Thursday 10 June 2010

গণমাধ্যমের জন্য বিষন্ন সময়

আতাউস সামাদ

বাংলাদেশের সংবাদপত্র ও টেলিভিশন জগৎ সম্পর্কে খুব কম করে বললেও বলতে হয়, এখানে ভয়, হতাশা আর নিরাপত্তাহীনতা বিরাজ করছে। গায়ের জোরে একটা ছুতো তৈরি করে দৈনিক আমার দেশ বìধ করে দিয়েছে সরকার। পত্রিকাটির ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে তিনটি পৃথক মামলায় সর্বমোট ১২ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন নিম্ন আদালত। গত ১ জুন ভোরে পুলিশ আমার দেশ অফিস থেকে মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে তাকে দিন-রাত কাটাতে হচ্ছে ঠিকানাবিহীনভাবে বা সদা পরিবর্তনশীল বন্দিশালা ও আদালতে। রিমান্ডে কী ঘটছে তাকে নিয়ে সেটি বাংলাদেশে আপাতত কেবলই অনুমান করে নিতে হবে। টেলিভিশনের পর্দা ও পত্রিকায় প্রকাশিত ছবিতে পুলিশবেষ্টিত মাহমুদুর রহমানকে দেখে সাড়ে তিন বছর আগে জরুরি আইনের লেবাসে যে আধা সামরিক শাসন চাপিয়ে দেয়া হয়, এক-এগারো নামে কুখ্যাত সেই অìধকার সময়ে রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীদের গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেয়ার বন্দোবস্ত করার জন্য আদালতে হাজির করার সময় টানাহেঁচড়া করে যেভাবে অত্যাচার ও হেনস্তা করা হতো­ সেসব দৃশ্য মনে পড়ছিল। সেই অসাংবিধানিক সরকারের আসুরিক অপতৎপরতার সাথে পাল্লা দেয়ার জন্য যদি বর্তমান নির্বাচিত সরকার বদ্ধপরিকর হয়ে থাকে, তবে তা হবে সার্বিকভাবে দেশ ও জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক।

আমার দেশ ও মাহমুদুর রহমান-বিষয়ক চলমান কাহিনীটির সূচনা পর্বে বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক মন্তব্য করেছিলেন, ‘ইত্তেফাক পত্রিকার বিখ্যাত সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার সঙ্গে মোনেম খান (ষাটের দশকে আইয়ুব শাসনামলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর) যে রকম ব্যবহার করেছিল, বর্তমান সরকার মাহমুদুর রহমানের সঙ্গে একই রকম আচরণ করল।’ জনাব রফিক-উল হক পতিত স্বৈরাচারীদের কথা মনে করিয়ে দেয়ায় তাকে আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। কারণ বর্তমানে যারা দেশ চালাচ্ছেন তারা সম্ভবত ১৯৭২ সালের জানুয়ারি থেকে ইতিহাসের শুরু বলে মনে করেন। তাদের কথাবার্তা থেকে মাঝে মধ্যে এমনই ধারণা জন্মায়। তবে যা সত্যি তা হলো, বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছে বেশ দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এবং সেই সংগ্রাম ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের অনেক আগ থেকেই চলে আসছিল। ব্যারিস্টার রফিক-উল হক সে কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন। তিনি যে গভর্নর মোনেম খানের কথা বলেছেন, সেই ব্যক্তির নেতা ও চাকরিদাতা ছিলেন পাকিস্তানে গণতন্ত্র উৎখাতকারী এবং এই উপমহাদেশে সামরিক শাসনের প্রবর্তক সেনাপতি আইয়ুব খান। ওই পাকিস্তানি জেনারেল পূর্ব বাংলার স্বাধিকার আন্দোলন দমন করার জন্য বঙ্গবìধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে একের পর এক রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা লাগাতে থাকলেন এবং তাকে কারারুদ্ধ করে রাখলেন। তাদের ওই সব জঘন্য কর্মকাণ্ডের জন্য আইয়ুব খান ও মোনেম খান এতই নিন্দার পাত্র হয়েছিলেন যে, তারা দেশে বা বিদেশে কোথাও মুখ দেখাতে পারতেন না। সেই সময়টা ছিল প্রথমে বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলন এবং তারপর মুক্তিযুদ্ধের সময়।

বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, তাই প্রেক্ষিত বদলেছে। তবে দু:খজনকভাবে পরিবর্তন অতটা হলো না যে আমরা নিশ্চিতভাবে ও নিশ্চিত করে বলতে পারি দেশে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রকৃতপক্ষে প্রচলিত হয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে, নির্বাচিত সরকারগুলো আমলেও আইনের শাসন, মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক রীতিনীতি মারাত্মকভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে ও হচ্ছে। আমাদের দেশের ওপর বিদেশী শক্তিগুলোর প্রভাব বিস্তার ও নানাভাবে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টাও হচ্ছে। কাজেই গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য সোচ্চার হতেই হচ্ছে। দেশের ভেতর প্রকট অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টি হওয়ায় এক দিকে লুটেরা শ্রেণী আর অন্য দিকে তাদের কৃপাধন্য সুবিধাবাদী গোষ্ঠীও আবির্ভূত হয়েছে। সত্যিকার বাকস্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা ও আইনের শাসন­ এই দুই গোষ্ঠী ও তাদের সহায়তাকারী শাসকশ্রেণীর জন্য খুবই অসুবিধাজনক। তাই দেশের যে নাগরিকরা ও প্রতিষ্ঠানগুলো নিরাপদ জীবন, নাগরিক অধিকার ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চাইবেন তাদের সাথে ওই তিন শ্রেণীর সঙ্ঘাত অনিবার্য। দৈনিক আমার দেশ ও পত্রিকাটির ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের অবস্খান প্রথমোক্তদের সাথে। আর সে জন্যই তাদের কঠিন বিপদে পড়তে হয়েছে। এই গুরুতর সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য তাদের এবং তাদের সমর্থকদের সংগ্রাম করতেই হবে। বস্তুতপক্ষে সেই আন্দোলন জারি আছে। আর যারা ক্ষমতাসীন তাদের অনুরোধ করছি গভীরভাবে চিন্তা করতে যে, তারা কি নিজেদের আইয়ুবশাহি-মোনেমশাহির সমগোত্রীয় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকতে চান?

বাংলাদেশের গণমাধ্যম জগতে ভয়, হতাশা ও নিরাপত্তাহীনতা চলছে শুরুতেই এ কথা লিখেছিলাম। স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধবাদী পত্রিকা হিসেবে এক সময় সাবেক পাকিস্তানজুড়ে খ্যাতি ছিল যে পত্রিকার, তখন যার নাম ছিল পাকিস্তান অবজারভার এবং যার বর্তমান নাম বাংলাদেশ অবজারভার, সেই খবরের কাগজটি বìধ হয়ে গেল। ১৯৬২ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত এ পত্রিকায় কাজ করতে গিয়ে জুনিয়র রিপোর্টার পদে থাকার সময়ই সাংবাদিক হিসেবে বেশ পরিচিতি পেয়েছিলাম। বার্তা সম্পাদক মূসা ভাই (এবিএম মূসা) তো ওই যুবা বয়সেই কিংবদন্তিতুল্য হয়ে গিয়েছিলেন। সদা সুবচন উচ্চারণে অভ্যস্ত; কিন্তু ইংরেজি ভাষায়, ক্ষুরধার লেখনীর অধিকারী সম্পাদক জনাব সালাম সবার শ্রদ্ধেয়, তবু নিপীড়ক মুসলিম লীগ সরকার তাকে জেলে পাঠিয়েছে। পাকিস্তান অবজারভারের দুই তরুণ সাংবাদিক শহীদুল হক ও এনায়েতুল্লাহ খান সম্পর্কে সম্মান করে কথা বলতে শুনেছি বঙ্গবìধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। পত্রিকাটির খ্যাতিমান ক্রীড়া সাংবাদিক তৌফিক আজিজ খান বর্তমানে বাংলাদেশে সর্বাধিক প্রচারিত ইংরেজি পত্রিকা ডেইলি স্টার পত্রিকার সাফল্যের একজন রূপকার। সেই বাংলাদেশ অবজারভার মালিকদের কোন্দল ও অব্যবস্খাপনার কবলে পড়ে ধুঁকতে ধুঁকতে বìধ হয়ে গেল গত মঙ্গলবার, ৮ জুন ২০১০। বìধ হওয়ার প্রক্রিয়াটি আমার কাছে অপরিচ্ছন্ন বলে মনে হচ্ছে। কর্মচারীদের অনেকেই তাদের অনেক বছরের বকেয়া বেতনের পুরোটা পাননি। অবজারভার এভাবে বìধ হয়ে যাওয়া সাংবাদিক ও সংবাদপত্রের অন্য কর্মীদের মধ্যে অনিশ্চয়তাবোধ বাড়িয়ে দিলো। আমার মতো সাবেক কর্মচারীদের মধ্যে সৃষ্টি করল তীব্র বেদনা ও দু:খবোধ। অবজারভারের আগে ভিন্ন ভিন্ন কারণে বìধ করে দেয়া হয়েছে চ্যানেল ওয়ান ও আমার দেশ। আমি এখনো মনে করি আইনি সমঝোতার মাধ্যমে চ্যানেল ওয়ান আবার চালু করা সম্ভব। আমার দেশ পত্রিকার মালিকরা আদালতে আইনি লড়াই করছেন পত্রিকাটির প্রকাশনা অব্যাহত রাখার জন্য। আমার দেশ বìধ হয়েছে সরকারের ইচ্ছায়। সরকারই ইচ্ছা করলে নিষেধাজ্ঞা (তথা ডিক্লারেশন বাতিল ঘোষণা) তুলে নিতে পারে এবং ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে মুক্তি দিতে পারে। সরকার তা করলে একটা গুমোট ও ভীতিকর পরিস্খিতি স্বাভাবিক হয়ে আসতে পারে। তবে শুনতে পাই যে, ক্ষমতার দরবারে নাকি এখন ‘এক হাত দেখিয়ে দেয়া হোক’ মানসিকতাসম্পন্ন পারিষদদের দাপট চলছে। তবে দেশবাসী এর ব্যত্যয় দেখতে পেলে আনন্দিত হবে।

আজকে (বৃহস্পতিবার) অর্থমন্ত্রী জাতীয় বাজেট ঘোষণা করবেন। তিনি জানিয়েছেন, এবারে বড় আকারের বাজেট আসছে। অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেছেন, উন্নয়নের গতি জোরদার করার জন্য সরকারকে বড় বাজেট দিতেই হবে। তবে পরিকল্পনামন্ত্রী এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার বলেছেন, এবার উন্নয়ন বাজেট বড় হওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে, এমন অনেক উন্নয়ন প্রকল্প রয়ে গেছে যেগুলোর কাজ শেষ হয়নি; কিন্তু সেগুলো সম্পন্ন করতে হবে। এ কথার একটা অর্থ হতে পারে যে, হাতে নেয়া উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়নের কাজ ঠিকমতো হয়নি। আরেকটু অগ্রসর হয়ে বলা যায়, বাজেট অর্থপূর্ণ হতে হলে সরকারকে যোগ্যতার পরিচয় দিতে হবে। এ নিয়ে কিছু কথা হয়েছে। ভবিষ্যতে যে আরো অনেক কথা শোনা যাবে, সে ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত। তবে আমাদের কথা হলো, সরকারের বাজেট যেন প্রতিটি দেশবাসীর ব্যক্তিগত বাজেট বাস্তবায়ন করতে সহায়তা করে, বিশেষ করে ছয় কোটি দরিদ্রের, যে দরিদ্ররা প্রয়োজনমতো অল্প জোটাতে পারছে না।

বিএনপি চেয়ারপারসন ও বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া গত সোমবার বিরোধী দলের বাজেট ভাবনা সবিস্তারে প্রকাশ করেছেন। আমাদের দেশের রাজনীতিতে এ রকমভাবে বড় রাজনৈতিক দলের প্রাক-বাজেট প্রস্তাব উপস্খাপন করা এই প্রথম। আমরা মনে করি দেশে গণতান্ত্রিক রীতিনীতির চর্চা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথে এটি একটি চমৎকার ও প্রশংসনীয় পদক্ষেপ। অথচ কেউ কেউ এর নিন্দা করেছেন। আমরা ওই নিন্দুকদের নিন্দা করছি এবং তাদের সম্পর্কে দেশবাসীকে সাবধান থাকতে অনুরোধ করছি।
লেখক : প্রবীণ সাংবাদিক ও কলামিস্ট
[সূত্রঃ নয়া দিগন্ত, ১০/০৬/১০]

No comments:

Post a Comment