মাহাবুবুর রহমান
নোবেলবিজয়ী ভারতীয় অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. অমর্ত্য সেন তার ‘আরগুমেন্টেটিভ ইন্ডিয়ান’ বইয়ে কোরআন ও হাদিস নির্দেশিত ইসলামকে প্রত্যাখ্যান করতে মুসলমানদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। এগুলো হাজার বছরেরও বেশি পুরনো হওয়ায় তা পরিত্যাগ করে হিন্দু ধর্ম থেকে উদ্ভব সম্রাট আকবরের ‘দ্বীন-ই-ইলাহি’কে মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করার পরামর্শ দেন তিনি। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের (সেক্যুলারিজম) ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি এ মত দেন।
অন্যদিকে সেক্যুলারিজমকে হিন্দু ধর্ম থেকে উদ্ভব বলে যুক্তি দেন তিনি। তার মতে, হিন্দু ধর্ম কোনোভাবেই ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ-বিরোধী নয়। কেউ ধর্মনিরপেক্ষতাকে বিশ্বাস করলে তাকে ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করতে হবে। আর বিশ্বাসী হয়ে উঠতে হবে হিন্দু ধর্মের প্রথায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. হাসানুজ্জামান চৌধুরী ‘আরগুমেন্টেটিভ ইন্ডিয়ান’ বইয়ের সমালোচনা করে ‘বাংলাদেশ পলিটিক্যাল সায়েন্স রিভিউ’ নামের গবেষণা জার্নালে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ প্রকাশিত ওই জার্নালের ৭ম সংখ্যায় এটি প্রকাশিত হয়েছে। অধ্যাপক ড. শওকত আরা হোসেন সম্পাদিত গবেষণা জার্নালে ওই প্রবেন্ধের শিরোনাম হলো ‘অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন ও দৈশিক দোষের আবর্তে ভারতীয় সেক্যুলারিজম : বিভ্রান্তিকর একটি ব্যাখ্যা’।
অধ্যাপক ড. হাসানুজ্জামান চৌধুরী লিখেছেন, ‘নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. অমর্ত্য সেনের মতামত দৈশিক দোষে দুষ্ট। সেক্যুলারিজম মূলতই একটি অগ্রহণীয় মতবাদ। ধর্ম ও সেক্যুলারিজম পারস্পরিক বিপরীত মত। ইসলাম ধর্ম নিয়ে তিনি যে মত দিয়েছেন, তা সর্বতোভাবে বিভ্রান্তিকর। আর সেক্যুলারিজম যদি হিন্দু ধর্ম থেকে উদ্ভবই হয়, তাহলে তা প্রকৃত ধর্মমত বাদ দিয়ে মুসলমানরা গ্রহণ করতে পারেন না।’
ড. হাসানুজ্জামান চৌধুরী তার প্রবন্ধের শুরুতে নোবেলবিজয়ী ড. অমর্ত্য সেনের ১১টি বইয়ের বিষয়বস্তু প্রশংসা করেন। অসমতা, দারিদ্র্য, দুর্ভিক্ষ, সক্ষমতা ও উন্নয়ন সম্পর্কিত ড. সেনের বইগুলো পাঠকপ্রিয় ও অগ্রগতির জন্য সহায়ক বলে মনে করেন তিনি। তবে ভারতীয় ইতিহাস, সংস্কৃতি ও পরিচয় নিয়ে লেখা অমর্ত্য সেনের ‘আরগুমেন্টেটিভ ইন্ডিয়ান’ বইটি একদেশদর্শিতা ও সাম্প্রদায়িক দোষে দুষ্ট হওয়ার কারণে সমালোচনার যোগ্য বলে ড. চৌধুরী মনে করেন। তিনি বলেন, বাইরে খাঁটি মনে হলেও অমর্ত্য সেন প্রকৃতপক্ষে হিন্দুত্ববাদের বশ্যতা স্বীকার করেই এ বইটি লিখেছেন।
ড. হাসানুজ্জামান চৌধুরী বলেন, আমি বইটির পুরোটা পড়েছি। তার লেখা থেকে নানা প্রশ্ন জেগে ওঠায় সমালোচনা লিখতে বাধ্য হয়েছি।
বইটির প্রথমাংশে ড. অমর্ত্য সেন ভারতের প্রাচীন ইতিহাস ও সমকালীন প্রসঙ্গ তুলে ধরেন। এতে তিনি বলতে চেষ্টা করেছেন, ধর্মের বিভিন্নতায় সাহিত্য, রাজনীতি, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ও গণিতের উন্নতির পথ ধরে ভারতীয় সেক্যুলারিজমের উত্পত্তি হয়েছে। ভারতীয় গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও সেক্যুলারিজম মূলতই হিন্দু ধর্মের ধারাবাহিক বিবর্তনে হয়েছে। মুসলমানদের মুঘল ও পাঠান শাসনও এক্ষেত্রে প্রভাবিত করেছে। বিশেষ করে সম্রাট আকবরের ‘দ্বীন-ই-ইলাহী’ ভারতীয় ঐতিহ্য ও সেক্যুলারিজমকে গড়ে উঠতে সহায়তা করেছে।
গবেষণা প্রবন্ধের উপসংহারে ড. হাসানুজ্জামান চৌধুরী বলেন, নোবেলবিজয়ী অমর্ত্য সেন একজন সম্মানিত ও জ্ঞানী ব্যক্তি হলেও তিনি ইসলাম ধর্ম নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন। পৃথিবীর যে কোনো ধর্মপ্রাণ মুসলমান এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবেন। ড. হাসানুজ্জামান বলেন : ‘Islam can be accepted when Amartya’s prescriptions of destroying Islam by disobeying Allah and Rasul (SM) are carried out. Quraan and Sunnah should be rejected (nauzbillah), with the excuse that they are traditions of the past of more than 1000 years. ...Amartya in his ‘The Argumentative Indian’ has repeatedly mentioned that (Islamic and Muslim) tradition should be rejected and ‘rahi aqbal’ theory given by Emperor Akbar should be accepted as the main principle. He has even gone to the extent of saying that this demon tradition should and must be fought and rejected by the society.’ অর্থাত্, ‘অমর্ত্যের মতামত অনুযায়ী আল্লাহ ও রাসুল (সা.)-এর নির্দেশিত পথকে প্রত্যাখ্যান করার মাধ্যমে যে ‘ইসলাম’ আসবে সেটাকে গ্রহণ করা যেতে পারে। হাজার বছরেরও বেশি পুরনো মতাদর্শ হওয়ায় কোরআন ও সুন্নাহ বর্জন করা উচিত (নাউজুবিল্লাহ)। ...অমর্ত্য তার ‘আরগুমেন্টেটিভ ইন্ডিয়ান’-এ বলেছেন, ইসলামের মৌলিক আদর্শ হিসেবে পুরনো মতাদর্শ (ইসলাম ও মুসলিম) বর্জন করে সম্রাট আকবরের ‘রাহি আকবল’কে গ্রহণ করা উচিত। তিনি আরও এক ধাপ এগিয়ে বলেন, সমাজের অবশ্যই উচিত এই দানবীয় ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া ও প্রত্যাখ্যান করা।’
ড. হাসানুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ‘ড. অমর্ত্য সেন ধর্মনিরপেক্ষতাবাদকে হিন্দুত্ববাদ হিসেবে দেখিয়েছেন। এমনকি দেখিয়েছেন, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ অর্থ হলো ইসলাম ত্যাগ করা এবং প্রকৃতপক্ষে হিন্দুত্ববাদকে গ্রহণ করা। কেননা হিন্দুত্ববাদ যে কোনো ধর্মের চেয়ে প্রচলিত মতের বিরোধিতার কারণে শ্রেষ্ঠ।’ (বাংলাদেশ পলিটিক্যাল সায়েন্স রিভিউ, পৃষ্ঠা-৪৪) ড. অমর্ত্য সেন ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ হিন্দুধর্ম থেকে উদ্ভব বলে চিত্রায়িত করেছেন। এ বিষয়ে ড. হাসানুজ্জামান চৌধুরী বলেন : ্তুঅসধত্ঃুধ নড়ধংঃং ংবপঁষধত্রংস, নঁঃ ধষষ রঃং ত্ড়ড়ঃং ধত্ব ঁষঃরসধঃবষু ফরংপড়াবত্বফ নু যরস ভত্ড়স ঐরহফঁ ঢ়যরষড়ংড়ঢ়যু, ঐরহফঁ ত্বষরমরড়হ ধহফ ঐরহফঁরংস.্থ অর্থাত্, অমর্ত্য ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের দম্ভোক্তি করেছেন, কিন্তু এর মূল হিসেবে তিনি হিন্দু দর্শন, হিন্দু ধর্ম ও হিন্দুত্ববাদকে আবিষ্কার করেছেন।’ (বাংলাদেশ পলিটিক্যাল সায়েন্স রিভিউ, পৃষ্ঠা-২৮)
আবার, আকবরের পরিচালিত মুসলিম শাসনের অনেকটা হিন্দু ধর্মের দ্বারা প্রভাবিত বলে মনে করেন ড. অমর্ত্য সেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন : ‘Akbar not only made unequivocal pronouncements on the priority of tolerance, but also laid the formal foundations of a secular legal structure and of religious neutrality of the state. ...Despite his deep interest in other religions and his brief attempt to launch a new religion, Din-ilahi (God’s religion), based on a combination of good points chosen from different faiths, Akbar did remain a good Muslim himself.’ অর্থাত্, আকবর কেবল ধৈর্যের প্রাধান্যের দ্ব্যর্থহীন ঘোষণাই দেননি, তিনি রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে ধর্মের নিরপেক্ষতা ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের আনুষ্ঠানিক ভিত্তিও রচনা করেন। ...অন্য ধর্ম সম্পর্কে গভীর আগ্রহ এবং সংক্ষিপ্ত উদ্যোগে তিনি বিভিন্ন বিশ্বাসের (ধর্ম) ভালো দিকগুলো সমন্বয় করে নতুন ধর্ম দ্বীন-ইলাহীর (ঈশ্বরের ধর্ম) উদ্ভাবন করেন। আর এভাবে আকবর একজন ভালো মুসলমান হয়ে থাকেন। (আরগুমেন্টেটিভ ইন্ডিয়ান, পৃষ্ঠা-১৮)
ইসলামের প্রকৃত বিশ্বাসের (কোরআন-সুন্নাহ) নীতিমালা সময়ের বিবর্তনে যৌক্তিক পর্যালোচনায় পরিবর্তন করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন ড. অমর্ত্য সেন। আর এক্ষেত্রে সম্রাট আকবরের একটি মন্তব্য উদ্ধৃত করেন তিনি : ‘The pursuit of reason and rejection of traditionalism are so brilliantly patent as to be above the need of argument. If traditionalism were proper, the prophets would merely have followed their own elders (and not come with new messages).’ অর্থাত্, যৌক্তিকভাবেই যুক্তির অনুসরণ এবং ঐতিহ্যের প্রত্যাখ্যান সাহসিকতার (মেধার) সঙ্গে উন্মুক্ত করা দরকার। ঐতিহ্য যদি সঠিক হতোই, তবে নবীরা শুধুই তাদের পূর্ববর্তীদের অনুসরণ করতেন (এবং তারা নতুন বার্তা নিয়ে আসতেন না)।
এ উদ্ধৃতি দেয়ার পর ড. অমর্ত্য সেন বলেন : ‘Reason had to be supreme, since even in disputing the validity of reason we have to give reasons.’ অর্থাত্, যুক্তিকেই প্রধান হতে হবে, যুক্তির বৈধতা নিয়ে বিতর্ক থাকলে সেক্ষেত্রে আমাদের অধিকতর যুক্তি দিতে হবে।’
বইয়ের দ্বিতীয় অংশে ভারতীয় সেক্যুলারিজমের দীর্ঘ ইতিহাস তুলে ধরা হয়। এতে তিনি সেক্যুলারিজমকে তার নিজের ধর্মের (হিন্দু ধর্ম) সন্তান হিসেবে চিত্রায়িত করেন।
ড. অমর্ত্য সেনের মতে, সেক্যুলারিজম হিন্দু ধর্ম থেকে এসেছে। সম্রাট আকবর ভারতীয় সেক্যুলারিজমের অগ্রগতিতে সহায়তা করেছেন। আর সেক্ষেত্রে তিনিও হিন্দু ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত। তবে সম্রাট আওরঙ্গজেব ইসলামী বিধি অনুযায়ী শাসন পরিচালনা করায় ড. অমর্ত্য সেনের সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছেন। অমর্ত্য সেন মনে করেন, মুসলিম আর ইসলাম হলো সাম্প্রদায়িক। নিজেকে অজ্ঞেয়বাদী হিসেবে পরিচয় দিলেও তার বইয়ে তিনি হিন্দুদের তেত্রিশ কোটি ঈশ্বরের অস্তিত্বের বিষয়টি স্বীকার করেছেন।
গীতা ও ঋৃক বেদে তর্কপ্রিয় ঐতিহ্যের প্রাধান্য রয়েছে। যুক্তি, তর্ক, গণতান্ত্রিক ধারা হিন্দু ধর্মের আদর্শ। আর এ থেকেই ভারতে আধুনিক গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে বলে অমর্ত্যের ধারণা।
কিন্তু হিন্দু ধর্মে প্রচলিত বহু দেবতার জড়ীয় অস্তিত্ব এবং নিজেদের হাতে বানানো দেবতাকে পূজা করার পেছনে বৈজ্ঞানিক কোনো যুক্তি উপস্থাপন করা যায় না। একজন নোবেলজয়ী জ্ঞানী ব্যক্তি হয়েও অমর্ত্য সেন হিন্দু ধর্মের এই অসারতার বিষয়টি অনুধাবন করেননি। বরং সেক্যুলারিজমসহ অন্য ধর্মগুলোকেও তিনি হিন্দু ধর্মের মধ্যে গুলিয়ে ফেলার অভিপ্রায়ে লিপ্ত হন।
সমালোচনায় ড. হাসানুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ড. অমর্ত্য সেন সেক্যুলারিজমে বিশ্বাসী হওয়ার কথা বললেও নিজের হিন্দু ধর্মকে তিনি ত্যাগ করতে চাইছেন না। এমনকি সেক্যুলারিজমের মূল সংজ্ঞা অনুযায়ী সব ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে সম-দূরত্ব ও সম-মর্যাদা প্রদানের বিষয়টিও তার বইয়ে বিবেচিত হয়নি। হিন্দু ধর্মকে উলঙ্গভাবে সমর্থন করা হয়েছে। একদিকে তিনি হিন্দু ধর্মকে ইতিবাচকভাবে সমর্থন করেছেন, আবার ইসলাম ধর্মকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। ধর্মীয় ঐতিহ্যের আলোচনায় হিন্দু ধর্ম থেকে আগত প্রথাকে তিনি শতভাগ গ্রহণীয় এবং ইসলাম ধর্ম থেকে আগত প্রথাকে আইনত অকার্যকর বলে চিহ্নিত করেছেন।
আরগুমেন্টেটিভ ইন্ডিয়ান বইয়ের ২১ পৃষ্ঠায় নোবেলবিজয়ী ড. অমর্ত্য সেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সমাবর্তনে সব ধর্মের পবিত্র গ্রন্থ থেকে তেলাওয়াত করার সমালোচনা করেন। এমনকি তিনি এতে ‘আঘাত’ পেয়েছেন বলে উল্লেখ করেছেন। ১৯৯৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সমাবর্তন অনুষ্ঠানে অধ্যাপক ড. অমর্ত্য সেন অতিথি হিসেবে অংশ নিয়েছিলেন। এ অনুষ্ঠানে সব ধর্মগ্রন্থ পাঠ করার মাধ্যমে ‘সেক্যুলার’ দৃষ্টিভঙ্গির প্রমাণ রাখা হয়েছিল। গত ১ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমীর একুশে বইমেলা উদ্বোধনেও ড. অমর্ত্য সেন অতিথি হিসেবে বক্তৃতা করেন। সেখানেও একই ধারায় সব ধর্মগ্রন্থের প্রতি সম্মান জানানো হয়। কিন্তু অমর্ত্য সেনের নিজ দেশ ভারতে সেক্যুলারিজম রাষ্ট্রনীতি হলেও সেখানে কেবল হিন্দু ধর্মগ্রন্থকে অধিকতর গুরুত্ব দেয়ার সমালোচনা করেন ড. হাসানুজ্জামান।
ইসলাম ধর্মে পর্দা প্রথার সমালোচনা করে অধ্যাপক ড. অমর্ত্য সেন তার বইয়ের ২০ পৃষ্ঠায় বলেন, পোশাক পরিধানে নিরপেক্ষতা এবং নিষেধাজ্ঞার দুটি বিষয় আছে। ব্যক্তি ইচ্ছা অনুযায়ী যে কোনো পোশাক পরিধান করতে পারে। আর রাষ্ট্র বা ধর্ম এক্ষেত্রে কোনো নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে না। একথা বলার পরই তিনি ফ্রান্সে বোরকা পরা নিষিদ্ধ করার রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের পক্ষে অবস্থান নেন। মুসলমানদের মাথায় স্কার্ফ (পর্দা) পরাকে তিনি লিঙ্গবৈষম্য হিসেবে অভিহিত করেন।
ড. হাসানুজ্জামান চৌধুরী পর্দাপ্রথা সম্পর্কে ড. অমর্ত্য সেনের মতের সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, কোরআনে পর্দাপ্রথার যে গুরুত্ব বর্ণনা আছে, সে সম্পর্কে তিনি কোনো ধারণা না নিয়েই মিথ্যা যুক্তি উপস্থাপন করেছেন। এক্ষেত্রে তিনি পবিত্র কোরআনের উদ্ধৃতি দেন। সুরাহ আল আহজাবে বলা হয়েছে, ‘হে নবী, আপনার স্ত্রী, কন্যা এবং মুমিন নারীদের বলে দিন, তারা যেন মাথাসহ শরীর ঢেকে রাখে। এটা ভালো হবে যে, তা বিশৃঙ্খলার (ডিস্টার্ব) হাত থেকে রক্ষা পেতে সহায়তা করবে। আল্লাহ সর্বক্ষমাশীল ও করুণাময়।’ ড. হাসানুজ্জামান চৌধুরী এ উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, কোরআনে যেখানে স্বয়ং আল্লাহ ‘পর্দা’ করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন, ড. অমর্ত্য তা প্রত্যাখ্যানের পরামর্শ দেন। এটা নিঃসন্দেহে বিভ্রান্তিকর মন্তব্য।
সেক্যুলারিজম ও প্রকৃত সত্য : ড. অমর্ত্য সেনের ব্যাখ্যার সমালোচনার পাশাপাশি ড. হাসানুজ্জামান চৌধুরী সেক্যুলারিজমের প্রকৃত ধারণা উপস্থাপন করেন। তার মতে, সেক্যুলারিজমের ধারণা মূলত ইউরোপে শুরু হয়। গির্জা ও ধর্মগুরুদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের পথ ধরে হজরত ঈসা (আ.)-এর ধর্ম বিবর্তিত হয়ে খ্রিস্টান ও পরবর্তীকালে সেক্যুলারিজমের ধারণার সৃষ্টি হয়। ধর্ম প্রচারের একপর্যায়ে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে হজরত ঈসা (আ.)-এর অনুপস্থিতিতে তার প্রবর্তিত ধর্মকে ইচ্ছামত পরিবর্তন করেন পল। এ পরিস্থিতিতে ‘ইঞ্জিল’ পরিবর্তিত হয়ে ‘বাইবেল’ তৈরি করা হয়। মুসলমানদের ধর্মকে উপেক্ষা করে মানবরচিত রীতি নিয়ে খ্রিস্টান ধর্ম পরিচালনা শুরু হয়। কলুষিত খ্রিস্টান ধর্মকে মানুষ প্রত্যাখ্যান করে। রোমান ক্যাথলিক ধর্মের বিপরীতে প্রটেস্টান্ট নীতিবিদ্যার আদলে নানা ধর্মমত গড়ে ওঠে। পারস্পরিক দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে এসব গোষ্ঠী। এতে জনজীবনে অশান্তি নেমে আসে। ক্যালভিন, লুথারসহ অনেকে এসব অশান্তি রোধে এগিয়ে আসেন। উইলিয়াম ওকাম, জন সেলিসবারি একটি নতুন আন্দোলন গড়ে তোলেন। ম্যাকাইভেলি রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে বিচ্ছিন্ন করে বিদ্যমান অশান্তি রোধে ভূমিকা রাখেন। সংস্কার ও রেনেসাঁ সংঘটিত হয়। দ্বান্দ্বিক খ্রিস্টান ধর্মের নানারূপ রাষ্ট্র, অর্থনীতি, সমাজ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতিতে বাধা হিসেবে দেখা দেয়।
এ পরিস্থিতিতে ইউরোপে খ্রিস্টান ধর্ম উপেক্ষিত হয় এবং তা কেবল ব্যক্তিগত জীবনেই ব্যবহার করা হতে থাকে। বিবর্তনের এ ধারায় রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ হয়ে ওঠে।
ড. হাসানুজ্জামান চৌধুরী সেক্যুলারিজমকে প্রত্যাখ্যাত মতবাদ হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা করেন। এক্ষেত্রে তিনি কয়েকজন বিজ্ঞানীর গবেষণা ও তত্ত্ব উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, বিজ্ঞান এরই মধ্যে সেক্যুলারিজমকে প্রত্যাখ্যান করেছে; বিগ ব্যাং তত্ত্ব, দেশ-কাল-পদার্থ-শক্তি তত্ত্ব, বিশ্বতাত্ত্বিক তত্ত্বের বিস্তৃত রূপসহ নানা তত্ত্ব আবিষ্কারের মাধ্যমে সর্বশক্তিমান আল্লাহর অস্তিত্ব প্রমাণ করেছে। বিজ্ঞানী পল ডেভিস তার ‘সুপার ফোর্স’ এবং ‘কসমিক ব্লু প্রিন্ট’, পদার্থবিদ হেনস্্্্্ তার ‘প্যাগেলস্্্্্ ইদ কসমিক কোড’ এবং ‘পারফেক্ট সাইমেট্রি’, স্যামুয়েল ভিসকাউন্ট তার ‘বিলিফ অ্যান্ড অ্যাকশন’ গেরাল্ড শ্রয়ডার তার ‘দি হিডেন ফেস অব গড : সায়েন্স রিভিলস্্্্্ ইদ আলটিমেট ট্রুথ’ বইয়ে আল্লাহর অস্তিত্ব প্রমাণ করেছেন এবং ধর্মনিরপেক্ষতাবাদকে প্রত্যাখ্যান করেছেন
।
No comments:
Post a Comment