Wednesday, 29 December 2010

বছরজুড়ে নানা সঙ্কটে কাটে নগর জীবন



মাহমুদা ডলি

ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন ও রাজনৈতিক ঠিকাদারদের কাজ ভাগাভাগি নিয়ে বছর জুড়েই ছিল নানা বিতর্ক ও নানা কেলেঙ্কারি। বছরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ডিসিসি ছিল সরকার সমর্থক রাজনৈতিক ঠিকাদার ও কর্মকর্তাদের হাতে জিম্মি। তাই অঞ্চলভিত্তিক কোটি কোটি টাকার বাজেট বরাদ্দ হলেও উন্নয়নের সুফল পৌঁছায়নি সাধারণ মানুষের দোড়গোড়ায়।
ডিসিসির রাস্তাঘাটসহ অন্য সেবা সংস্থার প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা না পেয়ে পুরো বছরটাই দুর্ভোগের মধ্যে কেটেছে নগরবাসীর জীবন। কোন অঞ্চলে গ্যাস সংকট, কোন অঞ্চলে পানি, আবার কোন অঞ্চলে লাগাতার লোডশেডিংয়ে বিপর্যস্ত ছিল সাধারণ মানুষ।
এমনকি রাজনৈতিক কারণেও সরকার ব্যবসায়ী মহলকেও নাগরিক সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে চাঁদাবাজরা অতিষ্ঠ করে তুললেও পুলিশ প্রশাসন পালন করে নীরব ভূমিকা। নগরীর বিভিন্ন অঞ্চলে সরেজমিনে ঘুরে এ চিত্র পাওয়া যায়।
বছরের শুরুতেই ‘গ্যাস পানি বিদ্যুত্ চাই’ দাবি নিয়ে সাধারণ মানুষ মিছিল নিয়ে রাস্তায় নামলেও তা দমন করার প্রয়াস চালানো হয়েছে।
ডিসিসি সূত্রে জানা গেছে, অঞ্চলভিত্তিক ছোট বড় ওয়ার্ড অনুযায়ী চলতি অর্থবছর এবং গত অর্থবছরে ৮ কোটি টাকা থেকে প্রায় ৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে বিভিন্ন ধরনের উন্নয়ন কাজের জন্য। কিন্তু সরেজমিনে ঘুরে এলাকাবাসীর সঙ্গ কথা বলে পাওয়া গেছে ভিন্ন চিত্র। কোন কোন অঞ্চলে দুই কিংবা একটি কাজ হলেও অনেক অঞ্চলে দুবছরেও কোন ধরনের উন্নয়ন কাজ হয়নি।
২০১০ সালে অঞ্চল-৪-এ রাস্তা নির্মাণ কাজের জন্য টেন্ডার আহ্বান করা হয়। বছর শেষ হলেও এখনো পর্যন্ত কাজটি শুরুই হয়নি। স্থানীয়রা জানান, তারা টেন্ডারের কথা শুনেছেন কিন্তু কাজ দেখেননি। মুগদার স্থানীয় ওয়ার্ড কমিশনার নিজে জানান, তার এলাকায় গত এক বছরে কোন উন্নয়ন কাজ করা হয়নি।
ব্যবসায়ী মহলের ক্ষোভ : অঞ্চল-৩ এবং অঞ্চল-২ এর মধ্যে প্রায় অর্ধশত বড় বড় পাইকারি বাজার রয়েছে। এসব বাজারের ব্যবসায়ীদের দাবি সরকারের বাজার সংক্রান্ত রাজস্ব আয়ের মধ্যে তিন ভাগের এক ভাগ রাজস্ব যোগ হয় পুরান ঢাকার এসব পাইকারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে। অথচ ওই দুই অঞ্চলের ব্যবসায়ী মহলসহ এলাকাবাসী ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ডিসিসি, পুলিশ প্রশাসন, ওয়াসা এবং তিতাস গ্যাসের প্রতি। তারা জানান, সব ধরনের নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়েছেন তারা।
ভাঙা রাস্তাঘাট, ময়লা আবর্জনার অব্যবস্থাপনায় তাদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। অথচ ডিসিসি সূত্রে জানা যায়, অঞ্চল-৩ এ ২০১০-২০১১ অর্থবছরে প্রায় ৮ কোটি টাকার বাজেট বরাদ্দ হয়েছে। তার মধ্যে প্রায় ১ কোটি টাকার ৫৩টি প্রকল্পের টেন্ডার প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। গত অর্থবছর এবং চলতি অর্থবছরে ২ ও ৩ অঞ্চলে প্রায় ৫০ কোটি টাকার বাজেট বরাদ্দ হওয়ার কথা। কিন্তু বাবুবাজার, নয়াবাজার, চকবাজার, ইসলামপুর বস্ত্র মার্কেট, উর্দু রোড মার্কেট, মৌলভীবাজার, সোয়ারিঘাট, শ্যামবাজার ব্যবসায়ী সমিতিগুলোর একই অভিযোগ। রাস্তাঘাটের বেহাল দশা, ড্রেনেজ সিস্টেম ভেঙে পড়া এবং বিদ্যুত্ ও গ্যাস সংকট।
এছাড়াও ব্যবসায়ীরা জানান, যানজট নিরসনের জন্য সরকার অঞ্চলভিত্তিক একদিন অর্ধ দিবস এবং পরদিন পূর্ণ দিবস মার্কেট হলিডে নির্ধারণ করেছে সরকার। এক্ষেত্রে প্রায় পুরো ২ দিনই হলিডে যায়। একদিন মার্কেট বন্ধ রাখার জন্য ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা বাণিজ্যমন্ত্রী, ডিসিসি, সচিবালয়ে একাধিকবার আবেদন জানালেও কোন সুরাহা হয়নি বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন ব্যবসায়ীরা।
শুধুমাত্র ইসলামপুর বস্ত্র ব্যবসায়ী সমিতি বছরে প্রায় ৬শ’ কোটি টাকা সরকারকে ট্যাক্স দেয় বলে জানায় সংশ্লিষ্ট সমিতি। বর্তমানে নীরব চাঁদাবাজি চলছে বলে অভিযোগ করেন ইসলামপুরের ব্যবসায়ীরা। একই ধরনের অভিযোগ করেন মৌলভীবাজার বণিক সমিতি, চকবাজার ব্যবসায়ী সমিতি, সাধারণ ব্যবসায়ী সমিতি, ইসলামপুর বস্ত্র ব্যবসায়ী সমিতি, উর্দু রোড ব্যবসায়ী সমিতি, তাঁতিবাজার ও বাবুবাজার ব্যবসায়ী সমিতিসহ অন্যান্য সমিতির নেতারা।
ব্যবসায়ীরা জানান, চাঁদাবাজির ধরন এখন পরিবর্তন হয়েছে। দোকানের সামনে টং ঘরে তুলে মোটা অংকের অর্থ আদায় করে টং ঘর সরিয়ে নেয়া হয়।
ইসলামপুর বস্ত্র মার্কেট সমিতির মো. ফরহাদ রানা এবং সদরঘাট হকার্স মার্কেটের ব্যবসায়ী ঢালী মো. দেলোয়ার হোসেন জানান, শাখারি বাজার, শ্যামপুর বাজার, ইসলামপুর ও সদরঘাটসহ এসব এলাকায় গত এক বছরে কোন উন্নয়ন কাজ হয়নি। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ছিনতাইকারি, অজ্ঞান পার্টি, পকেটমার ও ভাসমান যৌনকর্মীদের আস্তানা হিসেবে গড়ে ওঠা সদরঘাট ফুটওভার ব্রিজটিও অপসারণের উদ্যোগ নেই।
এলাকাবাসী জানান, নির্বাচনের পর এলাকায় স্থানীয় এমপি মিজানুর রহমান দিপুকেও এলাকায় কেউ দেখেননি। তার সন্ত্রাস নির্মূলের প্রতিশ্রুতিরও কোন হদিস নেই। সন্ধ্যার পর সাধারণ মানুষের জন্য স্থানটি বিপজ্জনক হয়ে ওঠেছে বলে তারা অভিযোগ করেন।
এছাড়াও ধানমন্ডি, শংকর, রায়েরবাজার, গ্রীনরোড, কলাবাগান এলাকার ফুটপাতগুলো হকারদের দখলে চলে গেছে। তারে অভিযোগ ইভটিজিংও বেড়েছে। পুলিশ ও ঢাকা সিটি করপোরেশনের লোকজন এসে উচ্ছেদের পরিবর্তে বখরা নিয়ে যায়। এমনকি যানজটও বাড়ছে ওসব এলাকায়। শীতে এসব এলাকায় লোডশেডিং থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
জাফরাবাদের এক আইনজীবী ২৪ তারিখে ডেসার কোন নোটিশ বা ঘোষণা ছাড়াই সকাল-সন্ধ্যা লোডশেডিং দিয়েছে। শীতের মধ্যেই লাগাতার লোডশেডিং থাকে এ অঞ্চলে। কয়েকটি রাস্তা ও স্যুয়ারেজ লাইনের সংস্কার করা হলেও অলিগলিতে রাস্তাঘাটের বেহাল দশা।
আলী হোসেন বালিকা উচ্চ বিদ্রালয় ওয়েআনমন্ডি ইউসুফ হাইস্কুলের চারপাশেসুয়োরেজ লাইন না থাকায় বাউন্ডারির মধ্য সামান্য বর্ষাতেই হাট পানি জমে যায় বলে অভিযোগ করেন স্কুল ম্যঅনেজিং কমিটির একটি সদস্য। তারা জানান গত বছর স্কুলের শহিদমিনার উদ্বোধন করতে এসে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবীর নানক। একটা বছর চলে গেলেও তা আর বাস্তবায়ন হয়নি। দুটি বিদ্যালয়ের প্রায় ১৮শ’ ছাত্রছাত্রী বর্ষাতে দুর্ভোগের মধ্যে থাকায় এছাড়াও - ধানমন্ডি এলাকায় রাস্তাঘাটের দু’পাশে যেখানে সেখানে গাড়ি পার্কিং করায় যানযজট শেষ হয় না। পুলিশের কোনো উদ্যোগ নেই। অঞ্চল- ৭এর ৮ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের অভিযোগ হহারানো। রাস্তাঘাটের বেহাল দশা, পানিয় সঙ্কট, গ্যাস সংকট তা রয়েছেই। গত দুই বছরেও বাউন্ডারী রোড, বিআরটিএ, শেওড়াপাড়া ইস্ট ওয়েস্ট স্কুলের রাস্তার উন্নয়ন কাজ নেই। মোহাম্মদপুরে বিভিন্ন অলিতে গলিতে রিকশা চলে লাফিয়ে লাফিয়ে। নর্দমা ড্রেন পরিষ্কার না করায় দুর্গন্ধে নাক চাপা দিয়ে চলতে হয় এরাকাবাসীর।
অঞ্চল ৭/এ ২০০৯-২০১০ অর্থ বছরে ৮টি ওয়ার্ডে পকেটি ৯ লাখ ৬৭ হাজার ৩শ’ ২৭টাকা বাজেট বরাদ্দ হয়। তার মধ্যে কাজ হয় ৪ কোটি ৫১ লাখ ২১ হাজার ২৯ টাকা। বর্তমানে ২ কোটি ৫৮ লাখ ৪৬ হাজার ২শ’ ৯৮ টাকার কাজ প্রক্রিয়াধীন। কিন্তু এলাকাবাসীর অভিযোগ বাজেট এলে স্থানীয় এমপিসহ রাজনৈতিকবিদরা কাজ ভাগবাটোয়ারা করে নিযে যায়। কিন্তু রাস্তাঘাটে তার অনেক -- নেই। কাজী পাড়া মাদ্রাসা রোড ও ওয়াসা রোডে ১ কোটি টাকার স্থলে ২০ লাখ টাকার কাজ ও হয়নি। এছাড়া ওয়াসা রোড অর্ধেক কাজ করে ফেলে রাখা হয়েছে কয়েককমাস ধরে। স্থানীয় কযেকজন ওয়ার্ড কমিশনার জানান, দু’চারজন মিলে মেয়রকে বলে বেশ কয়েকটি প্রকরআস করিয়ে এনেছেন কিন্তু আঞ্চলিক অফিসে বরাদ্দ আসার পর আর কিছু জানেনান।
মীরপুর ১৪ নম্বর, মীরপুর ১ থেকে চিড়িয়াখানা রাস্তা স্তার কাজ গত এক বছরে হয়নি বলে জানান স্থানীয়রা। মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সে স্থানীয় এমপির প্রতিশ্রুতি অনুায়অী পানির পাম্প দেয়ার কথা থাকলেও তা গত দু’বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি। মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের মো. মহিউদ্দিন মুন্সি, আবুল বাশারসহ বেশ কযেকজন জানান, রাত ১২ টার পর পানি আসে লোকজনের ঘুম হারাম করে পানি ধরতে হয়। উত্তরা কাফরুল ও দক্ষিণ কাফরুলে রিকশা চলাচল বন্ধ রাস্তাঘাটের বেহাল দশা --স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, এ অঞ্চলে থাকাটাই যেন বড় পাপ। গ্যাস নেই পানি নেই, যেন দোযক। তবুও পেটের টানে থাকতে হয়।
দয়াগঞ্জ, গেন্ডারিয়া এলাকায় রাস্তাঘাট উন্নয়নের জন্য টেন্ডার হলে ও নানা কারণে তা বাতিল হয়ে গেছে বলে জানান ঠিকাদাররা। গত অর্থ বছরে ৭১টি প্রকল্পের মধ্যে রাস্তাঘাটে কয়েকটা ইটের খোয়া পড়েছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
গ্যাস কঙ্কট, রাজধানীর অধিকাংশ এলাকায় বছর জুড়েই ছিল গ্যাস সংকট। তার পরেও শীত আসতেই নতুন নতুন এলাকায় গ্যাসের তীব্র সঙ্কট শুরু হয়। নগরীর মোহাম্মদপুর এলাকাসহ পুরান ঢাকা, লালবাগ, সূত্রাপুর, মিরপুর, মগবাজার, নযাটোলা, হাজিপাড়া, রামপুরা, হাজারীবাগ এলাকায় গত ৩/৪ মাস ধরে সারাবছরই গ্যাস সঙ্কট। সকাল ৯ টায় গ্যাস চলে যায় আর আসে সন্ধ্যা ৭টার পরে। সারাদিনের খাবার রাতেই রান্না করে রাখতে হয়। যা স্বাস্থ্যের জন্য ও ক্ষতিকর বলে অভযোগ করেন এলাকাবাসী। ৬৩, ৬৬ শেখের ট্যাক, এফ ব্লকের ১৯ তলা ভবন, --, শ্যামলী ১। রোকেয়া স্মরণীর ১৩ নম্বর ও ১৪ নম্বর শেওরা পাড়ার বাসিন্দারা জানান পুরো এলাকা জুড়েই গ্যাস সংকট সরা বছর ধরে। ১৩ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার জানয়, তারা তিতাম গ্যাসে একাধিক বার অভিযোগ করেছেন কিন্তু কোনো কর্ণপাত করেনি তিতাস গ্যাস। জাফরাবাদের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আইনজীবী জানান, তিনি লিখিত অভিযোগ করার পরেও তিতাস গ্যাস কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। ১ নম্বর মিরপুরের বাসিন্দারা জানান, মাত্র ২টা রাইতার দিয়ে দুই এরাকা চলে। চুলা জ্বলে টিপ টিপ করে। কবে ভাত হবে ঠিক নেই। টিফিনও দিয়ে দেয়া যায় না বাচ্চাদের স্কুলে এ এক অসহনীয় দুর্ভোগ। মোহাম্মদপুর এলাকাবাসী জানান, স্থানীয় এমপিরা নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি থাকলেও আজ তা গ্যাস সংকট নিরসন হয়নি। এখনো সন্ধ্যা-- তখনো গভীর রাতে সামান্য গ্যাসের দেখা মেলে তখন ঘুমানোর সময় রান্না বা খাওয়ার সময নয়। তবে তারা স্থানীয় এমপির প্রতি পুনরায় দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তাদের দীর্ঘদিনের সমস্যা নিরসনের জন্য

No comments:

Post a Comment