Wednesday 16 June 2010

মাহমুদুর রহমানকে নির্যাতন কেন জাতির জন্য অশনি সঙ্কেত

সিরাজুর রহমান

ইংরেজি প্রবাদ হচ্ছে : ‘মর্নিং শোজ দ্য ডে’। বাংলা করলে অর্থ হবে ‘সকাল বেলার চেহারা দেখেই বলে দেয়া যায় দিনটা কেমন হবে’। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি একটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হয় বর্তমান সরকার। তার অল্প কিছু দিনের মধ্যেই এ কলামে আমি হুঁশিয়ারি দিয়েছিলাম : লক্ষণ-আলামত ভালো নয়; নাৎসিদের পন্থায় ডিক্টেটরি ক্ষমতা চিরস্খায়ী করার প্রয়াস চলছে।

তখন থেকেই প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর দলীয়করণ ও আত্তীকরণ শুরু হয়। দক্ষ ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের সরিয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে তুলনামূলক অনভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেয়া হয়­ বহু ক্ষেত্রেই জুনিয়র অফিসারদের পদোন্নতি দিয়ে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কর্মকর্তাও আছেন। কেউই লক্ষ না করে পারেননি যে, এসব পদোন্নতি ও নিয়োগের বেলায় প্রধান মাপকাঠি ছিল সংশ্লিষ্টরা পুরোপুরি আওয়ামী লীগের সমর্থক কি না, তারা এ সরকারকে গদিতে কায়েম রাখার সব রকম চেষ্টা করবেন কি না। সংখ্যালঘুদের বেলায় যে কার্যকারণ ছিল সেটা এই যে, ক্ষমতাশীনদের কেউ কেউ সংখ্যাগুরুর চেয়ে সংখ্যালঘুদের বেশি বিশ্বাস করেন।

প্রশাসন লক্ষ্মী ছেলের মতো বিনা প্রতিবাদে তার নীতি ও নির্দেশ মেনে চলবে নিশ্চিত করার পর সরকার দেশ থেকে রাজনৈতিক বিরোধিতা নির্মূল করার কাজ শুরু করে। বিরোধী নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে, তৃণমূলপর্যায়ের বহু নেতাকর্মীর ভূসম্পত্তি দখল কিংবা ধ্বংস করা হয়েছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি’র বহু স্খানীয় দফতর জ্বালিয়ে দেয়া কিংবা তছনছ করা হয়েছে। বিরোধী দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের ভীতি প্রদর্শন ও আতঙ্কগ্রস্ত করার কোনো চেষ্টারই ত্রুটি রাখা হয়নি। তিন দফার প্রধানমন্ত্রী এবং বর্তমানে বিরোধী দলের নেত্রী খালেদা জিয়াকে তার বাসভবন থেকে উৎখাত করার সিরিজ চেষ্টা চলছে, তার অন্যান্য সম্পত্তি বাবদও হয়রানি চলছে।

একই সাথে খালেদা জিয়া ও তার পুত্রদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা সাজানো হচ্ছে­ যদিও আওয়ামী লীগের লোকদের বিরুদ্ধে ছয় হাজারেরও বেশি দুর্নীতি ও ফৌজদারি মামলা তুলে নেয়া হয়েছে, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ১৫টি দুর্নীতির মামলাও মন্ত্রবলে অদৃশ্য হয়েছে। সাধারণ মানুষেরও বুঝতে বাকি নেই যে, খালেদাকে দেশান্তরে পাঠানো এবং তার ছেলেদের দেশে ফিরতে নিরুৎসাহিত করাই এসব মামলা ও হয়রানির উদ্দেশ্য। কারণও সুস্পষ্ট। শেখ মুজিবের দ্বারা বীরপ্রতীক উপাধিতে ভূষিত মুক্তিযোদ্ধা এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমান, তার পরিবার ও তার স্খাপিত বিএনপি দলকে মহাজোট সরকার গদি স্খায়ী করার পথের প্রধান কাঁটা মনে করে।

ত্রাস সৃষ্টি, ভীতি প্রদর্শন

রাজনৈতিক বিরোধিতা নির্মূল করার অনেকখানি দায়িত্ব ছেড়ে দেয়া হয়েছে ছাত্রলীগ, যুবলীগ এবং আওয়ামী লীগের অন্যান্য অঙ্গসংগঠনের ওপর। তারা গোড়ায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং অন্যত্র সব বিরোধিতা নির্মূল করে এখন নিজেদের মধ্যেকার বিরোধী অংশকে খতম করার কাজে হাত দিয়েছে। সরকারপ্রধান ও তার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিশেষ করে বিদেশীদের দেখানোর জন্য বারবার তাদের ‘হুঁশিয়ারি’ দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তাদের উৎসাহ ও বাহবা দেয়া হচ্ছে বলেই মনে হয়। সাহারা খাতুনের হুঁশিয়ারি গ্রাহ্য করা দূরের কথা প্রধানমন্ত্রীর হুঁশিয়ারিও তারা কর্ণপাত করছে না।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক সদস্য নিহত হয়। ঘটনার পটভূমি সম্বন্ধে কোনো তদন্ত হয়নি বলেই জানি। কিন্তু দেশের যেখানে যেখানে ছাত্রশিবিরের লোকদের পাওয়া গেছে সেখানেই তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে­ যদিও তাদের প্রায় অনেকেই ঘটনার সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্খিত ছিল না। অনেকে আবার রাজশাহী থেকে শত শত কিলোমিটার পর্যন্ত দূরে ছিল। শুধু তা-ই নয়, দেশের সব অঞ্চলে খুঁজে খুঁজে জামায়াতে ইসলামীর বহু নেতাকর্মীকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের কাউকেই বিচারে তোলা হয়নি। শুধু তাদের দলীয়কৃত পুলিশের নির্যাতনের শিকার করা হয়েছে, আটক রেখে রাজনীতির অঙ্গন থেকে তাদের সরিয়ে দেয়া হয়েছে, আর সে সুযোগে বিরোধী দলগুলোর বিরুদ্ধে কুৎসা ছড়ানো হচ্ছে। অন্য দিকে যারা দাঙ্গা করতে গিয়ে একজন সহকর্মীর হত্যার কারণ সৃষ্টি করেছিল তাদের কাউকে গ্রেফতার করার হিম্মত সরকারের হয়নি, কেননা তারা সরকারের ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী। দেশজোড়া ত্রাস সৃষ্টি করে বিরোধীদের হত-মনোবল করার এই হচ্ছে ‘টেকনিক’।

আরেকটা ইংরেজি প্রবাদ হচ্ছে : ‘ব্ল্যাক উইল টেক নো আদার হিউ’ - যার বাংলা করা হয়েছে ‘কয়লা ধুলেও ময়লা ছাড়ে না’। শেখ মুজিব অবশ্যই আদিতে গণতান্ত্রিক নেতা ছিলেন। কিন্তু তার পরিবর্তন প্রকাশ পায় ক্রমে ক্রমে। রক্ষীবাহিনী ৪০ হাজার বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে হত্যা করেছে। দুর্নীতি বিষবাষ্পের মতো দেশকে ছেয়ে ফেলে। প্রশাসনিক ব্যর্থতার কারণে চুয়াত্তরের মনন্তরে ৭০ হাজার মানুষ মারা যায়। স্বভাবতই সমালোচনা ছিল প্রতিটি মানুষের মুখে মুখে। সরকারের ডিক্টেটরি মানসিকতা সেসব সমালোচনা শুনতে রাজি ছিল না। চুয়াত্তরে জননিরাপত্তা নামে একটা কালো আইন পাস করে সমালোচনার মুখ বন্ধ করার প্রয়াস লক্ষ্য করা গেছে। তখন কোনো বেসরকারি রেডিও কিংবা টেলিভিশন ছিল না বাংলাদেশে। সেদিক থেকে সরকারের ভয়ের কারণ ছিল না। কিন্তু পত্রিকাগুলোর সমালোচনা সরকারের নীতি নির্ধারকদের আহার-নিদ্রা হারাম করে তুলেছিল।

সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ

কলমের এক টানে চারটি বাদে সব দৈনিক-সাপ্তাহিক পত্রপত্রিকার ডিক্লারেশন (প্রকাশের লাইসেন্স) বাতিল করে দেয়া হয়­ শুধু দু’খানি বাংলা এবং দু’খানি ইংরেজি পত্রিকা ছাড়া। এগুলোর মধ্যে দৈনিক বাংলা ও ইংরেজি বাংলাদেশ টাইমস আগেই সরকারের মালিকানাধীন ছিল। তার ওপর তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার দৈনিক ইত্তেফাক আর হামিদুল হক চৌধুরীর বাংলাদেশ অবজারভারও রাষ্ট্রায়ত্ত করা হয়। এরপর আর গণমাধ্যমে সমালোচনার ভয় রইল না। কিন্তু মুখে মুখে, বৈঠকখানার আড্ডায় আর পাড়ার চায়ের দোকানে সরকারের এবং সরকার প্রধানের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের দুর্নীতি ছিল বলতে গেলে একমাত্র আলোচনার বিষয়।

জ্যামাইকা থেকে ঢাকা ফেরার পথে হিথরো বিমানবন্দরে মুজিব ভাই আমাকে বলেছিলেন, নিউজপ্রিন্টের ব্ল্যাকমার্কেটিং বন্ধ করার জন্যই তিনি পত্রিকাগুলো বন্ধ করে দিয়েছেন। (লেখকের নতুন বই ‘এক জীবন এক ইতিহাস দ্রষ্টব্য, পৃষ্ঠা ২০৬)। ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতার কারণে এবং জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা বশত আমি বরাবরই বলে এবং লিখে এসেছি যে কিছুসংখ্যক অসৎ এবং দুর্বৃত্ত ব্যক্তির খপ্পরে পড়েই শেখ মুজিব এসব অন্যায় কাজ করেছিলেন। এমনকি তিনি যখন গণতান্ত্রিক সংবিধান বাতিল করে একদলীয় বাকশাল পদ্ধতি চালু করেন, আজীবন রাষ্ট্রপতি হওয়ার প্রথম ধাপ হিসেবে নিজেকে সাত বছরের জন্য রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন, তখনো আমি বলেছিলাম যে, কিছুসংখ্যক দুষ্ট লোকের পরামর্শেই সেসব তিনি করেছিলেন।

কিন্তু এখন আর সংশয়ের অবকাশ নেই যে, অতীতের অন্যায় কাজগুলোকেই নিজেদের ঐতিহ্য বলে বিবেচনা করে বর্তমান সরকার জাতির সর্বনাশ করছে। অঙ্গ সংগঠনগুলো দিয়ে রাজনৈতিক বিরোধীদের খতম করার কাজ অনেকখানি এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মুখে পূর্ববর্তী সরকারের দুর্নীতির কথা বলে বলে তারা খই ফোটাচ্ছেন। কিন্তু এ সরকারের আমলে শাসক দলকে দুর্নীতির ‘ওপেন জেনারেল লাইসেন্স’ দেয়া হয়েছে। ব্যবসায়-বাণিজ্য সবই হাতিয়ে নিয়েছে শাসক দলের লোকরা। এখন আবার নানা টালবাহানায় টেন্ডার পদ্ধতিকেও বর্জন করা হয়েছে।
সরকার অতীতের মতো মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণের কাজে পুরোপুরি মনোযোগ দিয়েছে। অবশ্য প্রক্রিয়াটা শুরু হয়েছে গোড়া থেকেই। মুখে মুখে বাকস্বাধীনতা, সংবাদের স্বাধীনতার প্রতি তারা ‘দরদের’ বয়ান দেন। কাজে কিন্তু হচ্ছে সম্পূর্ণ বিপরীত। তারা কথা বলেন কাটা জিহ্বা দিয়ে। বস্তুত এটা আরেকটা ‘টেকনিক’। অপকর্মগুলো আড়াল করতেই তারা মুখে বড় বড় কথার খই ফোটান­ যেমন দেখা গেছে মানবাধিকারের বেলায়। অ্যামনেস্টি, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ প্রমুখ মানবাধিকার সংস্খাগুলো আইনবহির্ভূত হত্যাসহ বাংলাদেশে মানবাধিকারের শোচনীয় অবমাননা সম্বন্ধে প্রায়ই বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করছে, কিন্তু সরকার বলছে কোনো মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে না।

সাংবাদিক নির্যাতন

বাংলাদেশে অন্তত শতাধিক সাংবাদিককে আওয়ামী লীগ ও তাদের অঙ্গসংগঠনগুলো হয়রানি ও নির্যাতন করেছে। মাত্র গত মঙ্গলবার (৮ জুন) যুবলীগ কর্মীরা রাজশাহীতে একজন সাংবাদিককে কুপিয়ে হত্যা করেছে। যমুনা টেলিভিশন ও চ্যানেল ওয়ান টেলিভিশন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সরকারের অনুমোদিত ব্যক্তিদের ছাড়া আর কাউকে কোনো টকশোতে ডাকা নিষিদ্ধ হয়েছে। দেশ কলিং, ইউ-টিউব, নিউজ ফন্সম বাংলাদেশ ও ফেসবুক­ এসব ব্লক বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। অবশ্য বিদেশী প্রভুদের চাপে অবশেষে ফেসবুকের ওপর নিষেধাজ্ঞা গত সপ্তাহে তুলে নেয়া হয়েছে।
কিন্তু আমার দেশ পত্রিকার বিরুদ্ধে যা যা করা হয়েছে সেটা সরকারের কুশাসনের মধ্যেও জঘন্যতম অধ্যায় হয়ে থাকবে। এ পত্রিকার এক সাংবাদিকের প্রাণনাশের চেষ্টা হয়েছে তার ওপর আক্রমণ চালিয়ে। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের ওপর ঢাকায় ও লন্ডনে আওয়ামী লীগের সমর্থকরা হামলা করেছে। অনেক জেলায় আওয়ামী লীগের কর্মীরা তার বিরুদ্ধে সিরিজ ‘মানহানির’ মামলা করেছে। সভ্য দেশের আইনে যার মানহানি করা হয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে তিনি ছাড়া আর কেউ মানহানির মামলা করতে পারেন না। কিন্তু আজকের বাংলাদেশে যে কেউ কারো বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করছে, আইনব্যবস্খা আওয়ামী লীগের খেলার পুতুল হয়ে দাঁড়িয়েছে।

গত সপ্তাহে আমার দেশ পত্রিকার প্রকাশ বন্ধ, আপিস তালাবন্ধ ও মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তার এবং পত্রিকার সব সিনিয়র সাংবাদিক ও কর্মচারীর বিরুদ্ধে ভুয়া মামলা রুজু করা হয়েছে। হাইকোর্ট তাকে রিমান্ডে না নিয়ে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের নির্দেশ দিলেও তার বিরুদ্ধে সাজানো রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা এনে মাহমুদুর রহমানকে রিমান্ডে দেয়া হয়েছে। বর্তমান সরকারের আমলে রিমান্ড কথাটা সম্পূর্ণ নতুন এবং ভয়াবহ একটা অর্থ ধারণ করেছে। রিমান্ড মানে নির্যাতন। রিম্যান্ডে গেলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি কখনো ছাড়া পাবে কি না অথবা আদৌ বেঁচে থাকবে কি না সে সন্দেহ সবার।

এত আক্রোশ কেন?

মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে আক্রোশের কারণ কী? সরকারের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ, কুশাসন, নির্যাতন প্রভৃতির সমালোচনা তার পত্রিকা এবং তিনি প্রায়ই করেছেন। সেটা অবশ্যই সাংবাদিক হিসেবে তাদের নৈতিক কর্তব্য ছিল। কিন্তু আগেই বলেছি, তারা সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না। মাহমুদুর রহমান অভিযোগ ছেপেছিলেন যে, বিনা টেন্ডারে মার্কিন তেল কোম্পানি শেভরনকে কন্ট্রাক্ট দান বাবদ কয়েক মিলিয়ন মার্কিন ডলার উৎকোচ নেয়া হয়েছে। তার পর থেকেই মাহমুদুর রহমানকে ‘খতম’ করার সুপরিকল্পিত কর্মসূচি নেয়া হয়েছে। এসব অভিযোগ নিয়ে তদন্ত হতে পারত। যদি অভিযোগগুলো অসত্য হতো তাহলে আইনানুগ ব্যবস্খা নেয়া যেত। কিন্তু তা করা হলো না। অথচ এর পর থেকে আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে নতুন নতুন মামলা হচ্ছে। এখন মনে হচ্ছে গত বছর দেশের দক্ষিণাংশে যে আইলা সামুদ্রিক ঝড় ও বন্যা হয়েছে সেটাও মাহমুদুর রহমান ঘটিয়েছেন বলে অভিযোগ হতে পারে। আর একটা অভিযোগ হচ্ছে রাষ্ট্রদ্রোহিতার। উত্তরায় তার বাড়িতে কয়েকজন সরকারি কর্মচারী উপস্খিত ছিলেন। সেটাকেই বলা হচ্ছে রাষ্ট্রদ্রোহিতা। ওই সরকারি কর্মচারীরা যে চায়ের আমন্ত্রণে, কারো কুলখানি উপলক্ষে কিংবা কবিতার আসরে সেখানে যাননি তার প্রমাণ কী? আর অভিযোগ করছে কে? যারা সচিবালয়ের কোলঘেঁষে জনতার মঞ্চ করেছিল, নির্বাচিত সরকারকে অমান্য করতে সরকারি কর্মচারীদের প্রকাশ্যে উসকানি দিচ্ছিল। রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা প্রথমেই তাদের বিরুদ্ধে করা উচিত ছিল নাকি?

রাতের আঁধারের ষড়যন্ত্র

আমার দেশ পত্রিকার মালিকানা হস্তান্তরিত হয়েছিল। মাহমুদুর রহমান গত বছরই প্রকাশকের নাম পরিবর্তনের আবেদন করেছিলেন। সে আবেদনের সুরাহা হওয়া পর্যন্ত পূববর্তী প্রকাশের নাম বহাল রাখা প্রচলিত রীতি। একদা আমিও কয়েকটি পত্রিকায় কাজ করেছি, এসব আমার জানা আছে। তাতে সরকারের আপত্তি থাকলে তারা লিখিতভাবে পত্রিকার কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিতে পারত। তার পরিবর্তে একটি গোয়েন্দা সংস্খা প্রকাশককে ছিনতাই করে নিয়ে যায়। তাকে বেশ কয়েক ঘন্টা আটক রেখে (কোন পদ্ধতিতে কে জানে?) তার কাছ থেকে মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগে স্বাক্ষর নেয়া হয়। তারপরই অনেক রাতে আমার দেশ পত্রিকার আপিসে পুলিশ যায়, মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করে এবং পত্রিকার আপিসে তালা লাগিয়ে দেয়া হয়। এমন অধৈর্যের কোনো কারণ ছিল কি? দিনের আলো পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বাধা কোথায় ছিল? বহু দেশে ও বহু সমাজে এ বিশ্বাস পোষণ করা হয় যে, রাতের আঁধারে যা করা হয় তাতে ষড়যন্ত্রের দুর্গন্ধ পরিষ্কার।

বাংলাদেশের সাংবাদিকরা ছাত্রলীগের হাতে মার খাচ্ছেন, খুন হচ্ছেন। সরকার পদে পদে তাদের নৈতিক দায়িত্ব পালনে বাধা দিচ্ছে। দুটো টেলিভিশন চ্যানেল বন্ধ হয়ে গেল, আমার দেশ পত্রিকার পাঁচ-ছয় শ’ সাংবাদিক ও কর্মচারী চাকরি হারালেন। সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র কারণে বাংলাদেশ অবজারভার পত্রিকাও বন্ধ হয়ে গেল। সব মিলিয়ে কত সাংবাদিক বেকার হলেন? আড়াই হাজার? তিন হাজার? তাদের এবং তাদের পরিবারের ভরণ-পোষণের উপায় কোথায়? তারা কি ‘কনস্ট্রাকশনের’ কাজ করতে দুবাই কিংবা মালয়েশিয়ায় যাবেন?

আর বাংলাদেশের মানুষ। একটা বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা ও মানবাধিকারের দাবিতে তারা একাত্তর সালে শেখ মুজিব ময়দান থেকে অনুপস্খিত থাকলেও স্বাধীনতার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। মাহমুদুর রহমানের মানবাধিকার আর সংবাদপত্র আমার দেশের স্বাধীনতা পদদলিত হয়েছে। মাহমুদুর রহমান তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলোর অসারতা প্রমাণের সুযোগ পাবেন না। ফখরুদ্দীন-মইন ইউ সরকারের আমলের রিমান্ড ব্যবস্খায় দীর্ঘ দিন অবর্ণনীয় নির্যাতন চালিয়ে মাহমুদুর রহমানের ওপর বর্তমান সরকারের ক্রোধের প্রতিশোধ নেয়া হবে। কিন্তু মাহমুদুর রহমানই শেষ কথা নন। একে একে সবারই মানবাধিকার ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, মতামত প্রকাশ ও সংবাদের স্বাধীনতা পদদলিত হবে। এ সরকার যত দিন ক্ষমতায় থাকবে তত দিন কারোই কোনো অধিকার নিরাপদ নয়।

কিছুকাল আগে এক প্রবন্ধে মার্টিন নায়মোলারের মনস্তাপের উদ্ধৃতি দিয়েছিলাম। নায়মোলার জার্মান নৌবাহিনীর দুর্ধর্ষ সাবমেরিন অধিনায়ক ছিলেন, পরে চিন্তাবিদ ও লেখক হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন এবং হিটলারের নাৎসিদের দ্বারা কারারুদ্ধ হন। জার্মান জাতি নিষ্ক্রিয় ছিল বলেই হিটলার তাদের স্তব্ধ করে দিতে এবং নাৎসি শাসন চালু করতে পেরেছিলেন­ এ ব্যাপারটাকে নায়মোলার বর্ণনা করেছেন এভাবে :

প্রথমে ওরা এলো কমিউনিস্টদের ধরতে, আমি প্রতিবাদ করিনি­
কেননা আমি কমিউনিস্ট ছিলাম না।
তারপর তারা সোস্যালিস্টদের ধরতে এসেছিল, আমি প্রতিবাদ করিনি­
কারণ আমি সোস্যালিস্ট ছিলাম না।
তারপর তারা এলো ট্রেড ইউনিস্টদের ধরতে, আমি প্রতিবাদ করিনি­
কারণ আমি ট্রেড ইউনিয়নপন্থী ছিলাম না।
তারপর তারা এলো ইহুদিদের ধরতে, আমি প্রতিবাদ করিনি­
কারণ আমি ইহুদি ছিলাম না।
তারপর ওরা আমাকে ধরতে এলো­
তখন আর আমার হয়ে প্রতিবাদ করার কেউ ছিল না।

মাহমুদুর রহমান একজন ব্যক্তিমাত্র নন। আজ তিনি বাংলাদেশী জাতির স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, মানবাধিকার ও সংবাদের স্বাধীনতার প্রতীক। তার অবমাননা, গ্রেফতার ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে গোটা জাতিকে এক হয়ে রুখে দাঁড়াতে হবে। না হলে কারোই কোনো অধিকার নিরাপদ নয়।
serajurrahman@btinternet.com
[সূত্রঃ নয়া দিগন্ত, ১৫/০৬/১০]

No comments:

Post a Comment