Friday, 5 August 2011

ভারতের ট্রানজিটে বাংলাদেশের ফায়দা নাই

মাহমুদুর রহমান

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিজ দীপু মনি এবং এ দেশের ভারতপন্থী বুদ্ধিজীবী, অর্থনীতিবিদ ও সুশীল (?) শ্রেণীর হালের প্রিয় শব্দ কানেক্টিভিটি। ইংরেজি connectivity শব্দটি connect থেকে এসেছে। কানেক্ট-এর বাংলা আভিধানিক অর্থ সংযুক্ত করা বা সম্বন্ধ স্থাপন করা। বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ট্রানজিটের মাধ্যমে ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে উত্তর-পূর্বের সাত রাজ্যের যোগাযোগের ব্যবস্থা বা পড়হহবপঃ করা আঞ্চলিক সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রটির দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষা।

সাবেক পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান যেমন ভৌগোলিকভাবে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন ছিল, সাত রাজ্যের সঙ্গে দিল্লির অবস্থাটা সেরকম বিপজ্জনক না হলেও নিরাপত্তা ও অন্যান্য বিবেচনায় যোগাযোগের একটা বড় সমস্যা তাদেরও জন্মাবধি রয়েছে। বর্তমান অবস্থায় শিলিগুড়ির কথিত চিকেন নেক (chicken neck) অংশটি কোনো কারণে কাটা পড়লে সড়ক যোগাযোগের ক্ষেত্রে সাত রাজ্য দিল্লি থেকে সাবেক পাকিস্তানের দুই অংশের মতোই পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। তাছাড়া বর্তমান অবস্থাতেও বিদ্রোহকবলিত সাত রাজ্যের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ ব্যয়বহুল, বিপজ্জনক এবং সামরিক কৌশলগত বিবেচনায় সর্বদাই ঝুঁকিপূর্ণ। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভেঙে দুটো আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ভারতের শাসকশ্রেণী তাদের গুরুতর এই সমস্যার সমাধানে নানারকম কৌশল প্রয়োগ করে চলেছে। ১৯৭১ সালে ভারতের সহায়তায় উপমহাদেশে বাংলাদেশ নামক তৃতীয় স্বাধীন ভূখণ্ডের অভ্যুদয় তাদের দীর্ঘদিনের মাথা ব্যথা নিরাময়ের এক সুবর্ণ সুযোগ এনে দেয়।
পাকিস্তানি পরাজিত দখলদার বাহিনী ভারত ও মুক্তিবাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করে। আমাদের বিজয়ের সাড়ে ছয় মাসের মাথায় ভারত তত্কালীন বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে বন্যাকবলিত কাছাড় জেলায় জরুরি পণ্য পরিবহনের জন্য সর্বপ্রথম নৌ-ট্রানজিট সুবিধাটি আদায় করে নেয়। সেই সময় আসামে ভয়াবহ বন্যার ফলে কাছাড়ের সঙ্গে রাজ্যের বাকি অঞ্চলের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। ১৯৭২ সালের জুলাই মাসের ১ তারিখে ভারত সরকার নৌ-ট্রানজিট সংক্রান্ত নিম্নোক্ত প্রেসনোট জারি করে :

"Press note issued by the Government of India declaring that essential supplies to Cachar district will be allowed through Bangladesh waterways.
New Delhi, July 1, 1972
Transit facilities to Indian steamers from Calcutta or Gauhati to Cachar district in Assam through Bangladesh waterways have been made available following clearance by the Government of Bangladesh. The Union Ministry of Shipping and Transport has directed the Central Inland Water Transport Corporation Ltd., a public sector undertaking, to arrange movement of essential supplies to the region. The Government of India have greatly appreciated the gesture of the Bangladesh Government.
It may be recalled that surface communications between Cachar district and the rest of the country have been virtually cut off due to the devastating floods caused by the Brahmaputra and Barak rivers in Assam. The use of Bangladesh waterways will facilitate the movement of essential supplies to the flood-affected region."
(কাছাড় জেলায় অত্যাবশ্যকীয় পণ্য পরিবহনের নিমিত্ত বাংলাদেশের নৌপথ ব্যবহারের সম্মতি লাভের বিষয়ে ভারত সরকারের প্রেসনোট।
নয়াদিল্লি, জুলাই ১, ১৯৭২

বাংলাদেশ সরকারের অনুমতিপ্রাপ্ত হওয়ায় ভারতীয় জাহাজ কলকাতা অথবা গৌহাটি থেকে আসামের কাছাড় জেলায় চলাচলের জন্য বাংলাদেশের নৌপথ ব্যবহারের ট্রানজিট সুবিধা লাভ করেছে। কেন্দ্রীয় শিপিং ও ট্রান্সপোর্ট মন্ত্রণালয় সরকারি খাতের প্রতিষ্ঠান সেন্ট্রাল ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশন লিমিটেডকে ওই এলাকায় অত্যাবশকীয় পণ্য পরিবহনের ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছে। এই পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য ভারত সরকার বাংলাদেশ সরকারকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছে।

এখানে উল্লেখ্য, ব্রহ্মপুত্র এবং বরাক নদীর ভয়াবহ বন্যার ফলে কাছাড় জেলার সঙ্গে দেশের বাকি অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের নৌপথের এই ব্যবহার বন্যা উপদ্রুত অঞ্চলে জরুরি ত্রাণসামগ্রী পরিবহনে সহায়তা করবে।)

একই বছর নভেম্বরের ১ তারিখে ঢাকায় চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে ভারতকে বাংলাদেশের অভ্যন্তর দিয়ে অন্যান্য রুটে তাদের পণ্য চলাচলের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে নৌ ট্রানজিট প্রদান করা হয়। 'Protocol between the Government of India and the Government of Bangladesh on Inland Water Transit and Trade' শিরোনামের চুক্তিতে বাংলাদেশ ও ভারতের পক্ষে স্বাক্ষর করেন দুই দেশের তত্কালীন নৌ মন্ত্রণালয় সচিব যথাক্রমে এস জেড খান (S. Z. Khan) এবং এমজি পিম্পুটকার (M. G. Pimputkar)। নৌ ট্রানজিট চুক্তিতে দুই দেশের মধ্যকার ১৯৭২ সালের ২৯ মার্চ তারিখে সম্পাদিত বাণিজ্য চুক্তির অনুচ্ছেদ ৫-এর উল্লেখের বিষয়টি তাত্পর্যপূর্ণ এবং সুদূরপ্রসারী। নয়াদিল্লিতে স্বাক্ষরিত 'Trade Agreement between the Government of India and the Government of Bangladesh' শিরোনামের সেই চুক্তির Article 5 অর্থাত্ ৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে—

'The two Governments agree to make mutually beneficial arrangements for the use of their waterways, railways and roadways for commerce between the two countries and for passage of goods between two places in one country through the territory of the other.'

অনুচ্ছেদ -৫
(দুই সরকার এই মর্মে সম্মত হচ্ছে যে, দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে সহায়তা প্রদান এবং একটি দেশের এক অংশ থেকে পার্শ্ববর্তী দেশের ভেতর দিয়ে সেই দেশের অপর অংশে পণ্য পরিবহনের লক্ষ্যে উভয় সরকার পারস্পরিক লাভালাভের ভিত্তিতে যার যার দেশের নৌপথ, রেলপথ এবং সড়কপথ ব্যবহারোপযোগী করবে।)

ভারতের একতরফা স্বার্থপূরণে প্রণীত উপরিউক্ত চুক্তিতে ভারত ও বাংলাদেশের দুই তত্কালীন বাণিজ্যমন্ত্রী এল. এন. মিশ্র (L. N. Misra) ও এম আর সিদ্দিকী (M. R. Siddiqui) স্বাক্ষর করেছিলেন। বাংলাদেশের এক অংশ থেকে অপর অংশে ভারতের মধ্য দিয়ে যাওয়ার কোনোরকম ভৌগোলিক প্রয়োজনীয়তা না থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের জনগণকে ধোঁকা দিয়ে কেবল ভারতের স্বার্থ মেটানোর জন্যই বাণিজ্য চুক্তিতে এই উদ্ভট অনুচ্ছেদ সংযুক্ত করা হয়। পাঠকের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি যে, ১৯৭২ সালে প্রণীত তিনটি উল্লিখিত চুক্তির কোনোটিতেই কানেক্টিভিটি শব্দটি কোথাও ব্যবহার করা হয়নি। এই শব্দটি ভারতের বাংলাদেশীয় দালালদের সাম্প্রতিক আবিষ্কার। আমার কাছে এসব চুক্তির যে কাগজপত্র রয়েছে, সেখানে তারিখ সংক্রান্ত একটি বিভ্রান্তিও আমি খুঁজে পেয়েছি, যার উল্লেখ সঠিক ইতিহাস রচনার স্বার্থেই প্রয়োজন বিবেচনা করছি। নভেম্বরের নৌ-ট্রানজিট চুক্তিতে আগের বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরের তারিখ ২৯ মার্চ, ১৯৭২ উল্লেখ থাকলেও দিল্লিতে সেই চুক্তি প্রকৃতপক্ষে স্বাক্ষরিত হয়েছিল ২৮ মার্চ। ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্যমন্ত্রী ললিত নারায়ণ মিশ্র ২৯ মার্চ ভারতীয় লোকসভায় বাংলাদেশের সঙ্গে তার দেশের আগের দিনের চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়ে বিবৃতি প্রদান করেছিলেন মাত্র। আমার ধারণা, নৌ-ট্রানজিট চুক্তির খসড়া প্রণয়নকারীরা পরবর্তীকালে তারিখ গুলিয়ে ফেলেছিলেন।

একবার আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পাদিত হয়ে গেলে বাংলাদেশের মতো একটি দুর্বল দেশের পক্ষে তাকে রদ করা যে আর সম্ভব হয় না, তার উত্কৃষ্ট প্রমাণ ১৯৭২ সালে শেখ মুজিবুর রহমান সরকারের আমলে প্রণীত বাণিজ্য চুক্তি এবং নৌ-ট্রানজিট চুক্তি। ১৯৭২ সালের ২৮ মার্চ তারিখে স্বাক্ষরিত বাণিজ্য চুক্তির পাঁচ নম্বর অনুচ্ছেদের সুযোগ নিয়ে পরবর্তীকালে বাংলাদেশের কাছ থেকে ভারত একে একে তার সব ট্রানজিট চাহিদা পূরণ করে নিয়েছে। চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পরবর্তী দীর্ঘ ৩৯ বছরে আওয়ামী লীগ ছাড়া জেনারেল জিয়া, জেনারেল এরশাদ, বেগম খালেদা জিয়া এবং জেনারেল মইনের সরকার দেশ শাসন করলেও কোনো সরকারের পক্ষেই ওই চুক্তি কিংবা আর্টিকেল পাঁচ রদ বা পরিবর্তন করা সম্ভব হয়নি। বরং ২০০৭-০৮ সময়কালে মইনের জরুরি সরকার দেশবাসীকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে বেআইনিভাবে ভারতকে আকাশপথে ট্রানজিটও দিয়ে দিয়েছে। ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দিন সরকারের এই ধরনের চুক্তি করার কোনো সাংবিধানিক অধিকার না থাকলেও মার্কিন-ভারতের সহায়তায় কেবল ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তত্কালীন শাসকরা দেশের স্বার্থ অকাতরে বিকিয়ে দিয়েছেন এবং পরবর্তী সময়ে যোগসাজশের মাধ্যমে একটি ভারতবান্ধব সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়ে দিয়ে পিঠ বাঁচাতে দল বেঁধে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। সেই সময় নয়া দিগন্ত পত্রিকায় এ বিষয়ে প্রতিবাদ করে একাধিক কলাম লিখলেও এসব দেশবিরোধী কর্মকাণ্ড থেকে জেনারেল মইন ও ড. ফখরুদ্দীন আহমদকে নিবৃত্ত করতে পারিনি। বাংলাদেশের জনগণও নেশাগ্রস্তের মতো চোখ বুজে কেবল আপন সংসারধর্ম পালনের মধ্যে ব্যাপৃত থেকেছেন। এত আত্মকেন্দ্রিকতায় বিভোর থেকে একটি দেশের স্বাধীনতা রক্ষা করা যায় না।

তত্কালীন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ড. ইফতেখার আহমেদ চৌধুরীর একটি দম্ভোক্তির কথা এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি দাবি করেছিলেন, তত্ত্বাবধায়কের ছদ্মাবরণে সামরিক সরকার ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে এমন একটি পর্যায়ে নিয়ে যাবে, যার পরিবর্তন সাধন করা পরবর্তী কোনো সরকারের পক্ষেই সম্ভব হবে না। চারদলীয় জোট সরকারের সময়কার জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি এবং পরবর্তীকালে এক-এগারোর সহযোগী ড. ইফতেখারের কথা সঠিক প্রমাণিত হয়েছে। মইন-মাসুদ-মশহুদ-ফখরুদ্দীন গং দেশের চূড়ান্ত সর্বনাশটি সাধন করেই ক্ষমতার দৃশ্যপট থেকে বিদায় নিয়েছেন।

১৯৭২ সালে নৌ-ট্রানজিট সুবিধা লাভের মাধ্যমে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ তাদের প্রথম লক্ষ্য পূরণ করে। স্মরণে রাখতে হবে যে, সর্বদাই তাদের মূল লক্ষ্য ছিল সড়কপথে ট্রানজিটপ্রাপ্তি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকার বাণিজ্য চুক্তির পাঁচ নম্বর অনুচ্ছেদে সম্মত হয়ে দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশকে মূলত ভারতের একটি ‘ট্রানজিট রাষ্ট্রে’ পরিণত করার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল। ২০১০ সালের ২১ অক্টোবর ঢাকায় আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত প্রকাশ্যেই বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ ট্রানজিটের দেশ। আঞ্চলিক সম্পর্ক জোরদারে আমি বিশ্বাসী। আগে ভুটান ও নেপাল সরাসরি আলোচনায় আসেনি। এখন ভারত বলে দেয়ার পর ভুটান ও নেপাল লিংক হয়েছে।’ আমাদের মাতৃভূমি সম্পর্কে আওয়ামী মানসিকতা বোঝার জন্য অর্থমন্ত্রীর এই বক্তব্যই যথেষ্ট। বাংলাদেশের পরজীবী সুশীল (?) সমাজের চিন্তা-চেতনাও আওয়ামী লীগ থেকে ভিন্নতর কিছু নয়। তাই এ দেশের জনগণের নাকের সামনে উন্নত বিশ্বের প্রাচুর্যের কল্পিত মুলা ঝুলিয়ে ট্রানজিটের ইস্যুতে তাদের বিভ্রান্ত করার জন্য ভারত গত প্রায় দুই দশক ধরে এই সুশীল (?) সমাজকেই ব্যবহার করেছে। ঢাকা শহরের পাঁচতারা সব হোটেলে সেমিনার করে বায়বীয় পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে দাবি করা হয়েছে, ভারতকে ট্রানজিট দিলে প্রতি বছর আমরা কমপক্ষে বিলিয়ন ডলার নিট আয় করব, এক ট্রানজিটের ভাড়ায় বাংলাদেশের জাতীয় আয় সিঙ্গাপুরের সমপরিমাণে উন্নীত হবে, একবার কানেক্টিভিটি হয়ে গেলে আমরা সড়কপথে জাপান পর্যন্ত যেতে পারব, ইত্যাদি ইত্যাদি।

সিপিডি, বিলিয়া, হেরিটেজ ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউট ইত্যাকার সুশীল (?) সংগঠন বিদেশি আনুকূল্যে পালা করে দিনের পর দিন এসব সেমিনারের আয়োজন করেছে। প্রফেসর রেহমান সোবহান, ড. রহমতউল্লাহ, ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, ওয়ালিউর রহমান, ফারুক সোবহান, মোঃ জমির এবং অন্যান্য ভারতপন্থী বুদ্ধিজীবী-আমলা একজোট হয়ে তাদের লেখায় ও বক্তব্যে ভারতের ট্রানজিটে বাংলাদেশের ‘বেশুমার’ লাভ আবিষ্কার করেছেন। বাংলাদেশের তাবত্ সুশীল (?) ও ভারত সমর্থক মিডিয়ায় দিনের পর দিন ট্রানজিটের পক্ষে প্রচারণা চালানোর ফলে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যকার একটা বৃহত্ অংশ নিঃসন্দেহে প্রভাবিত হয়েছে। এদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মগজ ধোলাইয়ের কাজ মোটামুটি সম্পন্ন হওয়ার পর এখন একই ব্যক্তিদের কণ্ঠে ভিন্ন সুর শোনা যাচ্ছে।

গত তিন মাসে এদের দেয়া বক্তব্য স্মরণ করা যাক। প্রধানমন্ত্রীর অর্থ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান ফতোয়া দিয়েছেন, আমরা নাকি ট্রানজিটের বিনিময়ে ভারতের কাছে ভাড়া দাবি করলে একটি অসভ্য জাতিতে পরিণত হব। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভীর থিওরি হচ্ছে, ট্রানজিটের ভাড়া থেকে তেমন একটা অর্থপ্রাপ্তি না হলেও ভারতীয় ট্রাক ড্রাইভারদের জন্য হোটেল, রেস্তোরাঁ ইত্যাদি নির্মাণ করা হলে সেই সেবা খাত থেকে আমাদের প্রচুর আয় হবে। সেইসব ট্রাক ড্রাইভারের মনোরঞ্জনের জন্য লাভজনক আদিম ব্যবসার ব্যবস্থা করা হবে কি-না সে সম্পর্কে অবশ্য তিনি কিছু বলেননি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপুমনি এসব অর্থনীতির ঝুট-ঝামেলায় না গিয়ে দাবি করেছেন, ভারতকে ট্রানজিট না দিলে বাংলাদেশ বহির্বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একটি isolated country তে রূপান্তরিত হবে। তিনি ফতোয়া দিচ্ছেন, ভারতীয় জুজুর ভয় না দেখিয়ে কানেক্টিভিটির স্বার্থে সরকারের অবস্থানকে সমর্থন করা উচিত। মাঝখান থেকে কী উদ্দেশ্য সাধনে জানি না, অনেকটা হঠাত্ করেই তার দীর্ঘদিনের অবস্থান থেকে দৃশ্যত খানিকটা সরে এসে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য ভারতকে ট্রানজিট দেয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে বাংলাদেশের স্বার্থ বিশদভাবে দেখার জন্য সরকারকে নসিহত করছেন। ব্যাপারটা আমার কাছে অন্তত বাংলাদেশের সর্বনাশ নিশ্চিত হওয়ার পর এক পাল সুশীল (?) কে সঙ্গে নিয়ে দুই দশকব্যাপী উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণা চালানোর দায়িত্ব এখন এড়ানোর নিষম্ফল প্রচেষ্টার মতোই মনে হচ্ছে। ভারতের চরণতলে মাতৃভূমির স্বার্থ বিসর্জন দেয়ার দুই দশকের প্রক্রিয়ায় কার কতখানি রাষ্ট্রদ্রোহী ভূমিকা ছিল, সেটি ইতিহাস অবশ্যই একদিন নির্মোহভাবে বিচার করবে।

ট্রানজিট ইস্যুতে ক্ষমতাসীন মহাজোট, ভারত সরকার এবং এদেশের সুশীল (?) বুদ্ধিজীবীদের কাজ-কারবার দেখার পর আমাদের কথিত উন্নয়ন সহযোগীদের ভূমিকারও পর্যালোচনার প্রয়োজন রয়েছে। ভারত সরকার তাদের দেশের স্বার্থে যে কোনো মূল্যে বাংলাদেশের বুক চিরে ট্রানজিট পেতে চাইবে, এটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু সরকারি দায়িত্ব পালনের পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতায় বিশ্বব্যাংক, এডিবি, এসক্যাপের (ESCAP) এর মতো বহুপাক্ষিক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা আমাকে সবচেয়ে বেশি অবাক করেছে। পুঁজিবাদ সহায়ক এসব প্রতিষ্ঠান যে মূলত পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থরক্ষার জন্যই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেটা আমাদের সবার জানা। বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোও এসব অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ সহায়তা নিয়ে থাকে। কিন্তু ভারতের সঙ্গে আমাদের প্রায় প্রতিটি দ্বিপাক্ষিক বিরোধপূর্ণ বিষয়ে অন্তত আমার অভিজ্ঞতায় এদের সর্বদা ভারতের প্রতি অধিকতর নমনীয় দেখতে পেয়েছি।

এর পেছনে দুটো কারণ থাকতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলো চীনের সামরিক ও অর্থনৈতিক উত্থানকে ঠেকানোর জন্য যে কৌশল গ্রহণ করেছে, সেখানে আঞ্চলিক পরাশক্তি ভারতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় আধিপত্যবাদী ভারত যেহেতু সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অন্যতম মিত্রে পরিণত হয়েছে, সেজন্য বাংলাদেশের মতো দুর্বল রাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষার কোনো প্রয়োজনীয়তা বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো অনুভব করছে না। চীনকে মোকাবিলার জন্য ভারতকে ব্যবহারের বিনিময় মূল্য স্বরূপ দক্ষিণ এশিয়ার মৌরশি পাট্টা আমাদের বৃহত্ প্রতিবেশীকে এক রকম বিনা প্রশ্নে দেয়া হয়েছে।

দ্বিতীয়ত বিপুল জনসংখ্যার ভারতে শিক্ষার মান উন্নত হওয়ার কারণে বিশ্বব্যাংক, এডিবি, এসক্যাপ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানে ভারতীয় নাগরিক এবং ভারতীয় বংশোদ্ভূতরা নীতিনির্ধারণী পদে বেশি সংখ্যায় কাজ করছে। সুতরাং, সেদিক দিয়েও বাংলাদেশসহ অন্য দক্ষিণ এশীয় রাষ্ট্রগুলো অসম প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সহযোগিতার ছদ্মাবরণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা রাষ্ট্রের সম্মতিতে ভারতের ইচ্ছাই একে একে বাস্তবায়িত হচ্ছে। জেনারেল মইনের আমলে ঢাকা-কলকাতা ট্রেন যোগাযোগ উদ্বোধনের দিনে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে বিচিত্র পোশাক পরিহিত তত্কালীন এডিবি প্রতিনিধি মিজ হুয়া দু এবং ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর গান-বাজনার স্মৃতি আশা করি ভুলো বাঙালি মুসলমান এখনও ভুলে যায়নি।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহযোগিতার প্রসঙ্গ না তুললে আমার রচনাটি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিরা ইতিহাসের অন্যতম ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ড শুরু করলে প্রায় এক কোটি বাংলাদেশী উদ্বাস্তু ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে। দীর্ঘ নয় মাস ধরে ভারতের জনগণ এবং সে দেশের সরকার শরণার্থীদের বাসস্থান এবং খাদ্যের ব্যবস্থা করে আমাদের অবশ্যই গভীর কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছে। অধিকন্তু, বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ এবং তাদের প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহেও ভারত সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এগুলো সবই ইতিহাস। কিন্তু প্রশ্ন হলো, পাকিস্তান দ্বিখণ্ডিত হওয়ায় ভারতও কি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক দিক দিয়ে লাভবান হয়নি? জন্মাবধি পাকিস্তান এবং ভারতের মধ্যে চরম বৈরী সম্পর্ক বিদ্যমান না থাকলে ১৯৭১ সালে আমরা কি ভারতের কাছ থেকে একই ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা লাভ করতাম? প্রকৃত ঘটনা হলো, আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহযোগিতা কোনোভাবেই একতরফা দয়া-দাক্ষিণ্যের কোনো বিষয় ছিল না। স্বাধীনতা সংগ্রামে সহযোগিতা করার জন্য আমরা যেমন ভারতের কাছে কৃতজ্ঞ, একইভাবে নেহরু ডকট্রিনের আলোকে ভারতের দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক ও সামরিক লক্ষ্য পূরণে ১৯৭১ সালে আমাদের ভূমিকার জন্যও ভারতের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। চল্লিশ বছর আগে এক মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা প্রদান কোনো অবস্থাতেই ভারতকে আমাদের বিরুদ্ধে পানি আগ্রাসন চালানো, সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক নির্বিচারে বাংলাদেশী নাগরিককে বিভিন্ন উপায়ে হত্যা, আমাদের জমি দখল, বাংলাদেশের চারদিকে অবমাননাকর কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ, বাংলাদেশের যুবসমাজকে ধ্বংস করার অভিপ্রায়ে সীমান্ত ঘেঁষে মাদকের কারখানা নির্মাণ এবং আমাদের মাতৃভূমির বুক চিরে তাদের পণ্য ও সামরিক সরঞ্জাম পরিবহনের ট্রানজিটের জন্য রাস্তা নির্মাণের নামে পুরো দেশটিকেই টুকরো টুকরো করার বৈধতা প্রদান করে না। সত্য কথা হলো, একমাত্র ভারতের প্রয়োজন মেটাতেই ট্রানজিট, বাংলাদেশের এখানে কোনোরকম ফায়দা নেই।

ভারতের কাছ থেকে সুদে টাকা ধার করে আমরা যে রাস্তা নির্মাণ করব, তার ওপর দিয়ে প্রধানত ভারতীয় যানবাহন সেদেশের পণ্য ও অন্যান্য সরঞ্জাম নিয়ে চলাচল করবে। ওই রাস্তা দিয়ে আমাদের কোনো পণ্য ভারতের বাজারে প্রবেশ করবে না। একমাত্র ভুটান এবং নেপাল ছাড়া অন্য কোনো দেশের সঙ্গেও ট্রানজিটের রাস্তা দিয়ে বাংলাদেশের কোনো কানেক্টিভিটিও তৈরি হচ্ছে না। ভারতের মধ্য দিয়ে আমরা সড়কপথে চীন, পাকিস্তান যেতে পারলে তবেই তাকে প্রকৃত আঞ্চলিক কানেক্টিভিটি বলার সুযোগ ছিল। উপরন্তু ট্রানজিট দেয়া হলে বাংলাদেশ ক্রমেই ফিলিস্তিনিকরণ প্রক্রিয়ার দিকে ধাবিত হবে। দেশের জনগণকে নির্বোধ বিবেচনা করার উন্নাসিকতা শাসকশ্রেণী যত তাড়াতাড়ি পরিহার করতে পারেন ততই তাদের জন্য মঙ্গল। যারা বাংলাদেশকে ‘ট্রানজিটের দেশ’ নামকরণ করে হেয় করেন কিংবা কানেক্টিভিটির বিভ্রান্তিকর তত্ত্ব ফেরি করে ভারতের ট্রানজিট জায়েজ করার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছেন, ইতিহাস তাদের একদিন নির্ভেজাল রাষ্ট্রদ্রোহী রূপেই বিবেচনা করবে। বাংলাদেশকে অধিকৃত ফিলিস্তিনের দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি থেকে রক্ষা করতে হলে এই ট্রানজিটের বিরুদ্ধে একাত্ম হয়ে রুখে দাঁড়ানো প্রতিটি দেশপ্রেমিক নাগরিকের কর্তব্য। মনে রাখতে হবে, চুক্তি একবার স্বাক্ষরিত হয়ে গেলে সেটি রদ করা দুর্বল দেশের পক্ষে প্রায় অসম্ভব প্রয়াস। ১৯৭২ সালে সম্পাদিত বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য চুক্তির অশুভ পরিণতি দেখার পরও আমরা যদি নির্বিকার ঘরে বসে থাকি, তাহলে একটি quasi-independent রাষ্ট্রের প্রায়মুখাপেক্ষি নাগরিক হওয়াই এদেশের জনগণের চূড়ান্ত বিধিলিপি।

ট্রানজিট চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার আগেই ভারতীয় শাসকশ্রেণী সিলেট থেকে খুলনা পর্যন্ত দখল করে নেয়ার যে হুমকি উচ্চারণ করেছে, তার মাধ্যমে আমার আশঙ্কার সারবত্তা প্রমাণিত হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন প্রতিরোধ করার জন্য জনগণের ট্যাক্সে প্রতিপালিত বিশেষ বাহিনীর দিকে তাকিয়ে থেকে কোনো ফায়দা নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ও বিশিষ্ট পণ্ডিত ড. তালুকদার মনিরুজ্জামান এবং কবি ও চিন্তাবিদ ফরহাদ মজহারের গণপ্রতিরক্ষা তত্ত্ব বাস্তবে রূপ দেয়ার আজ সময় এসেছে।
[সূত্রঃ আমার দেশ, ০৩/০৮/১১]

No comments:

Post a Comment