Wednesday, 29 December 2010

সরকারের অস্তিত্ব কোথায়



ড. তারেক শামসুর রেহমান

গেল ২৪ ডিসেম্বর ঢাকার একটি দৈনিকের প্রথম পাতার খবর ‘পেঁয়াজের কেজি ৮০ টাকা’। বৃহস্পতিবার সাভার বাজারে দোকানি আমার কাছে চেয়েছিলেন ৭০ টাকা। মাত্র দু’দিন আগে যেখানে পেঁয়াজ ৪০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছে, হঠাত্ করে দুই দিনের ব্যবধানে ক্ষুদে দোকানিরা তা চাইছেন ৮০ টাকা করে। কী এক অদ্ভুত দেশে আমরা বসবাস করি! সরকারের এখানে কোনো অস্তিত্ব আছে কি? বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে কে? বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের কি কোনো ভূমিকা নেই? পেঁয়াজের এই মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে মূলত ভারত থেকে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দেয়ায়। ভারত সরকারের সিদ্ধান্ত অতিসম্প্রতি। কিন্তু এরই মধ্যে অনেক পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে, সেখানে তো মূল্যবৃদ্ধি কার্যকর হওয়ার কথা নয়। আসলে একটি অসাধু ব্যবসায়িক চক্র ভারতের সাময়িক রফতানি বন্ধের সুযোগ নিয়ে পেঁয়াজের মূল্য রাতারাতি বাড়িয়ে দিয়েছে। এমন নয় যে, বাজারে পেঁয়াজের সরবরাহ কম। বাজারে প্রচুর পেঁয়াজ রয়েছে। দোকানে দোকানে পেঁয়াজ; কিন্তু দাম আকাশ ছোঁয়া। এখানে যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দেয়, তা হচ্ছে ভারতে বেশক’টি রাজ্যে, যেখানে পেঁয়াজ উত্পাদন হয় বেশি, সেখানে খরার কারণে আশানুরূপ পেঁয়াজ উত্পাদন হয়নি। ভারত সরকার যেখানে সতর্ক হয়েছিল, সেখানে আমরা সতর্ক হলাম না কেন? এ খবর তো বেশ কয়েক মাস পুরনো। তাহলে সরকার সতর্ক হলো না কেন? কেন টিসিবিকে কার্যকর করা হলো না? এখানেই এসে যায় মূল কথাটি। সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ একটি গোষ্ঠী সিন্ডিকেট করে ভারতের ওপর আমাদের নির্ভরশীল করে তুলেছে। সুযোগ বুঝে তারা পেঁয়াজ গুদামজাত করে দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। খুচরা দোকানিদের নিয়ন্ত্রণ করার কেউ নেই। মূল্যবৃদ্ধির সুযোগ নিয়ে যে যেভাবে পারছে দাম হাঁকাচ্ছে। দেখার কেউ নেই। নিয়ন্ত্রণ করারও কেউ নেই। সাধারণ মানুষ আজ অসহায়। তাদের করার কিছুই নেই। অতিরিক্ত মূল্য দিয়েই পেঁয়াজ কিনতে হচ্ছে। আর পেঁয়াজ এমন একটি জিনিস, যা ছাড়া কোনো রান্নাই হয় না। স্বল্প আয়ের মানুষের দুঃখ-কষ্ট বাণিজ্যমন্ত্রী বুঝবেন না। কেননা, তাকে তো বাজার করতে হয় না। তিনি সংবাদপত্রে ছবি ছাপাতে পারছেন। চ্যানেলে ছবি দেখলে খুশি হন। তাই মাঝে-মধ্যে তথাকথিত বাজার পরিদর্শনের আগে সাংবাদিকদের খবর দেন। সাংবাদিক বন্ধুরা তার ছবি তুলে নিয়ে আসেন। এখন কোথায় বাণিজ্যমন্ত্রী? পেঁয়াজ যেখানে কেজি ৮০ টাকায়, তখন বাণিজ্যমন্ত্রীর ছবি আমি আর চ্যানেলে দেখি না।
অসাধু ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ করতে সরকারের ব্যর্থতা এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে গিয়ে উন্নীত হয়েছে। এখন পেঁয়াজের মৌসুম। এ সময় কোনো যুক্তিতেই কেজি প্রতি ৮০ টাকায় পেঁয়াজ বিক্রি হতে পারে না। অসাধু ব্যবসায়ীরা পেঁয়াজ মজুদ করছেন, এমন সংবাদও পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে; কিন্তু সরকারের উদ্যোগ কৈ? অতীতে এ ধরনের পেঁয়াজ সঙ্কটে থাইল্যান্ড, চীন, তুরস্ক ও মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছিল। শুক্রবার পর্যন্ত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কোনো টনক নড়েনি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যখন বৈঠকে বসবে, সিদ্ধান্ত নেবে এবং তা কার্যকর করবে, তত দিনে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ চরমে গিয়ে পৌঁছবে।গণতন্ত্রে একটি সরকার সাধারণ মানুষের ভোটে নির্বাচিত হয় বটে; কিন্তু সরকারের দক্ষতা নির্ভর করে ‘গুড গভর্নেন্স’-এর ওপর। অর্থাত্ এটা নির্ভর করে প্রশাসনের ওপর। নির্বাচনে বিজয় আর সুষ্ঠু প্রশাসন এক নয়। একটি দল বিজয়ী হতে পারে; কিন্তু সুষ্ঠু প্রশাসন নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হতে পারে। আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে এমনটিই হয়েছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সরকার ব্যর্থ হচ্ছে।
বিটিভিতে সরকারের ‘সাফল্য’ দেখালেও, বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা। গেল বুধবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে তেল ব্যবসায়ীদের বৈঠকে ঢাকা ও অন্যান্য জেলার জন্য সয়াবিনের সর্বোচ খুচরা দর ঠিক করে দেয়া হয়েছিল কেজি প্রতি ৯০ টাকা এবং পামঅয়েল ৮৬ টাকা; কিন্তু বাজারে এ দামে সয়াবিন বিক্রি হয়নি। তাহলে সরকারের অস্তিত্ব থাকে কোথায়? সরকার যদি মিল মালিক তথা অবৈধ ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে, তাহলে সেই সরকারের অস্তিত্ব তো থাকে না! নিন্দুকেরা বলেন, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রীর ‘অবৈধ সম্পর্ক’ (?) রয়েছে, যে কারণে বাণিজ্যমন্ত্রীর হুঙ্কারের পরও ব্যবসায়ীরা বাণিজ্যমন্ত্রীর কথাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না। কেউ যদি আজ বলেন বাণিজ্যমন্ত্রী ব্যর্থ, তাহলে তিনি কি ভুল বলবেন? সম্ভবত তিনি ভুল বলবেন না। কেননা, বাণিজ্যমন্ত্রী গত দুই বছরে তার আওতাধীন একটি সেক্টরেও কোনো সাফল্য দেখাতে পারেননি। শুনছি, প্রধানমন্ত্রী নাকি মন্ত্রীদের ‘পারফরমেন্স’ যাচাই করবেন। উদ্যোগটি নিঃসন্দেহে ভালো। যদি সত্যিকার অর্থে মন্ত্রণালয়গুলোর ‘পারফরমেন্স’ যাচাই করা হয়, তাহলে প্রথমেই বাদ পড়বেন বাণিজ্যমন্ত্রী; কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর আস্থাভাজন বাণিজ্যমন্ত্রী ‘পতাকাবাহী’ গাড়িতে চড়বেন না, এটা চিন্তা করাও যায় না। আমরা অপেক্ষায় রইলাম, দেখি প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রীদের কীভাবে মূল্যায়ন করেন।
শুধু পেঁয়াজ কিংবা ভোজ্যতেলের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে সরকারের ব্যর্থতা কেন বলি, চালের মূল্যবৃদ্ধি রোধ করতেও সরকার ব্যর্থ। চালের বাজার এখন অস্থির। সিন্ডিকেট করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন ধান-চালের বড় বড় মিল মালিকরা। ফলে আমাদের ভরা মৌসুমেও বাজারে চালের দাম না কমে উল্টো প্রতিদিনই বাড়ছে। মধ্যবিত্ত যে চালের ওপর নির্ভরশীল, বিশেষ করে মিনিকেট, নাজির শাইল চালের দাম এক সপ্তাহে বেড়েছে কেজিতে ৩ থেকে ৭ টাকা। পেঁয়াজের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে চালের দাম। বিআর-২৮ চালের দাম ৩৬ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে কেজি প্রতি ৪০ টাকা। আর বিআর-২৯ ৪০ টাকায়, পুরনো স্বর্ণা ৪০ টাকায় উঠেছে। মধ্যবিত্তরা এ চালের ওপরই নির্ভরশীল। আর ৩৫ টাকার নিচে কোনো মোটা চাল নেই। মিল মালিকদের কারসাজিতে সাধারণ মানুষ আজ অসহায়। প্রশ্ন হচ্ছে, মিল মালিকরা এ সাহস পান কোথায়? সরকারের একটা অংশের প্রচ্ছন্ন সমর্থন যদি না থাকে, তাহলে তো দফায় দফায় তারা চালের দাম বাড়াতে পারেন না। এই শীতের মৌসুমে যেখানে বাজারে প্রচুর শাক-সবজির সরবরাহ রয়েছে, সেখানে বৃহস্পতিবার একটা বাঁধাকপির দাম ২০ টাকা, আর ফুলকপি ৩০ টাকা। আমাকে বাজারে যেতে হয়। বাজারের দরদাম সম্পর্কে আমি মোটামুটি জ্ঞাত। প্রতিদিনই বিষয়টি আমার মাথায় খেলে যায়, তাহলে ক্রেতা অধিকার আইন তৈরি হলো কার জন্য? সরকারের কাজটি তাহলে কী? জনগণ ভোট দিয়ে একটি দলকে ক্ষমতায় পাঠিয়েছে। তারা এমপি হয়েছেন। মন্ত্রী হয়েছেন। এমপির সব সুযোগ-সুবিধা তারা নিচ্ছেন। রাষ্ট্র তাদের সব দিচ্ছে। আমজনতার এতে কিছু করার নেই; কিন্তু যার দায়িত্ব বাজার নিয়ন্ত্রণ করা, সাধারণ মানুষের স্বার্থরক্ষা করা, তিনি যদি তা করতে না পারেন, তাহলে তার ক্ষমতায় থাকার তো কোনো যুক্তি নেই। আইন আছে বাজার নিয়ন্ত্রণ করার; কিন্তু সেই আইন কার্যকর করবে কে? সরকারের এ দায় এড়ালে তো হবে না! দুই-একজন মন্ত্রী প্রায়ই বক্তৃতার সময় বিগত চারদলীয় জোট সরকারের তুলনা দেন; কিন্তু চারদলীয় জোট সরকারের প্রথম থেকে শেষ সময় পর্যন্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য কি এ পর্যায়ে ছিল? বাঁধাকপি কি ২০ টাকায় খেতে হয়েছে? এ নিয়ে আমি কোনো তুলনামূলক আলোচনায় যাব না। তবে আমি যা বুঝি, তা হচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা সরকারের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে চলবে আর সরকার এ ক্ষেত্রে উদাসীন থাকবে, এটা সমর্থনযোগ্য নয়। এর নাম গণতন্ত্রও নয়। সরকারকে অবশ্যই দায়বদ্ধ হতে হবে। বিষয়টি নিয়ে সংসদে আলোচনা হতে পারত। সেখানেও সুযোগ নেই। বিরোধী দল সংসদে যাচ্ছে না। আর অতীতে তারা যখন গেছে, তখন তারা কথা বলতে পারেনি। এই যে গণতন্ত্র, এই গণতন্ত্রকে আমরা কী বলব? লন্ডনের বিখ্যাত ‘দি ইকোনমিস্ট’ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গণতন্ত্র পর্যালোচনা করেছে। তারা ৪টি ভাগে এই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে ভাগ করেছে। যেমন—‘পূর্ণ গণতন্ত্র’, ‘খুঁতযুক্ত’, ‘হাইব্রিড বা শঙ্কর গণতন্ত্র’ এবং ‘কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা’। বাংলাদেশকে আমরা কোন পর্যায়ে ফেলব। এখানে সরকার আছে। নির্বাচিত সরকার। বিরোধী দলও আছে। বাজারের ওপর সরকারের কর্তৃত্ব নেই। সরকার হয়ে পড়ছে অনেকটা একদলীয়। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে জনগণ ভোট দেয়। সেই ভোটে একটি দল বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে; কিন্তু যে সরকার সুষ্ঠুভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারে না, ‘গুড গভর্নেন্স’-এর অভাব যেখানে, সেখানে সেই ব্যবস্থাকেও গণতন্ত্র বলা যায় না। ‘গুড গভর্নেন্স’ আর গণতন্ত্র পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। একটি ছাড়া অন্যটি চলে না।

No comments:

Post a Comment