাক্ষর নেয়ার অর্থ কী হতে পারে? এটা অনুমান করা কি ঠিক নয় যে, গোয়েন্দা সংস্থাটি আমার দেশ পত্রিকা ও তার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদককে চক্রান্তমূলকভাবে ফাঁসানোর জন্য সাদা কাগজে তাকে দিয়ে স্বাক্ষর করিয়ে নিজেদের যা প্রয়োজন সেটাই লিখে দিয়েছে?

প্রথমে আমার দেশ-এর প্রেস সিলগালা দিয়ে বন্ধ করা হয়। তারপর পত্রিকাটি বন্ধের কোন লিখিত নির্দেশ ছাড়াই পুলিশ গিয়ে তা বন্ধ করার নির্দেশ দেয়। তারপর তারা মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতারের কথা বললেন। কিন্তু গ্রেফতারের জন্য কোন ওয়ারেন্ট তাদের কাছে ছিল না। সরকার থেকে বলা হয়েছে, পুলিশকে তাদের কর্তব্য সম্পাদন করতে বাধা দেয়া অর্থাৎ মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতারে বাধা দেয়ার কারণেই তাকে গ্রেফতার করা হয়! এর থেকে অদ্ভুত ও উদ্ভট সরকারি যুক্তি আর হতে পারে? আমার দেশ বন্ধ করার ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে পত্রিকাটির কর্তৃপক্ষ নয়, সরকারই সম্পূর্ণ বেআইনি কাজ করে নিজেদের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করেছে।

আগেই বলা হয়েছে, নথিপত্র মোতাবেক আমার দেশকে প্রকাশকশূন্য করার জন্য প্রকৃতপক্ষে দায়ী হচ্ছেন ঢাকার ডিসি। কিন্তু তার কোন শান্তি হবে না। কারণ তিনি প্রশাসনে আওয়ামী ঘরানার লোক। সরকারের ইঙ্গিতেই তিনি নভেম্বর থেকে এ পর্যন্ত আমার দেশ-এর প্রকাশক পরিবর্তনের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত না নিয়ে চক্রান্তমূলকভাবে পত্রিকাটিকে হঠাৎ করে প্রকাশকশূন্য করেছেন। এর সঙ্গে এনএসআই কর্তৃক হাসমত আলীকে দিয়ে সাদা কাগজে স্বাক্ষর করিয়ে নেয়ার ব্যাপারটিও সম্পর্কিত। শেখ হাসিনা ধুয়োর মতো করে প্রায় প্রতিদিনই বলে থাকেন, কোন অপরাধী যে কোন দলেরই হোক তার মাফ নেই, তার শাস্তি হবে। তিনি যে কথাটি অনুচ্চারিত রাখেন তা হল, অপরাধী যে কোন দলের হোক তার শাস্তি হবে; শুধু আওয়ামী লীগ ঘরানার অপরাধী ছাড়া। তাদের ঘরানার ক্রিমিনালরা দিবারাত্রি চুরি, ডাকাতি, ঘুষখোরি, খুনখারাবি, রাহাজানি, প্রতারণা, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস ইত্যাদি সব রকম অপরাধ করে যাওয়া সত্ত্বেও তাদের কোন শাস্তি হয় না। অপরাধ করে ধনদৌলতের মালিক হয়ে ও শক্তি সঞ্চয় করে তারা আরও বড় বড় অপরাধ করে গেলেও তাদের শাস্তি হয় না।

সংবাদপত্র রিপোর্টে দেখা গেল, মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করার পর পুলিশ তাকে রিমান্ডে নেয়ার জন্য আদালতে আবেদন করেছে। আদালত এ ব্যাপারে শুনানির জন্য তারিখ ফেলেছেন। কিন্তু কেন? এজন্য শুনানির প্রয়োজন কেন হবে? এ আবেদন সরাসরি নাকচ করা হবে না কেন? এখন কথায় কথায় যে কোন লোককে গ্রেফতারের পর রিমান্ডে নেয়া হচ্ছে। এ প্রক্রিয়া ফখরুদ্দীনের বেনামি সামরিক সরকারের সময় চালু হয়েছিল। তারা তখন রাজনৈতিক নেতাদের রিমান্ডে নিয়ে তাদের ওপর যথেচ্ছভাবে শারীরিক ও মানসিক পীড়ন চালিয়েছিল। সেই প্রক্রিয়া এই তথাকথিত গণতান্ত্রিক সরকারের আমলেও পুরোদস্তুর বজায় আছে। আদালত নিয়মিতভাবে পুলিশের আবেদন অনুযায়ী শত শত ক্ষেত্রে গ্রেফতারকৃতদের রিমান্ডে নেয়ার আবেদন মঞ্জুর করছেন। মাহমুদুর রহমান একটি প্রতিষ্ঠিত জাতীয় দৈনিকের সম্পাদক। যদি ধরেও নেয়া যায়, প্রকাশকবিহীন অবস্থায় তিনি পত্রিকা বের করেছেন, তাহলেও এ কারণে তাকে রিমান্ডে নেয়ার প্রস্তাব কিভাবে পুলিশ করতে পারে? কিভাবেই বা আদালত তাদের এই আবেদন বিবেচনার অধীন রাখতে পারেন? হতে পারে তারা পুলিশের আবেদন অনুযায়ী মাহমুদুর রহমানকে রিমান্ডে পাঠিয়ে দেবেন। এর দ্বারা মহামান্য আদালতের মর্যাদা বৃদ্ধি অথবা গণতন্ত্রের জয়জয়কার কোনটাই হবে না। এর দ্বারা সরকারের ফ্যাসিস্ট চরিত্রই উšে§াচিত হবে।
সরকার এখন যেভাবে চলছে তাতে মনে হয়, এরা দ্রুত ১৯৭৪-৭৫ সালের আওয়ামী-বাকশালী ফ্যাসিবাদের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। তারা এখন বলছে ১৯৭২ সালের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার কথা। কিন্তু সেই সংবিধানের মূলে কুঠারাঘাত করে তাকে প্রকৃতপক্ষে উচ্ছেদ করেছিলেন কে? সেই সংবিধান পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনীর আগে যে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমেই উচ্ছেদ হয়েছিল, এটা একমাত্র আওয়ামী লীগের লোকজন ও তাদের তল্পিবাহক ছাড়া অস্বীকার করবে কে? ১৯৭৫ সালের সেই কুখ্যাত ও ফ্যাসিস্ট চতুর্থ সংশোধনীই বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার অঘোষিতভাবে কার্যকর করছে। তাদের আমলে এখন ফ্যাসিবাদের এক মহোৎসব চারদিকে শুরু হয়েছে। এই ফ্যাসিবাদ তাদের অতি দ্রুতগতিতে কোথায় নিয়ে যাবে এ বিষয়ে ভাবনার কোন সময় ও ক্ষমতা তাদের এখন নেই। তারা ক্ষমতা মদমত্ত অবস্থায় এখন এমন পরিণতির দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে, যা মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই তাদের উৎখাতকে অনিবার্য করবে।
[সূত্রঃ যুগান্তর, ০৬/০৬/১০]