ইলিয়াস খান
বাংলাদেশ বিষয়ে উইকিলিকসের প্রকাশিত বিভিন্ন তথ্য নিয়ে সরকার অস্বস্তিতে পড়েছে। একই সঙ্গে সরকার বিব্রত ইসলামী শিক্ষার পাঠক্রম দুই অনৈসলামিক দেশকে দিয়ে তৈরির সুযোগদান, র্যাবের মতো মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী বাহিনীকে যুক্তরাজ্যে প্রশিক্ষণ দেয়াসহ বিভিন্ন স্পর্শকাতর ঘটনা জনসমক্ষে আসায়। এ বিষয়ে দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও মানবাধিকার নেতারা বলেছেন, উইকিলিকস শুধু ওয়াশিংটনের নয়, বাংলাদেশ সরকারের মুখোশও উন্মোচন করে দিয়েছে। এ সরকারের ইসলামবিরোধিতা এবং ভারত তোষণনীতি এখন সর্বজনবিদিত।
উইকিলিকসের ফাঁস করা যুক্তরাষ্ট্রের গোপন তারবার্তার ভিত্তিতে ব্রিটেনের প্রভাবশালী দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, সন্ত্রাসবিরোধী কৌশলের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের মাদ্রাসা শিক্ষার পাঠক্রম পরিবর্তনে একত্রে কাজ করছে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র। ‘সামষ্টিক সন্ত্রাসবিরোধী কৌশলের’ অংশ হিসেবে মাদ্রাসা পাঠক্রমকে প্রভাবিত করতে চায় দেশ দুটি।
মাদ্রাসার পাঠক্রম পরিবর্তনে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একত্রে কাজ করছে যুক্তরাজ্যের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিভাগ (ডিএফআইডি)। এক তারবার্তায় যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবিরোধী কৌশলের বিষয়টি উল্লেখ করেন বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি।
উইকিলিকস জানিয়েছে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে ইউরোপসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তোপের মুখে থাকা র্যাবকে যুক্তরাজ্য সরকারের উদ্যোগেই প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এ খবরটিও প্রকাশ করেছে যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী দৈনিক ‘গার্ডিয়ান’। তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত সংবাদের শিরোনাম হচ্ছে, “বাংলাদেশী ‘ডেথস্কোয়াড’ ট্রেইনড বাই ইউকে গভর্নমেন্ট।” সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রম নিয়ে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের কথা চালাচালিতে যুক্তরাজ্য সরকারের র্যাবকে প্রশিক্ষণ দেয়ার বিষয়টি প্রকাশ হয়ে পড়ে। অন্য একটি তারবার্তায় মরিয়ার্টি বলেন, যুক্তরাজ্যের কর্মকর্তারা তাকে জানিয়েছেন, ব্রিটিশ পুলিশের বিশেষ বিভাগ ন্যাশনাল পুলিশিং ইমপ্রুভমেন্ট এজেন্সির (এনপিআইএ) কর্মকর্তারা ১৮ মাস ধরে র্যাবকে প্রশিক্ষণ দেয়। অনুসন্ধান ও জিজ্ঞাসাবাদের কৌশল সম্পর্কেও তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
এ ছাড়া ফুলবাড়ী কয়লাখনিতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের অনুমতি দিতে বাংলাদেশ সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র চাপ দিয়েছিল বলে উইকিলিকসের গোপন নথিতে বলা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ‘ভারত-ঘনিষ্ঠতা’ প্রচার বিষয়ে সতর্ক ভারত—উইকিলিকসের ফাঁস করা এ তথ্য পাওয়া গেছে বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের অন্য এক তারবার্তা থেকে।
জানা গেছে, সরকার মূলত অস্বস্তিতে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যকে মাদ্রাসা শিক্ষার পাঠক্রম তৈরির অনুমতি দেয়া এবং শেখ হাসিনার ভারত-ঘনিষ্ঠতার খবর প্রকাশ হয়ে পড়ায়।
২০০৯ সালের ১৪ জানুয়ারি মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি বাংলাদেশে নিযুক্ত তত্কালীন ভারতীয় হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তীর বক্তব্য উদ্ধৃত করে এক তারবার্তায় জনান, পিনাক বলেছেন, সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় যৌথ টাস্কফোর্স গঠনে হাসিনার প্রস্তাবকে স্বাগত জানাবেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি। এ বিষয়ে ভারত দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতামূলক কর্মকাণ্ড চায়। তবে ভারত বোঝে বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে আঞ্চলিক টাস্কফোর্স গঠনে আগ্রহী হতে পারে। এর ফলে হাসিনার বিরুদ্ধে ‘ভারত-ঘনিষ্ঠতা’র যে প্রচারনা সে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সুবিধাজনক অবস্থানে থাকতে পারবেন হাসিনা।
পিনাকের এ বক্তব্য উল্লেখ করে মরিয়ার্টি লিখেন, ভারত প্রায়ই দাবি করে, আন্তর্জাতিক ইসলামী জঙ্গিরা বাংলাদেশকে একটি নিরাপদ আস্তানা হিসেবে ব্যবহার করে; প্রায়ই বাংলাদেশের দুর্বল সীমান্ত পার হয়ে ভারতে ঢুকে বোমা ও অন্য হামলা চালায়।
বাংলাদেশকে নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে ব্যবহারকারী আসামের ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্টসহ ভারতের স্বাধীনতাকামী গ্রুপগুলো দমনে ঢাকাকে আরও কার্যকর ভূমিকা পালনের আহ্বান জানিয়ে আসছে নয়াদিল্লি।
চলতি বছর ৮ ফেব্রুয়ারির আগে পাঠানো ওই বার্তায় বলা হয়, জেমস এফ মরিয়ার্টিকে পিনাক চক্রবর্তী জানান, ৮ ফেব্রুয়ারি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রণব মুখার্জির ঢাকা সফরের পরিকল্পনা রয়েছে। সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা বিষয়ে প্রাথমিক আলোচনাই হবে সফরের মূল আলোচ্য বিষয়। তিনি জানান, নিরাপত্তা সহযোগিতার উন্নয়নই হবে বাংলাদেশের নতুন সরকারের সঙ্গে ভারতের কাজের ক্ষেত্রে প্রধান গুরুত্বের বিষয়।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয়ে আনন্দ প্রকাশ করেন ভারতীয় হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী। ঐতিহাসিকভাবে নয়াদিল্লির সঙ্গে আওয়ামী লীগের সুসম্পর্ক রয়েছে বলে তারবার্তায় উল্লেখ করেন মরিয়ার্টি।
প্রসঙ্গত, বর্তমান সরকার ইসলামবিরোধী হিসেবে ওলামা-মাশায়েখের কাছে পরিচিত। উইকিলিকস যে তথ্য ফাঁস করেছে তাতে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হলো। একই সঙ্গে মহাজোটের মূল শরিক আওয়ামী লীগ বরাবরই ভারতের তাঁবেদার দল হিসেবে পরিচিত। উইকিলিকস প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী তা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে। বাংলাদেশ বিষয়ে উইকিলিকস প্রকাশিত তথ্য নিয়ে কথা হয় দেশের কয়েক বিশিষ্টজনের সঙ্গে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমদ বলেন, এ দেশে দীর্ঘদিন যারা মাদ্রাসা পাঠক্রম তৈরি করে আসছেন তারাই প্রয়োজনে তা পরিবর্তন করবেন। বিদেশিরা কেন এখানে হাত দেবেন। তিনি বলেন, মাদ্রাসা শিক্ষা তো এক-দুই বছর ধরে চলছে না, ৭০০ বছর ধরে চলে আসছে। মাদ্রাসা শিক্ষা আধুনিকায়নের কথা বলা হচ্ছে। ভালো কথা। মাদ্রাসা শিক্ষার পাঠক্রমে যেমন বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ইত্যাদি থাকবে তেমনি নীতিনৈতিকতার বিষয়টিও থাকা অপরিহার্য। লোকের এমন কী অভাব পড়েছে যে বিদেশিদের পাঠক্রম পরিবর্তন করে দিতে হবে। সরকার যদি এই সুযোগ দিয়ে থাকে তাহলে তা দুর্ভাগ্যজনক।
মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের মহাসচিব অ্যাডভোকেট আদিলুর রহমান খান র্যাবকে প্রশিক্ষণ দেয়ায় যুক্তরাজ্যের কড়া সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, যুক্তরাজ্যের মতো একটি গণতান্ত্রিক দেশ এ ধরনের মানবাধিকারবিরোধী সংগঠনকে প্রশিক্ষণ দিতে পারে না। প্রশিক্ষণ দেয়ার আগে তাদের অবশ্যই খোঁজ নেয়া উচিত ছিল এই বাহিনী মানবাধিকার রক্ষায় কতটা কাজ করছে। তিনি বলেন, স্বাধীনতার পরপরই তত্কালীন সরকার জাতীয় রক্ষীবাহিনী গঠনের মাধ্যমে বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, নির্যাতন শুরু করে। এর ধারাবাহিকতায় র্যাব গঠিত হয়েছে। এদের লাগাম অবশ্যই টেনে ধরতে হবে।
বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষক সমিতির চেয়ারম্যান মাওলানা আবদুল লতিফ বলেন, সরকার ঘোষিত ২০১০-এর শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন হলে ইসলামী শিক্ষা বলতে আর কিছু থাকবে না। ইমান-আকিদার ওপর আঘাত আসবে। তিনি বলেন, মুসলিম সংস্কৃতি ধ্বংস করার জন্যই সরকারের সহযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য মাদ্রাসা শিক্ষার পাঠক্রম তৈরির উদ্যোগ নিচ্ছে। এটা খুব হাস্যকর ব্যাপার। ইসলামবিরোধী দেশগুলো ইসলামী শিক্ষার পাঠক্রম তৈরি করতে চাচ্ছে। উইকিলিকসের এই তথ্য প্রকাশের মধ্য দিয়ে সরকারের ইসলামবিরোধী ষড়যন্ত্র উন্মোচিত হলো। এ দেশের ইসলামপ্রিয় জনগণ যে কোনো মূল্যে এই চক্রান্ত রুখে দাঁড়াবে।
No comments:
Post a Comment