Saturday 26 June 2010

যৌন নিপীড়নে অভিযুক্ত শিক্ষক মানবাধিকার কমিশনের সদস্য!

সোলায়মান তুষার: যৌন নিপীড়নের দায়ে বাধ্যতামূলক ছুটিতে থাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষককে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অভিযুক্ত শিক্ষক অধ্যাপক ড. গিয়াস উদ্দিন মোল্লাকে মঙ্গলবার কমিশনের সদস্য নিয়োগ দেয়া হয়। বুধবার তিনি নিয়োগপত্র হাতে পেয়েছেন। তার নিয়োগের খবরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই সমালোচনার ঝড় বইছে। সদ্য নিয়োগ পাওয়া মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমানও আশ্চর্যান্বিত হয়েছেন। একই বিভাগের মাস্টার্সের এক ছাত্রীকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে ৯ই জানুয়ারি ড. মোল্লাকে বিভাগের সব কার্যক্রম থেকে অব্যাহিত এবং বাধ্যতামূলক ছুটি দেয়া হয়। ৮ ও ৯ই জানুয়ারি মানবজমিনসহ বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় এ নিয়ে নানা প্রতিবেদন ছাপা হয়। এর বিরুদ্ধে বিভাগের মাস্টার্সের এক ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, প্রক্টর ড. কে এম সাইফুল ইসলাম খানসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। অভিযোগটি তদন্তাধীন। অবশ্য বিভাগের নেয়া সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন মোল্লা হাইকোর্টে রিট করেন। রিটের শুনানি শেষ হয়নি এখনও। এ অবস্থায় তিনি মানবাধিকার কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠানের সদস্য হিসেবে নিয়োগ পেলেন। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেছেন, এ খবরটি শোনার পর আমার নিজের কাছেই খারাপ লেগেছে। বিতর্কের ঊর্ধ্বে আছে-এমন ব্যক্তিদের নিয়োগ দেয়া উচিত ছিল। নিয়োগ দেয়ার আগে যাচাই-বাছাই করা উচিত ছিল। এ বিষয়ে ড. গিয়াসউদ্দিন মোল্লাকে প্রশ্ন করা হয়, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ থেকে মুক্তি পাননি আপনি। এ অবস্থায় আপনার পক্ষে মানবাধিকার রক্ষায় কতটা ভূমিকা রাখা সম্ভব? উত্তরে তিনি বলেন, এটি সরকারের বিষয়। সরকার আমাকে নিয়োগ দিয়েছে। তিনি আরও বলেন, আমার বিরুদ্ধে নেয়া সিদ্ধান্তটি ’৭৩-এর অধ্যাদেশবিরোধী ছিল। কোন বিভাগ এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। এ সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে আমাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়া হয়নি। ২০০৯ সালের ১৩ই নভেম্বর তার কক্ষে যৌন নিপীড়নের শিকার হন বলে ওই বিভাগের এক ছাত্রী অভিযোগ করেন। ১৯শে নভেম্বর ওই ছাত্রী ও তার মা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক শওকত আরা হোসেনসহ আরও কয়েকজনকে লিখিতভাবে জানান। ১৯৯৯ সালে একই ধরনের অভিযোগে ইউরোপের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিনকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনীর ওপর গবেষণার জন্য জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বঙ্গবন্ধু চেয়ার’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। অধ্যাপক মোল্লাকে বঙ্গবন্ধুর জীবন নিয়ে গবেষণার জন্য ১৯৯৯ সালে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো হয়। কিন্তু যৌন উৎপীড়নের অভিযোগে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। বহিষ্কারের অভিযোগটি অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন মোল্লা এর আগে অস্বীকার করেন।


ছাত্রীর অভিযোগ
অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন মোল্লার বিরুদ্ধে ওই ছাত্রীর লিখিত সে অভিযোগ হুবহু তুলে ধরা হলো-‘আমি (ছাত্রীর নাম সামাজিক নিরাপত্তার স্বার্থে গোপন রাখা হলো) রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের এমএসএস (শেষ পর্ব)-এর একজন নিয়মিত ছাত্রী। ৪০২ নম্বর কোর্স নেয়ার সুবাদে কোর্স শিক্ষক শ্রদ্ধেয় গিয়াসউদ্দিন মোল্লার সাথে নিয়মিত কুশলাদি বিনিময় হতো। ক্লাসে ভাল ৎবংঢ়ড়হংব করার কারণে স্যারের দৃষ্টি আকর্ষণ করি। এতে করে স্যারের পক্ষ থেকেই আমার সাথে যোগাযোগের সূচনা হয়। যোগাযোগের মাত্রা বাড়ে যখন স্যার কোর্সের ১০টি ঃড়ঢ়রপ-এর মধ্যে ১টি ঃড়ঢ়রপ-এর ঢ়ৎবংবহঃধঃরড়হ-এর দায়িত্ব আমাকে দেন।
ঢ়ৎবংবহঃধঃরড়হ তৈরি করার জন্য প্রয়োজনীয় বই পাওয়ার ব্যাপারে তিনি আমাকে আশ্বস্ত করেন এবং তার রুমে গিয়ে বই আনার কথা বলেন। অতঃপর আমি একদিন আমার ঢ়ৎবংবহঃধঃরড়হ সম্পর্কিত বই আনতে স্যারের রুমে যাই। আমাকে দেখে তিনি খুশি হন এবং বিভিন্ন ধরনের আলাপ-আলোচনা করেন। স্যারের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা, যে কোন ব্যাপারে স্যারকে জানানো এবং আমাকে সর্বাত্মকভাবে সাহায্য করার ব্যাপারে তিনি তার আগ্রহ প্রকাশ করেন। আমার ঢ়ৎবংবহঃধঃরড়হ-এর পর থেকে যখনই স্যারের সাথে দেখা হতো তখনই তিনি আমাকে তার রুমে যেতে বলতেন। মাস্টার্সের বিভিন্ন কোর্সের মঁরফবষরহব পাওয়ার জন্য আমি মাঝেমধ্যেই স্যারের রুমে গিয়ে কথা বলতাম। আস্তে আস্তে স্যারের কথার ধরনের পরিবর্তন লক্ষ্য করি। প্রায়ই তিনি গল্পের ছলে বিভিন্ন ধরনের কথা খোলাখুলিভাবে বলে ফেলতেন, যা শুনে আমি কিছুটা বিব্রতবোধ করলেও প্রথম দিকে ব্যাপারগুলোকে স্যারের উদারনৈতিক মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে ধরে নিই। আবার রুম থেকে বেরোনোর সময় আমার শরীরের সাথে স্যার তার নিজের শরীর লাগিয়ে দেয়ার ব্যাপারটাকেও আমি অনিচ্ছাকৃত তুচ্ছ বিষয় ভেবে গুরুত্ব দিইনি। এতে করে স্যার আস্কারা পেয়ে বসেন। এরপর স্যারের রুমে যখনই দেখা হতো তখনই বিভিন্ন আপত্তিকর কথা সরাসরি বলে দিতেন, যা আমি বিভিন্নভাবে পাশ কাটানোর চেষ্টা করতাম। আমি সুন্দরী না হওয়া সত্ত্বেও একদিন তিনি আমার সৌন্দর্যের বিস্তর প্রশংসা করলেন। ভারতীয় দূতাবাসের সড়ারব দেখার দাওয়াতে তিনি আমাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সন্ধ্যায় ছবি শুরু হওয়া এবং বাসায় ফিরতে রাত ১০টা বেজে যাবে বলে আমি অস্বীকৃতি জানালে তিনি তার নিজের গাড়িতে করে আমাকে পৌঁছে দেয়ার কথা বলেন। পরে আমি পারিবারিক অসুবিধা দেখিয়ে ব্যাপারটি সুরাহা করি। ঙপঃড়নবৎ-এর মাঝামাঝি সময় থেকে দেখা হলেই বিভিন্ন ছুতোয় আমার হাতে, পিঠে স্যার হাত দিতো, ব্যাপারটাকে আমি পিতৃস্নেহ হিসেবেই ভেবে নিতাম এবং স্যারকেও তা বোঝানোর চেষ্টা করি। সর্বোপরি স্যারের সঙ্গে দেখা হওয়াটা কিছু বিরক্তিকর মনে হলেও সীমা লঙ্ঘিত হচ্ছে এ রকমটা আমার মনে হচ্ছিল না তখন। যা হোক, ৯ই নভেম্বর আমার ১৬ নম্বর টিউটোরিয়াল গ্রুপের শিক্ষক মামুন স্যার তার টিউটোরিয়াল ক্লাসে আমাকে গধী ডবনবৎ-এর ঞযব চৎড়ঃবংঃধহঃ ঊঃযরপ ধহফ ঃযব ংঢ়রৎরঃ ড়ভ ঈধঢ়রঃধষরংস বইটি পড়ে পরের সপ্তাহে বইটির ওপর আলোচনামূলক কথা বলার কাজ দেন। ক্লাসের পরে লাইব্রেরিতে বইটি খুঁজে পেতে ব্যর্থ হই। এতে কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়ি। ১২ই নভেম্বর মোল্লা স্যারের সাথে দেখা হলে বইটির ব্যাপারে বলি এবং পরামর্শ চাই। তিনি জানালেন, তিনি নিজ কার্ড দিয়ে বইটি তুলে রাখবেন এবং পরদিন ১৩ই নভেম্বর শুক্রবার সাড়ে ৩টার দিকে স্যারের রুমে এসে বইটি নিয়ে যেতে বলেন। আমি ৩টার দিকে কলাভবনে এসে স্যারের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি জানান তিনি পরীক্ষা হলে ডিউটিতে আছেন এবং আমাকে তার রুমের সামনে অপেক্ষা করতে বলেন। সাড়ে ৩টার দিকে তিনি রুমে এসে বসলেন। আমি বইয়ের কথা বলার আগেই তিনি নানা ধরনের কথা বলা শুরু করলেন। আস্তে আস্তে কথার মান নিম্ন থেকে নিম্নতর পর্যায়ে নামতে আরম্ভ করল। তিনি আমাকে এমন সব ব্যক্তিগত কথা জিজ্ঞেস করেন যা নিশ্চিতভাবেই একজন ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের সীমা লঙ্ঘন করে। আমি এরকম চরম বিব্রতকর অবস্থায় চুপ করে থাকি। আমার নীরবতাকে হ্যাঁ বোধক মনে করে তিনি তার কথার মাত্রাকে একদমই অশালীন পর্যায়ে নিয়ে যান। রুম ত্যাগ করার উদ্দেশ্যে তখন হঠাৎ করেই আমি বইটি চাই। তিনি বইটি নিয়ে টেবিল ঘুরে এসে আমার হাতে দেন। আমি বইটি আমার হাতে নেয়ার সাথে সাথেই তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাওয়ার চেষ্টা করেন। আমি নিজেকে কোনভাবে ছাড়িয়ে নিয়ে তৎক্ষণাৎ রুম ত্যাগ করি। একজন পিতৃতুল্য শিক্ষকের কাছ থেকে এমন আচরণ পেয়ে আমি খুবই মর্মাহত। আমি এর উপযুক্ত প্রতিকার কামনা করছি। আমার মনে হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো এমন প্রতিষ্ঠানে এরকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হওয়াটা এর সম্মানকে অক্ষুণ্ন রাখবে।’

http://202.79.16.19/index.php?option=com_content&task=view&id=2895&Itemid=1

No comments:

Post a Comment