Tuesday 26 April 2011

ভারতীয় লেখকদের বই পাঠ্য : ইতিহাস-বিকৃতির শিকার হচ্ছে তরুণ সমাজ





















হাসান শান্তনু
দেশের স্বায়ত্তশাসিত, জাতীয় ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাঠ্যপুস্তকের অধিকাংশ ভারতীয় লেখকদের লেখা। এসব বইয়ে আছে বাংলাদেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য নিয়ে ভারতীয়দের মনগড়া ব্যাখ্যা। যা পড়ে এদেশের লাখ লাখ শিক্ষার্থী নিজেদের সংস্কৃতি গ্রহণ করছে ভারতীয় সংস্কৃতির আদলে। সর-কারের অবহেলা, দেশীয় লেখকদের লেখা পাঠ্যপুস্তকের অভাব, অনেক শিক্ষকের উদাসীনতায় এ সাংস্কৃতিক আগ্রাসন দীর্ঘদিন ধরে চলছে। পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের পাশাপাশি ভারতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে নতুন মাত্রা হিসেবে যোগ হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের ‘ভারতীয়করণ’। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ভারতীয়করণে নেমেছেন দেশটির কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিকরা। তারা মুক্তিযুদ্ধের মনগড়া ইতিহাস উপস্থাপন করছেন এদেশের পাঠকদের কাছে। গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধের মাধ্যমে চলছে তাদের বিকৃতকরণ। দেশের সার্বভৌমত্বে আঘাত করার পাশাপাশি তারা মুক্তিযুদ্ধের সব কৃতিত্ব ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্ধিরা গান্ধী সরকারকে দিয়ে দিচ্ছেন। এভাবে তারা সাংস্কৃতিক আধিপত্য বিস্তার করছেন। এদেশের সরকার, বুদ্ধিজীবী মহল, সুশীল সমাজ চুপ থাকায় তাদের বিকৃতি বাড়ছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। তারা বলছেন, মুক্তিযুদ্ধের পর থেকেই ভারতীয়রা গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, চলচ্চিত্রে ইতিহাস বিকৃত করছে। সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ না থাকায় একের পর এক বিকৃত লেখা প্রকাশিত হচ্ছে। ভারতীয় বাংলা, ইংরেজি ভাষার বিভিন্ন পত্রিকায় এসব লেখা প্রকাশ হচ্ছে। কলকাতার ‘দেশ’সহ কয়েকটি পত্রিকার এদেশে বিরাট বাজার থাকায় সহজেই এসব লেখা পৌঁছে যাচ্ছে তরুণসহ সব বয়সের
পাঠকের কাছে। এসবের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্ম বেশি বিভ্রান্ত হচ্ছে। প্রাবন্ধিক আহমদ ছফা তার ‘বাঙ্গালি মুসলমানের মন’ বইয়ে উল্লেখ করেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেও কলকাতার দেশ পত্রিকায় মুক্তিযুদ্ধকে হেয় করে প্রবন্ধ ছাপানো হয়েছে।’
অভিযোগ আছে, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা এদেশে তাদের সংস্কৃতি চাপিয়ে দিতে ইতিহাস
বিকৃতিতে মদত দিচ্ছে। বিকৃত ইতিহাস তরুণ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরে এদেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি, শিল্প সম্পর্কে তাদের বিষিয়ে তুলছে। এদেশের জাতীয় বীরদের নিয়ে নানা অপকথা প্রচার করছে। গোয়েন্দা সংস্থাটির জরিপ মতে, কলকাতার অনেক কবি, লেখক এ দেশে খুব জনপ্রিয়। এদেশের পাঠকদের ওপর তাদের প্রভাব আছে। আর এ কাজে এসব কবি-লেখককে সংস্থাটি ব্যবহার করছে।
জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের পাঠ্যবইয়েও ভারতীয় লেখকদের বইয়ের ছড়াছড়ি। এসব বইয়ে ভারত বাংলাদেশ সম্পর্ক, বাংলাদেশের নিরাপত্তাসহ সব বিষয়ে নিজেদের দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। শিক্ষকরা এসব বইয়ের বর্ণনা শিক্ষার্থীদের হুবহু পড়াচ্ছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব বই পড়ে শিক্ষার্থীরা মূলত ভারতীয় সংস্কৃতিকে ধারণ করছে। প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, এদেশের লেখকদের বই না থাকায় ভারতীয়দের বই পড়াতে হচ্ছে। পাঠ্যবই লেখার মতো মেধাবী অনেক শিক্ষক এদেশে আছেন। তারা লিখতে আগ্রহী নন।’ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমান বলেন, ‘উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দেখেছি প্রতি তিন বছর পর শিক্ষকদের এক বছরের জন্য ছুটি দেয়া হয়। এক বছর ছুটিতে শিক্ষকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য পাঠ্যবই লেখেন। এদেশেও সাত বছর পর এক বছরের জন্য ছুটি নেন শিক্ষকরা। ছুটি কাটালেও বেশিরভাগ শিক্ষক বই লেখেন না।’ পাঠ্যবই লেখার জন্য তিনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটি গঠনের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আছে দশ লাখ। অথচ দেশের শিক্ষকদের লেখা পাঠ্যবই নেই। সেখানে এমন শিক্ষক আছেন প্রায় ১৮০ জন, তাদের কাজ পরীক্ষা নেয়া ও খাতা দেখা। তাদের দিয়েও বই লেখানো সম্ভব। তাদের কাজে লাগানো উচিত।’
অন্যদিকে ভারতীয় ইতিহাসবিদ শর্মিলা বোস তার সাম্প্রতিক লেখা ‘ডেড রেকনিং : মেমরিজ অব দ্য নাইনটিন সেভেনটি ওয়ান বাংলাদেশ ওয়ার’ বইয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চরমভাবে বিকৃত করেন। এতে একাত্তর সালে হত্যা, নারীদের ধর্ষিত হওয়ার সংখ্যা নিয়ে তিনি প্রশ্ন তোলেন। তথ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমার দেশকে বলেন, ‘সরকার বিতর্কিত এসব বইয়ের প্রকাশনা নিষিদ্ধ করতে ভারত সরকারের কাছে আপত্তি জানাতে পারে। এদেশে বইগুলো নিষিদ্ধ করতে পারে। তবে এরকম পরিকল্পনা সরকারের নেই।’ তিনি উদাহরণ টেনে বলেন, “বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর ’৭২ সালে হিন্দি ভাষায় ভারতীয় চলচ্চিত্রকার আইএস জোহরের নির্মিত ‘জয় বাংলাদেশ’ সিনেমাটি ছিল আপত্তিকর, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, যৌনদৃশ্যনির্ভর। এতে কবরীও অভিনয় করেন। বিতর্কিত এ ছবি বাংলাদেশের অনুরোধে ভারত সরকার মুক্তি পাওয়ার বছরই নিষিদ্ধ করে।” ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘এ বই নিয়ে সরকারের প্রতিবাদ করার কিছু নেই।’ বিকৃত ইতিহাসে তরুণ প্রজন্ম বিভ্রান্ত হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তরুণরা এর প্রতিবাদ করতে পারে। ইতিহাস বিকৃতকারীদের কুশপুত্তলিকা পোড়াতে পারে।’
অন্যদিকে গত বছর কলকাতার ‘দেশ’ পত্রিকার শারদীয় সংখ্যায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘বসুধা আর তাঁর মেয়ে’ নামে একটি উপন্যাস ছাপা হয়। এর বিষয়বস্তু একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। এতে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধে ইন্ধিরা গান্ধী আর ভারতীয় সৈন্যের ভূমিকা মুখ্য আর এদেশের মুক্তিযোদ্ধারা গৌণ। এতে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে নানাভাবে খাটো করেছেন সুনীল। পত্রিকাটির ওই সংখ্যার ৪৩২ পৃষ্ঠায় সুনীল বলেন, ‘ইন্দিরা গান্ধী বুঝে গিয়েছিলেন, এ যুদ্ধে তাঁকে একাই লড়তে হবে। অবশ্য খুব বিপদে পড়লে পাশে থাকবে রাশিয়া। আর পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে যে মুক্তিবাহিনী গড়ে উঠেছে, তাদের সাহায্যও গুরুত্বপূর্ণ।’ তার মতে, এখানে ইন্দিরা গান্ধীই একমাত্র ফ্যাক্টর। স্বাধীনতার জন্য এদেশের যারা কাতারে কাতারে প্রাণ বিসর্জন দিতে পাকিস্তানের সুসজ্জিত বাহিনীর সামনে দাঁড়ান, প্রতিরোধ করেন, তারা নির্ধারক শক্তি নয়। ৪৩২ পৃষ্ঠায় সুনীলের বর্ণনায় আছে একাত্তরে আমেরিকার সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগর দিয়ে পাঠানোর গুজব সংক্রান্ত বিকৃত তথ্য। তিনি ৪৩৫ পৃষ্ঠায় পরোক্ষভাবে এদেশের জনগণকে বর্বর মানসিকতার বলেছেন। উপন্যাসে বাংলাদেশের নাম নিয়ে যেসব কথাবার্তা বলা হয়েছে, তা যে কোনো স্বাধীন দেশের সার্বভৌমত্বে আঘাত করে। উপন্যাসের ৪৩৭ পৃষ্ঠায় সুনীলের প্রশ্ন ‘ওরা পুরো বাংলাদেশ নামটি নিয়ে নিল কেন? নামটি এখন বদলানো যায় না? বাংলাদেশ-এর বদলে জয় বাংলা, শুনতেও বেশ। তাহলে বাংলাদেশ নামটা থাকবে সবার জন্য।’
অনুসন্ধানে জানা যায়, দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত ওই উপন্যাস বই আকারে পরে প্রকাশ করে কলকাতার প্রকাশনা সংস্থা আনন্দ পাবলিশার্স। এ উপন্যাসের নকল কপি এখন ছড়িয়ে গেছে সারা বাংলাদেশে। এ বইয়ের জন্য সুনীলকে এদেশের কারও পক্ষ থেকে সমালোচনায় পড়তে হয়নি। এরপর সুনীল একাধিকবার ঢাকায় এসেছেন। তাকে নিয়ে এদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাপন্থী, পূজারী কবি-লেখকরা সভা, সেমিনার করেছেন। কেউ তাকে এ বিষয়ে প্রশ্নও করেননি। মাস দুয়েক আগে সুনীল এদেশে এসে চট্টগ্রামের এক অনুষ্ঠানে ‘সংস্কৃতি, বাংলা ভাষা রক্ষা করতে দুই বাংলাকে এক হওয়া’র আহ্বান জানান। এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত গীতিকার মোহাম্মদ রফিকুজ্জামানের বক্তব্য, ‘আমাদের স্বাধীন সত্তা, সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যকে ঘিরে চক্রান্ত শুরু হয়েছে স্বাধীনতার পর থেকে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারতে আশ্রয় নেয়া কিছু অমুক্তিযোদ্ধা, তথাকথিত বুদ্ধিজীবীকে দালাল হিসেবে চুক্তি করে ফেলে ভারতের কিছু প্রতিষ্ঠান। দালাল চরিত্রের বুদ্ধিজীবীরা দেশে থেকে, কখনও ভারতে অবস্থান করে, কেউ ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের টাকায় প্রবাসজীবন কাটিয়ে, পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে এক ভাষার দোহাই দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের সঙ্গে এক সংস্কৃতির স্লোগান দিয়ে চলেছেন। অথচ ভারতের সঙ্গে আমাদের সংস্কৃতি আজ যেমন এক নয়, তেমনি কোনোকালেই এক ছিল না। কারণ আমাদের সংস্কৃতির জন্ম এ মাটি থেকে। ভারতীয় সংস্কৃতি পশুপালক, লুণ্ঠনকারী, বহিরাগত আর্যদের তৈরি করা কৃত্রিম আচার-আচরণসর্বস্ব।


No comments:

Post a Comment