Saturday 29 January 2011

রক্ষীবাহিনীর নৃশংসতা মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানিয়েছিল



আলাউদ্দিন আরিফ

স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যা-কাণ্ডের প্রচলনের পর থেকে ব্যাপকসংখ্যক মানুষ এই নির্মমতার শিকার হয়। ১৯৭২ সাল থেকে ’৭৫ সাল পর্যন্ত রক্ষীবাহিনীসহ বিভিন্ন বাহিনীর নৃশংসতা মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানিয়েছিল। নির্যাতনে ২৭ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল বলে বিভিন্ন পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে। এছাড়াও ওই সময় রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয় ১৯ হাজার মানুষ। গুম ও খুন হয় এক লাখ। পিটিয়ে মারা হয় ৭ হাজার মানুষকে। জেলখানায় হেফাজতে থাকা অবস্থায় মারা যায় ৯ হাজার মানুষ।
লেখক, সাংবাদিক আহমেদ মূসা লিখেছেন, ‘আওয়ামী লীগ শাসনামলে যেসব প্রকাশ্য ও গোপন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ সরকার ও তার নীতির বিরোধিতা করেছে, ওইসব দলের মতে, সে আমলে ২৫ হাজার ভিন্ন মতাবলম্বীকে হত্যা করেছে আওয়ামী লীগ। এ হতভাগাদের হত্যা করা হয়েছে চরম নিষ্ঠুরতা ও নৃশংসতার মধ্য দিয়ে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ওই সময় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী জাতীয় রক্ষীবাহিনীর নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। তাদের মধ্যে জাতীয় কৃষক লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা নবাবগঞ্জ হাইস্কুলের শিক্ষক সিদ্দিকুর রহমান খান (সিদ্দিক মাস্টার) খুন হন ’৭২ সালের ১০ অক্টোবর। ’৭৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর রক্ষীবাহিনীর হাতে শত শত লোকের সামনে খুন হন জাসদ ছাত্রলীগ নেতা বুবলু, রবি, এবাদত আলী, মোতালেব, কালু ও সম্পদসহ অনেকে। রক্ষিবাহিনীর হাতে খুন হওয়া জাসদ কর্মীদের মধ্যে ছিলেন সিটি কলেজ ছাত্র সংসদের জিএস জাহাঙ্গীর, গণবাহিনীর দারাজ, মূয়র, আসাদ, মাসুদ হারুন, জাহাঙ্গীরনগরের শাহ বোরহান উদ্দিন রোকন, বুয়েটের নিখিল চন্দ্র সাহা, নরসিংদীর জাসদ নেতা আলাউদ্দিন, গাজীপুরের আক্রাম, জয়নাল, সামসু, বাদল, আনোয়ার, মানিকগঞ্জের সাহাদাত হোসেন বাদল, দেলোয়ার হোসেন হারাজ, আবদুল আউয়াল নাজু, নাজিম, জামালপুরের পেট্রোল, গিয়াসউদ্দিন মাস্টার, নেত্রকোনার আবদুর রশিদ, হাছু মিয়া, ময়মনসিংহের মাসুদুজ্জামান, আবদুল জাব্বার, মাদারীপুরের জাহাঙ্গীর, সাদাম, আলী হোসেন, মফিজুর, ফরিদপুরের কামালুজ্জামান, আবদুল হাকিম, রাজশাহীর মনিরুদ্দীন আহমদ, সালাম মাস্টার, রফিক উদ্দিন আহমেদ সেলিম, বগুড়ার আতা, রঞ্জু, মানিক দাশগুপ্ত, তোতা, রানা (কর্নেল) খলিল, রাজ্জাক (কক), নাটোরের নাসির উদ্দিন, পাবনার আসফাকুর রহমান কালসহ অনেকে। এভাবে সারাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা।
মওলানা ভাসানীর সাপ্তাহিক হক কথায় ২৬ মে ১৯৭২ সালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, ‘একটি বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থার বিশেষ প্রোগ্রামে এ দেশে কাজ করে যাচ্ছে। তাদের হিসাব হলো, বাংলাদেশে সোয়া লক্ষ বামপন্থী কর্মীকে হত্যা করতে হবে। তা না হলে শোষণের হাতিয়ার মজবুত করা যাবে না।’
রক্ষীবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ ছিল খুবই নির্মম ও ভয়াবহ। তারা বাবার সামনে ছেলেকে গুলি করে হত্যার পর বাবার ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন চালিয়ে ছেলের গলা কেটে দিতে বাধ্য করে। তাদের উক্তি ছিল ‘নিজহাতে তোর ছেলের গলাকেটে দে, ফুটবল খেলব তার মাথা দিয়ে’। লেখক আহমেদ মূসা তার ‘ইতিহাসের কাঠগড়ায় আওয়ামী লীগ’ বইয়ের উত্সর্গনামায় মুজিববাদী ঘাতক বাহিনীর অবর্ণনীয় নির্যাতনের শিকার বাজিতপুরের ইকুরটিয়া গ্রামের বৃদ্ধ কৃষক আবদুল আলীর অভিজ্ঞতার বর্ণনা তুলে ধরে লিখেছেন, ‘... ঐখানে আমাকে (আবদুুল আলী) ও আমার ছেলে রশিদকে হাত-পা বেঁধে তারা খুব মারলো। রশিদকে আমার চোখের সামনে গুলী করলো। ঢলে পড়লো বাপ আমার। একটা কসাই আমার হাতে একটা কুড়াল দিয়ে বলল, তোর নিজের হাতে ছেলের গলা কেটে দে, ফুটবল খেলবো তার মাথা দিয়ে। আমার মুখে রা নেই। না দিলে বলল তারা, তোরও রেহাই নেই। কিন্তু আমি কি তা পারি? আমি যে বাপ। একটানা দেড় ঘণ্টা মারার পর আমার বুকে ও পিঠে বন্দুক ধরলো। শেষে নিজের হাতে কেটে দিলাম ছেলের মাথা। আল্লাহ কি সহ্য করবে?’
স্বাধীন বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যার এক ভয়ঙ্কর তথ্য জানা যায় মাসুদুল হক রচিত ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং সিআইএ’ গ্রন্থে। ওই গ্রন্থের ১০৬ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ‘১৯৭২ সালে একদিকে তিনি (মুজিব) সকল মুক্তিযোদ্ধাকে অস্ত্র জমা দেয়ার নির্দেশ দেন, অপরদিকে আবদুর রাজ্জাক ও সিরাজুল আলম খানকে অস্ত্র জমা দিতে বারণ করলেন। শেখ মুজিবের ওই নিষেধ সম্পর্কে আবদুর রাজ্জাক বলেন, সিরাজুল আলম খান আর আমাকে ডেকেই বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, সব অস্ত্র জমা দিও না। যেগুলো রাখার দরকার সেগুলো রেখে দাও। কারণ, সমাজ বিপ্লব করতে হবে। প্রতি বিপ্লবীদের উত্খাত করতে হবে, সমাজতন্ত্রের দিকে এগুতে হবে। এটা আমাদের পরিষ্কারভাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন।’ মুজিব আমলে এসব হত্যাকাণ্ড যে পুরোপুরি রাষ্ট্রীয় মদতে হয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
সাপ্তাহিক হক কথার ২ জুন ১৯৭২ সংখ্যায় লেখা হয়েছে, ‘ঢাকা জেলার (বর্তমানে নরসিংদী জেলা ) মনোহরদী থানার পাটুলী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ কর্মকর্তারা দলীয় কর্মীদের সহযোগিতায় সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত শত্রুতা সাধনের উদ্দেশ্যে একজন মুক্তিযোদ্ধাকে জীবন্ত কবর দিয়াছে। এই অপরাধে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করিয়া নারায়ণগঞ্জ থানায় চালান দিলে জনৈক এমসিএ হস্তক্ষেপ করিয়া এই নরঘাতকটিকে মুক্ত করিয়াছেন।’
ময়মনসিংহে ১৫শ’ কিশোরকে হত্যার বর্ণনা দেন লেখক আহমেদ মূসা। ইতিহাসের কাঠগড়ায় আওয়ামী লীগ বইটিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘...রক্ষীবাহিনী গত জানুয়ারীতে এক ময়মনসিংহ জেলাতেই অন্তত ১ হাজার ৫শ’ কিশোরকে হত্যা করেছে। এদের অনেকেই সিরাজ সিকদারের পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টি (ইবিসিপি)-এর সদস্য ছিল। অন্যদের মার্কসবাদী ও লেনিনবাদী দলের প্রতি সহানুভূতিশীল বলে সন্দেহ করা হয়েছিল। এমনকি অনেক যুবক যারা রাজনীতিতে ততটা সক্রিয় ছিল না, তারাও এই অভিযানে প্রাণ হারিয়েছেন’।
ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরোর সাবেক সদস্য ও বর্তমানে সিপিবি নেতা হায়দার আকবর খান রনো ‘বাম রাজনীতি : সংকট ও সমস্যা বইতে লিখেছেন, ‘মুজিববাদীদের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো সন্ত্রাসের রাজনীতি, প্রকাশ্য হত্যা, গুপ্ত হত্যা, গুণ্ডামি। এগুলো ছিল খুবই সাধারণ ব্যাপার। রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পগুলো ছিল হত্যাযজ্ঞের আখড়া। যশোরের কালীগঞ্জ থেকে রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্প উঠে গেলে সেখানে গণকবর আবিষ্কৃত হয়েছিল। যাতে ৬০টি কঙ্কাল পাওয়া যায়। টঙ্গী থানার সামনে মেশিনগান স্থাপন করে শ্রমিক কলোনির ওপর নির্বিচারে গুলী চালানো হলো। শতাধিক নিহত হলেন।’
৩১ আগস্ট ১৯৭২ সালে কমিউনিস্ট পার্টি সভাপতিমণ্ডলী কর্তৃক ঢাকায় আহূত ‘ব্যর্থ-অযোগ্য দেউলিয়া সরকারের পদত্যাগ চাই’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে আইনশৃংখলা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, দেশে লুটতরাজ, রাহাজানি, পাইকারি হারে ডাকাতি ও রাজনৈতিক গুপ্তহত্যার ব্যাপকতা বেড়ে চলেছে। লাল বাহিনী নামক একটি বেসরকারি বাহিনী সংগঠিত করে ক্ষমতাসীন দল শিল্প শ্রমিকদের জীবন বিপদসঙ্কুল করে তুলেছে। এদের সশস্ত্র ফ্যাসিবাদী হামলায় এযাবত্ শত শত শিল্প-শ্রমিক শহীদ হয়েছেন’।
রক্ষীবাহিনীর নির্যাতন সম্পর্কে শরিয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার কার্তিকপুরের অরুণা সেনের একটি প্রতিবেদন ছাপা হয় সাপ্তাহিক হলিডের ১৭ মার্চ ১৯৭৪ সংখ্যায়। এছাড়াও মাসিক সংস্কৃতি পত্রিকার ১৯৭৪ এর মে-জুন সংখ্যায় তার একটি বিবৃতি ছাপা হয়েছে। এতে তিনি নড়িয়া ও ডামুঢ্যা ক্যাম্পসহ কয়েকটি ক্যাম্পে রক্ষীবাহিনীর নির্যাতন ও মানুষ হত্যার লোমহর্ষক বর্ণনা দেন। অরুনা সেন বিবৃতিতে বলেন, ‘১৭ আশ্বিন রক্ষিবাহিনীর লোকেরা তাদের গ্রামে প্রথম হামলা করে। গ্রামের লোককে মারধর করে তাকে ও লক্ষ্মণ সেন নামে এক কলেজ ছাত্রকে ধরে নিয়ে যায়। তারা অরুনার স্বামী শান্ডি সেন ও পুত্র চঞ্চলের অবস্থান জানতে চায়। তাদেরকে মারধর করে ছেড়ে দেয়। এর কিছুদিন পর ৩ ফেব্রুয়ারি রাতে রক্ষীবাহিনীর বিশাল একটি দল তাদের গ্রাম ঘিরে ফেলে। আওয়ামী লীগের থানা সম্পাদক হোসেন খাঁর নেতৃত্বে গ্রামের বালক ও পুরুষ লোকদের এনে হাজির করে। তারা কলিমদ্দি ও মোস্তফাসহ ২০ জন হিন্দু যুবককে ধরে নিয়ে যায়। অরুণা সেন নিজে এবং রীনা ও হনুফা নামে তিন মহিলাকে বর্বর নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে বলেন, বিপ্লব, মতি ও কৃষি ব্যাংকের পিয়ন আলতাফকে পিটিয়ে মেরে জল্লাদ গর্ব করে বলে ‘দেখ এখনও হাতে রক্ত লেগে আছে।’ আলতাফকে মারা হয় পিটিয়ে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় দোতলার ছাদ থেকে ফেলে। ৯ ফেব্রুয়ারি শীতের মধ্যে হনুফা, রীনা ও অরুণা সেনসহ কয়েকজনকে দিনভর পানিতে রেখে মারধর করা হয়। তাদের মধ্যে করিম মারধরে মারা গেছে। অপর একটি ছেলেকেও মেরে ফেলার কথা উল্লেখ করেন অরুণা। টানা কয়েকদিন নির্যাতনের পর ১৯ ফেব্রুয়ারি ডামুঢ্যা রক্ষীবাহিনী ক্যাম্পে নেয়া হয় অরুণা সেন ও রীনাকে। কলিমদ্দি, মোস্তফা, গোবিন্দ ও হরিপদকে রেখে দেয়। রক্ষীবাহিনী বলছিল তাদের মেরে ফেলা হবে। অরুণা সেন বের হয়ে আসার পর চারটি গুলির আওয়াজ শোনা যায়। ডামুঢ্যা ক্যাম্প থেকে তাকে নেয়া হয় মাদারীপুর ক্যাম্পে। শেষ রাতে নেয়া হয় ঢাকায়।

No comments:

Post a Comment