Wednesday 25 August 2010

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বোরকা পরতে বাধ্য করা যাবে না

Shamokal | ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ ভাদ্র ১৪১৭, ১৫ রমজান ১৪৩১, ২৬ আগস্ট ২০১০

সমকাল প্রতিবেদক
সরকারি অথবা বেসরকারি কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রীদের বোরকা পরতে বাধ্য করা ও খেলাধুলা-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে বাধা দেওয়া যাবে না। কোনো প্রতিষ্ঠানে বোরকা না পরার কারণে কোনো ছাত্রীকে নির্যাতন, হয়রানি ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে তা সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের অসদাচরণ বলে গণ্য হবে। একই সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কাজকর্মে অংশগ্রহণে বাধা দেওয়া যাবে না। গতকাল বুধবার শিক্ষা সচিব স্বাক্ষরিত এক পরিপত্রে এ আদেশ জারি করা হয়।
সরকারের এ পদক্ষেপ গ্রহণের কারণ সম্পর্কে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ গতকাল সমকালকে বলেন, 'প্রথমত হাইকোর্টের একটি আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ওই আদেশে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে একটি পক্ষভুক্ত
করে ব্যবস্থা নিতে আদেশ দেওয়া হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, এ রায়ের সঙ্গে সরকার সম্পূর্ণ একমত। আমরা মনে করি, প্রত্যেকেরই ব্যক্তিস্বাধীনতা আছে। কেউ কাউকে জোর করে কোনো পোশাক পরিধান করতে বাধ্য করতে পারে না।'
পরিপত্রে আরও বলা হয়, 'সরকারি-বেসরকারি কোনো কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত ছাত্রীদের ধর্মীয় পোশাক পরতে বাধ্য করা হচ্ছে এবং তাদের খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কাজকর্মে অংশ নিতে বাধা দেওয়া হচ্ছে মর্মে সম্প্রতি কয়েকটি পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ছাত্রীদের সুশিক্ষা ও মেধা বিকাশের জন্য ধর্মীয় পোশাক পরতে বাধ্য করা এবং খেলাধুলা
ও সাংস্কৃতিক কাজকর্মে অংশগ্রহণে বাধা দেওয়া কোনোক্রমেই কাম্য নয়। এমতাবস্থায় বাংলাদেশ সংবিধানের ২৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী মানবাধিকার সংরক্ষণের লক্ষ্যে এসব নির্দেশনা জারি করা হলো।' সরকারের এ নির্দেশনা ভঙ্গের অভিযোগ পাওয়া গেলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা অধিদফতর ও শিক্ষা বোর্ড তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে বলে পরিপত্রে উল্লেখ করা হয়।
শিক্ষা সচিব সৈয়দ আতাউর রহমান জানান, গতকালের এ পরিপত্রের মাধ্যমে সংবিধানের ২৮ অনুচ্ছেদে বর্ণিত মানবাধিকার সংরক্ষণের প্রচেষ্টা থেকে মূলত চার দফা নির্দেশনার কথা বলা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে_ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোনো ছাত্রীকে বোরকা অথবা ধর্মীয় পোশাক পরতে বাধ্য করা যাবে না। ছাত্রীদের খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকা করতে বাধা দেওয়া যাবে না। বোরকা না পরলে কোনো ছাত্রীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না এবং বোরকা ও ধর্মীয় পোশাক পরতে বাধ্য করা হলে তা অসদাচরণ বলে গণ্য হবে।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বিশেষ করে ছাত্রীদের ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে বলেন, 'খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড মানুষের সৃজনশীলতা, সৃষ্টিশীলতা ও মনুষ্যত্বকে বিকশিত করে। তাই এর চর্চা যে কোনো মূল্যে বজায় রাখতে হবে।'
মাদ্রাসার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে : শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আইন সেল থেকে জারি করা এ পরিপত্র সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রযোজ্য হবে। পরিপত্রে বলা হয়েছে, 'শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রীদের বোরকা বা ধর্মীয় পোশাক পরতে বাধ্য করা যাবে না।' আইন সেলের একজন কর্মকর্তা জানান, এখানে নির্দিষ্ট কোনো ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কথা বলা হয়নি বরং সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কথা বোঝানো হয়েছে। সে হিসাবে মাদ্রাসাগুলোও জোর করে কোনো ছাত্রীকে বোরকা পরাতে পারবে না। তবে স্বেচ্ছায় যার খুশি তিনি বোরকা পরতে পারবেন।
জানা গেছে, দেশে তিনটি বড় আলিয়া মাদ্রাসা (ঢাকা, বগুড়া ও সিলেট) ও ৯৩ হাজার কওমি মাদ্রাসা রয়েছে। এছাড়া দাখিল মাদ্রাসা (এসএসসি স্তর) ৬ হাজার ৮০টি, আলিম (এইচএসসি স্তর) মাদ্রাসা এক হাজার ১০০টি, ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসা ৮৮৫টি এবং কামিল (স্নাতকোত্তর) মাদ্রাসা রয়েছে ১৭৫টি। এসব মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করা নারী ও ছাত্রীদের প্রায় সবাই বোরকা পরিধান করেন। এসব প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এটিই রেওয়াজ। এছাড়া একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের পরিচালিত বেশকিছু স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় বোরকা পরা বাধ্যতামূলক করা হয় বলেও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে অভিযোগ রয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গতকালের পরিপত্র সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষক সমিতির চেয়ারম্যান মাওলানা আবদুল লতিফ সমকালকে বলেন, 'পর্দা করা ইসলামে ফরজ। এ ব্যাপারে কারও কোনো আদেশ প্রদান বা হস্তক্ষেপ অনভিপ্রেত ও অনৈতিক।' মাদ্রাসা শিক্ষকরা আদালতের নির্দেশ মানতে বাধ্য। তবে মাদ্রাসা শিক্ষকরা কাউকে বোরকা পরতে বাধ্য করেন না। তারা কেবল ইসলামের অনুশাসনের কথা স্মরণ করিয়ে দেন।
হাইকোর্টের আদেশ : এর আগে গত ২২ আগস্ট হাইকোর্ট সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও অফিসে বোরকা পরতে বাধ্য না করা এবং খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকা থেকে মেয়েদের বাদ না রাখার নির্দেশ দেন। বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি শেখ মোঃ জাকির হোসেনের বেঞ্চ গত রোববার এ আদেশ দেন। পাশাপাশি আদালত ওই কলেজের অধ্যক্ষ মোজাম্মেল হককে ২৬ আগস্ট সশরীরে হাজির হয়ে এ ব্যাপারে ব্যাখ্যা দেওয়ার নির্দেশ দেন। সে অনুযায়ী আজ তার আদালতে হাজির হওয়ার কথা রয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের দুই আইনজীবী মাহবুব শফিক ও কেএম হাফিজুল আলমের করা জনস্বার্থ রিট আবেদনে আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে এ আদেশ দেন।
রানী ভবানী কলেজে যা ঘটেছিল : নাটোরে রানী ভবানী সরকারি মহিলা কলেজে সাংস্কৃতিক কার্যক্রম ও খেলাধুলায় ছাত্রীদের অংশ নেওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করাকে কেন্দ্র করে উচ্চ আদালতের নির্দেশ ও তারপর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এ পরিপত্র জারি করা হলো। এ কলেজের অধ্যক্ষ মোজাম্মেল হক মাস দুয়েক আগে কলেজে যোগ দেওয়ার পরই নির্দেশ দেন, বোরকা পরে আসতে হবে ছাত্রীদের। এ নির্দেশ না মানায় অনেককেই ঢুকতে দেওয়া হয়নি কলেজে। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, অধ্যক্ষ 'অবাধ্য' ছাত্রীদের গায়ে হাত তুলতে পর্যন্ত দ্বিধা করেননি।
শিক্ষাবিদ ও শিক্ষকদের অভিমত : বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সমকালকে বলেন, 'বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারের এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ খুবই প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। তবে এ ধরনের পরিপত্র জারির প্রয়োজনীয়তা কেন দেখা দিল সেটি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে। পাকিস্তান আমলেও কাউকে বোরকা পরতে বাধ্য করার মতো ঘটনা আমরা দেখিনি।' ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ হোসনে আরা বেগম বলেন, 'আমি সরকারের এ আদেশে খুশি হয়েছি। বর্তমান যুগে এসে কাউকে জোর করে বোরকা পরানো অমানবিক।' তিনি বলেন, 'অনেকে মনে করেন, ইভটিজিং থেকে বাঁচতে বোরকা পরানো উচিত। এটা ঠিক নয়।' উত্তরা হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মোঃ মোয়াজ্জেম হোসেন ভঁূইয়া সমকালকে বলেন, 'সাধারণত স্কুলগুলো কাউকে জোর করে বোরকা পরে আসতে বাধ্য করে না। পারিবারিক কারণে অনেক ছাত্রী বোরকা পরে থাকে। সেটা তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার।' মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগম বলেন, 'আগ্রহ নিয়ে বোরকা পরলে শিক্ষকরা বাধা দেন না। তেমনিভাবে কাউকে নিষেধও করা হয় না।'

No comments:

Post a Comment