Friday, 31 December 2010

সরকারের ব্যর্থতা ও স্বৈরনীতি রুখতে সর্বত্র আন্দোলনের হাতছানি

মাহাবুবুর রহমান

নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নে তেমন কোনো সফলতা নেই আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের। অসংখ্য ইস্যুতে ব্যর্থতা নিয়ে সরকার পার করতে যাচ্ছে ক্ষমতার মেয়াদের দু’বছর। এসময়ে দেশের সব মানবাধিকার, পেশাজীবী ও আর্থ-সামাজিক প্রতিষ্ঠানে স্বৈরাচারী নীতির ছোঁয়া লেগেছে। হেনস্তা করা হচ্ছে বিশিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে। অস্থির করে তুলেছে সবাইকে। এ পরিস্থিতিতে সরকারের রাশ টেনে ধরতে সর্বত্রই শোনা যাচ্ছে আন্দোলনের আহ্বান। কঠোর আন্দোলনের মাধ্যমে স্বৈরনীতি রুখতে রাজপথে নামার হাতছানি এখন দিকে দিকে। তবে আন্দোলনের শক্ত কোনো প্ল্যাটফর্ম পাচ্ছে না কেউ।
এদিকে সরকার তাদের চলমান নীতিতেই দেশ পরিচালনায় তত্পর। ‘বিরোধী মত’ রুখতে ব্যবহার করা হচ্ছে নানা কৌশল। আন্দোলনের সব পথ বন্ধ করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যবহারের পাশাপাশি স্পর্শকাতর পেশাজীবী সংগঠনগুলো দখলের চেষ্টা চলছে। অন্য প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিকে বিতর্কিত করা এবং আইনের জালে আটকানো হচ্ছে। এ কাজে সরকার গোয়েন্দা সংস্থাকে ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লিখিত প্রতিশ্রুতির মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যা মামলার রায় কার্যকর এবং যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া শুরু ছাড়া বড় কোনো সফলতা তারা দেখাতে পারেনি। বিশেষ করে ইশতেহারে ‘অগ্রাধিকারের পাঁচটি বিষয়’ শিরোনামে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি প্রতিরোধ, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা, বিদ্যুত্ ও জ্বালানি সমস্যার সমাধান, দারিদ্র্য ঘুচাও বৈষম্য রোখো এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠার কথা উল্লেখ থাকলেও এসব ইস্যুতে তেমন কোনো সফলতা নেই।
বরং তাদের ব্যর্থতার বিরুদ্ধে যে কোনো ধরনের বক্তব্য-বিবৃতি, প্রচারণা-প্রতিবাদ রুখতে সরকার হার্ডলাইনে রয়েছে। বিরোধীদলীয় নেত্রীকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ থেকে শুরু করে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে বিতর্কিত করা এবং ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালকে আইনের মারপ্যাঁচে আটকানোর মতো কঠোর চেহারাও দেখিয়েছে সরকার। চ্যানেল ওয়ান ও একাধিক পত্রিকা বন্ধ করে দিয়ে গণমাধ্যমকেও ভয়ের মধ্যে রেখেছে।
শিক্ষাঙ্গন থেকে বিচার বিভাগ পর্যন্ত সর্বত্র নিজেদের লোক বসিয়ে দলের শাসন কায়েম করেছে। সরকারের এমন কঠোরতা রুখতে বিরোধী রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে পেশাজীবী ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোও মুখ খুলেছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ছোট-বড় কিছু কর্মসূচি পালন করলেও সরকারের হার্ডলাইনের বিরুদ্ধে তারা শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারছে না। সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদ, সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতি, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নসহ কয়েকটি সংগঠন ইস্যুভিত্তিক প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করলেও তাও তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি। সম্প্রতি আরও বেশ ক’টি মানবাধিকার ও শক্তিশালী সামাজিক সংগঠন সরকারের বিরুদ্ধে রাজপথে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছে। বিশেষ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রসহ নির্দলীয় প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেও গণতন্ত্র রক্ষায় কঠোর আন্দোলনের আহ্বান এসেছে।
প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে ব্যর্থ সরকার : দ্রব্যমূল্য বিষয়ে ১-এর ১ উপধারায় বলা হয়েছিল, ‘দ্রব্যমূল্যের দুঃসহ চাপ প্রশমনের লক্ষ্যে চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে স্থিতিশীল রাখার ব্যবস্থা করা হবে। দেশজ উত্পাদন বৃদ্ধিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে সময়মত আমদানির সুবন্দোবস্ত, বাজার পর্যবেক্ষণসহ বহুমুখী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। মজুতদারি ও মুনাফাখোরি সিন্ডিকেট ভেঙে দেয়া হবে, চাঁদাবাজি বন্ধ করা হবে। ভোক্তাদের স্বার্থে ভোগ্যপণ্য মূল্য নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ গড়ে তোলা হবে। সর্বোপরি সরবরাহ ও চাহিদার ভারসাম্য সৃষ্টি করে দ্রব্যমূল্য কমানো হবে ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করা হবে।’
দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে বলা হয়েছিল, ‘দুর্নীতি দমন কমিশনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে শক্তিশালী করা হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধে বহুমুখী কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হবে। ক্ষমতাধরদের বার্ষিক সম্পদ বিবরণী দিতে হবে। রাষ্ট্র ও সমাজের সব স্তরের ঘুষ, দুর্নীতি উচ্ছেদ, অনুপার্জিত আয়, ঋণখেলাপি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, কালোটাকা এবং পেশিশক্তি প্রতিরোধ ও নির্মূলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
সুশাসন প্রতিষ্ঠার বিষয়ে ৫-এর ২ উপধারায় বলা হয়েছিল, ‘বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা হবে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা হবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, স্বাধীন মানবাধিকার কমিশন গঠন ও ন্যায়পাল নিয়োগ করা হবে। মানবাধিকার লঙ্ঘন কঠোরভাবে বন্ধ করা হবে।’ আর ৫-এর ৩ উপধারায় বলা হয়, ‘নির্বাচন কমিশন এবং নির্বাচন পদ্ধতির চলমান সংস্কার অব্যাহত থাকবে। জাতীয় সংসদকে কার্যকর ও সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হবে। প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্য এবং সংসদ সদস্য এবং তাদের পরিবারের সম্পদের হিসাব ও আয়ের উত্স প্রতিবছর জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা সংক্রান্ত কতিপয় সুনির্দিষ্ট বিষয় ছাড়া সংসদ সদস্যদের ভিন্নমত প্রকাশের অধিকার দেয়া হবে।’ ৫-এর ৬ উপধারায় বলা হয়, ‘দলীয়করণমুক্ত অরাজনৈতিক গণমুখী প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করা হবে। যোগ্যতা, জ্যেষ্ঠতা ও মেধার ভিত্তিতে সব নিয়োগ ও পদোন্নতি নিশ্চিত করা হবে। প্রশাসনিক সংস্কার, তথ্য অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং ই-গভর্নেন্স চালু করা হবে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য স্থায়ী বেতন কমিশন গঠন করা হবে।’
নির্বাচনী ইশতেহারে এমন নানা আকর্ষণীয় প্রতিশ্রুতি দেয়া হলেও দু’বছরে দেশ পরিচালনায় সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র ছিল বলে বিশিষ্টজনরা মনে করেন। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ তো দূরে থাক, গত দু’বছরে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য ক্রমেই বেড়ে চলেছে। বিশেষ করে চাল, তেল, রসুন, হলুদ, আটা, ময়দাসহ সব জিনিসের দাম লাগামহীনভাবে বাড়ছে। এসব রোধ করতে সরকারের কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেই। গ্যাস, বিদ্যুত্ ও পানি সঙ্কট নিরসনে গণমাধ্যমে নানা বক্তৃতা-বিবৃতি শোনা গেলেও বাস্তবে শীতের সময়ও লোডশেডিং চলছে দেশব্যাপী। ঢাকার অধিকাংশ এলাকায় গ্যাস সঙ্কটে রান্নার কাজও বন্ধ থাকছে। সিএনজি স্টেশন বন্ধ রেখে পরিবহনের ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি করা হয়েছে। ঢাকার যানজট আরও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। জ্বালানি ও নিরাপত্তা নিশ্চয়তা না থাকায় বিনিয়োগ দিন দিন কমছে। নতুন কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে না। চাঁদাবাজি ও টেন্ডারসন্ত্রাসে জড়িয়ে পড়েছে সরকারি দলের নেতাকর্মীরা। ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতাকর্মীদের টেন্ডার ছিনতাই এখন নিত্যদিনের ঘটনা। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চললেও আইনশৃঙ্খলার ক্রমাবনতি হচ্ছে।
বেসরকারি শিক্ষকদের জাতীয় স্কেলের অধীনে নেয়ার কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেই। বেকার সমস্যা সমাধানে ফলপ্রসূ কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ন্যাশনাল সার্ভিসের নামে দলীয় কর্মীদের পুনর্বাসনের উদাহরণ সৃষ্টি করেছে সরকার। সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যায় তেমন কোনো প্রতিবাদ কিংবা দৃঢ় মন নিয়ে কোনো আলোচনাও করেনি সরকার।
সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা হলেও বর্তমান সরকারের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা সংসদকে ক্রমেই অকার্যকর করে ফেলা। বিরোধী দলের মুলতবি প্রস্তাব গ্রহণ না করা এবং প্রয়াত নেতাদের নিয়ে বিষোদ্গারের কারণে এখন কার্যত জাতীয় সংসদ অকার্যকর রয়েছে।
স্বৈরনীতিতে চলছে সরকার : শুরু থেকেই সরকার একের পর এক স্বৈরতান্ত্রিক পদক্ষেপ নিয়ে রাজনীতি, অর্থনীতিসহ জাতীয় স্বাধীনতাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। ভারতের সঙ্গে ৫০ দফার অসম চুক্তি, আলোচনা-পর্যালোচনা এবং জরিপ ছাড়াই ভারতকে ট্রানজিট ও বন্দর ব্যবহারের সুবিধা প্রদান, ভারতের ব্যবহারের জন্য রাস্তা তৈরিতে ঋণ গ্রহণের বিষয়টি এখনও জাতিকে স্পষ্ট করা হয়নি। শুরুতেই সবগুলো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় ভিসি নিয়োগ করা হয়। প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ে সরকার সমর্থকদের বসানো হয়। সবচেয়ে ন্যক্কারজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় উচ্চ আদালতে। দলীয় নেতাদের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি। এর বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতিসহ সচেতন আইনজীবীরা অবস্থান নিলেও সরকার তাদের পদক্ষেপ থেকে পিছপা হয়নি। আইনজীবীদের প্রতিবাদের মুখেও রুহুল কুদ্দুস তালুকদার ও খসরুজ্জামানকে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের ভয়াবহতা স্বৈরতান্ত্রিকতাকেও হার মানিয়েছে। সাবেক মন্ত্রী-এমপি থেকে শুরু করে পত্রিকা সম্পাদকদেরও রিমান্ডে নিয়ে বিবস্ত্র করার উদাহরণ সৃষ্টি করা হয়। দৈনিক আমার দেশ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান, সাবেক মন্ত্রী মির্জা আব্বাস, সাবেক প্রতিমন্ত্রী আ.ন.ম. এহছানুল হক মিলনকে রিমান্ডে নিয়ে অমানবিক নির্যাতন করা হয়।
সরকারের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের তথ্য প্রকাশে বিরত রাখতে গণমাধ্যমের ওপর সরকারি খড়গ এক-এগারোর সেনা সমর্থিত সরকারকেও ছাড়িয়ে যায়। সাজানো মামলার অভিযোগে একদিনের মধ্যেই দৈনিক আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। আদালতের রায়ের মাধ্যমে এখন পত্রিকাটি প্রকাশিত হচ্ছে। চ্যানেল ওয়ান বন্ধ করে দেয়া হয়। একাধিক টেলিভিশনের টকশো নোটিশ করে বন্ধ করা হয়।
বিরোধীদলীয় নেত্রীকে সেনানিবাসের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে হেনস্তা করা হয়। সংসদ সদস্য ও বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে গ্রেফতারের পর অমানবিক নির্যাতন করার অভিযোগ রয়েছে।
সরকারের সর্বশেষ স্বৈরতন্ত্রের শিকার নোবেল বিজয়ী প্রথম বাংলাদেশী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। খোদ প্রধানমন্ত্রীই জাতীয় সংসদে বিষোদ্গার করে ড. ইউনূসকে হেনস্তা করেছেন। রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে তাকে হয়রানি অব্যাহত রয়েছে। সরকারের চলমান দুর্নীতি, অনিয়ম ও দলীয়করণ তুলে ধরে রিপোর্ট প্রকাশ করে সরকারি খড়গের মুখে পড়েছে টিআইবি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে অধিকাংশ মন্ত্রী, পুলিশ কমিশনারসহ সবাই টিআইবির বিরুদ্ধে বিষোদ্গার অব্যাহত রেখেছেন। টিআইবি চেয়ারম্যান, নির্বাহী পরিচালক ও গবেষণা কর্মকর্তার বুিরদ্ধে মামলা এবং গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির মাধ্যমে নতুন এক ইতিহাসের সৃষ্টি হয়েছে। সর্বশেষ টিআইবিকে সুপ্রিমকোর্টে তলব করেও হয়রানি করা হয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে সবাই আতঙ্ক ও উদ্বেগের মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছে।
সর্বত্রই আন্দোলনের দাবি : সরকারের স্বৈরথাবায় ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় এখন সব শ্রেণী-পেশার মানুষের পক্ষ থেকে আন্দোলনের আহ্বান আসছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি শুরু থেকেই প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করে আসছে। দু’বছরে দেশব্যাপী তিনটি হরতাল ও অসংখ্য প্রতিবাদ সভা-সমাবেশ-শোভাযাত্রা করেছে দলটি। নতুন বছরে আরও কঠোর আন্দোলনের ঘোষণা রয়েছে তাদের। এ বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন আমার দেশকে বলেন, ‘জনগণকে সরকার ক্ষেপিয়ে তুলেছে। স্বাভাবিক জীবন নিয়ে মানুষ বাঁচতে পারছে না। তারা কঠোর আন্দোলন চায়। নতুন বছরে জনগণের এ চাওয়াকে সামনে রেখে বিরোধী দল রাজপথে কঠোর হবে।’
আরেক বিরোধী দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ ছয় নেতাকে নানা অভিযোগে গ্রেফতার করে কারারুদ্ধ রাখা হয়েছে। নেতাদের মুক্তি ও জনদাবি নিয়ে দলটি কিছু কর্মসূচি পালন করলেও নেতাকর্মীদের রাজপথে দাঁড়াতে দিচ্ছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এছাড়া চারদলীয় জোটের শরিক বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), ইসলামী ঐক্যজোট, খেলাফত মজলিস সভা-সমাবেশ করে যাচ্ছে। বিরোধী আরও ৮টি রাজনৈতিক দল ছোট ছোট কর্মসূচি পালন করেছে। চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশও সরকারের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে দু’চারটি প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে।
শিক্ষানীতিতে ধর্মকে অবজ্ঞার প্রতিবাদ ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনে অশ্লীলতার দায়ে মহাপরিচালককে অপসারণের দাবিতে ওলামা-মাশায়েখ পরিষদ ২৬ ডিসেম্বর হরতাল আহ্বান করেছিল। দাবি পূরণে আশ্বাসের প্রেক্ষিতে পরে হরতাল প্রত্যাহার করা হয়। অবশ্য দাবি বাস্তবায়নের পরিবর্তে ওলামা-মাশায়েখদের অবজ্ঞা করায় নতুন করে হরতালসহ কঠোর কর্মসূচি দেবে বলে দলটি ঘোষণা দিয়েছে।
বিরোধী দল দমনে আইনের ব্যবহার : এ বিষয়ে বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও জাতীয় অধ্যাপক ড. তালুকদার মনিরুজ্জামান বলেন, ‘সরকারের বিরুদ্ধে যখন সব মহলের নাভিশ্বাস ওঠে, তখন সবাই মিলেই একটি প্ল্যাটফর্ম গড়ে ওঠে। নির্যাতিতদের এ প্ল্যাটফর্ম থেকেই প্রতিবাদ-প্রতিরোধ শুরু হয়, যা অভ্যুত্থানেও রূপ নেয়। অবশ্য এজন্য দরকার হয় নেতৃত্ব। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে এমন আন্দোলন গড়ে তুলতে বিএনপিকে অগ্রভাগে থাকতে হবে। এছাড়া যে যার অবস্থান থেকেও বড় প্রতিবাদ গড়ে তুলতে পারে।’
সরকারের স্বৈরনীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনের বিষয়ে সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘১৯৭২ থেকে ৭৫ সাল পর্যন্ত সময়ের শাসনের চেয়ে দেশে ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। সরকার আইনকে বিরোধী দল দমনের জন্য ব্যবহার করছে। দেশের সিংহভাগ মানুষ অবিচারের শিকার। আইনজীবীদের প্রতিবাদের মুখেও উচ্চ আদালতে দলীয় বিচারপতি নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এসবের বিরুদ্ধে গণমানুষের আন্দোলনের বিকল্প নেই।’
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ বলেন, ‘দেশে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার বলতে কিছুই নেই। সব দিক বিবেচনা করলে অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে দেশের পরিস্থিতি এখন খুবই খারাপ। মানুষ জীবন নিয়ে শঙ্কিত ও উত্কণ্ঠিত। শাসক দলের অন্যায়, অত্যাচার ও নির্যাতন মুখ বুজে সহ্য করছে মানুষ। প্রতিবাদ করতে গেলে ‘পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রে’র কথা বলে তা স্তব্ধ করে দেয়া হচ্ছে। ‘মামলা আর রিমান্ড’ বিরোধী মতের লোকদের দমন করার জন্য এই হচ্ছে সরকারের অস্ত্র। সরকারের এ অন্যায়-অত্যাচার রুখতে গণআন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।’
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) চেয়ারম্যান এম হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, দেশে অঘোষিত ফ্যাসিজম চলছে। আইনের শাসন তো দূরের কথা, সরকার প্রতি পদে আইন ও সংবিধান লঙ্ঘন করে চলেছে। সরকারের বেআইনি কাজের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, প্রতিবাদ ও আন্দোলন হতে হবে। তা না হলে দেশে ফ্যাসিজম আরও শক্তিশালী হবে। গণতন্ত্র ও বহুমতের ধারাবাহিকতা হারিয়ে যাবে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল বলেন, আমরা দিন দিন গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছি। নির্বাচিত স্বৈরাচারের শাসন সামরিক শাসনের চেয়েও ভয়ঙ্কর। বর্তমানে দেশের মানুষ তা উপলব্ধি করতে পারছে। আইনের শাসন বলতে যা বোঝায়, বর্তমানে দেশে তা সম্পূর্ণই অনুপস্থিত। আমরা সবাই শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির মধ্যে বসবাস করছি। বিচার বিভাগের ওপরও মানুষের কোনো আস্থা নেই। হয়রানি ও নির্যাতনের ভয় থাকা সত্ত্বেও আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, দেশে বর্তমানে যে আইনবহির্ভূত শাসন চলছে—আমি তা মানি না। আমি এ ফ্যাসিজমের অবসান চাই। আজ সবাই আমরা অসহায় হয়ে পড়েছি। সরকারের এ অন্যায় নীতির বিরুদ্ধে তীব্র গণআন্দোলন প্রয়োজন। এজন্য জনমত গঠন করতে হবে।
সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের সদস্য সচিব অধ্যাপক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন বলেন, সরকার পদে পদে পেশাজীবীদের অধিকার খর্ব করছে। যোগ্য ও জ্যেষ্ঠদের ঢাকার বাইরে বদলি, ওএসডি ও চাকরিচ্যুত করে হয়রানি করা হচ্ছে। এতে চিকিত্সক, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ, শিক্ষক, সাংবাদিক কেউ তাদের সর্বোচ্চ সেবা দিতে পারছেন না। সবক্ষেত্রে দলীয়করণের মাধ্যমে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। আমরা পেশাজীবীদের অধিকারের পক্ষে কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছি। এখন রাজপথে কঠোর আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই।
শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোট চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ মো. সেলিম ভূঁইয়া বলেন, নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন বাদ দিয়ে এ সরকার শুধু দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে। শিক্ষকসহ গণমানুষ অধিকারহারা। আমাদের কোনো দাবিই সরকার বাস্তবায়ন করছে না। বরং দলীয় এমপিদের বসিয়ে স্কুল-কলেজে লুটপাট চলছে। এসবের প্রতিবাদে আমরা আন্দোলন করছি। ভবিষ্যতে আরও বৃহত্তর আন্দোলন কর্মসূচি পালন করা হবে।
এভাবে সর্বত্র আন্দোলনের আহ্বান থাকলেও রাজপথে কঠোরতা প্রদর্শনে শক্তিশালী কোনো প্ল্যাটফর্ম এখনও খুঁজে পাচ্ছে না তারা। অবশ্য সময়ের আবর্তে বিরোধী মতের ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্ম গড়ে উঠতে পারে বলে মনে করেন বিশিষ্টজনরা।
বিরোধী মত রুখতে তত্পর সরকার : এদিকে সর্বাত্মক আন্দোলন শুরুর আগেই সতর্ক অবস্থানে রয়েছে সরকার। বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দল এবং অধিকার নিয়ে পেশাজীবী ও শ্রমিকদের সব আন্দোলনকে পুলিশ-র্যাব দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করছে সরকার। প্রতিবাদ কর্মসূচি ও হরতালে বিএনপিকে কোনো মিছিলও করতে দেয়া হয়নি। আন্দোলন ঠেকাতে পুলিশ ও র্যাবকে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করা হয়েছে।
এদিকে সাধারণত যেসব সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ শুরু হলে তা কঠোর রূপ নেয়, সেসব স্পর্শকাতর স্থানে নিজেদের প্রতিনিধি বসাতে তত্পর রয়েছে সরকার। এরই মধ্যে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি পদে সরকার সমর্থিত ব্যবসায়ী নেতা এ কে আজাদ নির্বাচিত হয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদসহ অধিকাংশ পদে জয়ও ছিনিয়ে নিয়েছে তারা। গত দু’বছরে শতাধিক দলীয় কর্মীকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এ কাজে প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। আন্দোলনের মূল কেন্দ্রবিন্দু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় ভিসি ও প্রশাসন সাজিয়ে রেখেছে সরকার। আবাসিক হলগুলোও ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে রেখে বিরোধী সব ছাত্র সংগঠনকে ক্যাম্পাসের বাইরে রাখা হয়েছে। জাতীয় প্রেসক্লাব নির্বাচনেও দলীয় প্রার্থীদের জয় নিশ্চিত করতে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে কলকাঠি নাড়াচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সেখানেও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা নানা লিফলেট বিতরণ করছে। ঢাকা আইনজীবী সমিতির আগামী নির্বাচন নিয়েও চলছে সরকারের নানা পরিকল্পনা। এ বিষয়ে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম নেতা অ্যাডভোকেট মাসুদ আহমেদ তালুকদার বলেন, ‘দখলের মানসিকতা নিয়ে আওয়ামী লীগের পথচলা দীর্ঘদিনের। পেশাজীবী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঢাকা আইনজীবী সমিতিতেও প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে তারা। তবে বিচার বিভাগে সরকারি হস্তক্ষেপ রুখতে সাধারণ আইনজীবীরা এসব অপচেষ্টার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রস্তুত।’

No comments:

Post a Comment