Friday 4 June 2010

খারাপ দৃষ্টান্ত

সৈয়দ আবুল মকসুদ

গতকালের একটি বিস্ময়কর সংবাদ। দৈনিক আমার দেশের ডিক্লারেশন বাতিল করে পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করতে মধ্যরাতে তার অফিসে শতাধিক পুলিশের অভিযান। ঘটনাটি ষাটের দশকে আইয়ুব আমলে ইত্তেফাক ও সংবাদ পত্রিকার ডিক্লারেশন বাতিল এবং সম্পাদকদের গ্রেফতারের ঘটনাই স্মরণ করিয়ে দেয়।

রাতে যখন আমার দেশের প্রথম সংস্করণ ছাপা হচ্ছিল, কয়েক হাজার কপি ছাপাও হয়ে যায়, তখন পুলিশ গিয়ে কাগজের প্রেস সিলগালা করে দেয়। ওই প্রেস থেকেই আরও দুটি দৈনিক ছাপা হয়। যে অভিযোগে আমার দেশের ডিক্লারেশন বাতিল ও সম্পাদককে গ্রেফতারের জন্য হানা দেয়া হয়, তা খুবই ঠুনকো।

প্রচলিত আইন অনুযায়ী কাজটি করেছেন ঢাকার জেলা প্রশাসক। আসলে তিনি হুকুমবরদার মাত্র। কাজটি হয়েছে সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে। এবং যে কোন সাধারণ মানুষও বোঝে, সে নির্দেশের পেছনে রয়েছে রাজনীতিÑ আর কিছু নয়।

ভিন্নমত সহ্য করতে না পারা স্বৈরশাসকদের চারিত্র্য। গণতান্ত্রিক শাসকদের কাছে তা প্রত্যাশিত নয়। কিন্তু আমরা এটাও জানি এবং কুড়ি শতকের ইতিহাসও সাক্ষ্য দেয়, গণতন্ত্রের সূতিকাগার থেকেই ফ্যাসিবাদ জš§ নেয়। হিটলার বা মার্কোস নির্বাচিত শাসক ছিলেন। ফ্যাসিবাদের সবচেয়ে বড় শত্র“ সংবাদমাধ্যম। স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে হত্যার মধ্য দিয়েই স্বৈরাচারী শাসন শক্তি অর্জন করে।

বর্তমান মহাজোট সরকার সম্পর্কে তাদের প্রতিপক্ষরা বলছেন, তারা বাকশালের পথেই যাচ্ছেন। আমরা তা বিশ্বাস করতে চাই না। গণতন্ত্রের প্রতি শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের অঙ্গীকার অটুট আছে এবং থাকবে, সে বিশ্বাস নষ্ট করতে চাই না। কিন্তু কষ্ট হয়েছে যখন দেখেছি, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ই স্বাধীনতার পরেও গণকণ্ঠসহ কয়েকটি কাগজ বন্ধ করে দেয়া হয়।

আমার দেশ কর্তৃপক্ষ গতকালই আশঙ্কা করছিল, তাদের ওপর আঘাত আসতে পারে। একটা চক্রান্ত চলছে, তা তারা টের পেয়েছিলেন। সংবাদ সম্মেলন করে মাহমুদুর রহমান তা বলেছেনও। এর মধ্যেই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর সরকারের অসহিষ্ণুতার লক্ষণ প্রকাশ পেয়েছে। চ্যানেল ওয়ান বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। টকশোর ওপর নানারকম নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। ফেসবুক বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। যমুনা টিভির প্রচারে অনুমতি দিতে সরকার গড়িমসি করছে। এসবই মতপ্রকাশের ওপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নিষেধাজ্ঞা। বিশেষ করে ভিন্নমতকে সরকারের ভয়।

যে প্রক্রিয়ায় আমার দেশের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদককে গ্রেফতার করা হয়, তাকে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। আজ বাংলাদেশে হাজার হাজার রাজনৈতিক সন্ত্রাসী দিনদুপুরে অপরাধ করে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমাদের পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেট তাদের চুলটিও স্পর্শ করেন না। এ অবস্থায় একজন সম্পাদককে ওভাবে গ্রেফতার সাধারণ শিষ্টাচারের প্রতি চরম অসম্মান প্রদর্শন।

একটি কাগজ বন্ধ হলে শুধু পত্রিকার মালিক ক্ষতিগ্রস্ত হন না, কয়েকশ’ পরিবার বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে। এভাবে ভিন্নমতাবলম্বী পত্রিকা বন্ধ করা আর একটি চালু শিল্প-কারখানা বন্ধ করা একই কথা। কোন কাগজের মালিক, প্রকাশক, সম্পাদক অন্যায় করে থাকলে তার বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে। আদালতে বিচারের পর তাদের শাস্তি হতে পারে। কিন্তু কোন অজুহাতেই পত্রিকা বন্ধ করা যায় না। পত্রিকা বন্ধ শুধু মালিকের ক্ষতি নয়, পাঠক ও জনগণেরও ক্ষতি। জনগণের ক্ষতি করার অধিকার কোন সরকারের নেই। সংবাদমাধ্যমের ওপর আঘাত গণতন্ত্রের ওপরই আঘাত। সে আঘাত জনগণের নাগরিক অধিকারের ওপর আঘাত। সে আঘাত মানবাধিকারের ওপর আঘাত।

মাহমুদুর রহমানের রাজনৈতিক বিশ্বাস ও তার নীতি-আদর্শের সঙ্গে আমি মোটেই সহমত পোষণ করি না। কিন্তু তার এই গ্রেফতারকে আমি প্রতিহিংসামূলক কাজ এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিপীড়ন করা ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারি না।

আমি এক সময় একটি দৈনিকের সম্পাদক ছিলাম এবং একজন লেখক ও সচেতন নাগরিক হিসেবে অবিলম্বে মাহমুদুর রহমানের মুক্তি দাবি করি। আশা করি, সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হবে এবং পত্রিকার ডিক্লারেশন বাতিলের আদেশ বাতিল করে অবিলম্বে আমার দেশ প্রকাশের পথে স্বেচ্ছাচারী বাধা অপসারণ করা হবে।
সৈয়দ আবুল মকসুদ : লেখক ও গবেষক
[সূত্রঃ যুগান্তর, ০৩/০৬/১০]

No comments:

Post a Comment