Friday, 7 January 2011

বিদায়ী বছরে রেকর্ডসংখ্যক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা : ১৩৬৭২টি দুর্ঘটনা, অধিকাংশের কারণ বৈদ্যুতিক গোলযোগ

আলাউদ্দিন আরিফ

বিদায়ী ২০১০ সাল ছিল অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহতার বছর। এ সময় সারাদেশে ১৩ হাজার ৬৭২টি অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। আগের বছরের চেয়ে এটি ১ হাজার ৪৯০টি বেশি। ২০০৯ সালে সারাদেশে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছিল ১২ হাজার ১৮২টি। এসব অগ্নিকাণ্ডের অধিকাংশ হয়েছে বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে।
বিদায়ী বছরে অগ্নিকাণ্ডের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল রাজধানীর নিমতলী ট্র্যাজেডি। ৩ জুন সন্ধ্যায় ওই অগ্নিকাণ্ডে ঘটনাস্থলে ১২৪ জন পুড়ে কয়লা হয়েছিল। হাসপাতালে মারা যান আরও প্রায় ১০ জন। নিমতলীতে অগ্নিদগ্ধ হন দু’শতাধিক মানুষ। প্রাথমিকভাবে মনে করা হয়, একটি বিয়ে অনুষ্ঠানের রান্নার আগুন থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত। পরে তদন্ত শেষে জানা যায়, রাসায়নিক দাহ্য পদার্থ থেকে আগুনের ভয়াবহতা বেড়ে যায়। আগুন কেড়ে নিয়েছে কারও কারও পুরো পরিবার। মা, স্ত্রী ও সন্তান হারিয়ে আজও অনেকে নির্বাক।
গত ১৪ ডিসেম্বর আশুলিয়ায় এফবিসিসিআই সভাপতি এ কে আজাদের মালিনাকাধীন হা-মীম গ্রুপের পোশাক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে নিহত হয়েছিলেন ৩০ জন। ২৪ ডিসেম্বর ঢাকার খিলক্ষেতে গুডনাইট কয়েল ফ্যাক্টরিতে আগুনে পুড়ে মারা যান ১০ জন। ৬ অক্টোবর রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে জুতার সলিউশন তৈরির কারখানা লিলি কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিতে আগুনে পুড়ে মারা যান ৯ জন। অবশ্য বছরব্যাপী অগ্নিকাণ্ডে কত লোকের প্রাণহানি হয়েছে, তার সঠিক হিসাব জানা যায়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রাণহানির সংখ্যা ৩শ’র বেশি। এর আগের বছর ২০০৯ সালে আগুনে প্রাণহানির সংখ্যা ছিল ২৬৯ জন।
গত কয়েক বছরের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সর্বাধিক অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হয় বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে। বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে ২০০৭ সালে ৩ হাজার ৩৩৪টি, ২০০৮ সালে ৩ হাজার ৭৬০টি, ২০০৯ সালে ৪ হাজার ৫২০টি ও ২০১০ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৪ হাজার ৯৮৫টি অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে রান্নার চুলা থেকে আগুন। চলতি বছর রান্নার চুলা থেকে ৩ হাজারের বেশি অগ্নিকাণ্ড হয়েছে। সিগারেটের টুকরো থেকে অগ্নিকাণ্ড হয়েছে প্রায় ১ হাজার ৬০০টি, শিশুদের আগুন নিয়ে খেলার কারণে প্রায় ৪০০, যন্ত্রাংশের সংঘর্ষজনিত কারণে প্রায় ৩০০, অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে প্রায় ১৭৫টি ঘটনায়।
আগুনে পোড়া রোগীদের চিকিত্সা দেয় ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিট। এ ইউনিটের প্রকল্প পরিচালক সামন্ত লাল সেন বলেন, স্বাভাবিক যেসব অগ্নিকাণ্ড হয়, ওই সময় তারা ভালো সেবা দিতে পারেন। কিন্তু নিমতলী বা হা-মীম গ্রুপের কারখানার মতো বড় অগ্নিকাণ্ডে এত বেশি রোগীকে একসঙ্গে চিকিত্সা দেয়ার মতো অবকাঠামো ও জনবল তাদের নেই। বার্ন ইউনিটের চিকিত্সকরা জানান, গত জুনে নিমতলীতে অগ্নিকাণ্ডের পর যত রোগী এসেছে, এত রোগী আর কখনও দেখেননি তারা।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সূত্র জানায়, তারা আগুন প্রতিরোধ কার্যক্রম জোরদার করেছে। বস্তি, হকার্স মার্কেট, হাটবাজার, মহানগর ও শিল্প এলাকার গুরুত্বপূর্ণ স্থানে মহড়া এবং অগ্নিপ্রতিরোধে পরামর্শ দেয়া, পোশাক শিল্পে আগুন প্রতিরোধে প্রতি মাসে ঢাকা শহরের পোশাক কারখানাগুলো পরিদর্শন, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে অগ্নিনির্বাপণ এবং প্রতিরোধ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া, কমিউনিটি ভলান্টিয়ার তৈরি করাসহ নানা ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। অগ্নিপ্রতিরোধ ও নির্বাপণে মোবাইল কোর্টও পরিচালনা করা হচ্ছে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবু নাঈম মো. শাহিদ উল্লাহ বলেন, বিগত বছরগুলোর তুলনায় বিদায়ী ২০১০ সালে সারাদেশে অগ্নিকাণ্ড, অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহতা, প্রাণ ও সম্পদহানি হয়েছে অনেক বেশি—এ কথা সত্য। তবে যে কোনো দুর্ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস খবর পাওয়ার এক মিনিটের মধ্যে স্টেশন ত্যাগ করে অগ্নিনির্বাপণ ও উদ্ধারকাজে যোগ দেয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশ বিশ্বের ঘনবসতিপূর্ণ দেশের একটি। এখানে নগরায়ন ও শিল্পায়ন দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দুর্ঘটনা ও দুর্যোগ। এসব দুর্ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে জনসাধারণের অংশগ্রহণ প্রয়োজন। সম্প্রতি বসুন্ধরা সিটির অগ্নিকাণ্ড, পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের পর অনুসন্ধান ও উদ্ধার কার্যক্রম, বেগুনবাড়ীর ভবনধস, পুরনো ঢাকার নিমতলীতে স্মরণকালের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড—সব বিষয় আরও জোরালো হয়ে সামনে এসেছে। অগ্নিনির্বাপণ ও প্রতিরোধে জনসচেতনতার পাশাপাশি বিশাল স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী তৈরি করেছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্তৃপক্ষ। মানুষের সচেতনতা এবং স্বেচ্ছাসেবকরা নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করলে আগুন দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। গত চার বছরে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ৪৩ দশমিক ৪০ শতাংশ অগ্নিকাণ্ড ফায়ার সার্ভিস পৌঁছার আগেই স্থানীয় জনসাধারণ নির্বাপণ করতে সক্ষম হয়েছে। তাই আগুন প্রতিরোধে জনসচেতনতা অনেক বেশি প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।

No comments:

Post a Comment