Saturday 31 December 2011

শেখ হাসিনা ও তার মন্ত্রীদের খিস্তি-খেউড়












স্টাফ রিপোর্টার
বচনে জুড়ি নেই ক্ষমতাসীন সরকারের কর্তাব্যক্তিদের। সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিত্ব থেকে শুরু করে নিম্ন পর্যায় পর্যন্ত সবাই এ বিষয়ে যেন সিদ্ধহস্ত। বিশেষ করে বিরোধী দলের প্রতি আক্রমণাত্মক বক্তব্যে তাদের তুলনা হয় না। পাশাপাশি তারা গণমাধ্যম ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর প্রতিও বিষোদগার করেন। তাদের বক্তব্য বেশিরভাগ সময় রাজনৈতিক শিষ্টাচার ভেদ করে অশ্লীলতার পর্যায়ে চলে যায়। নতুন নতুন শব্দ চয়নের মাধ্যমে ছন্দ মিলিয়ে তারা বিরোধী দলকে আক্রমণ করেন। সরকারের পাশাপাশি ক্ষমতাসীন দলের নেতারাও সমান তালে বিরোধী দলকে ঘায়েল করে এসব অশালীন বক্তব্য দেন। এমন বক্তব্যের ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা চ্যাম্পিয়ন। তার বহুল আলোচিত বক্তব্য—‘একটির বদলে দশটি লাশ ফেলা হবে।’ এছাড়া ১০ টাকা কেজি চাল ও ঘরে ঘরে চাকরি দেয়ার বহুল আলোচিত বক্তব্যটি শেখ হাসিনাই দিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে দেয়া এসব বক্তব্যের আংশিক পাঠকদের সামনে তুলে ধরা হলো—
গত ৩০ নভেম্বর সংসদের একাদশতম অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা বিভক্তিকরণে বিরোধিতাকারী বুদ্ধিজীবীদের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বলেন, জনগণের সেবা নিশ্চিত করতে ঢাকা সিটিকে দু’ভাগ করা হয়েছে। দু’ভাগ নয়, আমাদের ঠাকা থাকলে ঢাকা চার ভাগ করতাম। একই দিনে তিনি বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার দুই ছেলেকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে বলেন, আমার সন্তানরা লেখাপড়া শিখে মানুষ হয়েছে। রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে টাকা নিয়ে উনার (বেগম জিয়ার) ছেলেদের একজন ‘মানি লন্ডারিংয়ে’ মাস্টার্স করেছে, আরেকজন ‘ড্রাগে’ করেছে ডিগ্রি পাস।
ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত বিভিন্ন চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সম্পর্কে ভারত সফর শেষে দেশে ফিরে ২০১০ সালে ১৬ জানুয়ারি এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নির্বাচনে জনগণ আমাদের যে হারে ভোট দিয়েছে তাতে ভারতের সঙ্গে সমঝোতা-চুক্তি করতেই পারি। নির্বাচন এলেই মহলবিশেষের ভারতবিরোধী ক্যাম্পেইন চলে। এটা তাদের স্বভাবজাত হয়ে গেছে, চাইলেও আর বদলানো যাবে না।
জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তন করে হযরত শাহজালাল (র.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর করার পক্ষে যুক্তি দিয়ে ২০১০ এর ১৯ ফেব্রুয়ারি এক অনুষ্ঠানে বিএনপির প্রতি ইঙ্গিত করে শেখ হাসিনা বলেন, অতীত থেকে যারা শিক্ষা নেয়নি, তাদের শেখানোর প্রয়োজন রয়েছে। তাদের শিক্ষা দিতেই জিয়ার নাম বদল হয়েছে। তারা একবারও ভাবেনি, নাম বদলের খেলা ভালো হবে না। ভাবেনি তাদেরও খারাপ দিন আসতে পারে। আমরা দু’-একটা নাম পরিবর্তন করাতেই এত জ্বালা। তাদের করা আড়াইশ’ প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করা হলে কেমন লাগবে? ২০১০ সালের বুদ্ধিজীবী দিবসের আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, মিথ্যা বলা বিএনপির অভ্যাস।
বিএনপি-জামায়াত জোটের কমিশন খাওয়ার কারণে দেশে নতুন কোনো বিদ্যুত্ কেন্দ্র স্থাপিত হয়নি অভিযোগ করে ২৩ মে ২০১০ এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের কমিশন খাওয়ার কোনো নিয়ত নেই। আগে কমিশন খাইওনি, আগামীতেও খাব না। আমাদের কমিশন খাওয়ার প্রয়োজনও নেই। ৩০ আগস্ট ২০১০ তারিখে বিএনপির প্রতি ইঙ্গিত করে শেখ হাসিনা বলেন, ওরা জালিয়াত, দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন। দেশের মানুষের সুখ-শান্তি তাদের ভালো লাগে না।
২০১০ সালে ছাত্রলীগ আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘নিজের গ্রুপ শক্তিশালী করতে গিয়ে ছাত্রলীগে যারা ছাত্রদল ও শিবির কর্মীদের ঢুকিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। যারা অপরাধ করবে তাদের কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।’
গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী তার মন্ত্রিপরিষদ সদস্যদের সতর্ক করে দিয়ে বলেন, সরকারের দুই বছর চলে যাচ্ছে, এখন থেকে ভাটার টান লাগবে। সরকারকে অনেক প্রতিকূলতা মোকাবিলা করতে হবে। মানুষ সরকারের কাজের মূল্যায়ন করবে। জানতে চাইবে কোন মন্ত্রণালয় ভালো করেছে, কোন মন্ত্রণালয় খারাপ করেছে।
এ বছরের ৯ জানুয়ারি শেখ হাসিনা রংপুরে গিয়ে বলেন, রংপুরের বউ হিসেবেও তো একটা দায়িত্ব আছে। তাই আপনাদের উন্নয়নের সব দায়িত্ব আমি নিয়ে নিচ্ছি। ৩ ফেব্রুয়ারি বলেন, ১০ টাকা কেজি চালের কথা এবার নয়, ’৯৬ সালে বলেছিলাম। ১ মে তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার সঙ্গে আমাকে এক পাল্লায় মাপবেন না। ১৩ অক্টোবর শেখ হাসিনা বলেন, মহাজোট সরকারের উন্নয়ন দেখে খালেদা জিয়া পাগল হয়ে গেছেন। ২৫ আগস্ট বলেন, দেশে জিনিসপত্রের দাম এখনও কম। ২৭ নভেম্বর বলেন, খালেদা জিয়া ঘোমটা খুলে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ নিয়েছেন।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১০ এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও বর্তমান যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বর্তমান সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের কঠোর সমালোচনা করে বলেন, মন্ত্রীদের দুর্নীতি নিয়ে আজ কথা উঠেছে। এমপি-মন্ত্রীদের মনে রাখতে হবে, নিজেদের দিন বদল করতে আপনাদের পাঠানো হয়নি, ১৬ কোটি মানুষের ভাগ্য বদলানোই হচ্ছে আপনাদের কাজ। ওই বছরের ডিসেম্বরে ওবায়দুল কাদের বর্তমান মন্ত্রিপরিষদ সদস্যদের দিয়ে ‘দিন বদল’ সম্ভব নয় মন্তব্য করে বলেন, অফিসে অফিসে প্রসাধনীর মতো কম্পিউটার সাজিয়ে রাখলেই দিন বদল হয় না। যারা দিন বদলের কথা বলে মুখে ফেনা তুলছেন তাদের মন-মানসিকতাই এখনও বদলায়নি। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দেয়া সরকারের প্রশাসনিক কাজ এনালগ পদ্ধতিতে চলছে।
মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়ার পর কাদের নিজের দায়িত্বকে চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে বলেন, ঢেউ না থাকলে নদী কিসের? ঢেউয়ের মধ্যে সাঁতার কাটাই চ্যালেঞ্জ। আর কোনো চ্যালেঞ্জই অনতিক্রমযোগ্য নয়। এরপর অন্য এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, পথ অনেক, পেট্রল কম। গত ২৭ নভেম্বর তিনি বলেন, আওয়ামী লীগে এমন পাতলা ঈমানের লোক নেই যে বিএনপি ডাকলেই সাড়া দেবে।
৩০ নভেম্বর ২০১০ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ও বর্তমান রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, বিরোধী দলে থাকতে আমরাও কোনো খুঁত বের করেই বলেছি, সংসদে যাব না। এর আগে এক অনুষ্ঠানে সুরঞ্জিত সেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদকে তাচ্ছিল্য করে বলেন, সে (ব্যারিস্টার মওদুদ) একজন সফল জোকার। তার মতো বহুরূপী আমি আর দেখিনি। অপর এক অনুষ্ঠানে সুরঞ্জিত সেন বলেন, বাঘে ধরলে বাঘে ছাড়ে, কিন্তু শেখ হাসিনা ধরলে ছাড়ে না। রেলের সমস্যা সমাধান বিষয়ে নতুন রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত : কোন অন্ধকারে কালো বেড়ালটি কীভাবে লুকিয়ে রয়েছে তা খুঁজে দেখতে চাই।
২০১০ সালের আগস্টে এক অনুষ্ঠানে কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী বিরোধী দলের উদ্দেশে বলেন, দিনের আলোতেই ভারতের সঙ্গে ঋণ সহায়তা চুক্তি হয়েছে। এ নিয়ে কোনো লুকোচুরি হয়নি। সারা বিশ্বের গণমাধ্যমে এ চুক্তির বিষয় প্রকাশিত হয়েছে। তাই অযথা এ নিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করে লাভ হবে না। আর কেউ ফুঁ দিলে সরকার উড়ে যাবে না বা পতন হবে না।
৭ মে ২০১০ এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে পারি, এরশাদ জিয়ার হত্যাকারী। বেগম খালেদা জিয়া তার কাছ থেকে বাড়ি এবং ছেলেদের ভরণ-পোষণের টাকা নিয়ে আঁতাত কাকে বলে তার প্রমাণ দিয়েছেন।
সরকারের বিরুদ্ধে লন্ডনভিত্তিক ম্যাগাজিনে সংবাদ প্রকাশ হওয়ার পর গত ১৩ আগস্ট মতিয়া চৌধুরী বলেন, সাপ্তাহিক ইকনোমিস্ট জঙ্গিবাদের টাকায় রিপোর্ট করছে। গত ১৩ মে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগই ধর্মীয় শিক্ষাকে শিক্ষানীতিতে বাধ্যতামূলক করেছে। ঈমান-আমান ঠিক রেখে বর্তমান সরকার কাজ করে যাচ্ছে বলেই দেশের উন্নয়ন হচ্ছে। ২ জুলাই তিনি বলেন, চোরাচালান রোধে ইউরিয়া সারের দাম বাড়ানো হয়েছে।
২০১০ সালের ২১ এপ্রিল এক অনুষ্ঠানে বিরোধীদলীয় নেত্রী ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে ‘যুদ্ধপরাধের সহযোগী’ আখ্যায়িত করে সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী বলেন, মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানের জেনারেল জানজুয়ার সঙ্গে বেগম জিয়া সেনাক্যাম্পে থেকে মুক্তিযোদ্ধা হত্যার পরিকল্পনায় ছিলেন। সেই অপরাধে তার বিচার হবে। রাজাকারের নেত্রী বেগম জিয়াকে রুখতে হবে।
সরকারের সমালোচনা করে সংবাদ পরিবেশনে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে ২৫ মে ২০১০ এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেন, নেতাদের চাঁদাবাজি হেডলাইন না করে যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টির বিষয়কে হেডলাইন করুন।
৮ জানুয়ারি ২০১০ সংবাদ ব্রিফিংয়ে সংসদ অধিবেশনকে ‘সার্কাস’ হিসেবে আখ্যায়িত করে আশরাফুল ইসলাম বলেন, বিরোধী দল সংসদের সব কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করছে এবং বেতন-ভাতাসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছে। তারা কেবল আসছে না সেই সম্মেলনে (সংসদ অধিবেশনে) যেখানে শুধু ‘সার্কাস’ হয়।
বিরোধী দলের ‘দেশ বিক্রি’র অভিযোগ খণ্ডন করে অপর এক সংবাদ সম্মেলনে আশরাফ বলেন, এটা বেগম জিয়া ও বিএনপি-জামায়াত জোটের একটি মেনিয়া, নিরাময়ের অযোগ্য ‘ক্রনিক ডিজিজ’। দেশ কি ছেলের হাতের মোয়া নাকি শাড়ি-গয়না যে ইচ্ছে করলেই তা বিক্রি করা যায়। তারা কথায় কথায় আমাদের বিরুদ্ধে দেশ বিক্রির ধোয়া তোলেন। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিসর্জন এবং নতজানুতার ভাঙা রেকর্ড বাজান। পার্বত্য শান্তি চুক্তির সময় তিনি বলেছিলেন, ফেনী পর্যন্ত নাকি ভারত নিয়ে যাবে। সেই ফেনী থেকে তিনি বর্তমানের কোন দেশের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।
২৭ মে এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী মাহাবুবউল আলম হানিফ বলেন, এমন কোনো ইসলামবিরোধী কাজ নেই যা বেগম জিয়া করেন না। তিনি এক ওয়াক্ত নামাজও পড়েন না। অথচ নিজামী-আমিনীরা তাকে ইসলামের পক্ষের নেত্রী দাবি করেন। তিনি দলীয় সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধর্মপ্রাণ মানুষ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, শেখ হাসিনা ইসলামের নিয়মনীতি মেনে চলেন। যত ব্যস্তই থাকুন, প্রতিদিন নামাজ আদায় ও নিয়মিত কোরআন তেলাওয়াত করেন।
৫ অক্টোবর ২০১০ এক অনুষ্ঠানে মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, আওয়ামী লীগ বাকশালের চিন্তা-চেতনা ও দর্শনকে আমরা এখনও ধারণ করে। সব দলকে সঙ্গে নিয়ে একটি প্লাটফর্মের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধভাবে বাকশালের চিন্তা-চেতনাকে কাজে লাগিয়ে আমরা মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে কাজ করতে চাই।
গত ২৬ অক্টোবর হানিফ বলেন, জামায়াত-শিবির কর্মী যাদের বয়স ৪০ বছরের কম তারা রাজাকার-আলবদর ছিল না, তারা যুদ্ধাপরাধও করেনি। ২৭ সেপ্টেম্বর তিনি বলেন, পিকেটারের বুকে পুলিশের বুটের ছবিতে সরকারের অর্জন ম্লান হবে না।
২০১০ সালের ৭ মে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা মোহাম্মদ নাসিম ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, ছাত্রলীগের নামে যা ঘটছে তা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। এদের কর্মকাণ্ডে মাথা হেঁট হয়ে যায়। জয়কালী মন্দিরে চুরি প্রসঙ্গে গত ২ ফেব্রুয়ারি তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধের বিচার বাধাগ্রস্ত করতে মন্দিরে চুরি হয়েছে।
২৯ মে ২০১০ এক অনুষ্ঠানে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে ‘পাকিস্তানের চর’ মুক্তিযোদ্ধা বলে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম। তিনি বলেন, আমার এ বক্তব্যকে যদি কেউ খণ্ডন করতে চান, মিথ্যা প্রমাণ করতে পারেন তবে প্রকাশ্যে আমার সঙ্গে টকশো, আলোচনা বা বিতর্কে আসতে পারেন।
বিরোধী দলের আহূত হরতালের প্রেক্ষাপটে ৩০ নভেম্বর ২০১০ বিরোধী দলের প্রতি হুশিয়ারি উচ্চারণ করে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবীর নানক বলেন, জনজীবন স্বাভাবিক রাখতে হরতাল প্রত্যাহার করে নিন। নইলে ১ টাকার বিনিময়ে গুলশানের ৩৩ শতাংশ বাড়িটিও খালেদা জিয়াকে ছাড়তে হবে। সেখানে ছিন্নমূলদের বসবাসের ব্যবস্থা করা হবে।
গত ২৫ ডিসেম্বর ২০০৯ তারিখে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন বলেন, সন্ত্রাসী-জঙ্গি-চাঁদাবাজ-টেন্ডারবাজরা গর্তে ঢুকলেও বের করে আনা হবে। এজন্য আমি জীবনবাজি রেখে হলেও দায়িত্ব পালন করব। ২০ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমই বেড়েছে। দাম বৃদ্ধি দেশের মানুষ সাদরেই গ্রহণ করছে। ৬ অক্টোবর তিনি বলেন, ১০ বছরের মধ্যে দেশের আইন-শৃঙ্খলা এখন সবচেয়ে ভালো ।
ট্রানজিট ফি সম্পর্কে ১২ অক্টোবর ২০১১ তারিখে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান বলেন, আমাদের লোকজন অভিজ্ঞ না হওয়া পর্যন্ত ভারত থেকে ফি নেয়া হবে না। এ বছরের ২০ জানুয়ারি তিনি বলেন, শেয়ারবাজারে ধসের জন্য মাথা ঘামানোর কোনো কারণ নেই। কারণ, কতগুলো লোক যদি অর্থনীতিতে অবদান না রেখে লাভবান হতে চায়, তাদের কষ্টে আমার হৃদয় কাঁদে না।
মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফর প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী বলেন, এই সফরে প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে যেসব চুক্তি হতে যাচ্ছে, তাতে বাংলাদেশ অনেক লাভবান হবে। তবে ভারত এই চুক্তির সুফল বেশি পাবে।
গত ১৭ নভেম্বর সরকারদলীয় সংসদ সদস্য শওকত মোমেন শাহজাহান মুক্তিযুদ্ধকালীন কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীকে উদ্দেশ করে বলেন, কাদের সিদ্দিকী একজন যুদ্ধাপরাধী। তার বিচার হওয়া উচিত।
অশিক্ষিতদের ড্রাইভিং লাইন্সেস দেয়ার পক্ষে যুক্তি দিয়ে ১৬ সেপ্টেম্বর নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ড্রাইভারও ফাইভ পাস।
স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. ক্যাপ্টেন (অব.) মুজিবর রহমান ফকির গত ১০ মে এক অনুষ্ঠানে বলেন, কমিউনিটি হেলথ প্রোভাইডার পদে আমরা আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ এবং সমমনাদেরই নিয়োগ দেব। বিএনপি বা অন্য মতের কাউকে নিয়োগ দিলে ওই প্রকল্পটি বন্ধ করে দেয়া হবে। গত ৪ মে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান বিচার ব্যবস্থা স্বর্ণযুগে প্রবেশ করেছে।
http://www.amardeshonline.com/pages/details/2011/12/17/122522

Friday 9 December 2011

বর্বরতা এবং আওয়ামী লীগের গণতন্ত্র!!

শাহ আহমদ রেজা

যথেষ্ট সংযমী নেত্রী বলেই আওয়ামী লীগ সম্পর্কে বলতে গিয়ে বেগম খালেদা জিয়া শুধু বর্বর শব্দটির মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকেছেন। কিন্তু এতেই গায়ে জ্বালা ধরে গেছে দলটির নেতাদের। অন্যদিকে সত্য কিন্তু অনেক ভয়ঙ্কর। বর্বরতা এবং নিষ্ঠুরতা কাকে বলে তা জানার জন্য ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরানো যেতে পারে। সে ইতিহাসে জানা যাবে গণতন্ত্রের প্রশ্নে আওয়ামী লীগের মনোভাব সম্পর্কেও।
প্রথমে একটি উদাহরণ। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা এবং ১৯৫৭ সালের জুলাই পর্যন্ত সভাপতি ছিলেন মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। তখন আওয়ামী লীগের প্রধান কর্মসূচি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের জন্য স্বায়ত্তশাসন আদায় করা। দাবিটি আদায়ের লক্ষ্য নিয়ে অবিভক্ত বাংলার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও কৃষক-শ্রমিক পার্টির নেতা ‘শেরে বাংলা’ আবুল কাশেম ফজলুল হকের সঙ্গে যুক্তফ্রন্ট গঠন করেছিলেন মওলনা ভাসানী। হক-ভাসানীর পাশাপাশি তৃতীয় প্রধান নেতা ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানকেন্দ্রিক আওয়ামী লীগের নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বেই ১৯৫৪ সালে আওয়ামী লীগ শেরে বাংলার সঙ্গে যৌথভাবে পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষমতায় গিয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন শেরে বাংলা ফজলুল হক। কিন্তু ষড়যন্ত্রের রাজনীতি গণতন্ত্রের সম্ভাবনাকে নস্যাত্ করেছিল। ৯২-এর ‘ক’ ধারার আড়ালে জারি হয়েছিল জরুরি অবস্থা। দ্বিতীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছিল ১৯৫৬ সালে। সেবার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন আতাউর রহমান খান। সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানসহ দলের অন্য নেতারাও মন্ত্রিত্ব পেয়েছিলেন। একই সময়ে অর্থাত্ ১৯৫৬ সালের সেপ্টেম্বরে পাকিস্তানের কেন্দ্রেও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গিয়েছিল। মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি হিসেবে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরই তিনি পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে পরিপন্থী অবস্থানে চলে গিয়েছিলেন। শহীদ সোহরাওয়ার্দী এমনকি একথা পর্যন্ত ঘোষণা করেছিলেন যে, পূর্ব পাকিস্তান নাকি ৯৮ শতাংশ স্বায়ত্তশাসন পেয়ে গেছে! এর প্রতিবাদে এবং স্বায়ত্তশাসন আদায় ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার প্রশ্নে মওলানা ভাসানী ‘আসসালামু আলাইকুম’-এর জন্য বিখ্যাত কাগমারী সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন। সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে সংঘাতের পরিণতিতে মওলানা ভাসানীকে তাঁর নিজের গড়ে তোলা আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে গিয়ে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠন করতে হয়েছিল। ওই দিনগুলোতে শেখ মুজিবুর রহমান কিন্তু মওলানা ভাসানীর তথা পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে ভূমিকা পালন করেননি। শুধু তা-ই নয়, ১৯৫৭ সালের ২৫ ও ২৬ জুলাই পুরনো ঢাকার ‘রূপমহল’ সিনেমা হলে যখন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রতিষ্ঠাকালীন অধিবেশন চলছিল তখন শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী গুণ্ডারা হামলা চালিয়ে অধিবেশনকে বাধাগ্রস্ত করেছিল। প্রথমদিন পাল্টা প্রতিরোধে পিছিয়ে গেলেও দ্বিতীয় দফা হামলা চালানো হয়েছিল পল্টন ময়দানের সমাবেশে। সেদিনও শেখ মুজিবই গুণ্ডাদের নেতৃত্বে ছিলেন। তার নেতৃত্বে আওয়ামী গুণ্ডারা মওলানা ভাসানীর এবং খান আবদুল গাফফার খানসহ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত নেতাদের অনেকেরই মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিল। ইট-পাটকেলের ঢিল শুধু নয়, লাঠির আঘাতও সহ্য করতে হয়েছিল মওলানা ভাসানীকে। ফলে পল্টন ময়দানের সমাবেশ অনেকাংশে ভণ্ডুল হয়ে গিয়েছিল। এই একটি ঘটনাই প্রমাণ করে, গুণ্ডামি করার এবং সন্ত্রাসী হামলা চালানোর শিক্ষাটাও উত্তরাধিকার হিসেবেই পেয়েছে বর্তমান আওয়ামী লীগ।
পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগের এই গুণ্ডামি ও বর্বরতা দিন দিন শুধু আরও মারাত্মক হয়েছে। পাকিস্তান যুগে মওলানা ভাসানীর ন্যাপ ছাড়া অন্য কোনো রাজনৈতিক দলই বিশেষ করে পল্টন ময়দানে বাধাহীনভাবে সমাবেশ করতে পারেনি। প্রতিটি সমাবেশে ঝাঁপিয়ে পড়েছে আওয়ামী গুণ্ডারা। বাংলাদেশ হওয়ার পর দলটির বর্বরতা সীমা ছাড়িয়ে গেছে। মিছিল সমাবেশে হামলা তো চালিয়েছেই, ব্যক্তিগত পর্যায়েও অনেককে জখম ও খুন করেছে আওয়ামী গুণ্ডা-সন্ত্রাসীরা। পুলিশ এবং রক্ষীবাহিনীকেও দলীয় কর্মীর মতো ব্যবহার করেছেন নেতারা। ভাসানী ন্যাপ এবং জাসদের অনেক নেতাকেই আওয়ামী গুণ্ডা-সন্ত্রাসীদের হামলার শিকার হতে হয়েছে। ন্যক্কারজনক সে বর্বরতা এখনও চালাচ্ছে দলটি।
প্রসঙ্গক্রমে গণতন্ত্রের প্রশ্নে আওয়ামী লীগের মনোভাব ও কৌশল সম্পর্কে বলা দরকার। ১৯৫০-এর দশকে শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন দলটি স্বায়ত্তশাসনের তো বটেই, গণতন্ত্রেরও বিরুদ্ধে ভূমিকা পালন করেছে। এরপর এসেছে ১৯৬০-এর দশক। এখন গালগল্প শোনানো হলেও সত্য হচ্ছে, গণতন্ত্রের জন্য কোনো আন্দোলনেই আওয়ামী লীগ যথাযথ ভূমিকা পালন করেনি। দলটি বরং প্রতারণাপূর্ণ কৌশলের মাধ্যমে অন্যের সাফল্যকে দখল করেছে। একটি উদাহরণ হিসেবে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের কথা উল্লেখ করা যায়। শেখ মুজিব ১৯৬৬ সালের মে থেকে বন্দি থাকায় আওয়ামী লীগের অবস্থা তখন ছিল শোচনীয়। যুক্তফ্রন্টের ২১ দফাকে ছয়টি ভাগে আলাদা করে শেখ মুজিব তার ছয় দফা পেশ করেছিলেন ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে। ছয় দফার প্রশ্নেই ১৯৬৭ সালে আওয়ামী লীগ দ্বিখণ্ডিত হয়েছিল। শেখ মুজিব ছিলেন ‘ছয় দফাপন্থী’ আওয়ামী লীগের সভাপতি, অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খানের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল ‘পিডিএমপন্থী’ আওয়ামী লীগ। ‘ছয় দফাপন্থী’ আওয়ামী লীগের অবস্থা সে সময় এতটাই খারাপ ছিল যে, শেখ মুজিবকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় প্রধান আসামি বানানোর পরও দলটির পক্ষ থেকে আন্দোলন গড়ে তোলা দূরের কথা, ওয়ার্কিং কমিটির এক প্রস্তাবে বরং তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়ার জন্য ‘আবেদন’ জানানো হয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে শুরু হওয়া গণঅভ্যুত্থানে যোগ দেয়ার পরিবর্তে ‘ছয় দফাপন্থী’ আওয়ামী লীগ গিয়ে এমন এক জোট ‘ড্যাক’ বা ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটির সদস্য হয়েছিল, যার আহ্বায়ক ছিলেন শেখ মুজিবের প্রত্যক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বী এবং ‘পিডিএমপন্থী’ আওয়ামী লীগের সভাপতি নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান। ‘ড্যাক’-এর আট দফায় স্বায়ত্তশাসন শব্দটি পর্যন্ত ছিল না এবং শেখ মুজিবের মুক্তি চাওয়া হলেও তার নামের আগে-পরে ছিল ওয়ালী খান এবং জুলফিকার আলী ভুট্টোর নাম। ‘ড্যাক’-এর মধ্যে ছিল জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম পার্টি ও কাউন্সিল মুসলিম লীগসহ পশ্চিম পাকিস্তানকেন্দ্রিক দলগুলো। উল্লেখ্য, মওলানা ভাসানী ‘ড্যাক’-এর সঙ্গে যুক্ত হননি। কিন্তু বাঙালির জন্য সংগ্রামের কৃতিত্ব দখলকারী দল ‘ছয় দফাপন্থী’ আওয়ামী লীগ ‘ড্যাক’-এ গিয়েছিল।
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সূচনা করেছিলেন মওলানা ভাসানী। ১৯৬৮ সালের ডিসেম্বরে তিনি ‘ঘেরাও’ নামের এক নতুন ধরনের আন্দোলন শুরু করেন, ৪ ডিসেম্বর তাঁর নেতৃত্বে ছাত্র-জনতা পল্টন ময়দানের সমাবেশ থেকে গিয়ে গভর্নর হাউস (বর্তমান বঙ্গভবন) ঘেরাও করে। পুলিশের গুলিতে আন্দোলনকারীদের মৃত্যু ও সরকারি দমন-নির্যাতনের প্রতিবাদে মওলানা ভাসানী পরপর দু’দিন হরতালের ডাক দিয়েছিলেন। তাঁর এই ঘেরাও আন্দোলনের পথ ধরেই ১৯৬৯ সালের জানুয়ারিতে ঘোষিত হয়েছিল ছাত্র সমাজের ১১ দফা, আর ১১ দফাভিত্তিক গণঅভ্যুত্থানেই মুক্তি পেয়েছিলেন শেখ মুজিবসহ রাজনৈতিক বন্দিরা। কিন্তু প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দিয়ে আন্দোলনকে বিভ্রান্ত এবং শেষ পর্যন্ত ভণ্ডুল করেছিলেন শেখ মুজিব। যে ১১ দফার ভিত্তিতে তিনি মুক্তি পেয়েছিলেন, সে ১১ দফাকে পরিত্যাগ করে নিজের ছয় দফাকে প্রতিষ্ঠিত করার মধ্য দিয়েও তিনি নিজের মনোভাব ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।
শেখ হাসিনাও পিতাকেই অনুসরণ করে চলেছেন। জনগণের সঙ্গে তো বটেই, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও আওয়ামী লীগ সব সময় প্রতারণামূলক কৌশল অবলম্বন করেছে। প্রতিটি উপলক্ষে প্রমাণিত হয়েছে, গণতন্ত্র বা জনগণের অধিকার আদায়ের আড়ালে ক্ষমতায় যাওয়ার এবং দলগত স্বার্থ উদ্ধার করার বাইরে আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্যের মধ্যে আর কিছু নেই। উদাহরণ দেয়ার জন্য বাকশালী শাসনের পতন-উত্তরকালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোর দিকে দৃষ্টি ফেরানো যায়। প্রতিটি নির্বাচনে অংশ নেয়ার প্রক্রিয়াতেই আওয়ামী লীগ কোনো না কোনোভাবে প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে। ১৯৭৯ সালের সংসদ নির্বাচনের কথা উল্লেখ করা যাক। আবদুল মালেক উকিল তখন সভাপতি। আওয়ামী লীগ সেবার নির্বাচনে অংশ নেয়ার পূর্বশর্ত হিসেবে সেনাবাহিনী থেকে জেনারেল জিয়াউর রহমানের পদত্যাগ এবং ১৯৭৪ সালে নিজেদেরই পাস করা চতুর্থ সংশোধনী বাতিলসহ চারটি প্রধান দাবি তুলে ধরেছিল। নেতারা জনগণকে বোঝাতে চেয়েছিলেন, চার দফা পূরণ না করা হলে তারা নির্বাচনে অংশ নেবেন না। অন্যদিকে কোনো একটি দাবি পূরণ করা দূরে থাকুক, মেনে নেয়ার আশ্বাস পর্যন্ত দেয়নি জিয়ার সরকার। তা সত্ত্বেও ১৯৭৯-এর ১৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নিয়েছিল।
১৯৮১ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নেয়ার প্রক্রিয়াতেও আওয়ামী লীগ ন্যক্কারজনক প্রতারণা করেছিল। নির্বাচনের তারিখ পেছানো, জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার, রাজবন্দিদের মুক্তি এবং ভোটার তালিকা সংশোধনের দাবি ছিল চার দফায়। কিন্তু শুধু নির্বাচনের তারিখ পেছানোর দাবিটি পূরণ করাতেই নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল আওয়ামী লীগ। বড় কথা, নির্বাচনে অংশ নেয়ার আগে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে হত্যার অভিযোগে ফিল্ড জেনারেল কোর্ট মার্শালের বিচারে মৃত্যু দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত ১২ জন সামরিক অফিসারের সঙ্গে গুরুতর প্রতারণা করেছিল।
আওয়ামী লীগের প্রতারণার ধারাবাহিকতায় আরও একটি দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছিল ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে। তারও আগে বিএনপির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগ এরশাদের অবৈধ অভ্যুত্থানকে সমর্থন জানিয়েছিল। সামরিক শাসনের পরবর্তী নয় বছরে নানা কৌশলে এরশাদকে রক্ষাও করেছে আওয়ামী লীগ। বিস্তারিত বর্ণনায় না গিয়ে ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচন সম্পর্কে এটুকু উল্লেখ করাই যথেষ্ট যে, ২১ মার্চ গভীর রাতে নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণার একদিন আগেও শেখ হাসিনা বলেছিলেন, চলমান আন্দোলনকে পাশ কাটিয়ে যারা স্বৈরাচারের নির্বাচনে অংশ নেবে, তাদের ‘জাতীয় বেঈমান’ হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। কিন্তু নিজেই নিজের সে ঘোষণার উল্টো কাজ করেছিলেন শেখ হাসিনা। প্রকাশ্য রাজনীতিতে নানান পূর্বশর্ত জুড়ে দেয়ার পাশাপাশি এভাবেই নির্বাচনে গেছে আওয়ামী লীগ। দলটির উদ্দেশ্য এবং কৌশলগত বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, দলীয় স্বার্থ উদ্ধারের প্রয়োজনে অন্যদের ব্যবহার করা এবং কাজ ‘উদ্ধার’ হয়ে গেলে পাশ কাটিয়ে চলা—কখনও একেবারে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া।
ধারণা দেয়ার জন্য এখানে কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করা যায়। ১৯৮৬ সালে ১৫ দলে ভাঙন ঘটিয়ে এবং আন্দোলনের প্রধান সহযোগী সাত দলীয় জোটের সঙ্গে প্রতারণা করে রাতারাতি তিনি নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। গভীর রাতে এমন এক সময়ে শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছিলেন, যখন চাইলেও খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন সাত দলীয় জোটের পক্ষে নির্বাচনে অংশ নেয়া সম্ভব হতো না। শেখ হাসিনার এই পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছিল, তিনি আসলে অন্যদের সাফল্য একাই ভোগ-দখল করতে চেয়েছিলেন। জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগ না করে সামরিক শাসক এরশাদকে টিকিয়ে রাখার প্রচেষ্টার মধ্যে রয়েছে প্রতারণার আরও একটি উদাহরণ। সেবার, ১৯৮৭ সালের নভেম্বরে আন্দোলন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল, যখন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা পদত্যাগ করলে জেনারেল এরশাদের পতন ঘটত। জামায়াতের এমপিরা আগেই পদত্যাগ করেছিলেন, আওয়ামী লীগের এমপিরাও নেত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু আজ দেই, কাল দেই করে শেখ হাসিনা পদত্যাগপত্রগুলো জমা দেননি। ফলে জেনারেল এরশাদ শুধু টিকেই যাননি, সংসদের বিলুপ্তি ঘটানোর মাধ্যমে নিজের ক্ষমতা দেখানোরও সুযোগ পেয়েছিলেন।
আওয়ামী লীগ সম্পর্কে ধারণা স্পষ্ট করার জন্য খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন প্রথম বিএনপি সরকারের আমলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে পরিচালিত আন্দোলনের কথাও স্মরণ করা যেতে পারে। সঙ্গী বামপন্থীরা তো বটেই, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীসহ অন্য সব বিরোধী দলও এতে অংশ নিয়েছে, কিন্তু আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে কোনো দলকেই সামান্য ছাড় দেয়নি। শুধু তা-ই নয়, সরকার গঠনের সুযোগ পাওয়ার পরও দলটি আন্দোলনের সহযোগী ও কথিত মুক্তিযুদ্ধপন্থী কোনো দলের কোনো নেতাকে মন্ত্রী বানায়নি। অর্থাত্ আওয়ামী লীগ বাম ও কথিত মুক্তিযুদ্ধপন্থীদের শুধু ব্যবহারই করেছিল।
পরবর্তীকালেও আওয়ামী লীগ প্রতারণা ও ঐক্যের অভিনয় থেকে সরে আসেনি। ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় নির্বাচনকে সামনে রেখে দলটি মহাজোট গঠন করেছে। নামসর্বস্ব কয়েকটি দলের সঙ্গে হাত মেলানোয় বুঝতে বাকি থাকেনি যে, জোট না করে আওয়ামী লীগের কোনো উপায় ছিল না। এর কারণ, সরকার বিরোধিতার নামে একদিকে তিনি দেশে-বিদেশে বাংলাদেশ বিরোধী ভয়ঙ্কর প্রচারণা চালিয়েছেন, অন্যদিকে জনগণের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট কোনো একটি বিষয়েই তাকে কখনও আন্দোলন করার বিশ্বাসযোগ্য উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। জনগণকে বিপদের মধ্যে ফেলে বিদেশে পাড়ি জমানোর নজিরও শেখ হাসিনা বার বার স্থাপন করেছেন। এজন্যই জনগণও তার আহ্বানে সাড়া দেয়নি। একই কারণে আওয়ামী লীগকে কয়েকটি নামসর্বস্ব দলের সঙ্গে জোট গঠন করতে হয়েছিল। এই প্রক্রিয়ায় সর্বশেষ পর্যায়েও আওয়ামী লীগ তার বৈশিষ্ট্য ও স্বভাব অনুযায়ী এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। লগি-বৈঠার ধারাবাহিকতায় নিজেদের ‘নিয়ে আসা’ সরকারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে দলটি। গণতন্ত্রের ব্যাপারে এতটাই সততা আওয়ামী লীগের—বিশেষ করে নেত্রী শেখ হাসিনার!

Tuesday 29 November 2011

মদপানে মৃত ছাত্রলীগ নেতার প্রতিকৃতি স্থাপনের প্রতিবাদ কুয়েট শিক্ষকদের তিন দিন ক্লাস বর্জন

সংগ্রাম ডেস্ক : নগরীর ফুলবাড়ীগেট এলাকায় অবস্থিত খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ কুয়েট শাখার সভাপতির প্রতিকৃতি স্থাপন করার প্রতিবাদে কুয়েট শিক্ষকরা তিন দিন ক্লাস বর্জন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
গতকাল সোমবার শিক্ষক সমিতি নতুন কর্মসূচি ঘোষণায় এ সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। নতুন কর্মসূচিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষক আজ মঙ্গলবার থেকে তিনদিন এ কর্মসূচি পালন করবেন।
কুয়েট শিক্ষক সমিতির ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রফেসর ড. মো. মাসুদ গতকাল সোমবার দুপুর ১২টায় জানান, মদপানে মারা যাওয়া শিক্ষার্থীর প্রতিকৃতি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে স্থাপনকে আমরা নিন্দা জানাই। বিধি বর্হিভূতভাবে স্থাপিত এ প্রতিকৃতি অপসারণের জন্য আমরা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে গত রোববার পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছিলাম। এ নিয়ে আমরা কর্মসূচিও পালন করেছি। কর্মসূচি চলাকালেই প্রতিকৃতিটি উন্মোচণ করা হয়েছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ সে সময়ের মধ্যে প্রতিকৃতিটি অপসারণ করেননি। তাই নতুন কর্মসূচি দিতে বাধ্য হয়েছি। নতুন কর্মসূচিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষক মঙ্গলবার থেকে তিনদিন শ্রেণীকক্ষে কোনো রকম পাঠদান করবেন না।
গত বছরের ২২ নবেম্বর কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারায় এক বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়ে অতিরিক্ত মদপান করে এ কে এম আহসান উল্লাহ ভূঁইয়া মেহেদী মারা যান। তিনি কুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের ছাত্র ও কুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। তারই স্মৃতি রক্ষার জন্য সম্পূর্ণ বেআইনী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালার বাইরে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিশালাকৃতির এক প্রতিকৃতি স্থাপন করা হয়। যা গত বুধবার খুলনা সিটি মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক আনুষ্ঠানিক উন্মোচণ করেন।
মদপান করে যে শিক্ষার্থী মারা গেছে তার স্মৃতি রক্ষার নামে ক্যাম্পাসে চলতি বছর অক্টোবর মাসের শেষদিকে ক্যাম্পাসের খান জাহান আলী হলের সামনে তার একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয়। ফলকটি স্থাপনের পর থেকে কুয়েটের শিক্ষকরা প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠেন।

Wednesday 23 November 2011

আত্মীয় রাহুগ্রাসে পিএসসি


আসাদুজ্জামান সাগর

ক্ষমতাসীনদের আত্মীয়কুলের রাহুগ্রাসে বন্দি এখন সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। প্রতিষ্ঠানটিতে চলছে ব্যাপক আত্মীয়করণ। বড় পদ, ছোট পদ—সব ক্ষেত্রেই স্বজনদের ছড়াছড়ি। প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, উপদেষ্টা ও এমপিসহ সরকারি দলের প্রভাবশালীদের আত্মীয় এবং অনুগতরা ছাড়া এ সংস্থায় এখন অন্য কারও ঠাঁই নেই। কমিশনে বর্তমানে ১৪ সদস্যের ১৩ জনই দলীয় অনুগত ও প্রভাবশালীদের আত্মীয়। সরাসরি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িত ও জনতা মঞ্চের রূপকারও আছেন কয়েকজন। পিএসসির সদস্য হয়েও সর্বেসর্বার আসনে আছেন আওয়ামী যুবলীগের বর্তমান কমিটির আন্তর্জাতিক সম্পাদক ড. এমরান কবির চৌধুরী। তত্ত্বাবধায়ক সময়ে নিয়োগ পাওয়া চেয়ারম্যানসহ সরকার সমর্থক বাদে অন্যরা প্রচণ্ড চাপ এবং কোণঠাসা হয়ে আছেন। দাবড়ে বেড়াচ্ছেন সরকার সমর্থকরা।
সংবিধানের ১৩৭ থেকে ১৩৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নিয়োগ রাষ্ট্রপতি দিলেও তাতে অনানুষ্ঠানিক নির্দেশনা আসে সরকারের নির্বাহী বিভাগ ও সরকারি দল থেকেই। নিয়োগের পর তাদের নিয়ন্ত্রণ করা হয় অদৃশ্য কোনো শক্তিবলয় থেকেই। অথচ হাইকোর্টের রুলিং অনুযায়ী এসব ব্যক্তির কোনো নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ নেই।
প্রতিষ্ঠানটির এমন দুরবস্থায় চরম হতাশা ব্যক্ত করেছেন বিজ্ঞজনরা। বিশিষ্ট সমাজচিন্তক, অর্থনীতিবিদ ও গবেষক সাবেক কেবিনেট সচিব ড. আকবর আলি খান বলেছেন, পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সুনাম ছিল তা আমি কখনোই শুনিনি। কমিশনে দলীয় ও আত্মীয়করণ, সেই ঊনবিংশ শতাব্দীর পরীক্ষা পদ্ধতি, ৪০ বছর আগের কারিকুলাম, চাকরির নিয়োগ দুর্নীতি প্রশাসনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পিএসসিতে আগের সরকারগুলোও দলীয়করণ করেছে। তবে বর্তমান সরকার যেভাবে একে দলীয়করণ ও আত্মীয়করণ করছে, তাকে নগ্নই বলা যায়। তিনি বলেন, কমিশনের সদস্যদের নিয়োগের যোগ্যতা, দক্ষতা, নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতার কোনো মাপকাঠি সংবিধানে নেই। সরকার ইচ্ছা করলেই নিয়ম ও আইন করে দিতে পারে; কিন্তু কোনো সরকারই তা করেনি।
কে কার আত্মীয় এবং দলীয় : পিএসসিতে পূর্ণ প্যানেলের ১৫ সদস্যের মধ্যে বর্তমানে ১৪ জন রয়েছেন। সংশ্লিষ্ট পিএসসি সূত্র এবং অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এসব সদস্যের মধ্যে ১৩ জনই আত্মীয় ও দলীয় অনুগত। সদস্যের জ্যেষ্ঠতার দিক থেকে ষষ্ঠ অবস্থানে রয়েছেন অধ্যাপক রাশিদা বেগম। তিনি স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানকের বড় বোন। ২০০৯ সালের ২৩ মার্চ তিনি পিএসসিতে যোগদান করেন। এর আগে তিনি গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন।
মোহাম্মদ হোসেন সেরনিয়াবাত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য ও সাবেক চিফ হুইপ আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর চাচাতো ভাই। আর আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ হচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই। ২০০৯ সালের ৯ এপ্রিল সেরনিয়াবাত পিএসসিতে যোগদান করেন। এর আগে তিনি প্রশাসনের ভুতাপেক্ষ যুগ্ম-সচিব ছিলেন। মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান ক্রয়সংক্রান্ত দুর্নীতি মামলার আসামি ছিলেন সেরনিয়াবাত। ২০০১ সালে দুর্নীতি দমন ব্যুরো এ মামলা করেছিল। বর্তমান সরকারের সময় তিনি সে মামলা থেকে খালাস পান।
অধ্যাপক এমরান কবির চৌধুরী যুবলীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক। ২০০৯ সালের ১৫ এপ্রিল তিনি যোগদান করেন। এর আগে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। নিয়োগ পাওয়ার পর তিনি বিসিএস পরীক্ষা ও নিয়োগ দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। টাকা নিয়ে চাকরি না দেয়ার অভিযোগে সম্প্রতি তার বাসায় হামলাও করেছিল ছাত্রলীগ।
পিএসসির আরেক সদস্য এ টি আহমেদুল হক চৌধুরী। কথিত আছে, তিনি ১৯৯৬ সালে সচিবালয়ের সামনে জনতার মঞ্চের অন্যতম রূপকার ছিলেন। ২০০৯ সালের ২৩ জুন যোগদান করেন। এর আগে তিনি অতিরিক্ত আইজিপি ছিলেন। ২০১০ সালের এপ্রিল মাসে পিএসসির চেয়ারম্যান ড. সা’দত হোসাইনকে পদ থেকে সরিয়ে দিতে তার নেতৃত্বে ষড়যন্ত্র হয়েছিল। তিনি এজন্য রাষ্ট্রপতির কাছে ‘কর্ম কমিশনে স্থবিরতা’ শীর্ষক চিঠি দিয়েছিলেন।
সৈয়দ হাসিনুর রহমান সাবেক প্রভাবশালী আমলা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের আপন ভাগ্নে। ২০০৯ সালের ২৯ জুলাই যোগদান করেন। এর আগে তিনি অতিরিক্ত সচিব ছিলেন।
ইকরাম আহমেদ সংরক্ষিত মহিলা আসনে আওয়ামী লীগ এমপি তারানা হালিমের বোনজামাই। ২০০৯ সালের ২৯ জুলাই তিনি যোগদান করেন। এর আগে তিনি অতিরিক্ত সচিব ছিলেন।
অধ্যাপক ডা. ফরিদা আদিব খানম আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরের আপন ভাগ্নি। তিনিও ২০০৯ সালের ২৯ জুলাই যোগদান করেন।
আওয়ামী লীগের অনুগত আরেক পিএসসি সদস্য মুহম্মদ লিয়াকত আলী খান। কথিত আছে, তিনি ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগ এবং জনতার মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ২০০৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর যোগদান করেন। এর আগে তিনি কারা মহাপরিদর্শক ছিলেন।
মো. ওয়াজেদ আলী খান প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ আত্মীয় বলে পরিচিত। ২০১০ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর তিনি যোগদান করেন। এর আগে তিনি অতিরিক্ত সচিব ছিলেন।
ড. ফখরুদ্দীন-মইন উ আহমেদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় নিয়োগ পাওয়া বাকিদের ব্যাপারেও দলীয় ও আত্মীয়করণের অভিযোগ রয়েছে। মো. নুরুন নবী আওয়ামী লীগের অনুগত এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল বলে পরিচিতি রয়েছে। অধ্যাপক সুরাইয়া বেগম পিএসসি চেয়ারম্যান ড. সা’দত হোসাইনের কাছের লোক বলে ওই প্রতিষ্ঠানে পরিচিতি আছে। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবিদুর রেজা খান সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদের ঘনিষ্ঠ। এহসান শামীম পিএসসি চেয়ারম্যান ড. সা’দত হোসাইনের দূরসম্পর্কীয় আত্মীয় বলে পরিচিত। এছাড়া কমিশনের সচিব চৌধুরী মো. বাবুল হাসান সরকারের অনুগত হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। জানা যায়, গোপালগঞ্জ কোটায় তিনি কমিশনের সচিব হন।
কোণঠাসা বর্তমান চেয়ারম্যান ও তার অনুগতরা : আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর নানা কারণে কোণঠাসা বর্তমান চেয়ারম্যান ও তার অনুগতরা। দলীয় নিয়োগ, ২০০ নম্বরের ভাইভা পরীক্ষা, কোটা পদ্ধতি সংস্কার—এসব বিষয়ে সরকার এবং কমিশনের মধ্যে দ্বিমত হয়। পরীক্ষা, প্রশ্ন পদ্ধতি, খাতা মূল্যায়ন, মান উন্নয়নে কমিশনের উদ্যোগের বিরোধিতা করছে সরকার অনুগত সদস্যরা। এছাড়া সরকার সমর্থিত সদস্যদের বিরুদ্ধে পারস্পরিক যোগসাজশে বিসিএস ভাইভা বোর্ডে দলীয় অনুগতদের কিংবা লেনদেনের বিনিময়ে বেশি নম্বর দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। আর এসব কারণে চেয়ারম্যান সা’দত হোসাইন তাদের জন্য কাঁটা হয়ে দাঁড়ান। তাকে সরিয়ে দিতে একাধিকবার ষড়যন্ত্র করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ২০১০ সালের এপ্রিল মাসে চেয়ারম্যানকে সরিয়ে দিতে এ টি আহমেদুল হক চৌধুরী রাষ্ট্রপতির কাছে ‘কর্ম কমিশনে স্থবিরতা’ শীর্ষক চিঠি দিয়েছিলেন।
এছাড়া কমিশনের সচিব চৌধুরী মো. বাবুল হাসান একটি প্রভাব বলয় তৈরি করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। কমিশন একটি স্বতন্ত্র সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও তিনি সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নে উঠেপড়ে লেগেছেন। কমিশনের মান উন্নয়নে বিভিন্ন উদ্যোগ নিলেও তাতে বাধা সৃষ্টি করছেন তিনি।
সরকার সমর্থকদের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে একটি বাস্তব কেস স্টাডি হয়। সূত্র জানায়, সম্প্রতি ৩০তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফলাফলে ২ হাজার ৩৬৭ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়। এর মধ্যে জেনারেল ক্যাডারে এক প্রার্থী খাদ্য ক্যাডার পেয়েছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সূত্র জানায়, ওই প্রার্থী লিখিত পরীক্ষার ফলাফলে ৬৮৫ নম্বর অবস্থানে ছিলেন। এ টি আহমেদুল হক চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত ভাইভা বোর্ডে তাকে ২০০ নম্বরের মধ্যে ১৭৮ নম্বর দেয়া হয়। এত বেশি নম্বর দেয়ায় ওই প্রার্থী মেধাতালিকায় এগিয়ে গিয়ে খাদ্য ক্যাডার পেয়েছেন। অন্যদিকে ভিন্নমতের প্রার্থী অনুমান করতে পারলে তাদের নম্বর কমিয়ে দেয়া এবং মানসিক হেনস্তার অভিযোগ ওঠে। এছাড়া সম্প্রতি প্রশ্নপত্র এবং খাতা মূল্যায়নের মান উন্নত করতে কমিশন চেয়ারম্যান উদ্যোগ নিলেও তা নিয়ে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। সূত্র জানায়, সদস্য মোহাম্মদ হোসেন সেরনিয়াবাত এর বিরোধিতা করে বিভিন্ন যুক্তি উপস্থাপন করছেন।
নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ নিয়ে দৌড়ঝাঁপ : কে হচ্ছেন পিএসসির নতুন চেয়ারম্যান, তা এখনও স্পষ্ট না হলেও সরকারের পছন্দের ব্যক্তি যে ওই পদে আসছেন তাতে সন্দেহ নেই। গুঞ্জন রয়েছে, সদ্যবিদায়ী কেবিনেট সচিব আবদুল আজিজকে পিএসসি চেয়ারম্যান করা হতে পারে। দৌড়ে পিছিয়ে থাকলেও পিএসসি’র সদস্য মোহাম্মদ সেরনিয়াবাত ওই পদে বসতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন বলে জানা গেছে। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভিসি অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশীদ, ঢাবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন, ঢাবি সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামানের নামও শোনা যাচ্ছে।
নামেমাত্র সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান : ১৯৭২ সালে গঠিত পিএসসি একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। সংবিধানের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে কর্ম কমিশনের কথা বলা হয়েছে। ১৩৭ থেকে ১৪০ অনুচ্ছেদে পিএসসি’র গঠন, চেয়ারম্যান ও সদস্য নিয়োগ, পদের মেয়াদ এবং কমিশনের দায়িত্ব বর্ণিত আছে। ১৩৮(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়, ‘প্রত্যেক সরকারি কর্ম কমিশনের সভাপতি ও অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হইবেন।’ ১৩৮(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়, ‘সংসদ কর্তৃক প্রণীত যে কোন আইন-সাপেক্ষে কোন সরকারি কর্মকমিশনের সভাপতি ও অন্যান্য সদস্যের কর্মের শর্তাবলী রাষ্ট্রপতির আদেশের দ্বারা যেরূপ নির্ধারণ করিবেন, সেইরূপ হইবে। এছাড়া ১৩৯ (১), (২), (৩) ও (৪) অনুচ্ছেদে কর্মকমিশনের সভাপতি বা অন্য কোন সদস্য তাহার দায়িত্ব গ্রহণের বয়স, মেয়াদ, অপসারণ সম্পর্কে বলা হয়েছে। ১৪০(১) অনুচ্ছেদে কমিশনের দায়িত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘১৪৭ অনুচ্ছেদে কমিশনের সভাপতি ও সদস্যদের পারিশ্রমিক, বিশেষ অধিকার ও কর্মের অন্যান্য শর্তের এমন কোন তারতম্য করা যাবে না যা তাদের পক্ষে অসুবিধাজনক হতে পারে। ১৪৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তারা শপথ গ্রহণের মাধ্যমে দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হন। এছাড়া হাইকোর্টের রুলিং অনুযায়ী এসব ব্যক্তির কোন নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ নেই।’
সংবিধান এই কমিশনকে স্বতন্ত্র সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা দিলেও বাস্তবে মর্যাদা অনেক নিচে। কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নিয়োগে সততা, নিরপেক্ষতা, স্বচ্ছতা ও যোগ্যতার মাপকাঠি কী হবে, সে সম্পর্কে সংবিধানে কিছুই বলা হয়নি। সংবিধানে সভাপতি ও সদস্যদের পারিশ্রমিক, বিশেষ অধিকার ও কর্মের অন্যান্য শর্তের এমন কোনো তারতম্য করা যাবে না—বলা হলেও তার কোনো বাস্তবায়ন নেই। মর্যাদার দিক থেকে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশন, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে (বিমক) পিএসসি’র চেয়ে উচ্চমর্যাদা দেয়া হয়েছে।
কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্য রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত করেন—সংবিধানে এমন কথা বলা হলেও বাস্তবে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রণালয়ের পরামর্শেই নিয়োগ হয়ে থাকে। কমিশনের সদস্য নিয়োগে কোনো নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ নেই বলা হলেও বাস্তবে তার মিল নেই। সরকারের নির্বাহী বিভাগের মন্ত্রী, এমপি, উপদেষ্টা, সচিব কিংবা দলীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরাই নিয়োগে প্রভাব বিস্তার ও নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন।
এসব বিষয়ে ড. আকবর আলি খান আমার দেশ-কে বলেন, কমিশনের সদস্যদের নিয়োগের যোগ্যতা, দক্ষতা, নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতার কোনো মাপকাঠি সংবিধানে নেই। সংবিধানের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের ১৩৭, ১৩৮ এবং ১৩৯ অনুচ্ছেদে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নিয়োগ এবং বয়সের কথা বলা হলেও নিয়োগ মাপকাঠির বিস্তারিত কিছু নেই। কমিশন প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত কোনো সরকারই তা করেনি। অথচ ইচ্ছা করলেই সরকারের পক্ষে এটা করা সম্ভব এবং এতে প্রতিষ্ঠানটির সুনাম ও মর্যাদাও প্রতিষ্ঠা হবে।
চেয়ারম্যানের বক্তব্য : পিএসসি’র চেয়ারম্যান ড. সা’দত হোসাইন বলেন, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হলেও বাস্তবে এটি একটি ন্যারো-বেজড লো-প্রফাইলের প্রতিষ্ঠান। আমাদের চেয়ে অন্য অনেক সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা বেশি। এখানে নিয়োগের কোনো মাপকাঠি না থাকায় রাস্তা থেকে একজনকে ধরে নিয়ে বসালেও তা আইনবহির্ভূত হয় না। তিনি বলেন, আমাদের সদস্যরা নতুন স্কেলে বেতন পর্যন্ত পাচ্ছেন না।
পিএসসিতে দলীয় সদস্য নিয়োগ সম্পর্কে তিনি বলেন, এটি আমার এখতিয়ারবহির্ভূত। পিএসসি কোনো সদস্যকে নিয়োগ দেয় না। সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ।

ক্ষমতাসীনদের কোন্দলে বাড়ছে খুন



নাছির উদ্দিন শোয়েব
চাঞ্চল্যকর খুনের আসামিকেও গ্রেফতার করা হচ্ছে না। ঘুরে বেড়াচ্ছে পুলিশের নাকের ডগায়। এমনকি উল্টো বাদীপক্ষকেও হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। বাড়িঘরে হামলাও চালানো হচ্ছে। বাদী ও ভুক্তভোগীরা মামলা করেও পড়ছেন বিপাকে। মামলার এজাহারভুক্ত আসামি হলেও এসব আসামিকে কেন গ্রেফতার করা হচ্ছে না? পুলিশ নাগালে পেয়েও কেন ধরছে না? এসব প্রশ্নের জবাবে পুলিশেরই ঊর্ধ্বতন কেউ কেউ বলছেন, যারা আসামি তারা অত্যন্ত ক্ষমতাশালী। দলের লোক খুন হলেও একই দলের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থাকায় চিহ্নিত আসামিদের গ্রেফতার করা যাচ্ছে না। এক্ষেত্রে পুলিশ অনেকটা নিরুপায় বলেও মন্তব্য করেছেন একাধিক কর্মকর্তা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত ১১ দিনেও গ্রেফতার হয়নি নরসিংদীর জনপ্রিয় মেয়র লোকমান হোসেন হত্যার আসামিরা। এ ঘটনায় ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন রাজুর ভাইসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীসহ কয়েকজনকে আসামি করে থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন লোকমানের ভাই। কিন্তু আসামিরা গ্রেফতার তো হয়ইনি; বরং লোকমানের বাড়িতে পুলিশের উপস্থিতিতেই হামলা ও বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে তারা। পরিবারটি এখন চরম নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েছে। কিন্তু এ ঘটনায় কোনো সংশ্লিষ্টতা না থাকলেও বিএনপি নেতা খায়রুল কবির খোকনকে তাত্ক্ষণিকভাবে গ্রেফতার করে পুলিশ। অথচ বাদীপক্ষ মামলার এজাহারেও তার নাম উল্লেখ করেনি। এমনকি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে খোকনের জড়িত থাকার ব্যাপারে কোনো মৌখিক অভিযোগও করা হয়নি। পুলিশ কোনো কারণ ছাড়াই তাকে গ্রেফতার করে রিমান্ডের জন্য আবেদন করে আদালতে। আদালত তাকে জামিন দিলেও ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করা পুলিশ অন্য একটি মামলায় তাকে আটক দেখিয়ে হয়রানি করছে বলে খোকনের পরিবার অভিযোগ করেছে। প্রকৃত আসামিদের গ্রেফতার না করে ভিন্নমতের নেতাদের হয়রানি করে খুনিদের উত্সাহ বাড়িয়ে দিয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। অত্যুত্সাহে হত্যাকারী চক্র লোকমানের বাড়িতে হামলা-বোমাবাজি করছে মহানন্দে। অভিযোগ আছে, ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের হাতে দলীয় লোক খুন হলেও পুলিশ এসব হত্যা মামলা আগ্রহ নিয়ে তদন্ত করছে না। আসামিরা দলীয় লোক হওয়ায় পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে না। খুন করেও পার পেয়ে যাচ্ছে তারা।
প্রসঙ্গত, গত ৩১ অক্টোবর রাতে নরসিংদীর আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে দুর্বৃত্তরা গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করে জনপ্রিয় পৌর মেয়র লোকমান হোসেনকে। সন্ধ্যার পরে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে বসে মিটিং করার সময় সন্ত্রাসীরা সেখানে ঢুকে লোকমান হোসেনকে লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি চালায়। এতে তিনি গুরুতর আহত হলে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হয়। সেখানে তিনি মারা যান।
মানবাধিকার সংস্থা অধিকার-এর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের ৩৪ মাসে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে আওয়ামী লীগের ৯৪ জন নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন। এ সময় আহত হয়েছেন আরও প্রায় ১৫ হাজার নেতাকর্মী। অনুসন্ধানে দেখা গেছে আধিপত্য বিস্তার, টেন্ডারবাজি, ভাগ-বাটোয়ারা ও ক্ষমতার দ্বন্দ্বের জেরে এসব হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। এসব হত্যাকাণ্ডের কোনোটিরই কিনারা হয়নি। বেশিরভাগ আসামিই আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের লোক। তাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গা বাঁচিয়ে চলছে। আলোচিত হত্যা মামলা হলেও এ ধরনের বহু মামলার তদন্ত ঝুলে আছে। দু-একটি ছাড়া বেশিরভাগ মামলার বাদীপক্ষও সোচ্চার না থাকায় মামলাগুলো হিমাগারে পড়ে আছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন প্রায় সময়ই বলে থাকেন, ‘সন্ত্রাসী সে যে দলেরই হোক, তাকে ছাড় দেয়া হবে না’, কিন্তু নিজের দলের লোকের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হচ্ছে। এমনকি লোকমান হোসেন হত্যার পরও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, দ্রুত আসামিদের গ্রেফতার করা হবে। মন্ত্রীর আস্ফাালন কোনো কাজে আসছে না। জিডিতে তার ‘নির্দেশনা’র হম্বিতম্বি ফলাও করে দেখানো হলেও কেউ তা মানছে না।
অধিকারের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে গত অক্টোবর পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর অভ্যন্তরীণ কোন্দলে কমপক্ষে ৯৪ জন নিহত হয়েছে, আহত কমপক্ষে ১৫ হাজার। কোন্দলে গত বছর মারা গেছেন ৫২ জন, আহত হয়েছেন ৮ হাজার ৫০০ জন। এর আগের বছর কোন্দলে আওয়ামী লীগের ৩৮ জন খুন হয়েছেন। চলতি বছর জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ সংঘাতে নিহত হয়েছেন ১৬ জন। আহত হয়েছেন তিন হাজার ২০৮ জন।
তবে থেমে নেই ক্ষমতাসীনদের অভ্যন্তরীণ সংঘাত-সংঘর্ষ। চলতি মাসেই নিহত হলেন দুই জনপ্রতিনিধি। এ হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ছে। ভাংচুর করা হয়েছে যানবাহন এবং মানুষের ঘরবড়ি। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, মাদক ব্যবসা, এলাকার নিয়ন্ত্রণ, আধিপত্য বিস্তার, স্থানীয় নির্বাচন, ব্যক্তিগত ও দলীয় রেষারেষির কারণে এসব খুনের ঘটনা ঘটে।
গত ১৪ জানুয়ারি আগারগাঁওয়ে ৪১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফজলুল হক খুন হন। এ ঘটনার এক সপ্তাহ আগে দুর্বৃত্তদের গুলিতে আহত হন একই ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগের সভাপতি হাজি নূর মোহাম্মদ। তিনি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর আত্মীয়স্বজনরা অভিযোগ করেছিলেন, অভ্যন্তরীণ বিরোধের কারণে খুন হয়েছেন ফজলুল হক। নূর মোহাম্মদকে গুলি করার ঘটনায় ফজলুল হক গ্রুপের হাত রয়েছে মনে করে দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধ চরমে ওঠে। প্রতিশোধ নিতে গিয়েই ফজলুকে হত্যা করা হয়।
গত বছর ৭ অক্টোবর রাজধানীর মগবাজারে টেন্ডার বিরোধে ছাত্রলীগ ক্যাডারদের হামলায় খুন হয় যুবলীগ নেতা ইউসুফ আলী সরদার। এর আগে সংসদ ভবন এলাকায় ভোলা-৩ আসনের এমপি নুরুন্নবী চৌধুরী শাওনের পিস্তলের গুলিতে খুন হন যুবলীগ নেতা ইব্রাহীম আহমেদ। এ ঘটনার এখন পর্যন্ত কোনো কিনারা হয়নি। এ মামলায়, মাজহারুল ইসলাম মিঠু, গোলাম মোস্তফা শিমুল ও শাওনের গানম্যান দেলোয়ার হোসেন ও গাড়িচালক কামাল হোসেন কালাকে গ্রেফতার করা হলেও একজন ছাড়া বাকি আসামিরা বর্তমানে জামিনে মুক্ত।
গত বছর ১২ ফেব্রুয়ারি রাতে ক্যান্টনমেন্ট থানা ছাত্রলীগের সভাপতি এবিএম ফারুক হোসেন খুন হন। আত্মীয়স্বজনরা অভিযোগ করেন, ছাত্রলীগের প্রতিপক্ষের একটি গ্রুপ ফারুককে গুলি করেছে। এলাকায় মাদক ব্যবসা নিয়ে বিরোধে এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। কিন্তু এ হত্যা মামলায় দলীয় কোনো ক্যাডার গ্রেফতার হয়নি। একই বছরের ২৬ জুলাই চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে রাজধানীর কাফরুলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মাহবুব ও তার দলবল ১৪ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের নেতা গিয়াস উদ্দিন গেসুকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। এ ঘটনায় পুলিশ মাহবুবকে গ্রেফতার করেছিল। পরে সে জামিনে বেরিয়ে আসে। অভিযোগ রয়েছে, চাঁদাবাজির ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে গেসুকে খুন করা হয়েছিল। মোহাম্মদপুর এলাকায় ক্যাবল ব্যবসার নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে পিটিয়ে হত্যা করা হয় থানা ছাত্র লীগের সহ-সভাপতি জামাল উদ্দিন ওরফে কুতু বাবুকে। মোহাম্মদপুরের মাদক ব্যবসা, ডিশ লাইনের ব্যবসা, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গ্রুপের সঙ্গে বিরোধের জের ধরে ক্ষমতাসীন দলের প্রতিপক্ষের ক্যাডাররা কুতুকে হত্যা করেছিল বলে ওই সময় কুতুর স্বজনরা অভিযোগ করেন। এছাড়া ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফজলে রাব্বি হলে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। এতে আবুল কালাম আসাদ নামে এক ছাত্রলীগ নেতা নিহত হয়। নিহত আসাদ ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের একাংশের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ওই সংঘর্ষে আহত হয়েছিল প্রায় ৫০ জন। এ ঘটনায়ও প্রকৃত খুনি গ্রেফতার হয়নি।

Monday 31 October 2011

ভারতের ট্রানজিট ফি নিয়ে দীপু মনির মিথ্যাচার : কোনো ধরনের ফি না দিয়েই ট্রানজিট নিচ্ছে ভারত বিদ্যুেকন্দ্রের চুক্তির আড়ালে পণ্য পরিবহন চলছে বাংলাদেশী ব্যবহারকারীদের সমান ঘাট ফি দিচ্ছে



বশীর আহমেদ

ট্রানজিট ও ট্রানশিপমেন্টের চার্জ বা ফি নিয়ে রীতিমত মিথ্যাচার করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি। তিনি বলেছেন, পরীক্ষামূলক ট্রানজিট ও ট্রানশিপমেন্টের জন্য প্রযোজ্য সব ধরনের চার্জ আদায় করা হচ্ছে। আমার দেশ-এর পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট দফতরের সঙ্গে যোগাযোগ ও অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যে দেখা যাচ্ছে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী অসত্য বক্তব্য দিয়েছেন। আসলে ট্রানজিটের জন্য কোনো চার্জ বা ফি আদায় করা হচ্ছে না। শুধু ল্যান্ডিং ও শিপিং চার্জ হিসেবে টনপ্রতি ৩০ টাকা নেয়া হচ্ছে। এটা বাংলাদেশী পণ্যের জন্য নির্ধারিত। গত মঙ্গলবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, পরীক্ষামূলক ট্রানজিট এবং ট্রানশিপমেন্টের মাধ্যমে যে ভারতীয় পণ্য আশুগঞ্জ বন্দর হয়ে সড়কপথে আখাউড়া সীমান্ত দিয়ে আগরতলা যাচ্ছে, সেখানে প্রযোজ্য সব চার্জ আদায় করা হচ্ছে।
এ ব্যাপারে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা রাজস্ব কর্মকর্তা মো. আবুল হোসাইন আমাদের আশুগঞ্জ প্রতিনিধি সাদেকুল ইসলাম সাচ্চুকে জানান, পরীক্ষামূলক এই ট্রানজিটের জন্য কোনো ফি বা শুল্ক আদায় করা হচ্ছে না। কারণ ত্রিপুরার পালাটানা বিদ্যুেকন্দ্রের জন্য ওডিসি পরিবহনের চুক্তির আওতায় এই পরীক্ষামূলক ট্রানজিট ও ট্রানশিপমেন্ট চলছে।
ট্রানজিটের ফি বা চার্জ নিয়ে এ অসত্য বক্তব্য সম্পর্কে জানতে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সরাসরি কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে এ ব্যাপারে মন্ত্রীর জনসংযোগ কর্মকর্তা আমার দেশকে বলেন, নৌ মন্ত্রণালয় থেকে যে তথ্য জানানো হয়েছে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেটাই বলেছেন। ট্রানজিটের ফি, সার্ভিস চার্জ, শুল্কসহ যাবতীয় বিষয় চূড়ান্ত করার দায়িত্ব জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের। এ ব্যাপারে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছ থেকে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দেয়া বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে একেক সময় একেক ধরনের বক্তব্য দেয়া হয়েছে। সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তি এবং মন্ত্রীরা বিভিন্ন সময় অসত্য এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়েছেন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় বহুল আলোচিত তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি না হওয়ায় ভারতের সঙ্গে ট্রানজিট চুক্তি হয়নি বলে জানান সরকারের প্রভাবশালী নীতিনির্ধারক কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী।
মতিয়া চৌধুরীর এ বক্তব্যের পর তিন সপ্তাহ যেতে না যেতেই হঠাত্ কয়েকদিন আগে পরীক্ষামূলক ট্রানজিটের নামে ভারতীয় পণ্য নদী ও সড়কপথে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে পরিবহন শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে তিনটি ভারতীয় পণ্যবাহী জাহাজ আশুগঞ্জ বন্দরে এসে ভিড়েছে। এসব জাহাজ থেকে পণ্য খালাসেরও কাজ চলছে এবং খালাস হওয়া পণ্য সড়কপথে আখাউড়া সীমান্ত দিয়ে আগরতলা পৌঁছানো হচ্ছে। কোনো ধরনের ফি, শুল্ক বা সার্ভিস চার্জ ছাড়া কীভাবে ভারতীয় পণ্য পরিবহন হচ্ছে, সে ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে কোনো বক্তব্য দেয়া হয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ট্রানজিটের জন্য একটি নীতিমালা তৈরি করা হচ্ছে, যেখানে ট্রানজিট ফিসহ যাবতীয় বিষয় সুনির্দিষ্ট করা হবে। সেই নীতিমালা তৈরির আগেই পরীক্ষামূলক ট্রানজিট কীভাবে শুরু হতে পারে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
গত মঙ্গলবারের সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছিলেন, পরীক্ষামূলকভাবে ভারতীয় পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য সব ধরনের চার্জ আদায় করা হচ্ছে। তবে কোন খাত থেকে কী পরিমাণ চার্জ আদায় করা হচ্ছে, সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য দিতে পারেননি তিনি।
এছাড়া বাংলাদেশী জাহাজগুলো পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে সরকারের দেয়া নানা সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে থাকে। বিশেষ করে জ্বালানি তেলের ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা ভর্তুকি দেয়া হয়। ভারতীয় পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে এ সুবিধা দেয়া হচ্ছে কি না, সে ব্যাপারেও কিছু জানাতে পারেননি পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এ বক্তব্যের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য আমার দেশ-এর পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দফতরে যোগাযোগ করা হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা রাজস্ব কর্মকর্তা মো. আবুল হোসাইন এ ব্যাপারে বলেন, ট্রানজিটের পরীক্ষামূলক চালানের ভারতীয় পণ্যবাহী তিনটি জাহাজের কাগজপত্র আমাদের কাছে এসেছে। এই পণ্য পরিবহনে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহারের জন্য কোনো ফি বা চার্জ নেয়া হচ্ছে না। পালাটানা বিদ্যুেকন্দ্রের জন্য ভারী যন্ত্রপাতি বা ওডিসি পরিবহনের জন্য যে চুক্তি হয়েছিল, তার আওতায় এই পরীক্ষামূলক ট্রানজিট। এজন্য এই পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে কোনো ফি আদায় করা হচ্ছে না। তবে শুধু এমভি নীলকণ্ঠ জাহাজের ক্ষেত্রে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের গত ২৫ আগস্টের আদেশ মোতাবেক শুল্কের সমপরিমাণ টাকার ব্যাংক গ্যারান্টি বা বিল অব এন্ট্রি নেয়া হচ্ছে।
এই পরীক্ষামূলক ট্রানজিট এবং ট্রানশিপমেন্টের ব্যাপারে বিআইডব্লিউটিএ’র নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমার দেশকে বলেন, আসলে কী হচ্ছে আমরা জানি না।
ফি এবং অন্যান্য চার্জ নির্ধারণের দায়িত্ব এনবিআরের। তারা আমাদের কিছুই জানায়নি। পরীক্ষামূলক ট্রানজিটের জন্যও কী কী চার্জ প্রযোজ্য, তা নির্ধারণ করে এনবিআরের পক্ষ থেকে চিঠি দিয়ে আমাদের জানানোর কথা। কিন্তু এ ব্যাপারে আমাদের কিছুই জানানো হয়নি। এ ব্যাপারে এনবিআর চেয়ারম্যান ড. নাসির উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে চেষ্টা করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি। বারবার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ এবং মেসেজ পাঠিয়েও তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
পরীক্ষামূলক এই ট্রানজিটের আওতায় ভারতীয় পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে শুধু ল্যান্ডিং ও শিপিং চার্জ নেয়া হচ্ছে। এই চার্জ বাংলাদেশী পণ্যের জন্য নির্ধারিত টনপ্রতি মাত্র ৩০ টাকা হারে আদায় করা হচ্ছে। বিআইডব্লিউটিএ’র একজন উপ-পরিচালক (বন্দর) আমার দেশকে এ প্রসঙ্গে বলেন, আসলে কোনো নীতিমালা হয়নি। তাই বিদেশি পণ্যের জন্য চার্জের পরিমাণ কত হবে, তা আমরা জানি না। বাংলাদেশের পণ্যের জন্য যা নির্ধারিত আছে, তা-ই নেয়া হয়। এছাড়া আর কিছু করার নেই। ট্রানজিট নিয়ে সরকার শুরু থেকেই ছল-চাতুরীর আশ্রয় নিয়েছে। প্রথমে বলা হয়েছে, ট্রানজিটের মাধ্যমে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা আসবে। বিভিন্ন সময়ে অসত্য তথ্য দিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়েছে। ড. মনমোহন সিং ঢাকা আসার আগে প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী বলেছিলেন, ট্রানজিটের জন্য কোনো ধরনের চুক্তি বা প্রটোকল সই করার প্রয়োজন নেই। কারণ ১৯৭২ সালেই ট্রানজিট চুক্তি হয়েছে। সেই চুক্তি অনুযায়ীই ভারত ট্রানজিট সুবিধা ব্যবহার করতে পারবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি তখন বলেছিলেন, ট্রানজিটের জন্য একাধিক প্রটোকল সই করতে হবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এখন আবার বলছেন, ১৯৭২ সালেই ভারতকে ট্রানজিট দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান বলেছিলেন, ভারতের কাছে ট্রানজিট ফি চাওয়া অসভ্যতা। সরকার আসলে ভারতকে ফ্রি ট্রানজিট দিতেই যেন তত্পর

Saturday 24 September 2011

মন্তব্য প্রতিবেদন : দেশপ্রেমিক হলে দেশের স্বার্থ দেখুন



মাহমুদুর রহমান
কাল ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং তার দেশের মন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী এবং প্রভাবশালী আমলাদের এক বিরাট দল নিয়ে বাংলাদেশ সফরে আসছেন। সেই সফরসঙ্গীদের মধ্যে বাংলাদেশসংলগ্ন রাজ্যগুলোসহ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পাঁচ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরাও রয়েছেন। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর এই অতীব গুরুত্বপূর্ণ সফরকে উপলক্ষ করেই সাপ্তাহিক লেখাটা বুধবারের পরিবর্তে দু’দিন এগিয়ে আনতে হলো। দেশের দীর্ঘমেয়াদি অনিষ্ট হয়ে যাওয়ার আগে ক্ষমতাসীন নীতিনির্ধারকসহ দেশবাসীর চৈতন্যোদয়ের সর্বশেষ ব্যক্তিগত, ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা হিসেবেই আমার আজকের মন্তব্য প্রতিবেদন।
শক্তিধর ও আগ্রাসী প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সরকার প্রধানের এই সফর নিয়ে বাংলাদেশের সরকারি মহলে অনেক দিন ধরেই সাজ সাজ রব চলছে। এ দেশের ভারতপ্রেমীরাও তাদের আরাধ্য দেবতাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য ব্যাকুলচিত্তে অপেক্ষমাণ। এই সফরে বাংলাদেশ কী কী অর্জন করবে, তার বায়বীয় হিসাবও আগ বাড়িয়ে পরজীবী সুশীল (?)রা করে চলেছেন।
ট্রানজিটের মোড়কে ভারতকে করিডোর দেয়ার বিনিময়ে বাংলাদেশকে সিঙ্গাপুর বানানোর আষাঢ়ে গল্প এই চিহ্নিত গোষ্ঠী বিগত প্রায় দুই দশক ধরে ফেরি করে কার্যোদ্ধারের পর ইদানীং পিঠ বাঁচানোর জন্য কিছুটা ভিন্ন সুরে গান গাইছেন। বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যকার বিভিন্ন দ্বিপাক্ষিক সমস্যা নিয়ে লেখার আগে সোজাসাপটা বলে রাখছি, ভারতের প্রধানমন্ত্রী দিতে নয়, তিনি বাংলাদেশ থেকে নিতে আসছেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এক ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করা ছাড়া সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই পূর্ববঙ্গের জনগোষ্ঠীকে ওরা কখনও কিছু দেয়নি।
মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা প্রদানের পেছনেও তাদের রাজনৈতিক, সামরিক এবং অর্থনৈতিক স্বার্থচিন্তা কাজ করেছে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে পূর্ববঙ্গের সম্পদে লুটেরা সাম্রাজ্যবাদীদের রাজধানী কলকাতার শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে। প্রধানত, উচ্চবর্ণের হিন্দু জমিদারশ্রেণী এপার থেকে কৃষকের হাড়-মাংস নিংড়ে খাজনা আদায় করে ওপারে প্রাসাদ নির্মাণ করেছেন, বাবু সংস্কৃতির ধ্বজা উড়িয়েছেন। তত্কালীন পূর্ববঙ্গকে মূলত, কাঁচামাল এবং খাদ্যশস্য সরবরাহকারী হিন্টারল্যান্ড (hinterland) বা পশ্চাত্প্রদেশ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। পূর্ববঙ্গের দরিদ্র কৃষকের সন্তানরা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার ন্যূনতম সুযোগও যাতে না পায়, সেই লক্ষ্যে আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা, নোবেল বিজয়ী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ কলকাতার ব্রাহ্মণ বাবু সমাজ তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠারও ঘোরতর বিরোধিতা করেছিলেন।
পাকিস্তান আমলে গঙ্গার জলপ্রবাহ আটকে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছিল তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তান এবং আজকের বাংলাদেশকে ক্রমশঃ মরুকরণ প্রক্রিয়ার দিকে ঠেলে দেয়ার জন্য। ১৯৪৭ পরবর্তী পূর্ব পাকিস্তানে আমদানি-রফতানির সুবিধার্থে ভারত সরকারের কাছে সাময়িকভাবে কলকাতা বন্দর ব্যবহারের প্রস্তাব করলে তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু অবজ্ঞাভরে সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন,
"It is a strange demand from a peculiar country. A passage to go to their own country through a foreign country, it is unprecedented." (এটা এক অদ্ভুত রাষ্ট্রের আজব দাবি। একটি বিদেশি রাষ্ট্রের ভেতর দিয়ে তাদের দেশে যাওয়ার জন্য পথ, এটা নজিরবিহীন।)
আজ সেই পণ্ডিত নেহরুর বর্তমান প্রজন্ম বাংলাদেশের কাছে একাধিক চিরস্থায়ী করিডোর প্রাপ্তির আজবতর দাবি করতে এতটুকু লজ্জাবোধ করছে না, এটাই আশ্চর্য!
বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত মাত্র ক’দিন আগে আমরা যারা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা সম্পর্কিত স্বার্থ বিকিয়ে ভারতকে ট্রানজিট দেয়ার সাধ্যমত বিরোধিতা করছি, তাদেরকে ‘কাণ্ডজ্ঞানহীন’ বলে গাল দিয়েছেন। ভারতের সঙ্গে আগামী দু’দিনের আনুষ্ঠানিক আলোচনায় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর মুখের সামনে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুকে তার উদ্ধৃত বক্তব্যের জন্য একইভাবে কাণ্ডজ্ঞানহীন বলতে পারলে আমরা অবশ্যই বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রীর নৈতিক দৃঢ়তা ও সাহসের প্রশংসা করব। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবুর রহমানের সম্মতিতে ফারাক্কা বাঁধ চালু করে বিগত তিন যুগে এ দেশের এক-তৃতীয়াংশ অংশকে প্রায় শুষ্ক করে ফেলেছে পরম ‘বন্ধুরাষ্ট্র’ ভারত। সত্তরের দশকে চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলের সশস্ত্র বিদ্রোহীদের অর্থ, অস্ত্র এবং প্রশিক্ষণ দিয়ে মহান প্রতিবেশী ভারত তথাকথিত ‘শান্তি বাহিনী’ তৈরি করেছিল ওই অঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদ ও সন্ত্রাস উসকে দেয়ার জন্য। ভারত সরকার প্ররোচিত এবং পরিচালিত সেই সন্ত্রাসী তত্পরতায় বাংলাদেশের কত বাঙালি ও পাহাড়ি বেসামরিক নাগরিক এবং আমাদের সেনাবাহিনীর কত সদস্যের প্রাণ গেছে, তার হিসাব আমরা ক’জনই বা রাখি!
শেখ হাসিনার আগের আমলে ত্রিপক্ষীয় শান্তিচুক্তি সম্পাদনের পর পার্বত্য চট্টগ্রামে হত্যাকাণ্ড কমে এলেও ভারতীয় বাহিনী কর্তৃক অন্যান্য সীমান্ত অঞ্চলে অসহায় বাংলাদেশী নাগরিক হত্যা আগের মতোই সমানতালে চলছে। গুলি করে, পিটিয়ে, তীর ও পাথর ছুঁড়ে অথবা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে সপ্তাহে গড়ে অন্তত দু’জন বাংলাদেশী নাগরিককে হত্যা করছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ। ফারাক্কা ও গজলডোবা বাঁধের পর এবার সিলেট সীমান্তের ওপারে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের তোড়জোড় চলছে বাংলাদেশের অপর এক-তৃতীয়াংশ অঞ্চলকে মরুভূমিতে পরিণত করার উদ্দেশ্যে। একই অঞ্চলে সারি নদীর (ভারতে মাইনথ্রু নদী) উজানে বাঁধ দিয়ে জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জের পরিবেশকে ধ্বংস করার প্রক্রিয়া সমাপ্ত করা হয়েছে। গত তিন যুগে পদ্মা বেসিন শুকিয়ে যাওয়ার পর আগামী তিরিশ বছরে মেঘনা বেসিনের জন্যও একই পরিণতি অপেক্ষা করছে। এদিকে তিস্তা নদীর পানিচুক্তি নিয়েও প্রতিদিন পরস্পরবিরোধী খবর শুনতে পাচ্ছি।
দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের এমন প্রেক্ষাপটেই কাল বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখছেন আমাদের সম্মানিত অতিথি ড. মনমোহন সিং। ২০১০ সালের মার্চে ভারত সফরে গিয়ে সে দেশের প্রতি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ প্রধানমন্ত্রী ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং দলীয় ঋণ পরিশোধের লক্ষ্যে যে একতরফা চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করে এসেছেন, সেগুলোকে পাকাপোক্ত করে দ্রুত বাস্তবায়নযোগ্য করার জন্যই ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশে আগমন। এই কঠিন বাস্তবতা উপলব্ধি করে আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হলে তার প্রতিফল প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বাংলাদেশের নাগরিকদের ভোগ করতে হবে। গত পাঁচ বছর ধরে বাংলাদেশের এই ভয়ানক বিপদের বিষয়ে জনগণকে অব্যাহতভাবে সতর্ক করার চেষ্টা করেছি। বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যকার যে সমস্ত অনিষ্পন্ন সমস্যা রয়েছে, তার সবগুলো নিয়ে আলোচনা একটি মাত্র মন্তব্য প্রতিবেদনে সমাপ্ত করা সম্ভব নয়। আজ আমি কেবল ট্রানজিট, পানি আগ্রাসন, বাণিজ্য ঘাটতি এবং সীমান্ত হত্যার মধ্যেই আমার লেখা সীমিত রাখব।
১। ট্রানজিট :
গত মাসেরই ৩ তারিখে ‘ভারতের ট্রানজিটে বাংলাদেশের ফায়দা নাই’ শিরোনামে মন্তব্য প্রতিবেদনে বিভ্রান্তিকর ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে ট্রানজিট প্রদানের পক্ষে বাংলাদেশে জনমত তৈরিতে ভারতপন্থী, পরজীবী বুদ্ধিজীবী ও সুশীল (?) সমাজের অপতত্পরতার বিষয়ে লিখেছিলাম। জাতীয় স্বার্থ বিরোধী এই কর্মকাণ্ড এ দেশে বিগত প্রায় দুই দশক ধরে চালানো হচ্ছে। জনমত বিভ্রান্ত করার অপকর্মে এই মেয়াদে তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী এবং উপদেষ্টাগণ।
গত মাসের ২৫ তারিখে আওয়ামীপন্থী বিএফইউজে ও ডিইউজে আয়োজিত ইফতার অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে ট্রানজিট প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী দুটো মন্তব্য করেছেন। সেখানে তিনি দাবি করেন জিয়াউর রহমানের আমলেই নাকি ট্রানজিট কাঠামো তৈরি হয় এবং সেই দলিলে সই করেছিলেন বাংলাদেশ ও ভারতের তত্কালীন বাণিজ্যমন্ত্রী তানভীর আহমেদ সিদ্দিকী ও প্রণব মুখার্জী। ট্রানজিট প্রদান প্রসঙ্গে তিনি একই অনুষ্ঠানে আরও বলেন, ‘এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে, ট্রানজিট চুক্তি হবে না। কারণ, এখনও অবকাঠামো বা রাস্তাঘাট ঠিক হয়নি।’ ট্রানজিট প্রসঙ্গে ইতিহাস বিকৃত করে জিয়াউর রহমানকে টেনে আনার ব্যাপারটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। শেখ হাসিনা সম্ভবত উপলব্ধি করছেন যে, ভারতকে ট্রানজিট দেয়াটা জাতীয় স্বার্থবিরোধী হচ্ছে এবং সেই কারণেই এর দায়-দায়িত্ব তিনি মরহুম জিয়াউর রহমানের কাঁধে চাপানোর ব্যর্থ চেষ্টায় লিপ্ত হয়েছেন। তিনি যদি সত্যিই বিশ্বাস করতেন যে, ভারতকে ট্রানজিট দিলে বাংলাদেশের প্রকৃতই লাভ হবে, তাহলে সেই কৃতিত্ব অবশ্যই তার পিতা শেখ মুজিবুর রহমানকে দিতেন অথবা নিজে গ্রহণ করতেন। দুর্ভাগ্যবশত তারই পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী প্রধানমন্ত্রীর নতুন ইতিহাস আবিষ্কারের আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যেই তাকে ডুবিয়ে ছেড়েছেন। ডিপ্লোম্যাটিক করেসপন্ডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ (ডিকাব) আয়োজিত ইফতার অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘‘নতুন কোনো চুক্তি ছাড়াই ভারতকে ট্রানজিট দেয়া হবে। ১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিতেই ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দেয়ার কথা বলা আছে। আমরা এখন সেই চুক্তিই বাস্তবায়ন করব। নতুন কোনো চুক্তি বা প্রটোকল সইয়ের প্রয়োজন নেই।”
জিয়াউর রহমানের ওপর ট্রানজিটের দায়-দায়িত্ব চাপানোর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই অনৈতিক চেষ্টা মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি উল্লেখের মাধ্যমে ব্যর্থ করে দিয়েছেন তারই পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী। তবে ড. গওহর রিজভীর তথ্যেও কিছু সংশোধনী প্রয়োজন। ভারতকে ট্রানজিট দেয়ার প্রেক্ষাপট তৈরি করা হয়েছিল আমাদের স্বাধীনতা প্রাপ্তির তিন মাসের মধ্যেই। ১৯৭২ সালের মার্চের ২৯ তারিখে 'Trade agreement between the Government of India and the Government of Bangladesh' শিরোনামে নয়াদিল্লিতে যে বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, তার অত্ঃরপষব ৫ অর্থাত্ অনুচ্ছেদ ৫ এ বলা হয়েছে,
"The two Governments agree to make mutually beneficial arrangements for the use of their waterways, railways and roadways for commerce between the two countries and for passage of goods between two places in one country through the territory of the other."
(দুই সরকার এই মর্মে সম্মত হচ্ছে যে, দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সহায়তা প্রদান এবং একটি দেশের এক অংশ থেকে পার্শ্ববর্তী দেশের ভেতর দিয়ে সেই দেশের অপর অংশে পণ্য পরিবহনের লক্ষ্যে উভয় সরকার পারস্পরিক লাভালাভের ভিত্তিতে যার যার দেশের নৌপথ, রেলপথ এবং সড়ক পথ ব্যবহারোপযোগী করবে।)
দৃশ্যতই ভারতের একতরফা স্বার্থ উদ্ধারের লক্ষ্যে প্রণীত উপরিউক্ত চুক্তিতে সেই সময় স্বাক্ষর করেছিলেন দুই দেশের বাণিজ্যমন্ত্রীদ্বয় যথাক্রমে এম আর সিদ্দিকী এবং এলএন মিশ্র। দিল্লিতে স্বাক্ষরিত ১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি ১৯৭২-এর পুরনো চুক্তিকেই পোক্ত করেছিল। ১৯৭২ এবং ১৯৭৪ সালে সম্পাদিত উভয় চুক্তির সর্বরকম দায়-দায়িত্ব অবশ্যই শেখ মুজিবুর রহমান এবং আওয়ামী লীগকেই বহন করতে হবে। এখানে জিয়াউর রহমানের কোনো ভূমিকা ছিল না। তিনি ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছেন ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের মহান সিপাহী জনতা বিপ্লবের মাধ্যমে। এটাই প্রকৃত ইতিহাস। শেখ হাসিনা হিটলারের প্রচারমন্ত্রী গোয়েবলসের পন্থা অনুসরণ করে বার বার মিথ্যা বললেও সেই ইতিহাস পাল্টানো যাবে না। উল্লেখ্য, ভারতকে কোনো চুক্তি ব্যতিরেকেই এই মুহূর্তে ট্রানজিট দিতে উদগ্রীব ড. গওহর রিজভী এর আগে বলেছিলেন, “ভারতকে ট্রানজিট দিতে ৪০ বছর অপেক্ষা করেছি, আর অপেক্ষা করতে আমি রাজি নই।” বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি ভাগ্য নির্ধারণে এই ব্যক্তিটি নিজেকে এতটা গুরুত্বপূর্ণ ভাবছেন কেন, সেটা বুঝতে আমি অক্ষম। লোকমুখে লোকটির নাম আমি প্রথম শুনি এক এগারোর সময়। ডিজিএফআই-এর তত্কালীন ডাকসাঁইটে কর্মকর্তা এবং বর্তমানে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় অভিযুক্ত আসামি মেজর জেনারেল (অব.) আমিন এই ড. গওহর রিজভীকে নিয়েই সেই সময় বিশেষ কারাগারে আটক শেখ হাসিনার সঙ্গে নানান কিসিমের দর কষাকষি সম্পন্ন করেছেন। হয়তো তার সেই সাফল্যের কারণেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে উড়ে আসা ব্যক্তিটি পরবর্তীকালে প্রধানমন্ত্রীর অত্যন্ত প্রভাবশালী পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা বনে গেছেন।
ড. গওহর রিজভী জনপ্রতিনিধি নন, এমনকি তার প্রকৃত নাগরিকত্ব নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। স্বাধীনতা পরবর্তী চল্লিশ বছরের মধ্যে তিনি ক’দিন বাংলাদেশে অবস্থান করেছেন, তাও এ দেশের জনগণ জানে না। তার পরিবার-পরিজন সম্পর্কেও জাতি সম্পূর্ণ অন্ধকারে। এমন এক রহস্যময় চরিত্র আশ্চর্যজনকভাবে বাংলাদেশের ভাগ্য নিয়ে আজ ছিনিমিনি খেলছেন এবং দেখতে পাচ্ছি, দেশের ষোল কোটি জনতা সেই অনধিকার চর্চা বিনা প্রতিবাদে আবার মেনেও নিচ্ছে! ড. গওহর রিজভীর ট্রানজিটবিষয়ক সর্বশেষ বক্তব্যের তিনদিন আগে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ঢাকায় এক কর্মশালায় বলেছেন, “ট্রানজিট দেয়ার আগে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে হবে। সড়ক ও রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই নাজুক হওয়ায় এগুলোর উন্নয়ন ছাড়া এখনই ট্রানজিট সম্ভব নয়।”
উপদেষ্টা কণ্টকিত বর্তমান সরকারের অপর এক প্রভাবশালী ব্যক্তি, অর্থ উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান দিল্লি সফর শেষে ১৯ আগস্ট দেশে ফিরে বলেছিলেন, “মনমোহনের সফরের সময় ট্রানজিট নিয়ে কোনো চুক্তি হবে না। কারণ, ট্রানজিটের বিষয়ে দু’টি প্রটোকল ইতোমধ্যেই স্বাক্ষর হয়েছে।” এই মশিউর রহমানই এর আগে ফতোয়া দিয়েছিলেন যে, ট্রানজিটের বিনিময়ে ফি দাবি করলে আমরা নাকি এক অসভ্য জাতিতে পরিণত হব। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিজ দীপুমনি অপ্রত্যাশিত মন্ত্রিত্ব লাভের পর থেকে তোতা পাখির মতো কানেক্টিভিটির গল্প আউড়ে ট্রানজিটের পক্ষে ওকালতি করেই চলেছেন। বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতাসীনদের এই জাতীয় বিভ্রান্তিকর, পরস্পরবিরোধী বক্তব্য থেকে প্রমাণিত হচ্ছে যে, তারা জাতিকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে দেশের স্বার্থ পুরোপুরি বিকিয়ে দিয়েই ভারতকে করিডোর দিতে আগ্রহী। ১৯৭২ সালের বাণিজ্য চুক্তিতে ‘পারস্পরিক লাভালাভের’ যে বিষয়টি সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছিল, তা থেকেও শেখ হাসিনা সরকার দৃশ্যত সরে এসেছেন। তাদের কাছে ব্যক্তিগত ও ভারতের লাভই বর্তমানে একমাত্র বিবেচ্য, বাংলাদেশের লাভের কোনো প্রয়োজন নেই। এমতাবস্থায়, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও জনগণের স্বার্থ রক্ষা করতে হলে এ দেশের ষোল কোটি নাগরিকের ট্রানজিটের মোড়কে করিডোরের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। আমি দেশবাসীর কাছে পুনরায় সেই আহ্বানই জানাই।
২. পানি আগ্রাসন
বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করার পর থেকেই বলে এসেছে তাদের বর্তমান মেয়াদের মধ্যেই ভারতের সঙ্গে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি সম্পন্ন হবে। পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে যে, সেই চুক্তির খসড়াও নাকি মন্ত্রিসভা চূড়ান্ত করে ফেলেছে। বাংলাদেশের জনগণ অবশ্য এ বিষয়ে এখনও পর্যন্ত সম্পূর্ণ অন্ধকারে। এ ধরনের একটা আন্তর্জাতিক চুক্তি হওয়ার আগে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার নাগরিকের মধ্যে যে ধরনের মতবিনিময় করা হয়ে থাকে, তার কিছুই তিস্তা নদীর চুক্তির ক্ষেত্রে করা হয়নি। আগস্ট মাসের তৃতীয় সপ্তাহে দিল্লিতে এ বিষয়ে দ্বিপাক্ষিক আলাপ সেরে এসেছেন দুই উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী এবং ড. মশিউর রহমান। এদের মধ্যে কেউ পানি বিশেষজ্ঞ, এমন তথ্য আমার অন্তত জানা নেই। বাংলাদেশের মন্ত্রিসভায় সম্ভবত এখনও একজন পানিসম্পদ মন্ত্রী রয়েছেন। চুক্তির খসড়া প্রস্তুতে তার এবং তার মন্ত্রণালয়ের ভূমিকাটাও কেউ জানে না। এই সম্পূর্ণ অস্বচ্ছ প্রক্রিয়াতেই প্রণীত হতে যাচ্ছে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি। ক্ষমতাসীনদের কর্মকাণ্ডদৃষ্টে কবি শামসুর রাহমানের সেই বহুল পরিচিত কবিতাটির বিখ্যাত পঙিক্তর কথাই মনে পড়ে যাচ্ছে, ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ।’
পানি আগ্রাসন জায়েজ করতে ‘বন্ধুরাষ্ট্র’ ভারতের কৌশলটাও চমত্কারভাবে কার্যকরী। ভাটির দেশের ন্যায্য হিস্যার কোনোরকম তোয়াক্কা না করে প্রথমে তারা আন্তর্জাতিক নদীর ওপর বাঁধ নির্মাণ করে একতরফা পানি প্রত্যাহার করতে থাকে দীর্ঘদিন ধরে। কয়েক দশক এই অবস্থা চলার ফলে অসহায় ও দুর্বল ভাটি অঞ্চলের রাষ্ট্রের, এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নদীসমূহ ভরাট হয়ে মরুকরণ প্রক্রিয়া অনেকটা এগিয়ে যাওয়ার পর কোনোরকম একটা চুক্তি চাপিয়ে দিয়ে তারা বাহবা নেয়। একই খেলা আমরা দেখেছি ফারাক্কা বাঁধের বেলায়। তিস্তার ক্ষেত্রেও এর কোনো ব্যতিক্রম হচ্ছে না।
এদিকে দু’দিন আগে বলা হলো, তিস্তা নদীর পানি বণ্টনের বিষয়টি নাকি ড. মনমোহনের সফরের সময় দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের এজেন্ডা থেকেই বাদ দেয়া হয়েছে। কূটনৈতিক মহলে শোনা গেল, আলোচনা থেকে তিস্তা চুক্তি বাদ দেয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন একজন অতি মাত্রায় ভারতপন্থী উপদেষ্টা। সর্বশেষ সংবাদ অনুযায়ী অবশ্য, তিস্তা পানিচুক্তি এজেন্ডায় ফেরত এসেছে। তবে সেই চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ কী পরিমাণ পানি পেতে যাচ্ছে, তা নিয়ে শুরু হয়েছে আর এক অনিশ্চয়তা। ভারতীয় পত্রপত্রিকায় লেখা হয়েছে গজলডোবা পয়েন্টে পানি ৫২:৪৮ হারে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ভাগাভাগি হবে। অপরদিকে বিবিসি রেডিওতে পশ্চিমবঙ্গের ওই এলাকার সাংসদ বলেছেন, বাংলাদেশ নাকি মাত্র ২৫ শতাংশ পানি পাবে। উল্লেখ্য, গজলডোবা পয়েন্টের আগেই অন্তত ডজনখানেক স্থান থেকে ভারত তিস্তার পানি প্রত্যাহার করে চলেছে। অথচ এসব বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার নিশ্চুপ, জনগণ অন্ধকারে। তিস্তা নিয়ে প্রতিদিন যেভাবে নাটকের স্ক্রিপ্টের পরিবর্তন হচ্ছে, তাতে চুক্তি সই না হওয়া পর্যন্ত কোনোরকম ভরসা পাচ্ছি না।
যাই হোক, একদা নদীমাতৃক বাংলাদেশকে মরুভূমিতে পরিণত হওয়া থেকে বাঁচাতে হলে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বর্তমান সফরের সময় আমাদের নিম্নোক্ত দাবিগুলো জোরের সঙ্গে, পরিষ্কারভাবে তুলে ধরতে হবে :
১. গঙ্গায় ফারাক্কা বাঁধ এবং তিস্তার উজানে গজলডোবা বাঁধ নির্মাণের ফলে বাংলাদেশের যে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ক্ষতি হয়েছে, ভারতকে তার যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
২. অনতিবিলম্বে বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করে তিস্তা চুক্তি সম্পন্ন করতে হবে।
৩. টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্প বন্ধের ঘোষণা দিতে হবে।
৪. সীমান্তের ওপারে ৫৪টি আন্তর্জাতিক নদী সংযোগ করে সেই পানি ভারতের দক্ষিণ ও উত্তরাঞ্চলে প্রত্যাহারের পরিবেশ বিপর্যয়কারী যে প্রকল্প ভারত সরকার গ্রহণ করেছে, সেটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করতে হবে।
৩. বাণিজ্য ঘাটতি
বাংলাদেশের শতাধিক পণ্যকে বিনাশুল্কে ভারতের বাজারে রফতানির সুযোগ প্রদানের একটি প্রতিশ্রুতির মুলা নব্বইয়ের দশক থেকে সে দেশের সরকার আমাদের নাকের সামনে ঝুলিয়ে রেখেছে। এদিকে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের ঘাটতি দিন দিন বেড়েই চলেছে। সরকারি হিসেবেই এই ঘাটতির পরিমাণ এখন ২৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। ঘাটতি পূরণে কোনো রকম কার্যকর সহায়তা প্রদানের পরিবর্তে বাংলাদেশে উত্পাদিত যে যত্সামান্য পণ্য ভারতে রফতানি হয়ে থাকে, সেটাও বন্ধের জন্য ভারতীয় প্রশাসন নানারকম শুল্ক ও অশুল্ক বাধা অব্যাহতভাবে তৈরি করে চলেছে। ১৯৯৮ সালে তত্কালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ী ঢাকায় এসে অবিলম্বে বাংলাদেশকে শুল্কমুক্ত পণ্য রফতানির যে সুবিধা দানের কথা ঘোষণা করেছিলেন, তার বাস্তবায়ন দীর্ঘ এক যুগেও সম্পন্ন হয়নি। পার্শ্ববর্তী দেশের উত্তর-পূর্বের সাত রাজ্যে বাংলাদেশের পণ্য রফতানির যে সুযোগ এতদিন বিদ্যমান ছিল, সেটাও বাংলাদেশের বর্তমান ভারত-বান্ধব সরকার ট্রানজিট প্রদানের মাধ্যমে চিরতরে শেষ করে দিচ্ছে।
সুতরাং ভারতের বাজার উন্মুক্ত করার জন্য এখনই যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি করা না গেলে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের অর্থনীতির পক্ষে এই বিশাল বাণিজ্য ঘাটতির বোঝা বহন করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। ঈদের পূর্ব রাতে হঠাত্ করে একটি সরকারপন্থী ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় স্ক্রলে লেখা দেখলাম, ভারত নাকি তৈরি পোশাকসহ ৪৭টি পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয়ার কথা ঘোষণা করেছে। কিন্তু, গত ক’দিনে এ নিয়ে কোনো মহল থেকেই আর কোনো উচ্চবাচ্য শুনিনি। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন সফরে এমন কোনো ঘোষণা আসছে কিনা, সেটা আমাদের জানা নেই। অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে দু’টি আশঙ্কার কথা আগে থেকেই উত্থাপন করে রাখছি। শুল্কমুক্ত পণ্যের তালিকায় এমন কোনো পণ্যের উল্লেখ যেন না থাকে, যা বাংলাদেশে উত্পাদিতই হয় না। একবার শুনেছিলাম, শুল্কমুক্ত পণ্যের তালিকায় নাকি ‘বিমানের যন্ত্রাংশ’ থাকবে। এই প্রকার পণ্য বাংলাদেশে বর্তমানে উত্পাদিত তো হচ্ছেই না, নিকট ভবিষ্যতেও আমাদের সেই প্রযুক্তি অর্জনের কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। শুল্কমুক্ত পণ্য রফতানির সুবিধা পাওয়ার নামে এই প্রকার তামাশা আশা করি বর্তমান সরকার দেশবাসীর সঙ্গে করবে না।
দ্বিতীয়ত, ভারতীয় ঘোষণা কেবলমাত্র কাগজেই যেন সীমাবদ্ধ না থাকে। চল্লিশ বছর ধরে ভারত তিনবিঘা করিডোরসহ বাংলাদেশকে অনেক রকম কাগুজে সুবিধা দিয়েছে। ঘোষণার প্রকৃত বাস্তবায়ন দেখার আগ পর্যন্ত আমাদের ক্ষুদ্র হৃদয়ের মহান প্রতিবেশীর ওপর এ বিষয়ে আস্থা স্থাপন করা সম্ভব নয়।
৪. সীমান্ত হত্যা
সীমান্তে ভারত কর্তৃক নির্মিত কাঁটাতারে কিশোরী ফেলানীর ঝুলন্ত লাশ এখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্বের প্রকৃত প্রতিচ্ছবি। গত এক দশক ধরে গড়ে প্রতি সপ্তাহে অন্তত দু’জন দরিদ্র বাংলাদেশী নাগরিককে হত্যা করে চলেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী, বিএসএফ। চল্লিশ বছরের ইতিহাসে ভারতের প্রতি সর্বাপেক্ষা নমনীয় সরকার এ দেশে ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পরও এই নির্মম গণহত্যা বন্ধ হয়নি। বিডিআর যতদিন সীমান্ত রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল, ততদিন অন্তত বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এসব হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানানো হতো। বিডিআর-এর লাশের ওপর বিজিবির জন্মের পর থেকে উল্টো নিহতদেরই চোরাকারবারি, সন্ত্রাসী, ইত্যকার নামে অভিহিত করে বিএসএফ’র হত্যাযজ্ঞকেই এক প্রকার ন্যায্যতা দেয়ার অপচেষ্টা চলছে।
গত দুই মাসে দেখতে পাচ্ছি আমাদের দেশটি ভারতীয় সেনাপতি, মন্ত্রী, উপদেষ্টা এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বিচরণ ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। সে দেশ থেকে প্রতিবার একজন হোমরা-চোমরা আসছেন, আর ভাঙা রেকর্ড বাজাচ্ছেন যে এখন থেকে আর কোনো বাংলাদেশী নাগরিককে হত্যা করা হবে না। এটুকুতেই আমাদের ক্ষমতাসীনরা কৃতজ্ঞতার ভারে নুয়ে পড়ছেন। মাস দুয়েক আগে একবার স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে দাঁড়িয়ে দেশবাসীকে ভরসা দিয়েছিলেন যে, ভারতীয় সফরকারী সেনাপ্রধান তাকে নাকি সীমান্ত হত্যা বন্ধের ব্যাপারে কথা দিয়ে গেছেন। আগের অনেক প্রতিশ্রুতির মতো এই প্রতিশ্রুতি ভাঙতেও ভারত খুব একটা বিলম্ব করেনি। সীমান্তে প্রকৃত অবস্থা এতটাই ভয়ানক যে, নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (HRW) পর্যন্ত এই হত্যাযজ্ঞের নিন্দা জানিয়ে ভারত সরকারের কাছে অবিলম্বে হত্যা, নির্যাতন বন্ধের দাবি করেছে। গত বছর ডিসেম্বরে 'Trigger Happy : Exessive use of force by Indian troops at the Bangladesh Border' শিরোনামে ৮১ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে মানবাধিকার সংস্থাটি গত দশ বছরে সীমান্তে ৯০০ বাংলাদেশীকে হত্যার কথা বলেছে।
প্রতিবেদনের একটি প্রাসঙ্গিক অংশ এখানে উদ্ধৃত করছি, "Because of the absence of effective accountability mechanism for abuses carried by BSF, even the most serious abuses go unpunished. This sends a clear message that the Indian government finds such abuses acceptable.’
(বিএসএফএ’র নির্যাতন রোধে কোনো কার্যকর জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা না থাকায় অত্যন্ত গুরুতর অপরাধেও কোনো সাজা হচ্ছে না। এখান থেকে পরিষ্কার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে, ভারত সরকারের কাছে এসব নির্যাতন গ্রহণযোগ্য।)
ভারতীয় কংগ্রেসের সভানেত্রী এবং ইউপি (UPA) জোট প্রধান মিসেস সোনিয়া গান্ধীর সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফরের সময় সীমান্ত হত্যা নিয়ে ঐজড আরও একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যার শিরোনাম, "India : New killing, Torture at Bangladesh border" মিসেস সোনিয়া গান্ধীর ঢাকায় আগমনের দিনেও বিএসএফ একজন বাংলাদেশীকে হত্যা এবং অপর একজনকে অপহরণ করেছিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আমার প্রশ্ন, এসব অসহায় নাগরিকদের প্রতি তার কি কোনো দায়িত্ব নেই? ফেলানীর ঝুলন্ত লাশের দৃশ্যে তার হৃদয়ে কি কোনো রক্তক্ষরণ হয় না?
আমাদের প্রধানমন্ত্রী নিজেকে দেশের এক নম্বর দেশপ্রেমিক রূপে ঘোষণা দিয়েছেন। বাংলাদেশে সচরাচর সেনাবাহিনীর প্রসঙ্গ এলে সেখানে দেশপ্রেমিকের বিশেষণ লাগানোর এক আজব রেওয়াজ দীর্ঘদিন ধরে চালু রয়েছে। এখন থেকে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষেত্রেও সেই রীতি পালন করতে হবে কিনা, সে সম্পর্কে কোনো সরকারি নির্দেশ মিডিয়াকে অবশ্য এখনও দেয়া হয়নি। জুলাই মাসের একুশ তারিখে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সভায় বক্তৃতা দেয়ার সময় সম্ভবত অতি মাত্রায় আবেগতাড়িত হয়ে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, “আমি হয়তো আছি তাই বাংলাদেশ নিরাপদে আছে। আমার চোখ বন্ধ হলে কী হবে তা আল্লাহ রাব্বুল আলামিন জানেন।” আল্লাহর রহমতে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সফরের সময় তিনি সুস্থ আছেন, তার চোখও পুরোপুরি খোলা রয়েছে। দেশপ্রেমের পরীক্ষা দেয়ার এক সুবর্ণ সুযোগ আজ শেখ হাসিনার সামনে উপস্থিত।
আগেই বলেছি, গত বছর দিল্লি সফরে তিনি দীর্ঘদিনের ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং দলীয় ঋণ ভালোভাবেই চুকিয়ে এসেছেন। এ দেশের জনগণও আর স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের সহায়তা প্রদানের একঘেয়ে ঋণের গল্প শুনতে রাজি নয়। এবার দয়া করে দেশ ও জনগণের স্বার্থ বিবেচনা করে ভারতের কাছ থেকে সব বিষয়ে আমাদের ন্যায্য হিস্যা আদায় করতে পারলেই কেবল দেশপ্রেমের পরীক্ষায় তিনি উত্তীর্ণ হবেন। তখন তাকে নিজ থেকে আর দেশপ্রেমিকের দাবি করতে হবে না। কৃতজ্ঞ দেশবাসী সানন্দে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে সেই আসনে বসাবে।
ক্ষমতাপ্রাপ্তির বিনিময়ে কিংবা ক্ষমতালাভের বাসনায় সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পায়ে দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দেশপ্রেমের বড়াই জনগণের সঙ্গে শঠতারই নামান্তর। সরকারি এবং বিরোধী পক্ষ এই সত্যটি স্মরণে রাখলে তারাও উপকৃত হবেন, দেশও রক্ষা পাবে।
ইমেইল : admahmudrahman@gmail.com

Thursday 22 September 2011

মহানবী (সা.) সম্পর্কে কটূক্তিকারী শিক্ষক মদন মোহন পুরস্কৃত

রিয়াজ চৌধুরী
মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এবং পবিত্র হজ নিয়ে কটূক্তিকারী শিক্ষক মদন মোহন দাসকে শাস্তির আড়ালে আসলে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা এ শিক্ষককে গণবিক্ষোভের মুখে রাজধানীর ধানমন্ডি সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয় থেকে চলতি বছরের ৩১ জুলাই পঞ্চগড় বিপি সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে বদলি করা হয়। সেখানে শিক্ষক মদনের চাকরিচ্যুতি ও দৃষ্টান্তমূলক বিচারের দাবি তীব্র হলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউশি) সে সময় তাকে বরখাস্ত করেছে বলে সবাইকে জানায়। কিন্তু বরখাস্তের কথা বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের বোকা বানিয়ে উত্তেজিত ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সামাল দেয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মাউশি মহাপরিচালকের নির্দেশক্রমে সহকারী পরিচালক (মাধ্যমিক-১) সাখায়েত হোসেন বিশ্বাস স্বাক্ষরিত ১ আগস্ট এক অফিস আদেশে বলা হয়, মাউশি ঢাকার স্মারক নং-৭এ/২৯-সম (পার্ট-১)/২০০৬/ ৪৫৪৪/১২-সম তারিখ ৩১ জুলাই ২০১১ মোতাবেক ঢাকার ধানমন্ডি গভ. বয়েজ হাইস্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক (চলতি দায়িত্ব) মদন মোহন দাসের পঞ্চগড় বিপি সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে বদলির আদেশ বাতিল করা হলো। তাকে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ১৯৮৫-এর বিধি-৩ ও বিধি-১১ মোতাবেক ১ আগস্ট অপরাহপ্ত থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলো। সাময়িক বরখাস্তকালীন সরকারি বিধি মোতাবেক তিনি খোরপোশ ভাতা পাবেন। মদন মোহনকে মাউশি অধিদফতরের উপ-পরিচালকের (মাধ্যমিক) সঙ্গে সংযুক্তির আদেশ জারি করা হলো।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মানুষের ক্ষোভের মুখে শিক্ষক মদন মোহনকে মাউশি কর্তৃপক্ষ বরখাস্ত করেছে বলে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এতে মানুষের ক্ষোভ প্রশমিত হয়। মানুষকে বোকা বানিয়ে মাউশি কর্তৃপক্ষ গোপনে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে উপ-পরিচালকের (মাধ্যমিক) সঙ্গে সংযুক্ত করে প্রকৃতপক্ষে তাকে পুরস্কৃত করেছে। যেখানে মাউশি কর্তৃপক্ষের তার বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করার কথা, সেখানে তাকে পদোন্নতি দিয়ে তার ক্ষমতাই আসলে বৃদ্ধি করেছে। সংশ্লিষ্টরা আরও বলছেন, মদন মোহন স্কুলশিক্ষক। এ ঘটনায় সাময়িক বরখাস্ত হওয়ার কারণে তাকে ঢাকায় এসে মাউশি’র কাছে বার বার কৈফিয়ত দেয়ার কথা। কিন্তু তাকে আর এ কষ্টটুকু করতে হলো না। স্কুল থেকে সরাসরি মাউশি’তে স্থান পাওয়ায় তিনি এখন দেশের সব স্কুলশিক্ষকের ওপর খবরদারি করার ক্ষমতা পেয়েছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাউশি মহাপরিচালক প্রফেসর মো. নোমান উর রশীদ আমার দেশকে বলেন, শিক্ষক মদন মোহনের বিষয়টি জানার পর তার বিরুদ্ধে তাত্ক্ষণিকভাবে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আমি সংশ্লিষ্ট শাখায় নির্দেশ দিই। তিনি জানান, একজন সরকারি কর্মকর্তাকে সরাসরি বরখাস্তের বিধান নেই। একটি আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তার প্রাপ্ত সাজা কার্যকর করতে হয়। তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। প্রফেসর নোমান জানান, সৃষ্ট ঘটনার সময় দেশের যে প্রতিষ্ঠানেই তাকে পোস্টিং দেয়া হতো, সেখানে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো। বিক্ষোভ মিছিল ও সভা-সমাবেশ হতো। তাই মদন মোহনকে সাময়িক বরখাস্ত করে মাউশি’তে এনে বসিয়ে রাখা হয়েছে। তাকে কোনো শিক্ষকের ওপর খবরদারি করার ক্ষমতা দেয়া হয়নি বলে জানান তিনি।
প্রসঙ্গত, ধানমন্ডি গভর্নমেন্ট বয়েজ স্কুলের ভারপ্রাপ্ত সহকারী প্রধান শিক্ষক থাকাকালে ২৬ জুলাই মদন মোহন দাস তার সহকর্মী শিক্ষকদের এক সভায় মন্তব্য করেন, ‘এক লোক সুন্দরী মহিলা দেখলেই বিয়ে করে। এভাবে বিয়ে করতে করতে ১৫-১৬টি বিয়ে করে। মুহাম্মদও ১৫-১৬টি বিয়ে করেছে। তাহলে মুসলমানরা মুহাম্মদের হজ করা স্থান মক্কায় গিয়ে হজ না করে ওই ১৫-১৬টি বিয়ে করা লোকের বাড়িতে গিয়ে হজ করলেই তো হয়।’—এমন মন্তব্যে কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকের মধ্যে চরম ক্ষোভ ও উত্তেজনা দেখা দেয়। এর প্রতিবাদে স্কুল ক্যাম্পাসে ব্যাপক বিক্ষোভ করে শিক্ষার্থীরা। বিক্ষোভকালে শিক্ষক মদন মোহন দাসকে চাকরি থেকে অপসারণ ও তার বিচার দাবি করা হয়। এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে মাউশি অধিদফতরের ডিজিকে ঘটনা তদন্ত করে খুব দ্রুত ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। গণবিক্ষোভের মুখে ধানমন্ডি সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয় থেকে গত ৩১ জুলাই তাকে পঞ্চগড় বিপি সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে বদলি করা হয়। সেখানে গিয়ে জনরোষের মধ্যে পড়েন তিনি। তার চাকরিচ্যুতি ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি ওঠে। বিক্ষোভ তীব্র হতে থাকলে মাউশি অধিদফতর ১ আগস্ট অপরাহপ্ত থেকে মদন মোহনকে বরখাস্ত করেছে বলে সবাইকে জানানো হয়। ফলে মানুষের ক্ষোভ প্রশমিত হয়।
জানা যায়, টাঙ্গাইলের অধিবাসী মদন মোহন দাস ২০১০ সাল থেকে ভারপ্রাপ্ত সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তিনি বিভিন্ন সময় শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সঙ্গে হজরত মুহাম্মদ (সা.) এবং ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কটূক্তি করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রসঙ্গত, ১৫ জুলাই গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া উপজেলার জিটি পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের ইংরেজির শিক্ষক শঙ্কর বিশ্বাস মণ্ডল মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে কটূক্তি করেন। দশম শ্রেণীর ক্লাসে শিক্ষক শঙ্কর মণ্ডল বিশ্বাস দাড়ি রাখা নিয়ে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে ছাগলের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। এতে জনমনে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।

Tuesday 9 August 2011

মন্তব্য প্রতিবেদন : বাংলাদেশে আক্রান্ত ইসলাম
















মাহমুদুর রহমান
ক’দিন আগে অন্য একটি পত্রিকায় কর্মরত এক সিনিয়র রিপোর্টারের কাছ থেকে বাংলাদেশে ইসলামবিদ্বেষী মিডিয়ায় প্রচারণার এক বিস্ময়কর গল্প শুনেছি। একদিন পত্রিকাটির সম্পাদকমণ্ডলীর একজন নীতিনির্ধারক সেই রিপোর্টারকে ডেকে এদেশে ‘ইসলামী জঙ্গিবাদের’ পুনরুত্থানের ওপর জরুরি ভিত্তিতে একটা স্টোরি লিখতে নির্দেশ দিলেন। সাংবাদিকটি দেশের কোন জায়গায় নতুন করে এই জঙ্গিবাদের উত্থান হয়েছে, সেই তথ্য জানতে চাইলে সম্পাদক মহোদয় অগ্নিশর্মা হয়ে তাকে বললেন, জঙ্গি আছে কী নেই সেটা বিষয় নয়, স্টোরি লিখতে বলেছি, লিখে আনেন। বেচারা সিনিয়র রিপোর্টার বুঝতে পারলেন পেশাদার, ‘স্বাধীন’ সম্পাদক মহাশয় মালিকের নির্দেশ পালন করছেন মাত্র। পত্রিকার মালিকও হয়তো সরকারের ওপর মহল কর্তৃক বিশেষ উদ্দেশ্যে এ ধরনের প্রচারণা চালানোর জন্য নির্দেশিত হয়েছেন। আমার পত্রিকা অফিসে বসে সেই সিনিয়র রিপোর্টার যেদিন এই ঘটনাটি বলছিলেন, তার আগের দিনেই চরম মুসলমানবিদ্বেষী এক মৌলবাদী খ্রিস্টান যুবক নরওয়ের রাজধানী অসলোতে গুলি চালিয়ে এবং বোমা ফাটিয়ে প্রায় একশ’ স্বদেশীকে হত্যা করেছে। তার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী সে নাকি ইউরোপকে মুসলিম অধিগ্রহণ থেকে রক্ষা করার ‘মহান’ উদ্দেশ্যেই এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। এই সন্ত্রাসী কাণ্ডের পর ‘সব মুসলমান সন্ত্রাসী নয়, তবে সব সন্ত্রাসী মুসলমান’, ভারত ও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী এবং আমাদের সুশীল (?)দের একাংশের এই প্রিয় তত্ত্বের কী হাল হবে, সেটি তারাই বিবেচনা করুক। ইউরোপে সংঘটিত সন্ত্রাসী হামলা সম্পর্কে ইউরোপোল-২০০৯ প্রতিবেদন এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৬-২০০৮ সময়কালে ইউরোপে যতগুলো সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে, তার মধ্যে মাত্র ০.৪ শতাংশ মুসলিম উগ্রবাদী কর্তৃক পরিচালিত হয়। ২০০৬ সালে ৪৯৮টি ঘটনার মধ্যে মাত্র একটিতে, ২০০৭ সালে ৫৮৩টি ঘটনার মধ্যে ৪টিতে এবং ২০০৮ সালে ৫১৫টির মধ্যে শূন্যটিতে ইসলামিস্টরা জড়িত ছিল। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ৯৯.৬ শতাংশ সন্ত্রাসী ঘটনার জন্য অমুসলিমরাই দায়ী। আমার আজকের লেখার মূল বিষয়বস্তু বাংলাদেশ পরিস্থিতি বিধায় পাশ্চাত্য নিয়ে কথা আর না বাড়িয়ে স্বদেশের দিকে দৃষ্টিপাত করছি। বর্তমান সেক্যুলার সরকারের আড়াই বছরে বাংলাদেশে ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ও ঘৃণা ছড়ানোর লক্ষ্যে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় চরম নিন্দনীয় যে কাজ-কর্মগুলো করা হয়েছে, তার মধ্য থেকে কয়েকটির দিকে পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করছি।১. ২০০৯ সালের ২৮ মার্চ ‘সন্ত্রাস নিরসনে ধর্মীয় নেতাদের ভূমিকা’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক সামীম মোহাম্মদ আফজাল বলেছেন, পৃথিবীতে যত সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ রয়েছে, তার সবই ইসলাম ও মুসলমানদের মধ্যে (!)। হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানদের মধ্যে কোনো সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ নেই। হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানরা সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত নয়। ২. ২০০৯ সালের ১ এপ্রিল এদেশের আওয়ামীপন্থী শিল্পপতিদের অর্থে পরিচালিত সুশীল (?) থিংক ট্যাংক বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউট আয়োজিত ওয়ার্কশপে বক্তৃতায় বাংলাদেশের আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেছিলেন, কওমি মাদরাসাগুলো এখন জঙ্গিদের প্রজনন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। কওমি মাদরাসাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ বিস্তার লাভ করেছে। এসব কওমি মাদরাসায় যে শিক্ষা দেয়া হয়, তা কূপমণ্ডূকতার সৃষ্টি করছে। ’৭৫-পরবর্তী সামরিক শাসনামলে বিভিন্ন সংশোধনী এনে ’৭২-এর সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনাকে নস্যাত্ করার ফলেই এবং ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণার পর ধর্মের নামে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়েছে। ৩. ২০০৯ সালের ২৩ এপ্রিল বরিশালের নিউ সার্কুলার রোডের এক বাড়িতে র্যাব হানা দিয়ে বোরকা পরে ধর্মীয় শিক্ষার জন্য জড়ো হওয়ার অপরাধে ২১ নারীকে গ্রেফতার করে। র্যাব সাংবাদিকদের কাছে তাদের অভিযানের সংবাদ জানালে তা ফলাও করে ছাপা হয়। দিনভর জিজ্ঞাসাবাদ শেষে জঙ্গিসংশ্লিষ্টতার কোনো তথ্য না পেয়ে ২১ পরহেজগার নারীকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে চালান দেয়া হয়। ঘটনার দীর্ঘ ২ মাস পর ২৩ জুন আদালত তাদের বেকসুর খালাস দেন।৪. ২০০৯ সালের ১৯ জুন রাজশাহীতে জঙ্গি সন্দেহে ১৫ নারী ও শিশুকে গ্রেফতার করা হয়। ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ওইদিন বিকালেই মুচলেকা দিয়ে তাদের মুক্ত ঘোষণার পর আবার ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখানো হয়। পুলিশ গ্রেফতারকৃতদের সম্পর্কে ব্যাপক তদন্ত করেও জঙ্গিসংশ্লিষ্টতার কোনো তথ্য পায়নি। শেষ পর্যন্ত আদালত তাদের বেকসুর খালাস দিলে জুলাই মাসের ১ তারিখে ১১ দিন কারাবাস শেষে ১৫ জন নিরপরাধ নাগরিক মুক্তি পান। ৫. বোরকা পরার অপরাধে ২০০৯ সালের ৩ জুলাই পিরোজপুর জেলার জিয়ানগরে ছাত্রলীগের বখাটে কর্মীদের প্ররোচনায় পুলিশ জঙ্গি সন্দেহে তিন তরুণীকে গ্রেফতার করে। তারপর পুলিশের আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করলে তিন তরুণীকে ঢাকায় টিএফআই সেলে নিয়ে আসা হয়। ৫৪ ধারায় গ্রেফতারকৃত তরুণীদের বিরুদ্ধে মামলায় তদন্তকারী কর্মকর্তা ছিলেন অমর সিংহ। এ সময় তাদের বোরকা খুলতে বাধ্য করে মহাজোট সরকারের দিনবদলের পুলিশ। ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদেও কোনো জঙ্গি সংযোগের কাহিনী বানাতে ব্যর্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ফাইনাল রিপোর্ট দিতে বাধ্য হয়। দীর্ঘদিন কারাগারে বন্দি থেকে অবশেষে তিন অসহায়, নিরপরাধ তরুণী মুক্তি পান।৬. ২০১০ সালের ৩ এপ্রিল সংবাদপত্রে খবর প্রকাশিত হয় যে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ড. একেএম শফিউল ইসলাম তার ক্লাসে ছাত্রীদের বোরকা পরার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। তিনি ক্লাসে ‘মধ্যযুগীয় পোশাক বোরকা’ পরা যাবে না এবং এটি সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের কোনো পোশাক হতে পারে না বলে ফতোয়া জারি করেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এটি বিভাগীয় কোনো সিদ্ধান্ত নয়, তবে আমার ক্লাসে কোনো ছাত্রীকে আমি বোরকা পরতে দেব না।৭. ২০১০ সালের ১ আগস্ট বিশ্ব শান্তি পরিষদের প্রেসিডেন্ট পরিচয়দানকারী জনৈক দেবনারায়ণ মহেশ্বর পবিত্র কোরআন শরিফের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেন। রিট আবেদনে তিনি দাবি করেন, হজরত ইবরাহিম (আ.) তার বড় ছেলে ইসমাইল (আ.)কে কোরবানির জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন বলে যে আয়াত পবিত্র কোরআন শরিফে রয়েছে, তা সঠিক নয়। তিনি দাবি করেন, হজরত ইবরাহিম তার ছোট ছেলে হজরত ইসহাক (আ.)কে কোরবানি করতে নিয়ে যান। এ বিষয়ে সঠিক ব্যাখ্যা ও কোরআনের আয়াত শুদ্ধ করার জন্য দেবনারায়ণ মহেশ্বর আদালতের কাছে প্রার্থনা করেন। আদালত রিট খারিজ করে দেয়ার পর দেবনারায়ণের এই চরম হঠকারী ও উস্কানিমূলক কর্মকাণ্ডে আদালতে উপস্থিত আইনজীবীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠলে পুলিশ দেবনারায়ণ মহেশ্বরকে কর্ডন সহকারে এজলাস থেকে বের করে তাদের ভ্যানে প্রটেকশন দিয়ে আদালত এলাকার বাইরে নিরাপদ অবস্থানে নিয়ে যায়।৮. বিচারপতি এইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেনের দ্বৈত বেঞ্চ ২০১০ সালের ২২ আগস্ট স্বপ্রণোদিত (সুয়োমোটো) আদেশ প্রদান করেন যে, দেশের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অফিসে বোরকা পরতে বাধ্য করা যাবে না। ‘নাটোরের সরকারী রাণী ভবানী মহিলা কলেজে বোরকা না পরলে আসতে মানা’ শিরোনামে ২২ আগস্ট একটি দৈনিকে সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার প্রেক্ষিতে হাইকোর্টের বিচারপতিদ্বয় বোরকা পরিধানের বিরুদ্ধে সুয়োমোটো এই রায় দেন।৯. ২০১১ সালের ২ জুন সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের অন্যতম নেতা মেজর জেনারেল (অব.) কে এম শফিউল্লাহ দাবি করেন, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, বিসমিল্লাহ ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি—এ তিনটির বিরুদ্ধে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। ওইদিন জাতীয় প্রেস ক্লাবের মতবিনিময় সভা থেকে ঘোষণা করা হয় যে, সংবিধানে বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্রধর্ম থাকলে হরতাল দেয়া হবে।১০. ২০১১ সালের ৩০ জুন সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী গ্রহণ করে আমাদের সংবিধানের মূল নীতি থেকে আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাস বাদ দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিস্থাপন করা হয়।১১. ২০১১ সালের ১৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পিতৃভূমি টুঙ্গিপাড়া উপজেলার জিটি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের ইংরেজি শিক্ষক শঙ্কর বিশ্বাস দশম শ্রেণীর ক্লাসে দাড়ি রাখা নিয়ে সমালোচনাকালে হজরত মোহাম্মদ (সা.)কে ছাগলের সঙ্গে তুলনা করেন। এতে ওই ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। পরে পুরো এলাকায় সাধারণ জনগণের মধ্যে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়লে শঙ্কর বিশ্বাস টুঙ্গিপাড়া থেকে পালিয়ে যান।১২. ২০১১ সালের ২৬ জুলাই ধানমন্ডি সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত সহকারী প্রধান শিক্ষক মদন মোহন দাস মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) এবং পবিত্র হজ নিয়ে কটূক্তি করেন। সহকর্মী শিক্ষকদের সঙ্গে এক সভায় তিনি মন্তব্য করেন, ‘এক লোক সুন্দরী মহিলা দেখলেই বিয়ে করে। এভাবে বিয়ে করতে করতে ১৫/১৬টি বিয়ে করে। মুহাম্মদও ১৫/১৬টি বিয়ে করেছে। তাহলে মুসলমানদের মুহাম্মদের হজ করা স্থান মক্কায় গিয়ে হজ না করে ওই ১৫/১৬টি বিয়ে করা লোকের বাড়িতে গিয়ে হজ করলেই তো হয়।’বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার অন্তত ৮৫ শতাংশ যে জন্মসূত্রে মুসলমান এ নিয়ে সম্ভবত বিতর্ক নেই। সেই দেশে আড়াই বছর ধরে অব্যাহতভাবে ইসলাম, কোরআন, হাদিস এবং মহানবী (সা.)কে কটাক্ষ করার অভ্যাস চর্চার ফলে ইসলামবিদ্বেষ এখন সরকারের সর্বত্র প্রায় দুরারোগ্য ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে এবং এই ব্যাধির ভাইরাস ক্ষমতাসীন মহলের সব পর্যায়ের লোকজন অকাতরে বিতরণ করে চলেছেন। ইউরোপে অসুস্থ ইসলামবিদ্বেষ সর্বব্যাপী হয়ে ওঠার বিষক্রিয়াতেই নরওয়েতে অ্যানডার্স বেরিং ব্রেইভিক (Anders Behring Breivik) নামক খ্রিস্টান মৌলবাদী ঘাতকের উত্থান ঘটেছে। দীর্ঘদিন ধরেই ইউরোপে ইসলাম, মুসলমান এবং আমাদের মহানবী (সা.)কে বিকৃতভাবে উপস্থাপনের চর্চা চলছে। ডেনমার্কে হজরত মুহাম্মদ (সা.)কে নিয়ে সাম্প্রদায়িক কার্টুন ছাপা এবং বাকপ্রকাশের স্বাধীনতার নামে পাশ্চাত্যের জনগোষ্ঠীর এক বিরাট অংশের এই অতীব নিন্দনীয় কর্মকাণ্ডকে সমর্থনের ফলে জন্মলাভ করা বিষবৃক্ষের স্বাদ তারাই আজ আস্বাদন করছে। নরওয়ের সুবুদ্ধিপূর্ণ রাজনীতিবিদরা অবশেষে স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছেন যে, এই ঘৃণ্য মানসিকতার আশু চিকিত্সা করা না হলে পশ্চিমের সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা ভেঙে পড়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। মধ্যযুগের ইউরোপে এ-জাতীয় অন্ধ ধর্মীয় ঘৃণা ও বিদ্বেষ বিকশিত হওয়ার ফলেই তখন সেখানে যাজকদের নির্দেশে ডাইনি আখ্যা দিয়ে নারীদের পুড়িয়ে মারা হয়েছে এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ইউরোপের দেশে দেশে চরমপন্থী খ্রিস্টানদের হাতে ইহুদি ধর্মাবলম্বীরা নিগৃহীত, অত্যাচারিত হয়েছে। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির মতো করেই আজ পূর্ব ইউরোপে ইহুদি বিদ্বেষ এবং পশ্চিম ইউরোপে ইসলামবিদ্বেষ দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ছে। অসলো হত্যাকাণ্ডের তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ইসলামবিদ্বেষী পশ্চিমা মিডিয়া কর্তৃক এর দায়ভার কথিত ইসলামী জঙ্গির ঘাড়ে চাপানোর দুর্ভাগ্যজনক অপচেষ্টাও আমরা লক্ষ্য করেছি। ১৯৯৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমা সিটিতে এক ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলায় শত শত মার্কিন নাগরিক নিহত হলে সেখানেও প্রাথমিকভাবে মৌলবাদী মুসলমানদের দায়ী করা হয়েছিল। তার ক’দিনের মধ্যেই প্রকৃত ঘাতক মৌলবাদী খ্রিস্টান টিমোথি ম্যাকভেই (Timothy McVeigh)-এর নাম বিশ্ববাসী জেনে ফেলে।২০০৮ সালে বাংলাদেশের সর্বাধিক প্রচারিত সুশীল (?) বাংলা দৈনিকে মহানবী (সা.) এবং তাঁর সাহাবিকে কটাক্ষ করে ইউরোপের অনুরূপ ছড়া এবং কার্টুন ছাপা হলে দেশে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। জেনারেল মইনের তত্কালীন জরুরি সরকারের উদ্যোগে বায়তুল মোকাররম মসজিদের খতিব উবায়দুল হকের কাছে উপস্থিত হয়ে পত্রিকাটির প্রখ্যাত ‘সেক্যুলার’ সম্পাদকের জোড় হস্তে ক্ষমাপ্রার্থনার ফলে সেই সময় ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ক্ষোভ খানিকটা প্রশমিত করা সম্ভব হয়েছিল। বাস্তবতা হলো, আমাদের দেশে ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজাধারীদের হৃদয়ে গভীরভাবে প্রোথিত নরওয়ের ব্রেইভিকের সমতুল্য ইসলামবিদ্বেষ সময়-সুযোগমত জনসমক্ষে প্রকাশ পায়। মুখে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা প্রচার করলেও অন্তরে এদের অধিকাংশই চরমভাবে সাম্প্রদায়িক। এদের সাম্প্রদায়িকতা অবশ্য মূলত ইসলাম ধর্মবিরোধী। ইসলাম ছাড়া অন্য সব ধর্মমতের প্রতিই তাদের প্রগাঢ় শ্রদ্ধা। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফের দাবি অনুযায়ী ডিজিএফআই’র কারসাজিতে মহাজোট সরকার ক্ষমতাসীন হলে বাংলাদেশে চিহ্নিত ইসলামবিরোধী গোষ্ঠীর এদেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকের ধর্মের বিরুদ্ধে সুসংগঠিত আক্রমণ চালানোর সুবর্ণ সুযোগ তৈরি হয়। গত আড়াই বছরে ইসলাম ধর্মের প্রতি ঘৃণা ছড়ানোর প্রাথমিক কিছু নমুনা আমরা দেখতে পেয়েছি।বাংলাদেশের অধিকাংশ নাগরিক যে বর্তমান সরকারের গণবিরোধী কর্মকাণ্ডে বীতশ্রদ্ধ হয়ে তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করে নিয়েছে, সেটি সম্ভবত নীতিনির্ধারকদের অজানা নয়। গত এক বছরের স্থানীয় সরকার পর্যায়ের সবক’টি নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে যে কোনো নিরপেক্ষ বিশ্লেষক নিশ্চিতভাবেই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হবেন যে, মহাজোট সরকারের পায়ের তলায় আর মাটি নেই। জনসমর্থনহীন শাসকশ্রেণী যে কোনো মূল্যে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য স্বাভাবিকভাবেই ক্রমেই অতিমাত্রায় বিদেশনির্ভর হয়ে পড়ছে। দেশের স্বার্থ বিকিয়ে ভারতের সব অন্যায্য চাহিদা পূরণ করার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের সাম্রাজ্যবাদী প্রতিবেশীর একমাত্র বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য মিত্রে পরিণত হতে পেরেছেন। সুতরাং ধরে নেয়া যেতে পারে যে, ভারতীয় শাসককুল শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় আসীন রাখার জন্য যথাসম্ভব প্রচেষ্টা চালাবে। লন্ডনের ‘ইকোনমিস্টে’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৮ সালের নির্বাচনেও ভারত মহাজোটকে টাকার থলি এবং এন্তার পরামর্শ দিয়ে নির্বাচনে জিততে সহায়তা করেছিল। আন্তর্জাতিক রাজনীতির বাস্তবতায় একমাত্র ভারতের সহযোগিতায় বাংলাদেশের জনমতের বিরুদ্ধে ক্ষমতায় টিকে থাকা যে সম্ভব নয়, সেটা শেখ হাসিনার মতো ঝানু রাজনীতিবিদ অবশ্যই বোঝেন। ২০০৮-এর পরিস্থিতির মতো ভারতের সমর্থনের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থন যুক্ত হলে দেশের জনগণকে তখন মহাজোটের আর তোয়াক্কা না করলেও চলবে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় অব্যাহত ইসলামবিরোধিতা সম্ভবত সেই সমর্থন আদায়েরই কৌশল।বাংলাদেশে সীমিত পরিসরে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটেছিল শেখ হাসিনারই আগের শাসনামলে। সেই দুর্ভাগ্যজনক ও চরম নিন্দনীয় জঙ্গিবাদও মাথাচাড়া দিয়েছিল আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটেই। আশির দশকে আফগানিস্তানে সোভিয়েট দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামে কিছু বাংলাদেশী নাগরিকও যোগদান করেছিল। তারাই এদেশে মূলত জঙ্গিবাদের বীজ বহন করে নিয়ে এসেছে। এখানে উল্লেখ্য, সে সময় আফগানিস্তানের রণাঙ্গনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রগুলো তাদের আদর্শগত সোভিয়েটবিরোধিতার কারণে মুজাহিদদের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছিল। ফলে আশির দশকে মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য ইসলামিক রাষ্ট্র থেকে স্বেচ্ছাসেবকরা আফগানিস্তানে সোভিয়েট দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গেলে সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব তাতে সায় দিয়েছিল। ২০০১ সালে বেগম খালেদা জিয়ার নির্বাচনে বিজয় লাভের ঠিক আগে নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারে বিমান হামলা বিশ্বরাজনীতির হিসাব-নিকাশ সম্পূর্ণ পাল্টে দেয়। বিশ্বব্যাপী জোরেশোরে কথিত ইসলামী জঙ্গিবাদবিরোধী প্রচারণা শুরু হলে বাংলাদেশও তার প্রভাবমুক্ত থাকতে পারেনি। কাকতালীয়ভাবে একই সময়ে বাংলাদেশে শায়খ আবদুর রহমান ও বাংলাভাইয়ের রাষ্ট্র ও ধর্মবিরোধী জঙ্গি কর্মকাণ্ড এবং তাদের উত্থানের প্রাথমিক পর্যায়ে তত্কালীন সরকারের মধ্যকার এক ধরনের নির্লিপ্ততা পশ্চিমের সঙ্গে বিএনপির নীতিনির্ধারকদের দূরত্ব সৃষ্টি করে। শেষপর্যন্ত বেগম খালেদা জিয়ার শাসনামলেই উভয় জঙ্গি নেতার গ্রেফতার ও তাদের বিচার সম্পন্ন হলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর নীতিনির্ধারকরা তাতেও পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারেননি। যে কোনো বিচক্ষণ রাজনীতিবিদের মতোই শেখ হাসিনা প্রতিপক্ষের এই দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করে প্রেসিডেন্ট বুশের কথিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ (war against terror)'র সঙ্গে প্রকাশ্যে একাত্মতা ঘোষণা করেন। সেই থেকে মার্কিন সমর্থন ধরে রাখার লক্ষ্যে শেখ হাসিনা তার ইসলামী জঙ্গি কার্ড অবিরাম খেলে চলেছেন। ফলে বাংলাদেশ আজ এমন একটি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে, যেখানে ইসলামবিরোধী নগ্ন প্রচারণা কোনো ব্যতিক্রম নয়; বরং দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা। যে সংবাদপত্রের ঘটনা দিয়ে আজকের মন্তব্য-প্রতিবেদন শুরু করেছি, তারাও সরকারের হুকুম তামিল করে চলেছেন মাত্র। উত্তরার র্যাব-১ হেডকোয়ার্টারে অবস্থিত টিএফআই সেলে রিমান্ডে থাকা অবস্থায় আমি নিজ চোখে শ্মশ্রুমণ্ডিত তরুণ এবং মধ্যবয়সীদের সেখানে আটক দেখতে পেয়েছি। তাদের গোঙানির শব্দ থেকে নির্যাতনের মাত্রাটাও খানিক আন্দাজ করতে পেরেছি। ক’দিন পরপর টেলিভিশনের পর্দায় ইসলামী জঙ্গি নাম দিয়ে যাদের আটক দেখানো হয়, তাদেরও হয়তো উপরের নির্দেশে প্রয়োজনমাফিক টিএফআই সেল মার্কা নির্যাতনকেন্দ্রগুলো থেকেই সরবরাহ করা হয়। এর মাধ্যমে মার্কিন নীতিনির্ধারকদের কাছে শেখ হাসিনা বাংলাদেশে ইসলামী জঙ্গি দমনে তার অপরিহার্যতা প্রমাণের চেষ্টা করছেন।প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপে নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ইউনূসকে সরকার চরমভাবে অপমানিত করায় সরকারের সঙ্গে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের যে টানাপড়েন সৃষ্টি হয়েছে, নিয়মিতভাবে জঙ্গিনাটক মঞ্চায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের নীতিনির্ধারকরা সেই দূরত্ব কমানোর প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। তাদের মূল লক্ষ্য সম্ভাব্য গৃহপালিত বিরোধীদলীয় নেতা এরশাদকে সঙ্গে নিয়ে আগামী ভোটারবিহীন একদলীয় নির্বাচনের আন্তর্জাতিক বৈধতা লাভ। ২০০৮ সালে নির্বাচনের মাত্র মাসখানেক আগে দেশে ফেরার সময় শেখ হাসিনা ওয়াশিংটনে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তত্কালীন বুশ প্রশাসনকে প্রকাশ্য সমর্থন জানিয়ে নির্বাচনে ফায়দা লাভে সমর্থ হয়েছিলেন। বাংলাদেশে আগামী সাধারণ নির্বাচনের আগেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে যাবে। সেই নির্বাচনে যিনিই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হোন না কেন, এখানে শেখ হাসিনা তার গতবারের সফল ইসলামী জঙ্গি কার্ডই যে ব্যবহার করবেন, সেটা নিশ্চিত।
সাম্য ও শান্তির ধর্ম ইসলামে জঙ্গিবাদ যে সর্বতোভাবে পরিত্যাজ্য, এ নিয়ে ইসলামের প্রকৃত আদর্শে বিশ্বাসীদের মধ্যে কোনো মতবিরোধ নেই বলেই আমার ধারণা। কিন্তু একই সঙ্গে জালিম শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোও একজন ঈমানদার মুসলমানের কর্তব্য। বাংলাদেশে কল্পিত ইসলামী জঙ্গিতত্ত্ব বিদেশে ফেরি করে যারা ক্ষমতায় টিকে থাকতে চাচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধে ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাসীদের ঐক্যবদ্ধ হয়েই মিথ্যা প্রচারণার জবাব দিতে হবে। ভারতীয় সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতায় বিমোহিত হয়ে যারা আমাদের সংবিধান থেকে আল্লাহর ওপর বিশ্বাস ও আস্থা সরিয়ে ফেলার ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন, তাদের নরেন্দ্র মোদীর গুজরাটের দিকে দৃষ্টিপাত করতে অনুরোধ জানাই। বাংলাদেশে আড়াই বছর ধরে যা ঘটে চলেছে, তার উল্টোটি গুজরাটে ঘটলে সেখানে অসহায় সংখ্যালঘুদের ভাগ্যে কী হতো, তার নমুনা ২০০২ সালে দেখা গেছে। সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা লেখা থাকলেই যে জনগণ অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী হয় না, তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ প্রতিবেশী ভারত। অপরদিকে সংবিধানে বিসমিল্লাহ এবং আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাস লিপিবদ্ধ থাকলেই যে দেশের নাগরিকরা সাম্প্রদায়িক হয়ে পড়েন না, তার উজ্জ্বল উদাহরণ আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মিলে-মিশে থাকা বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর হাজার বছরের ঐতিহ্য। আশা করি, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কুক্ষিগত করার ঘৃণ্য কৌশল হিসেবে ক্ষমতাসীনরা ধর্মনিরপেক্ষতার ছদ্মাবরণে ইসলামবিরোধী সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করে তুলবেন না।