Saturday 29 January 2011

সিরাজ সিকদার হত্যার পরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিই এখনও চালানো হচ্ছে



আলাউদ্দিন আরিফ

র্যাব-পুলিশের প্রেস বিজ্ঞপ্তি থেকে ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার বা বন্দুকযুদ্ধ নামে বিচারবহির্ভূত হত্যার যে বিবরণ দেয়া হয় তার প্রথমটি পাওয়া গেছে ১৯৭৫ সালের ২ জানুয়ারি। পুলিশের দেয়া ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, ‘পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি’ নামে পরিচিত একটি গুপ্ত চরমপন্থী দলের প্রধান সিরাজুল হক সিকদার ওরফে সিরাজ সিকদারকে পুলিশ ১ জানুয়ারি চট্টগ্রাম থেকে গ্রেফতার করে। একই দিন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে ঢাকা পাঠানো হয়। জিজ্ঞাসাবাদের সময় তিনি স্বীকারোক্তিমূলক এক বিবৃতি দেন। এতে তার পার্টি কর্মীদের কয়েকটি গোপন আস্তানা এবং তাদের বেআইনি অস্ত্র ও গোলাবারুদ রাখার স্থানে পুলিশকে নিয়ে যেতে রাজি হন। সেভাবে ২রা জানুয়ারি রাতে একটি পুলিশ ভ্যানে করে তাকে ওইসব আস্তানার দিকে পুলিশ দল নিয়ে যাওয়ার সময় তিনি সাভারের কাছে ভ্যান থেকে লাফিয়ে পড়ে পালানোর চেষ্টা করেন। তার পলায়ন রোধ করার জন্য পুলিশ দল গুলিবর্ষণ করলে তাত্ক্ষণিক ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। এ ব্যাপারে সাভারে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। ’
‘উল্লেখ যে, সিরাজ সিকদার তার গুপ্ত দলে একদল দুর্বৃত্ত সংগ্রহ করে তাদের সাহায্যে হিংস্র কার্যকলাপ, গুপ্তহত্যা, থানার উপর হামলা, বন অফিস, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ইত্যাদির উপর হামলা, ব্যাংক-হাটবাজার লুট, লঞ্চ-ট্রেনে ডাকাতি, রেললাইন তুলে ফেলার দরুন গুরুতর ট্রেন দুর্ঘটনা, লোকজনের কাছ হইতে জোর করে অর্থ আদায়ের মত কার্যকলাপের মাধ্যমে দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা বিঘ্নিত করে আসছিল।’ এই বিজ্ঞপ্তিরই অনুসরণে এখন তৈরি হচ্ছে র্যাব ও পুলিশের প্রেস বিজ্ঞপ্তি।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০০৫ সালের ৩০ মে পল্লবীতে পুলিশের ক্রসফায়ারে সাইদুল নামে এক সন্ত্রাসী মারা যায়। প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে র্যাব সাজায়, ৩০ মে রাতে সাভারের আমিনবাজার এলাকা থেকে দুই সহযোগীসহ সাইদুলকে গ্রেফতার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে সে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেয়। রাতে তাকে নিয়ে পল্লবীর বিভিন্ন এলাকায় অস্ত্র, মাদক উদ্ধার ও অপর সহযোগীদের অভিযানে নামে। রাত ৩টার সময় পুলিশ পল্লবীর শহীদবাগ কালাপানি এলাকার সাগুপ্তা হাউজিং প্রজেক্টের মাঠের কাছে গেলে সাইদুলকে ছিনিয়ে নেয়ার জন্য তার সহযোগী সন্ত্রাসীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। পুলিশও পাল্টা গুলি করে। গোলাগুলি চলাকালে পালিয়ে যাওয়ার সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই সাইদুল মারা যায়। শীর্ষ সন্ত্রাসী সাইদের নামে জোড়াখুনসহ তিনটি হত্যা মামলা আছে।
একই দিন র্যাব-৩-এর ক্রসফায়ারে সুমন নামে এক যুবক মারা যায়। পরদিন র্যাবের দেয়া বিজ্ঞপ্তিতে ঘটনার বিবরণ ছিল এই রকম—র্যাব-৩-এর একটি দল রামপুরার বনশ্রী প্রজেক্টে কতিপয় সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনার খবরে টহল দিতে আসে। সেখানে এক যুবককে আটক করার পর তার সহযোগীরা র্যাবকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। র্যাবও পাল্টা গুলি করে। উভয়পক্ষের মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ বন্দুকযুদ্ধ হয়। সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যাওয়ার পর ঘটনাস্থলে এক যুবকের লাশ পড়ে থাকতে দেখা য়ায়। পরে খিলগাঁও থানা পুলিশ এসে তার লাশ শনাক্ত করে। ঘটনাস্থল থেকে দুই রাউন্ড গুলিভর্তি একটি রিভলবার উদ্ধার করেছে। সে সবুজবাগ থানার তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী। তারা নামে সবুজবাগ থানায় হত্যা মামলাসহ একাধিক মামলা রয়েছে। সে খিলগাঁও ভূঁইয়াপাড়ার ফজলু হত্যা, গোড়ান শাহী মসজিদের পাশে বেলায়েত নামের এক ব্যক্তিকে জবাই করে হত্যা, গার্মেন্টস শ্রমিক হালিমা ধর্ষণ, স্কুলছাত্রী তামান্নাকে কুপিয়ে জখম, গোড়ান টেম্পু স্ট্যান্ডের ডিশ ব্যবসা দখল এবং চাঁদাবাজিসহ বেশ কিছু অভিযোগ রয়েছে। দীর্ঘ দিন থেকে তার অপকর্ম চলে আসলেও এলাকাবাসী তার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস পায়নি। এ ব্যাপারে খিলগাঁও থানায় একটি মামলা হয়েছে। যদিও ওই সময় সুমনের স্বজনরা দাবি করে, সে স্থানীয় যুবলীগের কর্মী। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে সে ক্রসফায়ারের শিকার হয়েছে।
র্যাব গঠনের পর থেকে বেশ কিছু প্রেস বিজ্ঞপ্তি পর্যালোচনা করে যে চিত্র পাওয়া যায়, তা হচ্ছে—‘আটককৃত ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। তাকে নিয়ে অস্ত্র উদ্ধার ও সহযোগীদের গ্রেফতারের জন্য অভিযানে নামে। এ সময় প্রতিপক্ষের সন্ত্রাসীরা র্যাব বা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি করে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাও পাল্টা গুলি করে। পালানোর সময় আটক ব্যক্তি ক্রসফায়ারে পড়ে মারা গেছেন। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট থানায় মামলা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে এই মামলা রয়েছে .........। তবে মাঝে মাঝে ক্রসফায়ারের স্থলে বন্দুকযুদ্ধ বা এনকাউন্টারের উল্লেখ থাকে। কখনও সন্ত্রাসীকে আগেই ধরার বিষয়টি স্বীকার করা হয়, কখনও করা হয় না। বলা হয়, র্যাব বা পুলিশের দল অভিযানে গেলে সন্ত্রাসীরা গুলি করে। তারাও পাল্টা গুলি করলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সন্ত্রাসীদের বা র্যাবের গুলিতে মৃত্যু হয়েছে বলে প্রচার করা হয়।
স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম ক্রসফায়ার নয়, বরং রাজনৈতিক দলের প্রধান হিসেবে প্রথম বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন সিরাজ সিকদার। কেউ কেউ বলেন, এটাই ছিল সরকার কর্তৃক ঘোষিত প্রথম ক্রসফায়ার। পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নেতা ছিলেন প্রকৌশলী সিরাজুল হক ওরফে সিরাজ সিকদার। ১৯৭৫ সালের ২ জানুয়ারি পুলিশি অভিযানে ক্রসফায়ারে পড়ে নিহত হয়েছিলেন তিনি। সিরাজ সিকদার নিহত হওয়ার পরবর্তী সংখ্যায় ইংরেজি সাপ্তাহিক হলিডে ৩-এর পাতায় আট কলামে হেডলাইন করেছিল দঝরত্ধল ংরশফবত্ শরষষফ রহ ঢ়ড়ষরপব ধপঃরড়হ.্থ
পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টির অস্থায়ী পরিচালনা কমিটির (অপক) সাবেক সম্পাদক কমরেড রইসউদ্দিন আরিফ আমার দেশের সঙ্গে এক সাক্ষাত্কারে বলেন, সিরাজ সিকদার বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার পর তত্কালীন সরকার প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান দম্ভের সঙ্গে বলেছিলেন, ‘কোথায় আজ সেই সিরাজ সিকদার’। তার লেখা ‘আন্ডারগ্রাউন্ড জীবন সমগ্র’ ও ‘রাজনীতি, হত্যা ও বিভ্রান্ত জাতি’ বই দু’টিতে সেই বর্ণনা দিয়েছেন।
রইসউদ্দিন আরিফ বলেন, সিরাজ সিকদারের আগেও তাদের দলসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলের অনেক নেতাকর্মী ক্রসফায়ারে বা পুলিশি হেফাজতে মারা গিয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশ সেগুলো প্রেসনোট বা প্রেসবিজ্ঞপ্তি দিয়ে স্বীকার করেনি। বলা যায়, রাজনৈতিক দলের প্রধান ব্যক্তি হিসেবে সিরাজ সিকদার প্রথম নিহত হয়েছিলেন।
কমরেড রইসউদ্দিন আরিফ আরও বলেন, ’৭২ থেকে ’৭৫ সাল পর্যন্ত রক্ষীবাহিনীসহ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় তাদের দলের নেতাকর্মী খুন হতে থাকে। ওই সময় সর্বহারা দলের লোকজনও বসে ছিল না। তারাও কাউন্টার অ্যাকশনে যান। তার বর্ণনা মতে, ওই সময় রক্ষীবাহিনী ও মুজিববাদীরা তাদের ১০ জন হত্যা করলে সর্বহারা দলের লোকজন রক্ষীবাহিনী বা আওয়ামী লীগের ১০ জন না পারলেও ৫ জনকে হত্যা করেছিল।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ধারাবাহিকতায় সিরাজ সিকদার নিহত হওয়ার ঘটনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, পরবর্তীতে র্যাব বা পুলিশের প্রেসবিজ্ঞপ্তিতে প্রায় একই রকম বিবরণ দেখা যায়। এসব বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে বৈধতা দেয়া হচ্ছে। বলা হয় যে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা আত্মরক্ষার্থে গুলি করে, এতে ক্রসফায়ারে পড়ে সন্ত্রাসীরা মারা পড়ে।
পর্যবেক্ষণে বলা যায়, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার গুলিতে প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোনো না কোনো অঞ্চলে লোকজন মারা যাচ্ছে। প্রায় ঘটনায়ই বলা হয়, সন্ত্রাসীরা র্যাব-পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। কিন্তু এসব গুলিতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজনের মৃত্যু হওয়ার রেকর্ড পাওয়া যায় না। আর এই সূত্র দিয়েই বৈধতা দেয়া হয় বিচারবহির্ভূত হত্যার।
সিরাজ সিকদারের বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হওয়া প্রসঙ্গে বর্তমানে আওয়ামী লীগ নেতা মাহমুদুর রহমান মান্নার লেখা ‘খবরের কাগজ’-এ প্রকাশিত হয়। লেখাটি ২ জানুয়রি ১৯৯৯ সালে দৈনিক ইনকিলাবে পুনঃপ্রকাশিত হয়। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘সিরাজ সিকদার একজন অসাধারণ যোগ্যতাসম্পন্ন সংগঠক ছিলেন। আমি যদ্দূর জানি, এ কথা তার ঘোর সমালোচকরাও স্বীকার করেছেন। সিরাজ সিকদারের মৃত্যুর ঘটনাটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ইতিহাসের একটি বর্বরতম ঘটনা। আমরা মধ্যযুগ কিংবা হিটলার মুসোলিনির আমলে এ ধরনের বর্বরতম ঘটনার নিদর্শন পাই। বুর্জোয়া যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের কথা বলে থাকে আজকাল, এমনকি আমাদের দেশেও, তাতে সিরাজ সিকদার অপরাধ করে থাকলেও তার বিচার পাবার দাবিতো উপেক্ষিত হতে পারে না। সিরাজ সিকদার যে বিচারবঞ্চিত হয়েছিলেন, সরকারি প্রেসনোটে তখন যা উল্লেখ করা হয়েছিল (জিপ থেকে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার গুলিতে তিনি নিহত হন), তা যে বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না সে কথা যারা এ প্রেসনোট দিয়েছিলেন তারাও স্বীকার করবেন। আর সবচেয়ে ন্যক্কারজনক হলো, তত্কালীন সংসদে প্রধানমন্ত্রীর উল্লসিত আস্ফাালন— কোথায় আজ সিরাজ সিকদার?’
লেখক আহমদ শরীফ ‘সেই গ্লানিবোধ কাঁটার মতো বুকে বেঁধে’ শীর্ষক লেখায় বলেন, .. ‘এ মানবতাবাদী সাম্যবাদী নেতাকে হাতে পেয়ে যেদিন প্রচণ্ড প্রতাপে শঙ্কিত সরকার বিনা বিচারে খুন করলো সেদিন ভীতসন্ত্রস্ত আমরা আহা শব্দটিও উচ্চারণ করতে সাহস পাইনি। সেই গ্লানিবোধ এখনো কাঁটার মতো বুকে বিঁধে।

No comments:

Post a Comment