Thursday 3 June 2010

চ্যানেল ওয়ান বন্ধ করে দিয়েছে সরকার



28/04/2010

স্টাফ রিপোর্টার
জনপ্রিয় বেসরকারি স্যাটেলাইট টেলিভিশন কেন্দ্র চ্যানেল ওয়ান বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। ঠুনকো অজুহাতে গতকাল সন্ধ্যা ৬টা ৪১ মিনিটে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশনের (বিটিআরসি) কর্মকর্তারা চ্যানেলটির গুলশান অফিসে গিয়ে সম্প্রচার বন্ধ করে দেন। এতে সেখানে কর্মরত ৪০০ সাংবাদিক, কর্মচারী ও কলাকুশলী বেকার হয়ে পড়েছেন। বন্ধের কারণ হিসেবে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু বলেন, টেলিযোগাযোগ আইন লঙ্ঘন করে চ্যানেল ওয়ান তাদের সম্প্রচার যন্ত্রপাতি ব্যাংকে বন্ধক রেখে পরবর্তীকালে সেগুলো নিলামে বিক্রি করে দেয়ার প্রেক্ষিতে সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে চ্যানেলের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বলেছেন, ভিন্নমত দলন ও কণ্ঠরোধের অংশ হিসেবে চ্যানেলটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বেশ কিছুদিন ধরে চ্যানেলের সংবাদ ও টকশো’র ব্যাপারে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছিল বলেও জানা গেছে। শেষ পর্যন্ত সরকারের রোষানলে পড়ে টিভি পর্দা থেকে হারিয়ে গেল চ্যানেলটি। চ্যানেলের অন্যতম পরিচালক মাজেদুল ইসলাম বলেছেন, তারা এখন আইনের আশ্রয় নেবেন।
গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় যথারীতি বুলেটিন প্রচার করছিল চ্যানেল ওয়ান। ওই সময়ই বিটিআরসির কর্মকর্তারা গুলশানের উদয় টাওয়ারে অবস্থিত চ্যানেলটির অফিসে ঢোকেন। বুলেটিনটি শেষ করতেও দেয়া হয়নি। তার আগেই সংবাদ পাঠককে চ্যানেল বন্ধের ঘোষণা দিতে হয়। বুলেটিনের মাঝখানেই প্রায় বাকরুদ্ধ কণ্ঠে খবর পাঠক শামীম মাহবুব বলেন, ‘প্রিয় দর্শক সম্ভাবনার কথা বলে’—এ স্লোগানে আধুনিক প্রযুক্তি নিয়ে ২০০৬ সালের ২৪ জানুয়ারি যাত্রা শুরু করে স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল ওয়ান। দীর্ঘ পথপরিক্রমায় এরই মধ্যে দেশ-বিদেশে দর্শকদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে চ্যানেলটি। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, ‘বিটিআরসির নির্দেশে এখন থেকে চ্যানেল ওয়ানের সম্প্রচার সাময়িকভাবে বন্ধ হচ্ছে। এজন্য চ্যানেল ওয়ানের সব দর্শক, কেবল অপারেটর, কলাকুশলী ও বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত। আশা করি খুব শিগগিরই আমরা আবারও আমাদের সংবাদ এবং অনুষ্ঠান নিয়ে ফিরে আসব আপনাদের মাঝে।’
গতকাল সন্ধ্যায় চ্যানেল ওয়ান বন্ধ করে দেয়ার জন্য বিটিআরসি কর্মকর্তারা যাওয়ার আগে প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে চ্যানেল ওয়ান পরিচালনাকারী কোম্পানি ওয়ান এন্টারটেইনমেন্ট টেলিভিশনের পরিচালক মাজেদুল ইসলাম বলেন, বিটিআরসি যে ক’টি শোকজ নোটিশ চ্যানেল ওয়ানকে পাঠিয়েছে, তার সবক’টির যথাযথ উত্তর দেয়া হয়েছে। চ্যানেল ওয়ানের বিষয়টি মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করার অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, প্রয়োজনে সরকারের সব কথা আমরা মেনে চলব। তিনি বলেন, চ্যানেল ওয়ানের সম্প্রচারযন্ত্র নিলামে বিক্রি হয়েছে কিনা সে বিষয়ে প্রাইম ব্যাংক কোনো নোটিশ পাঠায়নি। যন্ত্রপাতি নিলাম হওয়ার পর ব্যাংকের বিরুদ্ধে মামলা করে চ্যানেল ওয়ান। পরে হাইকোর্ট রায় দেন যন্ত্রপাতি নিলামে বিক্রি করা যাবে। এরপর ব্যাংক নিলামে যন্ত্রপাতি বিক্রি করে। তবে তারা বলেছে, লেনদেন পুরোপুরি না হওয়ায় যন্ত্রপাতি হ্যান্ডওভার করা হয়নি। এ বিষয়ে বিটিআরসি জানতে চাইলে তাদের কাছে পরিষ্কার ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে টেলিভিশনের বার্তা প্রধান রাশিদ-উন নবী বাবুও উপস্থিত ছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত চ্যানেল ওয়ানের শতাধিক কর্মীর চোখে ছিল জল। টেলিভিশনটির বিশেষ সংবাদদাতা কেরামতউল্লাহ বিপ্লব চ্যালেন ওয়ানের কর্মীদের পক্ষে বক্তব্য দেয়ার সময় বলেন, প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলে ৪০০ কর্মী দিশাহারা হয়ে যাবে। তারা কী খাবে, তাদের সংসার কিভাবে চলবে তা অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘চ্যানেল ওয়ানের বিষয়ে কোনো কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, তথ্যমন্ত্রী, বিটিআরসি মানবিক দিকটি বিবেচনা করবেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ভিন্নমতের আরও একাধিক চ্যানেলের ওপর সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে একই ধরনের চাপ ও হুশিয়ারি রয়েছে বলেও জানা গেছে। এর আগে বিগত জরুরি সরকারের সময়ে বন্ধ করে দেয়া হয় আরেক জনপ্রিয় স্যাটেলাইট চ্যানেল সিএসবি। অবশ্য গত বিএনপি সরকারের আমলে সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে একুশে টেলিভিশনের সম্প্রচারও বন্ধ হয়েছিল। বর্তমান সরকারের আমলে যমুনা টেলিভিশন আনুষ্ঠানিকভাবে সম্প্রচারে যাওয়ার আগেই তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়।
মন্ত্রীই প্রথম জানালেন চ্যানেল বন্ধের সিদ্ধান্তের কথা : গতকাল সচিবালয়ে মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে জাতীয় টেলিকম দিবস উদযাপনের প্রস্তুতি সভার পর ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু সাংবাদিকদের চ্যানেল ওয়ান বন্ধ করে দেয়া হবে বলে জানান। তারপর থেকেই ‘চ্যানেল ওয়ান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে’ এ ধরনের খবর ছড়িয়ে পড়ে। অন্যান্য টেলিভিশন চ্যানেলে ব্রেকিং নিউজ হিসেবে প্রচার করা হয় ‘চ্যানেল ওয়ান যে কোনো সময় বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে’। এতে হতবিহবল হয়ে পড়ে চ্যানেল ওয়ান কর্মীরা। মালিকানা বিবেচনা করে চ্যানেল ওয়ান বন্ধ করা হচ্ছে কি না—সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে টেলিযোগাযোগমন্ত্রী বলেন, এখানে মালিকানার কোনো বিষয় নেই। আর হুট করেই চ্যানেল বন্ধ করার সিদ্ধান্ত হয়নি। দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মন্ত্রী বলেন, মালিক দেখে চ্যানেল বন্ধ করা হলে আরও অনেক চ্যানেল বন্ধ করতে হয়। প্রসঙ্গত, চ্যানেল ওয়ানের অন্যতম মালিক ব্যবসায়ী গিয়াসউদ্দিন আল মামুন। মন্ত্রী বলেন, তাদের টিভি চ্যানেলের লাইসেন্স কেন বাতিল করা হবে না তা জানতে চেয়ে তিন মাস আগে চ্যানেল ওয়ান কর্তৃপক্ষকে নোটিশও দেয়া হয়। কিন্তু চ্যানেল ওয়ান কর্তৃপক্ষ ওই নোটিশের সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেনি। আর সে কারণেই চ্যানেলটি বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বর্তমানে অন্য প্রতিষ্ঠানের নামে আমদানি করা যন্ত্র দিয়ে চ্যানেল ওয়ান চলছে বলে জানান তিনি। মন্ত্রী বলেন, এ অবস্থায় সরকার এ প্রতিষ্ঠানটিকে চলতে দিতে পারে না। তারা যে অপরাধ করেছে, তার শাস্তি হচ্ছে চ্যানেলটি বন্ধ করে দেয়া। এ সময় বিটিআরসি চেয়ারম্যান জিয়াউদ্দীন আহমেদ বলেন, চ্যানেলটি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে সরকার একটি ন্যায়সঙ্গত সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
চ্যানেল ওয়ানের একটি সূত্র জানায়, গতকাল সকালে তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে ফোন করে তাদের জানানো হয়, চ্যানেল ওয়ান বন্ধ করে দেয়া হবে। বন্ধের সময় তারা যেন কোনো ধরনের ঝামেলা না করেন। তবে তথ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব (সম্প্রচার) আমিনুল ইসলাম জানান, এ বিষয়টি বিটিআরসির অধীনে। চ্যানেল ওয়ান বন্ধের ব্যাপারে তিনি কিছু জানেন না। তবে তিনি বলেন, চ্যানেল ওয়ানের মালিকানা, ব্যাংকঋণ ও যন্ত্রপাতি ক্রয় সংক্রান্ত বেশ কিছু জটিলতা রয়েছে।
উল্লেখ্য, দেশে এ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যতবার এসেছে ততবারই বিভিন্ন সংবাদ প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হয়েছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী আওয়ামী লীগের প্রথম শাসনামলে সরকারি নিয়ন্ত্রণে ৪টি সংবাদপত্র রেখে অন্যসব সংবাদপত্র বন্ধ করে দেয়া হয়। বেকার হয়ে পড়েন শত শত সাংবাদিক। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে দৈনিক বাংলা, বাংলাদেশ টাইমস, বিচিত্রা ও আনন্দ বিচিত্রা বন্ধ করে দিয়ে কয়েকশ’ সাংবাদিককে বেকারত্বের মুখে ঠেলে দেয়া হয়।
সংবাদ কর্মীদের মধ্যে উদ্বেগ, ক্ষোভ ও হতাশা : চ্যানেল ওয়ান বন্ধ করে দেয়ায় চ্যানেলটির কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং সংবাদকর্মীদের মধ্যে উদ্বেগ, ক্ষোভ ও হতাশা দেখা দিয়েছে। চ্যানেলটির নিউজ এডিটর ফাহিম আহমেদ তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েই এটা বন্ধ করেছে। এতে চার-পাঁচশ’ পেশাদার সাংবাদিক-কর্মচারী-কর্মকর্তা বেকার হলেন। অনেকের জীবন অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে গেল। হয়তো অনেককে পরিবার-পরিজন নিয়ে এখন খেয়ে না খেয়ে কাটাতে হবে নতুন চাকরি পাওয়ার আগ পর্যন্ত। তিনি বলেন, চ্যানেল ওয়ানের সাংবাদিক-কর্মচারীরা তাদের বিষয়টি মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনার আহ্বান জানিয়ে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছেন।
সম্প্রচার বন্ধের ব্যাপারে জানতে চাইলে চানেল ওয়ানের চিফ রিপোর্টার মোস্তফা আকমল অত্যন্ত আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, আমি প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে শুরু থেকেই জড়িত। এমন একটি জনপ্রিয় চ্যানেল যন্ত্রপাতি বিক্রির অজুহাতে বন্ধ করে দিলে এর সঙ্গে জড়িত সাংবাদিক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কী হবে সরকার কী তা একবার ভেবে দেখেছে? তিনি জানান, টেলিযোগাযোগমন্ত্রী সকালে বলেছেন চ্যানেল ওয়ান একটি পরিচ্ছন্ন বিনোদনমূলক নিরপেক্ষ চ্যানেল। যদি তাই হয় তাহলে এমন একটি চ্যানেল বন্ধ করার কী যৌক্তিকতা আছে? তিনি বলেন, চ্যানেল ওয়ান বন্ধ করে দেয়ায় এখানে কর্মরত সবাই একেবারে ভেঙে পড়েছেন। এখানে প্রায় চার-পাঁচশ’ সাংবাদিক-কর্মকর্তা-কর্মচারী কাজ করছিলেন। তাদের পরিবার মিলে এই মিডিয়ার সঙ্গে জড়িত প্রায় দশ হাজার লোক। সরকার কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার প্রতিশ্রুতি দিয়েই ক্ষমতায় এসেছে। তাদের কাছে আমাদের দাবি, ভুল যদি হয়েও থাকে তাহলে তার জন্য দায়ী মালিকপক্ষ। কোনোভাবেই স্টাফরা নন। সমস্যা হলে সমাধানও আছে। কিন্তু চ্যানেল বন্ধ করে দিয়ে সমাধান খোঁজা ঠিক হবে না। তিনি বলেন, আমরা বিটিআরসি কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি, মালিকপক্ষের কোনো ভুল থাকলে প্রশাসক নিয়োগ করুন। নতুবা আপনারা চালান। তবু চ্যানেলটি বন্ধ করবেন না।
স্পোর্টস এডিটর পরাগ আরমান ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, সব শেষ হয়ে যাওয়ার পর প্রতিক্রিয়া জানিয়ে কি লাভ। প্রেজেন্টার কাম নিউজরুম এডিটর শবনম নূপুর বলেন, ভীষণ খারাপ লাগছে। এটা যে আবার কবে চালু হবে তা জানি না। নেটওয়ার্ক ইনচার্জ মনিরা তানভীন টুলি চ্যানেল ওয়ান বন্ধের ঘোষণা শুনে প্রায় কেঁদেই ফেলেন। তিনি বলেন, অসুস্থ হয়ে ক’দিন বাসায় ছিলাম। বাসায় বসেই টিভিতে ঘোষণাটি শুনলাম। চ্যানেল বন্ধের এই ঘোষণাটি আমার কাছে বিনামেঘে বজ্রপাতের মতো মনে হয়েছে। তিনি বলেন, চ্যানেল ওয়ানের সাংবাদিক ও স্টাফদের অবস্থা খুবই খারাপ। তারা বিশ্বাসই করতে পারছেন না তাদের প্রিয় চ্যানেলটি বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি সরকারের কাছে আহ্বান জানান, সমস্যা সমাধান করে তাড়াতাড়ি যেন এই চ্যানেলটি খুলে দেয়া হয়।

http://www.amardeshonline.com/pages/details/2010/04/28/29513

No comments:

Post a Comment