শফিক রেহমান গত ২৮ নভেম্বর ২০১০ থেকে ওয়েবসাইট উইকিলিকস ও তার সহযোগী পাঁচটি আন্তর্জাতিক দৈনিক পত্রিকা ধারাবাহিকভাবে গোপন আমেরিকান কূটনীতিক বার্তা প্রকাশ শুরু করে। বিশ্ব জুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। বিশ্ব রাজনীতি নতুন চেহারায় প্রতিভাত হয়। কম্পিউটারের মাধ্যমে বিনিময়কৃত এসব তথ্য ছিল অতি গোপনীয়। উইকিলিকস সেসব ফাঁস করে দেয়ায় বিশেষত আমেরিকান সরকার খুব বিব্রত হয়েছে। এখন চলতিভাবে এসব বার্তা পরিচিত হয়েছে সিক্রেট আমেরিকান ডিপ্লম্যাটিক কেবলস (Cables) নামে। সংক্ষেপে উইকিলিকস নামে। উইকিলিকসের ফাঁস করা এসব তথ্যবহুল আলোচিত হলেও তার সত্যতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। কিন্তু ১৬ জানুয়ারি ২০১১-তে প্রকাশিত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ওয়াশিংটন থেকে আমেরিকার সেক্রেটারি অফ স্টেট (পররাষ্ট্রমন্ত্রী) হিলারি ক্লিনটনের টেলিফোন আলাপ সত্য কি না তা নিয়ে ঢাকার বিভিন্ন মহলে জোরালো আলোচনা চলছে। এই টেলি-কথার ট্রান্সকৃপ্টের ফটোকপি পাওয়া যাচ্ছে এবং এর কিছু অংশ বাংলা দৈনিক মানবজমিন ও ইংরেজি সাপ্তাহিক হলিডে-তে প্রকাশিত হয়েছে। অন্য পত্রিকাগুলো এই টান্সকৃপ্ট ছাপেনি। হিলারি-হাসিনা টেলি-কথার ট্রান্সকৃপ্ট, যাকে সংক্ষেপে বলা যায় হিলারিলিক, সেটা প্রকাশ না করার কারণ হতে পারে এর সত্যতা সম্পর্কে সংশয়। আওয়ামী লীগ সমর্থকরা হিলারিলিক-কে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিতে চেয়েছেন। অন্য দিকে বিএনপি সমর্থকদেরও কেউ কেউ হিলারিলিকের সত্যতা বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করেছেন। সুতরাং, আসুন বিবেচনা করা যাক হিলারিলিক সত্য কি না। তার আগে আমি সাম্প্রতিক সময়ের একজন সেরা স্যাটায়ার ও রাজনৈতিক কলাম লেখক, আর্ট বুখওয়াল্ড (Art Buchwald)-এর বিষয়ে কিছু বলে নিতে চাই। নিউ ইয়র্কে বসবাসকারী একটি গরিব অস্টৃয়ান-হাংগেরিয়ান ইহুদি পরিবারে ১৯২৫-তে জন্ম হয়েছিল আর্ট বুখওয়াল্ডের। তাকে একটি এতিমখানায় ভর্তি করে দিয়েছিলেন তার পিতা, যিনি ছিলেন দরজি। পরে তাকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনা হলেও ১৭ বছর বয়সে তিনি পালিয়ে যান এবং সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হবার পরে তিনি সাংবাদিকতা ও লেখালেখিকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। এক পর্যায়ে তিনি আমেরিকা থেকে ইওরোপে চলে যান। সেখানে প্যারিসে ১৯৪৯-তে দি নিউ ইয়র্ক হেরাল্ড টৃবিউনের ইওরোপিয়ান সংস্করণের সম্পাদকীয় স্টাফ পদে যোগ দেন। এর পর থেকে তিনি তার রসালো কিন্তু তীক্ষ্ম, ব্যঙ্গাত্মক কিন্তু মানবতাবোধসম্পন্ন, ঝরঝরে ভাষা কিন্তু বিশ্লেষণমুখী বিভিন্ন ধরনের কলামের জন্য বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। ১৯৬২-তে বুখওয়াল্ড ফিরে যান আমেরিকায়। টৃবিউন মিডিয়া সিনডিকেট তার লেখা আটলান্টিকের উভয় তীরে একযোগে ৫৫০টি পত্রপত্রিকায় প্রকাশ করতে থাকে। বুখওয়াল্ডের কলাম একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। রসবোধসম্পন্ন ও রাজনীতিকভাবে উদার, আর্ট বুখওয়াল্ডের কলাম অবশ্য পাঠ্য হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৮২-তে বুখওয়াল্ড পান পুলিৎজার প্রাইজ। বুখওয়াল্ডের লেখার সঙ্গে আমি পরিচিত হই আশির দশকের শুরুতে। ১৯৭৯-তে লন্ডন থেকে ঢাকায় ফিরে এসে আমি ভালো দৈনিক পত্রিকার তীব্র অভাব অনুভব করছিলাম। তখন বিদেশের খবর জানার জন্য শর্ট ওয়েভে বিবিসি রেডিও-র ওপর নির্ভর করতে হতো। সেই সময়ে ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড টৃবিউন পড়া শুরু করি এবং সেখানে বুখওয়াল্ডের কলাম আমাকে গভীরভাবে আকৃষ্ট করে। লক্ষ্য করি, তিনিই একমাত্র কলাম লেখক, যিনি বাস্তব ঘটনার সঙ্গে কল্পনার মিশ্রণ ঘটিয়ে বিভিন্ন চরিত্রের সংলাপ লিখতে পারেন। তার সব লেখাই যে এই ধরনের সংলাপনির্ভর ছিল, তা নয়। কিন্তু প্রায়ই তিনি সংলাপ-নির্ভর ব্যঙ্গাত্মক কলাম লিখতেন। বলা হয়, গালিভার্স ট্রাভেলস-এর লেখক জনাথন সুইফট (১৬৬৭-১৭৪৫)-এর পরে আর্ট বুখওয়াল্ড-ই বিশ্বের সেরা পলিটিকাল স্যাটায়ার লেখক। এপৃল ১৯৮০-তে যখন ঢাকায় সাপ্তাহিক সচিত্র সন্ধানীতে আমি যায়যায়দিন নামে একটি রাজনৈতিক কলাম লেখা শুরু করি, তখন মাঝে মাঝে আর্ট বুখওয়াল্ডের সংলাপ-নির্ভর টেকনিক অনুসরণ করি। অক্টোবর ১৯৮৪-তে যায়যায়দিন নামে যখন একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করি, তখন মাঝে মাঝে সংলাপ-নির্ভর লেখা দিনের পর দিন কলামে প্রকাশ করতাম। এটি পাঠকের প্রিয় হলেও শাসকের অপ্রিয় হয়। জুলাই ১৯৮৬-তে সাপ্তাহিক যায়যায়দিন নিষিদ্ধ হয়ে যাবার অন্যতম কারণ ছিল দিনের পর দিন কলামে তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সঙ্গে তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হুমায়ুন রশিদ চৌধুরীর কল্পিত সংলাপ। আমাকে নির্বাসনে যেতে হয়। কল্পিত রাজনৈতিক সংলাপ লেখা ও প্রকাশ করা যে খুব বিপজ্জনক হতে পারে সেটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় বুঝি। এই ঝুঁকি কিভাবে এড়ানো সম্ভব সেটা জানার জন্য আমি আরো নিয়মিতভাবে আর্ট বুখওয়াল্ডের কলামগুলো পড়ি। আমি সিদ্ধান্তে আসি যে, কল্পিত রাজনৈতিক সংলাপ লিখতে হলে সংশ্লিষ্ট চরিত্রদের সম্পর্কে গভীর জ্ঞান থাকতে হবে, কল্পনাশক্তি হতে হবে প্রখর এবং এই ধরনের লেখায় সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। অর্থাৎ, কল্পিত রাজনৈতিক সংলাপ লেখা একটি ডিফিকাল্ট আর্ট। আর সেজন্যই আমেরিকা, ইংল্যান্ড ও বাংলাদেশে অনেক ভালো ও শক্তিশালী কলাম লেখক থাকলেও কল্পিত রাজনৈতিক সংলাপ লিখিয়ে ভালো স্যাটায়ারিস্ট নেই। এই যুক্তিতেই হয়তো বলা যায়, হিলারিলিক কোনো কল্পিত টেলি-কথা নয়। কারণ ইংরেজি ভাষায় এ রকম টেলি-কথা কল্পনাকারী, যাকে অবশ্যই আমেরিকা-বাংলাদেশ বিশেষজ্ঞ হতে হবে তার কোনো অস্তিত্ব আমরা জানি না। যদি এ রকম কল্পনাশক্তির অধিকারী আমেরিকা-বাংলাদেশ বিশেষজ্ঞ রাজনৈতিক কলাম লেখক থাকতেন, তাহলে তার লেখালেখির সঙ্গে আমরা ইতিমধ্যে নিশ্চয়ই পরিচিত থাকতাম। সে রকম কোনো লেখক নেই বলেই ধরা যেতে পারে, হিলারিলিক কল্পিত সংলাপনির্ভর নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন হিলারিলিককে সত্য বলে মেনে নিতে অনেকে দ্বিধান্বিত হচ্ছেন? এর উত্তর দিতে হলে বিবেচনা করতে হবে হিলারিলিকের বিষয়বস্তুগুলো কি? পড়ুন তাহলে। এক. প্রাথমিক সৌজন্য বিনিময়ের পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন বলেন, ‘আমেরিকার অ্যামবাসাডর-অ্যাট-লার্জ স্টিফেন র্যাপ-কে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে দিল্লির অনুরোধে। ভ্রমণকারী রাষ্ট্রদূত র্যাপ ও ঢাকায় নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত মরিয়ারর্টি-র রিপোর্ট আমি পেয়েছি। যথার্থভাবে মানব অধিকার রক্ষায় আমি এবং প্রেসিডেন্ট ওবামা উভয়েই আগ্রহী। আর সেজন্যই আপনাকে জানাতে চাইছি, যে ফর্ম ও বিষয় নিয়ে বিচার চলছে, সেটাকে আমেরিকা সমর্থন করে না। (বিচারের) পুরো পদ্ধতিটা বাংলাদেশকে এমনভাবে বদলাতে হবে এটা যেন বিরোধীদের শাস্তি দেয়ার বাহক না হয়।’ মন্তব্য : ১৩ জানুয়ারিতে ঢাকায় একটি প্রেস ব্রিফিংয়ে রাষ্ট্রদূত র্যাপ যুদ্ধাপরাধের বিচার উন্মুক্ত ও স্বচ্ছ করার জন্য ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। সুতরাং এটা নতুন কোনো তথ্য নয়। নতুন তথ্যটা হচ্ছে দিল্লির অনুরোধে রাষ্ট্রদূত র্যাপকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছিল। দুই. হিলারির এই কথার উত্তরে হাসিনা বলেন, ‘আমার আইনমন্ত্রীকে রাষ্ট্রদূত র্যাপের বক্তব্য নোট করার জন্য ইতিমধ্যেই বলেছি। আমরা দিল্লির সক্রিয় সমর্থন ও সাহায্যে এই বিচারকাজে হাত দিয়েছি। আমি নিশ্চিত যে, ওয়াশিংটনে নিযুক্ত ইনডিয়ান রাষ্ট্রদূত এ বিষয়ে আপনাকে আরো জানাবেন।” মন্তব্য : দিল্লির সক্রিয় সমর্থন ও সাহায্যে যে হাসিনা এই বিচারকাজ শুরু করেছেন সেটা অনেকেই মনে করতেন। তবে নতুন জানা গেল, এই নেটওয়ার্কে ওয়াশিংটনে নিযুক্ত ইনডিয়ান রাষ্ট্রদূত আছেন। তিন. এরপর হিলারি বলেন, “আমেরিকার যে মূল্যবোধ ও নীতিমালা আছে সেসব দিল্লির মতো হতে পারে না-ও হতে পারে। আমরা দিল্লির বেশির ভাগ মতামতের প্রতি গুরুত্ব দেই। তবে এই প্রসঙ্গটা (ভিন্ন) তাই আমি ভেবেছি আপনাকে আগেই সেটা বলা উচিত।” এর উত্তরে হাসিনা বলেন, ‘আপনার উদ্বেগটা বুঝেই বলছি। এসব আমাদের (নির্বাচনী) ম্যানিফেস্টোতে ছিল এবং জনগণ চায় এই বিচারটা যেন চলে।’ মন্তব্য : এটা নতুন কিছু নয়। হাসিনা সব সময়ই বলে এসেছেন জনগণ এই বিচার চায়। চার. হিলারি তখন বলেন, “অবশ্যই। কিন্তু সেটা এমনভাবে হতে হবে যেন আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হয়। তবে আমাদের মনে হয়, ত্রুটিপূর্ণ এবং রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ফর্ম বা কায়দায় সেটা হলে, এমনকি যারা আপনার পার্টিকে ভোট দিয়েছেন তাদের কাছেও গ্রহণযোগ্য হবে না। বিশ্বের যে অঞ্চলে আপনার দেশটি অবস্খিত সেখানে শান্তি আনার জন্য প্রেসিডেন্ট ওবামা খুব পরিশ্রম করছেন। সুতরাং আমেরিকা এমন কোনো কাজ করতে দেবে না, যার ফলে কিছু বৈধ রাজনৈতিক শক্তিকে গোপনে কাজ করতে হতে পারে। কারণ তার ফলে সেটা আপনার জন্য এবং আমাদের জন্যও আরো সমস্যার সৃষ্টি করবে।” হাসিনা এর উত্তরে বলেন, “এ নিয়ে আপনি দুর্ভাবনা করবেন না। এটাকে তেমন সিরিয়াসলি নেবেন না। আমরা এটা (বিচার) করছি, কারণ এটা আমাদের করতে হবে। এখানে কিছু দোষী মানুষ আছে, যাদের সোজা করতে হবে।” মন্তব্য : আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতি কিছুটা বদলে গেছে। তারা চায় না সন্ত্রাসীদের দমনের অজুহাতে ধর্মভিত্তিক মুসলিম দলগুলোর ওপর কোনো অত্যাচার হোক। আমেরিকা এখন জানে এই ধরনের দমন-পীড়ন নীতির ফলে ধর্মভিত্তিক মুসলিম দলগুলো আত্মগোপন করলে তারা নাশকতামূলক কাজে লিপ্ত হতে বাধ্য হতে পারে। এবং যেহেতু আন্তর্জাতিক চলাচল এখন সহজ সেহেতু নাশকতার কাজে অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা বাংলাদেশ থেকে আমেরিকাতেও হাজির হয়ে ধ্বংসাত্মক কাজ করতে পারে। সুতরাং আমেরিকা চায় খোলামেলা রাজনীতিতেই ধর্মভিত্তিক দলগুলো অংশ নিক। লক্ষণীয় যে, হাসিনা তাকে প্রবোধ দেয়ার জন্য বলেছেন বিষয়টা অত সিরিয়াসলি না নিতে। কিন্তু জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতার করার মাধ্যমেই বোঝা যায়, বিষয়টি হাসিনা সিরিয়াসলিই নিয়েছেন। পাচ. এরপর হিলারি বলেন, “রাষ্ট্রদূত র্যাপ আমাকে আরো জানিয়েছেন, বিচার বিভাগের (জুডিশিয়ারি) ওপর আপনার সরকারের প্রভাবের বিষয়টি তিনি আমাকে বলেছেন, আপনি যেভাবে চান সেভাবেই বিচার বিভাগ রায় দিচ্ছে। এর পরিণতি ভালো হয় না। এ বিষয়ে আপনার সতর্ক হওয়া উচিত।” হাসিনা তখন বলেন, “ধন্যবাদ। আপনার ও প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের মতামতকে আমি সব সময়ই দাম দেই।” মন্তব্য : বর্তমান সরকার যে বিচার বিভাগকে সাজিয়েছে সেটা সর্বজনবিদিত। আমেরিকাও সেটা জেনে গেছে। তাই হিলারি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, এর পরিণাম অশুভ হয়। ছয়. এরপর হিলারি বলেন, “যে জন্য আমি আপনাকে ফোন করেছি সেই মোদ্দা কথাটা বলতে চাই। ড. ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতি আপনি যে আচরণ করছেন সে বিষয়ে এমনকি (দৈনিক) ওয়াশিংটন পোস্টও যে লিখেছে সেটা আপনি দেখেছেন। আমি ভাবলাম আপনাকে জানানো উচিত এ জন্য ওয়াশিংটনে আমরা কতটা ক্ষুব্ধ হয়েছি। আমি ব্যক্তিগতভাবে ক্ষুব্ধ হয়েছি, কারণ নোবেল প্রাইজ পাওয়ার অনেক আগেই ক্লিনটন পরিবারের পারিবারিক বন্ধু ছিলেন ড. ইউনূস। আমার মতোই প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনও দু:খ পেয়েছেন। আশা করি আপনি জানেন, ড. ইউনূস যেন এই পুরস্কারটি পান সেজন্য তিনি কত খেটেছেন। আমি জানি, মানুষের কিছু ব্যক্তিগত ইসু থাকতে পারে। কিন্তু ড. ইউনূসের বিষয়টা জাতীয়। তিনি একজন জাতীয় ব্যক্তিত্ব। আমি মনে করি, দেশের একমাত্র নোবেল লরিয়েটকে শয়তান রূপে চিহ্নিত করা (Demonize) বাংলাদেশের উচিত নয়।’ হিলারির কথা এই পর্যায়ে হাসিনা থামিয়ে দিতে চাইলে হিলারি বলেন, “আগে আমার কথা শেষ করতে দিন। আশা করি, আপনি জানেন প্রেসিডেন্ট ওবামা ক্ষুদ্রঋণ (মাইক্রো ক্রেডিট)-এর একজন বড় গুণগ্রাহী। প্রেসিডেন্ট ওবামার মা যখন মাইক্রো-ফাইনান্সের ওপর থিসিস লেখেন, তখন থেকেই তিনি এর গুণগ্রাহী। তাই আমি আপনাকে এই ফোন কল দিয়ে জানাতে চাইছি, ড. ইউনূসকে শয়তান রূপে চিত্রিত করার (Demonize) আপনার অব্যাহত প্রচেষ্টায় আমি এবং আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ওবামা উভয়েই কতটা ক্ষুব্ধ হয়েছি।” হাসিনা তখন আত্মরক্ষার জন্য বলেন, “আমরা তো এই ইসুটা তুলিনি। আশা করি আপনি জানেন এই ইসুটা প্রথম তুলেছিল নরওয়ে। তারা অভিযোগ করেছিল ড. ইউনূস ফান্ড অন্যত্র সরিয়ে ফেলেছেন। তা ছাড়া, এটা আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং আমাদের নিয়মনীতি অনুযায়ী এর সুরাহা আমরা করব।” মন্তব্য : ড. ইউনূসের নোবেল প্রাইজ প্রাপ্তির অনেক আগেই ক্লিনটন পরিবারের সঙ্গে যে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল সেটা সবাই জানেন। বিল ক্লিনটন যে ড. ইউনূসের নোবেল প্রাইজ প্রাপ্তির বিষয়ে কাজ করেছিলেন সেটাও কেউ কেউ অনুমান করেছিলেন। নতুন যেটা জানা গেল সেটা হচ্ছে, বর্তমান প্রেসিডেন্ট ওবামার মা-ও ক্ষুদ্রঋণ বিষয়ে থিসিস লিখেছিলেন এবং তখন থেকে ওবামা-ও হয়েছেন ড. ইউনূসের ফ্যান। লক্ষণীয় যে, ড. ইউনূসকে হয়রানির বিষয়ে হাসিনা দায়ী করেছেন নরওয়ের উদ্যোগকে। কিন্তু বলেননি যে, নরওয়ে এ বিষয়ে আগেই তদন্ত করে নির্দোষ জেনে তারপর ড. ইউনূসকে নোবেল প্রাইজ দিয়েছে। শেখ হাসিনা বলেননি নরওয়ের টেলিভিশনে একটি ডকুমেন্টারি মুভিতে মূলত ক্ষুদ্রঋণের তাত্ত্বিক দিকটির সমালোচনা করে বলা হয়েছিল যে, এতে গরিবদের উপকার হয় না। ওই ডকুমেন্টারির মূল সমালোচনা ছিল ক্ষুদ্রঋণের উপকারিতা বিষয়ে ড. ইউনূসের ফান্ড ট্রান্সফার বিষয়ে নয়। কিন্তু এসব তথ্য হাসিনা চেপে গেলেও হিলারি ঠিকই জানতেন। সাত. তাই এরপর হিলারি বলতে বাধ্য হন, “আমি ভেবেছিলাম আমাকে এত দূর যেতে হবে না। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য, আমি ভুল ভেবেছিলাম। আপনি জানেন এবং আমরাও জানি কিভাবে আপনার সরকার ক্ষমতায় এসেছে। ভুলে যাবেন না, নির্বাচনের পর আমরা বলেছিলাম, সেটা অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে এবং আপনাকে সাহায্য করেছিলাম। প্রধানমন্ত্রী, আপনি জানেন দিল্লিতে আমাদের বন্ধুদের নির্দেশে কিভাবে ফলাফল আগেই ঠিক করা হয়েছিল। তারা যেভাবে চেয়েছিল সেভাবেই আমরা চলেছিলাম। প্লিজ, আপনি এটাও ভুলে যাবেন না যে, জেনারেল মইন যিনি আপনাকে ক্ষমতায় এনেছিলেন তিনি এখন আমেরিকাতে আছেন এবং আপনি যতখানি কল্পনা করতে পারেন, তার চেয়েও বেশি এখন আমরা জানি। আমি বলছি না যে, আমরা এখনই আপনার কাছ থেকে দূরে সরে যাব। আমি শুধু ঐতিহাসিকভাবে বিভিন্ন ইসু তুলে ধরছি।” হিলারির এই কড়া কথায় হাসিনা দ্রুত প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, “আমরা আপনার সমর্থন ও সাহায্যবিষয়ে জানি। আপনাকে খুশি রাখার চেষ্টা করব। দুশ্চিন্তা করবেন না। আপনার কথাগুলো মনে রাখব। এখন বলুন, কবে আমাদের দেশ সফর করতে আসবেন?” প্রতি উত্তরে হিলারি শুধু বলেন, “আমন্ত্রণের জন্য ধন্যবাদ। আপনি যে সময় দিলেন সেজন্য ধন্যবাদ।” এরপর হাসিনা বলতে থাকেন, “প্লিজ প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনকে, আপনার মেয়েকে, জামাইকেও সঙ্গে নিয়ে আসবেন।” ততক্ষণে হিলারি ফোন ছেড়ে দিয়েছেন। মন্তব্য : জেনারেল মইন ও ইনডিয়ার সাহায্য ও সমর্থনে আওয়ামী লীগ যে গত নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিল সেটা তখন অনেকেই বুঝেছিলেন। তবে জানা ছিল না, এর পেছনে আমেরিকার সমর্থন কতখানি। হিলারি-হাসিনার এই টেলিটক থেকে বেরিয়ে আসা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দুটি হচ্ছে : এক. নির্বাচনের ফল আগেই ঠিক করা ছিল এবং দুই. তাতে আমেরিকান সমর্থন ছিল। তাহলে এই ছিল হিলারিলিকের সারাংশ। যারা বলছেন এটি নির্ভরযোগ্য নয়, তাদের প্রধান দুটি যুক্তি হচ্ছে এই তথ্যের সোর্স বা সূত্রটির পূর্ণ পরিচয় নেই এবং হিলারির ভাষা আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মানানসই নয়। প্রথমে বিবেচনা করা যাক সোর্সটি। ফেইসবুকে রবিবার ১৬ জানুয়ারি ২০১১-তে সকাল ১০.২৮ মিনিট বা সাড়ে দশটায়। এটি প্রকাশ করে হিডেন ট্রুথ (Hidden Truth) বা গোপন সত্য। বলা বাহুল্য, এটি প্রকাশকের ছদ্ম নাম। বোধগম্য কারণেই এই প্রকাশক উইকিলিকসের জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের মতো কোনো ঝুঁকি নিতে চান না। তাই ছদ্মনাম ব্যবহার করেছেন। এটি প্রকাশের তারিখ ও সময়টি বিবেচনা করুন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ শনিবার ১৫ জানুয়ারিতে জানান, সেদিন বাংলাদেশ টাইম সকাল সাড়ে ন’টায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন টেলিফোন করেছিলেন। তখন ওয়াশিংটনে সময় ছিল শুক্রবার ১৪ জানুয়ারি রাত সাড়ে দশটা। এরপর রবিবার ১৬ জানুয়ারি ওয়াশিংটন ডিসি টাইম সকাল সাড়ে দশটায় ফেইসবুকে এই টেলি-কথার ট্রান্সকৃপ্ট প্রকাশিত হয়। অর্থাৎ, ওয়াশিংটন থেকে ফোন কল করার ঠিক ৩৬ ঘন্টা পরে। ধারণা করা হচ্ছে, এই ৩৬ ঘন্টার মধ্যে স্টেট ডিপার্টমেন্ট জেনে যায় হিলারির বক্তব্যকে সম্পূর্ণ বিপরীতভাবে হাসিনার প্রেস সচিব বর্ণনা করেছেন। রোববার ১৬ জানুয়ারিতে বাংলাদেশের বিভিন্ন দৈনিকে এই ফোনালাপের খবর প্রকাশিত হয় এবং তাতে বলা হয় ভূয়সী প্রশংসার পাশাপাশি বিভিন্ন ইসুতে বাংলাদেশ ও আমেরিকা একযোগে কাজ করার অঙ্গীকার জানিয়েছেন হিলারি। সত্যের এই নির্লজ্জ অপলাপে ক্ষুব্ধ, ওয়াশিংটনে অবস্খানকারী কোনো আমেরিকান তখন ছদ্মনামে ফেইসবুকে জানিয়ে দেন প্রকৃত টেলিটক কি ছিল। আর যারা হিলারির ভাষাগত দিকটির সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছেন, তাদের জানাতে চাই, এই টেলিকথায় হিলারির বক্তব্যের কয়েকটি শব্দ যেমন অ্যাবসলিউটলি, অনেস্টলি, কনডুইট (conduit), ডিমনাইজ (Demonize), লেট মি কাম টু দি কোর পয়েন্ট (Let me come to the core point), প্রভৃতি মিলে যায় তার আগের অন্যান্য কথাবার্তায়। প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনকে তিনি মিস্টার বলেননি, প্রেসিডেন্ট বলেছেন। কারণ, আমেরিকায় নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট রিটায়ার করলেও আমৃত্যু প্রেসিডেন্ট পদবি ব্যবহার করতে পারেন। হিলারি এটা জানেন। হিলারি এটাও জানেন যে, প্রেসিডেন্ট ওবামার মা ক্ষুদ্রঋণ বিষয়ে থিসিস লিখেছিলেন। কোনো কল্পনাশ্রয়ী টেলি-সংলাপ লেখকের পক্ষে এতটা জানা সম্ভব না-ও হতে পারে। হাসিনার ভাষা তার একান্ত নিজস্ব, যেটা বোঝা যায় পুনরুক্তিতে। যেমন আই আন্ডারস্ট্যান্ড আই আন্ডারস্ট্যান্ড, থ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ, প্লিজ লিসেন প্লিজ লিসেন ইত্যাদিতে। যুদ্ধ অপরাধীদের বিচার ও ইনডিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক প্রভৃতি ইসুতে সাধারণ মানুষ যা জানত তারই কনফার্মেশন পাওয়া গেছে এই টেলি-কথায়। সুতরাং এটি গ্রহণযোগ্য হতে বাধা কোথায়? নতুন শুধু যেটা জানা গেছে সেটা হলো, গত নির্বাচনটা ছিল সাজানো। এবং ইনডিয়ার এই প্ল্যানে সমর্থন ছিল আমেরিকার। এই তথ্যেও আশ্চর্য হবার কিছু আছে কি? এটাও সত্য রূপে অনেকে মনে করেন। তারা বলেন, এ জন্যই নভেম্বরে ২০০৮-এ আমেরিকা থেকে বাংলাদেশে ফিরে ডিসেম্বরে শেখ হাসিনা নির্বাচনে অংশ নেন। নির্বাচনী অভিযানের জন্য এত অল্প সময় পাওয়ায় তার দুশ্চিন্তা ছিল না। যখন ডিসেম্বর মাসে দুই সপ্তাহে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া ১০,০০০ কিলোমিটার পথ চষে দিনে ও রাতে নির্বাচনী অভিযান চালিয়েছেন, তখন শেখ হাসিনা ঢাকায় বসে ভিডিও কনফারেন্স করেছেন। তার কোনো নির্বাচনী অভিযানের প্রয়োজন ছিল না। কারণ তিনি জানতেন, তিনিই বিজয়ী হবেন। যারা দাবি করছেন, হিলারিলিক সত্য তাদের একটি যুক্তি হচ্ছে, এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে আমেরিকার পররাষ্ট্র দফতর কোনো প্রতিবাদ জানায়নি। হিলারিলিক যদি সত্যি হয়, তাহলে বলতেই হবে ‘ডিসেম্বর ২০০৮-এর নির্বাচনে গণতন্ত্র পুনরুজ্জীবিত হয়নি চক্রান্ত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।” সে ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা কি ছিল? উত্তরটা দেয়ার আগে, আর্ট বুখওয়াল্ড প্রসঙ্গে আমি ফিরে যাব। ১৭ জানুয়ারি ২০০৭-এ কিডনি ফেইলিওরে ৮১ বছর বয়সে আর্ট বুখওয়াল্ডের মৃত্যু হয়। মৃত্যুর আগে তিনি তার নিজের একটি ভিডিও অবিচুয়ারি (Obituary) তৈরি করে যান। তার মৃত্যুর পরদিন দি নিউ ইয়র্ক টাইমস তাদের ওয়েবসাইটে এই ভিডিও অবিচুয়ারি প্রকাশ করে। এতে আর্ট বুখওয়াল্ড নিজেই বলেন, Hi, I'm Art Buchwald, I just died. (হাই, আমি আর্ট বুখওয়াল্ড। আমি এই মাত্র মারা গিয়েছি)। হিলারিলিক প্রকাশিত হবার পরে নির্বাচন কমিশন বলতে পারে, Hi, we're Election Commission. We just died. (হাই আমরা ইলেকশন কমিশন। আমরা এই মাত্র মারা গিয়েছি)। কিন্তু আর্ট বুখওয়াল্ডের মতো সততা ও রসবোধ কি নির্বাচন কমিশনের আছে? [সূত্রঃ নয়া দিগন্ত. ০২/০২/১১] | |
Wednesday, 23 February 2011
উইকিলিকস থেকে হিলারিলিক
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment