Friday 4 June 2010

মাহমুদুর রহমান ও দৈনিক আমার দেশ

ফরহাদ মজহার

বহুল প্রচারিত জাতীয় দৈনিক আমার দেশ পত্রিকা মহাজোট সরকার বন্ধ করে দিয়েছে। বলা বাহুল্য, চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রশ্নে যে সাংবিধানিক ও নাগরিক অধিকারের কথা সাধারণত বলা হয়ে থাকে এবং দাবি করা হয় বাংলাদেশের সংবিধান নাকি সেই অধিকার স্বীকার করে­ সেই অধিকার আমরা প্রকাশ্যেই দলিত-মথিত হতে দেখলাম। নাগরিক ও মানবিক অধিকারের ফানুস সশব্দে ফুটা হয়ে গেল আমাদের চোখের সামনেই। স্রেফ গায়ের জোরে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে আমার দেশ। তবুও যাঁরা মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের প্রতি ক্ষমতাসীনদের প্রতিশ্রুতিকে এখনো মূল্য দেন, তারা এর নিন্দা করবেন, নিন্দা করছেনও অনেকে। তবে এগুলো কদলির বাইরের খোসা। কাঁচকলার ভেতরতাও যে কাঁচকলা সেটা আমরা ক্রমে ক্রমে আরো বুঝব।

এ কথা আমি স্বীকার করি, মাহমুদুর রহমান আমার বন্ধু। কিন্তু এই বন্ধুত্বের চরিত্র আলাদা। আমাদের সংস্কৃতিতে বন্ধুত্বকে আমরা ব্যক্তিগত ব্যাপার বলে মনে করি। কিন্তু মাহমুদুর রহমানের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব কোন ব্যক্তিগত কারণে গড়ে ওঠেনি। সেটা গড়ে উঠেছিল রাজনৈতিকতার সংজ্ঞায় শত্রু ও মিত্র নির্ধারণের মানদণ্ড দিয়ে। বাংলাদেশে জনগণের রাজনৈতিক শত্রুদের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলা, সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থ রক্ষা করবার জন্য জনগণের বন্ধুদের মধ্যে পথ ও কাজের কৌশলের পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও মৈত্রীর পথ অনুসন্ধান, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে অর্থপূর্ণ করে বিশ্বব্যবস্থায় ইজ্জত নিয়ে বাঁচা, বাংলাদেশকে সমৃদ্ধির পথে নেবার নীতি ও কৌশলের জায়গাগুলো পরিষ্কার করা­ ইত্যাদির মধ্য দিয়েই আমাদের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। কয়েকটি বিষয়ে আমাদের চিন্তার ঐক্য দ্রুত আমাদের কাছাকাছি নিয়ে আসে। এক. পরাশক্তির হস্তক্ষেপে এবং বাংলাদেশের কয়েকটি গণমাধ্যম ও তথাকথিত সুশীলসমাজের মীরজাফরী বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে, এদের রুখে দিতে হবে। যারা বাংলাদেশকে ধ্বংস করতে চাইছে সেই সকল গণশত্রুদের বিরুদ্ধে জনগণকে সচেতন ও ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। দুই. বাংলাদেশকে ইসলামি সন্ত্রাসীদের ‘আখড়া’ প্রমাণ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইজরায়েল ও ভারত বাংলাদেশকে আরেকটি আফগানিস্তান বানাতে চাইছে, তাকে রুখতে হবে। বিশেষত ভারতের শাসক শ্রেণী চাইছে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আড়ালে ভারতের পূর্বাঞ্চলের স্বাধীনতা সংগ্রামকে নিশ্চিহ্ন করবার জন্য বাংলাদেশকে যুদ্ধের ময়দানে পরিণত করা। তিন. বাংলাদেশকে লুণ্ঠনের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করবার ক্ষেত্রে বহুজাতিক কম্পানি ও তাদের স্থানীয় দালালদের তৎপরতা রুখে দেওয়া। বলা বাহুল্য গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী প্রতিটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলে এই দালালরাই সবচেয়ে শক্তিশালী। এক কথায় গণশত্রুদের বিরুদ্ধে গণশক্তির বিকাশ ঘটানোর রাজনৈতিক কর্তব্যই আমাদের বন্ধুত্বের ভিত্তি তৈরি করেছে। শত্রুকে সুনির্দিষ্ট করা ও বন্ধুকে চেনার মধ্য দিয়েই আমরা পরস্পরকেও চিনেছি।

ব্যক্তিগত বন্ধুত্বের রাজনৈতিক দিক নিয়ে কথা বলছি কারণ এখন অনেকে আমার দেশ পত্রিকা ও মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে সরকারের আচরণের নিন্দা করছেন। কিন্তু অনেকে তাঁদের ব্যক্তিগত পাতি বুর্জোয়া অহঙ্কার কাটিয়ে উঠতে পারছেন না দেখে তাঁদের প্রতি আমার করুণা হচ্ছে। অনেকে দাবি করছেন মাহমুদুর রহমানের সঙ্গে তাঁদের চিন্তা, জীবনবোধ ইত্যাদির নাকি পার্থক্য আছে। কী পার্থক্য? করুণা হয় এই কারণে যে তাঁরা খোলাসা করে বলতে পারছেন না কোথায় তাদের পার্থক্য। এই অহঙ্কারকে আমি পাতি বুর্জোয়া বলছি এই কারণে যে রাজনীতিতে শত্রুমিত্র নির্ধারণের প্রশ্ন ঠিক হয় ব্যক্তিগত মতপার্থক্য বা জীবনবোধ নিয়ে ভিন্ন অবস্থান দিয়ে নয়, বরং বর্তমানের রাজনৈতিক কর্তব্য চিহ্নিত করার মধ্য দিয়ে। সেই দিক থেকে ওপরে বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থ রক্ষার প্রশ্নে যে তিনটি অবস্থানের কথা বলছি, সেই অবস্থান নিয়ে বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক মিত্রদের সঙ্গে অবশ্যই তর্ক হতে পারে, কিম্বা নতুন প্রসঙ্গ যুক্ত হতে পারে। কিন্তু শত্রু নির্ধারনের প্রশ্নে যদি আমরা সুস্পষ্ট থাকি তাহলে ঠিক এই সময়ে, যখন ফ্যাসিবাদ তাঁর হিংস্র থাবা নিয়ে আমার দেশ ও মাহমুদুর রহমানকে ধ্বংস করতে উদ্যত তখন এই ‘ব্যক্তিগত’ মতপার্থক্যকের কেচ্ছা শোনানো শেয়াল পণ্ডিতের মতো হাস্যকর শোনায়। সরকারের নিন্দা তখন হিপোক্র্যাসি হয়ে ওঠে।

প্রথম আলোয় মিডিয়া ভাবনায় মুহম্মদ জাহাঙ্গির লিখছেন, “পাঠক জানেন, আমার দেশ একটি বিরোধী দল সমর্থিত পত্রিকা। শুরু থেকেই পত্রিকাটি সরকারের নানা সমালোচনা করছে। বিরোধী দলের পত্রিকা যেমনটি হয়। তা ছাড়া পত্রিকাটি একটি বিশেষ বিরোধী দলের মুখপত্রের মতো সাংবাদিকতা করে থাকে। সংবাদপত্রে এ ধরনের ‘দলীয় মুখপত্র’ কতটা সমর্থনযোগ্য, সেটা ভিন্ন প্রশ্ন। সেই বিতর্ক হতেই পারে। কিন্তু দেশে যখন বহুদলীয় গণতন্ত্র চালু রয়েছে, তখন ভিন্নমতের সংবাদপত্রকে সহ্য করতে সরকার বাধ্য। ভিন্নমতের সংবাদপত্র ও টিভি গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত। সরকার আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ ঘোষণা করে গণতন্ত্রের প্রতি তাদের অঙ্গীকারের দুর্বলতাই প্রকাশ করেছে। আমার বিশ্বাস, সরকারের বহু সমর্থকও এই পদক্ষেপকে সমর্থন করতে পারছে না।”

প্রশ্ন হোল, এক-এগারোর সময় প্রথম আলোর ভূমিকা এবং বাংলাদেশে জনগণের স্বার্থের বিবেচনায় প্রথম আলোর সাংবাদিকতার নীতি কি সমর্থনযোগ্য? আমরা কি সাংবাদিকতার নীতির বিচার নিয়ে এখন তর্ক করব? প্রথম আলো কার স্বার্থ রক্ষা করে? এখন আমার দেশ পত্রিকাকে দলীয় মুখপত্র বলে স্নেহভাজন জাহাঙ্গির তার বাকি কথাগুলোর ওজন কমিয়ে দিয়েছেন। একই তারিখে প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সংযত হলেও আমরা একই সুর শুনি। তারা লিখেছেন, ‘আমার দেশ পত্রিকার মালিকানা, পুঁজি, মালিকানা বদল, এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাংবাদিকতার নীতিমালা কতটা স্বচ্ছ কিংবা নীতিসম্মত ছিল, সে বিষয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। কিন্তু সেটা সম্পূর্ণ ভিন্ন বিতর্ক। আমরা যে কারণে উদ্বিগ্ন তা হলো, ভিন্নমতকে জব্দ করতে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহারের বিষয়টি।’ বেশ।

কথা হোল প্রশ্ন থাকতে পারে কার? কিসের? মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে প্রথম আলোর ভূমিকা সম্পর্কে আমরা সচেতন ও সজ্ঞান। আমাদের সমাজ বিভক্ত। আমরা কেউ বাংলাদেশ রক্ষা করতে চাই, আর কেউ চায় তা ধ্বংস করতে। এখানে শত্রুমিত্রের বিভাজন তৈরি হয়। ভিন্নমতকে জব্দ করতে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহারের বিষয়টি উদ্বিগ্নের সন্দেহ নাই, কিন্তু ভিন্নমতকে জব্দ করতে প্রথম আলোকে কি ব্যবহার করা হয় নি? অবশ্যই হয়েছে। প্রথম আলো কি স্বেচ্ছায় অন্যের ভাড়া খাটে না? অবশ্যি খাটে। প্রথম আলোর সাংবাদিকতার নীতি নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন আছে। কথাটা বলছি বাধ্য হয়ে। কারণ প্রথম আলো কথাটা তুলতে চাইছে। আমাদেরও প্রশ্ন, সাংবাদিকতার নীতিমালা প্রথম আলোয় কতটা স্বচ্ছ কিংবা নীতিসম্মত?

আমার দেশ পত্রিকার প্রেস সিলগালা করে বন্ধ করে দেওয়া, মধ্যরাতে বিরাট পুলিশ বাহিনী নিয়ে পত্রিকার সম্পাদককে গ্রেফতার করা, পত্রিকার প্রকাশককে তাঁর বাসা থেকে বিশেষ বাহিনী দিয়ে ধরে নিয়ে যাওয়া ও দুটি সাদা কাগজে প্রকাশকের সই নেওয়া তো মইন উদ্দিন-ফখরুদ্দীন সরকারের আমল থেকেই শুরু হয়েছে। প্রথম আলো ছিল সেই সরকারের সমর্থক। এক-এগারোর সেনাসমর্থিত বিশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কর্মকাণ্ডের কি সহযোগী ছিল না প্রথম আলো?

তবু আমরা প্রথম আলোসহ গণমাধ্যমের এই অবস্থানের প্রশংসা করি। আমরা অতীতে ভুল করতে পারি। দেশ ও দশের স্বার্থে যথাসম্ভব সকলকে নিয়েই ফ্যাসিবাদী শক্তিকে আমাদের মোকাবেলা করতে হবে। ঘটনার পর্যালোচনা এবং গণশক্তি পরিগঠনের প্রতি লক্ষ রেখে কোন দিকে আমাদের নজর নিবদ্ধ রাখতে হবে সেই দিকগুলো নির্দিষ্ট করাই এখন সকলের কাজ। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতার সঙ্গে নির্বাহী ও বিচার বিভাগের সম্পর্ক, সংবিধান ও আইনের মধ্যে পার্থক্য, বুর্জোয়া রাষ্ট্রে নাগরিক ও মানবিক অধিকারের প্রতি এক দিকে প্রতিশ্রুতি অন্য দিকে দিকে তার লঙ্ঘন ইত্যাদি দিক কখনো স্পষ্ট আবার কখনো প্রচ্ছন্নভাবে ফুটে উঠেছে। আমার দেশ-এর ডিক্লারেশান বাতিল, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার, ওই পত্রিকার সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ঢালাওভাবে মামলা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে এই সম্পর্কগুলোকে যতটুকু সম্ভব আমাদের সবাইকেই বুঝতে হবে।

আমার দেশ পত্রিকার আইনি গাফিলতির যে কাহিনী সরকার ও সরকারের সমর্থকরা বানিয়েছিলেন এবং গণমাধ্যমগুলো মাঝে মধ্যে যার প্রতিধ্বনি তুলছে, তাকে নাকচ করা দরকার। সংক্ষেপে সেই কাজ সম্পন্ন করবার জন্য আমি চিন্তা ওয়েবসাইটের (chintaa.com) শরণাপন্ন হচ্ছি। তাঁদের তৈরি ঘটনাক্রমটাই আমি টুকছি। এবং তাঁদের বিশ্লেষণ।

২৬ এপ্রিল ২০০৯ঃ ঢাকার জেলা প্রশাসককে আমার দেশ পাবলিকেশন্স লিমিটেড চিঠি দিয়ে জানায় যে, কম্পানির বোর্ড অব ডিরেক্টরসের সিদ্ধান্ত মোতাবেক কম্পানির চেয়ারম্যান মাহমুদুর রহমান আমার দেশের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক নিযুক্ত হয়েছেন। উল্লেখ্য, প্রিন্টিং প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অ্যাক্ট ১৯৭৩-এর নিয়ম অনুযায়ী সম্পাদক নিয়োগ-প্রত্যাহার-বদল ইত্যাদি সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসনকে জানাতে হয়।

১৬ জুন ২০০৯ঃ জেলা প্রশাসনের তরফে ঢাকার বিশেষ পুলিশ সুপার আমার দেশ পাবলিকেশন্স লিমিটেডকে জানান যে, নিযুক্ত ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের বিষয়ে জেলা প্রশাসনের আপত্তি নেই।

৩ সেপ্টেম্বর ২০০৯ঃ মুদ্রণালয়ের নিয়ন্ত্রক ও মুদ্রাকরের নাম বদলের জন্য কম্পানি আবেদন করে জেলা প্রশাসকের কাছে­ তিয়াত্তর সালের প্রিন্টিং প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অ্যাক্ট অনুযায়ী। এবং আইনের বিধান অনুযায়ী এই বদলের বিষয়ে আদালতে ঘোষণাপত্র দেয়। একই সাথে পত্রিকার প্রকাশক বদল করে নতুন প্রকাশক হিশাবে মাহমুদুর রহমানের দায়িত্ব গ্রহণের বিষয়টিও জেলা প্রশাসনকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়।

১১ অক্টোবর ২০০৯ঃ এই দিন সাবেক প্রকাশক হাসমত আলী জেলা প্রশাসনের কার্যালয়ে গিয়ে আইনে নির্ধারিত ফরমে স্বাক্ষর করে ঘোষণা দেন যে, তিনি প্রকাশকের পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন। (বিবিসির সাথে সাক্ষাৎকারে জেলা প্রশাসকের দেয়া বক্তব্য অনুযায়ী)।

৫ নভেম্বর ২০০৯ঃ চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর প্রকাশক বদল বিষয়ে এই দিন অনাপত্তিপত্র দেয়। অধিদপ্তরের উপপরিচালক মাসুদা খাতুন স্বাক্ষরিত ওই পত্রে বলা হয়, ‘আমার দেশ পত্রিকার প্রকাশক আলহাজ্ব মোঃ হাসমত আলীর পরিবর্তে জনাব মাহমুদুর রহমানের নাম প্রতিস্থাপন করার অনুমোদন দেয়া যেতে পারে।’

১৫ মার্চ ২০১০ঃ এই দিন ঢাকার জেলা প্রশাসন এক চিঠিতে আমার দেশ পাবলিকেশন্স লিমিটেডের কাছে জানতে চায় যে, দৈনিক আমার দেশের প্রিন্টার্স লাইনে কেন এখনো প্রকাশক হিশাবে হাসমত আলীর নাম ছাপা হচ্ছে? জবাবে আমার দেশ চিঠিতে জানায় যে, ৩ সেপ্টেম্বর ২০০৯ তারিখে জেলা প্রশাসনকে মুদ্রণালয়ের নিয়ন্ত্রক-মুদ্রাকর ও প্রকাশক বদল বিষয়ে জানানো হলেও এখনো এ বিষয়ে আপত্তি বা অনাপত্তি জানানো হয়নি। কাজেই প্রিন্টিং প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অ্যাক্ট অনুযায়ী বাধ্যবাধকতা থাকার কারণে এখনো আগের প্রকাশকের নামই প্রিন্টার্স লাইনে ছাপা হচ্ছে। একই সাথে কম্পানি কর্তৃপক্ষ জেলা প্রশাসনকে অনুরোধ জানায় খুব দ্রুত তাদের আবেদন নিষ্পত্তি করতে।

১ জুন ২০১০ঃ এই দিন রাতে স্থানীয় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তার বাহিনী নিয়ে পত্রিকাটির তেজগাঁও শিল্প এলাকস্থ প্রেসে যান এবং প্রেসটি সিলগালা করে বন্ধ ঘোষণা করেন। যদিও সংবাদমাধ্যমকে তারা বলেন যে, পত্রিকাটির কোনো বৈধ প্রকাশক না থাকার কারণে পত্রিকাটির ডিক্লারেশন মানে প্রকাশনা বাতিল করেছে জেলা প্রশাসন, ওই সময় তারা প্রকাশনা বাতিল করা বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্র কর্মরত সাংবাদিক ও কর্মচারীদের বা বাইরে অপেক্ষারত সংবাদমাধ্যমকে দেখান নি। এই প্রতিবেদক ১ জুন দিবাগত রাত নয়টা থেকে শুরু করে ২ জুন ভোর পৌনে পাঁচটাতক পত্রিকাটির কাওরান বাজারস্থ বার্তা, সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক বিভাগে হাজির ছিলেন, পুরো সময়ে কোনো আনুষ্ঠানিক দলিলপত্র পত্রিকার কার্যালয়ে পৌঁছায় নি জেলা প্রশাসন।

এবং এখনো এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে, লিখিতভাবে ডিক্লারেশন বাতিল করার বিষয়ে পত্রিকাটিকে কিছুই জানায় নি প্রশাসন। অবশ্য বিবিসি রেডিওর বাংলা বিভাগকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ঢাকা জেলা প্রশাসক জনাব মুহিবুল হক কিছু বিষয়ে কথা বলেছেন। অতএব ‘সরকারের বক্তব্য’ কেবল এইটুকুই। সাক্ষাৎকারের প্রচারিত অংশের হুবহু পাণ্ডুলিপি তুলে দিচ্ছি।

জেলা প্রশাসকঃ অ্যাকচুয়ালি আমার দেশ পত্রিকার বর্তমানে কোনো প্রকাশক নেই। নেই বলতে বৈধ কোনো প্রকাশক নেই। কোনো পত্রিকা যদি প্রকাশ করতে হয় তাহলে বৈধ যে আইনটা আছে, ছাপাখানা ও প্রকাশনা আইন ১৯৭৩-এর ৫ ধারা অনুযায়ী একজন প্রকাশক থাকতে হবে এবং ৭ ধারা অনুযায়ী তাকে আমাদের সাথে এখানে একটা ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করতে হবে। এই পত্রিকার যে বৈধ প্রকাশক ছিলেন তিনি আমাদের অফিসে এসে স্বেচ্ছায় নির্ধারিত ফরমে স্বাক্ষর করে, উনি প্রকাশক হিশাবে অব্যাহতি নিয়েছেন।
বিবিসিঃ এটা উনি কবে নিয়েছেন?

উনি নিয়েছেন এগারো দশ দুই হাজার নয় তারিখে। পত্রিকাটার প্রকাশক ছিলেন আলহাজ্ব মোহাম্মদ হাসমত আলী।
এগারো দশ দুই হাজার নয় . . . আর এখন তো দুই হাজার দশ। তো এতদিন ধরে কী হলো­ মানে তখনি কি আপনারা কোনো কারণ জানতে চেয়েছিলেন আমার দেশ পত্রিকার তরফ থেকে, তাদের কাছ থেকে?

হঁ্যা, আমরা তাদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম। অফিসিয়ালি আমরা তাদের চিঠি দিয়েছি। তারা আমাদেরকে রেসপন্স করেছে। তারা আমাদেরকে অফিসিয়ালি জানিয়েছে­ না, এই পত্রিকার আর কোনো প্রকাশক নেই, কাজেই এই পত্রিকা চলতে পারে না। এই কারণে আমরা পত্রিকাটা এখন বাতিল করে দিয়েছি, ঘোষণাটা বাতিল করে দিয়েছি।

আমার দেশকে আপনারা যে চিঠি দিলেন, তার জবাবে তারা স্বীকার করলেন লিখিতভাবে যে তাদের কোনো প্রকাশক নেই?
হঁ্যা, তাদের কোনো প্রকাশক নেই। তারা জানিয়েছে তাদের প্রকাশক নেই।
এবং এটা তারা কবে জানালেন?
এটা তারা আমাদের জানিয়েছেন কয়েক দিন, কিছু দিন, কয়েক দিন আগে আমাদের।
মানে আমার দেশের তরফ থেকে কারা তাহলে আপনাদের চিঠির জবাব দিলেন? মানে প্রকাশক যদি না থাকেন তাহলে কে সেই দায়িত্ব নিয়ে আপনাদের চিঠির জবাব দিলেন?
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক জবাব দিয়েছেন।

আমার দেশ পত্রিকার তরফ থেকে অবশ্য বলা হচ্ছে যে তারা এই প্রকাশক বদলের জন্য আপনাদের কাছে অনুমতি চেয়েছিলেন। তো সেটার কি হলো?

প্রকাশক বদলের জন্য নয়, যে মূল প্রকাশক ছিলেন উনি পদত্যাগ করেছেন আমাদের এখানে ঘোষণাপত্র স্বাক্ষর করে। এরপর আরেকজন প্রকাশক হতে চেয়েছিলেন সেটা আমাদের প্রক্রিয়ায় পড়েনি বলে তার আবেদনটা নামঞ্জুর করা হয়েছে। কাজেই এখন আমার দেশ পত্রিকার কোনো প্রকাশক নেই।

আপনাদের পক্রিয়ায় পড়েনি মানে? মানে, নামঞ্জুরের প্রক্রিয়াটা যদি আমাদের একটু ব্যাখ্যা করেন ...
নামঞ্জুর করার পক্রিয়া হলো যে আমাদের যে আইনটা আছে, যে ছাপাখানা ও প্রকাশনা আইন অনুযায়ী আবেদন করেছিলেন, আবেদন করার পরে এটা আমরা তদন্তের জন্য পাঠাই, তদন্তে তার পক্ষে মতামত আসে নি। এই কারণে আমরা কোনো প্রকাশককে দিতে পারি নি যিনি আবেদন করেছিলেন। মাহমুদুর রহমান আবেদন করেছিলেন তাকে আমরা প্রকাশক নিযুক্ত করতে পারি নি।

কেন তাকে.... তার আবেদন নামঞ্জুর করা হলো? মানে তদন্তে কী সমস্যা পাওয়া গেছে সেটা কি তাকে জানিয়েছেন বা সেটা কি বলা যাবে?
আমরা অফিসে... আমরা অফিসিয়ালি চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছি। অনেকগুলো বিষয় উল্লেখ আছে। এতটা এই স্বল্প সময়ের ভিতরে বিস্তারিত বলা সম্ভব নয়।
এটা আপনারা কবে জানিয়ে দেন তাকে?
আমরা আজকে জানিয়েছি।’’

এত দীর্ঘ উদ্ধৃতি দেয়ার কারণ জেলা প্রশাসন এবং চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের সাথে যেসব আনুষ্ঠানিক পত্র বিনিময় হয়েছে দৈনিক আমার দেশের, সেই সব দলিলপত্র আমাদের কাছে আছে। অতএব সব পত্রিকাগুলোর কাছেও আছে। আছে সরকারের তরফ থেকে পাওয়া একমাত্র বক্তব্য­ এই সাক্ষাৎকারও। তাহলে এই সকল আইনি কেচ্ছা গাইবার কোনোই কারণ নাই। স্রেফ গায়ের জোরে, অসাংবিধানিক-অগণতান্ত্রিক ও আইনবহির্ভূতভাবে ফ্যাসিবাদী সরকার আমার দেশ বন্ধ করে দিয়েছে।

বিবিসি’র প্রথম প্রশ্নের উত্তরে জেলা প্রশাসক স্বীকার করে নিচ্ছেন যে, ‘এগারো দশ দুই হাজার নয় তারিখে’ অর্থাৎ ১১ অক্টোবর ২০০৯ তারিখে সাবেক প্রকাশক যথানিয়মে ইস্তফা দিয়েছেন। কিন্তু তিনি যা লুকাচ্ছেন তা হলো­ সাবেক প্রকাশকের এই ইস্তফার প্রায় দেড় মাস আগে­ ৩ সেপ্টেম্বর ২০০৯ তারিখে আমার দেশ পাবলিকেশন্স লিমিটেড কর্তৃপক্ষ জেলা প্রশাসনকে আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি মারফত জানিয়েছেন যে, কম্পানি প্রকাশক পদে বদল করেছে এবং এ বিষয়ে প্রশাসনের অনাপত্তির জন্য আবেদন করেছে। আগের এই আবেদনের কথা তিনি লুকাচ্ছেন এবং ওই আবেদনের সপক্ষে সাবেক প্রকাশকের দেয়া ইস্তফার কথাই কেবল বলছেন। তথ্য চেপে যাওয়ার পরে জেলা প্রশাসক জনাব মহিবুল হক এবার সরাসরি মিথ্যা তথ্য দিচ্ছেন; চতুর্থ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলছেন যে, ‘তারা জানিয়েছে তাদের প্রকাশক নেই’। অথচ ১৫ মার্চ দেয়া জেলা প্রশাসনের চিঠির জবাবে পত্রিকাটি আনুষ্ঠানিকভাবে যে চিঠি দেয় সেখানে এমন কোনো কথা নাই। বরং সেই চিঠিতে পত্রিকা কর্তৃপক্ষ আবারো জেলা প্রশাসনকে মনে করিয়ে দিয়েছিল যে, ৩ সেপ্টেম্বর ২০০৯ তারিখে তাদের দেয়া প্রকাশক বদল-সংক্রান্ত চিঠির বিষয়ে প্রশাসন কিছুই না জানানোর কারণে, আইন অনুযায়ী তারা সাবেক প্রকাশকের নাম লিখছেন। একই সাথে পত্রিকাটি অনুরোধ জানিয়েছিল যাতে খুব তাড়াতাড়ি এ বিষয়ে প্রশাসন সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু প্রকাশকের এই বদলে আপত্তি নাকি অনাপত্তি দেবে সেই বিষয়ে জনাব মুহিবুল হকের জেলা প্রশাসন কোনো সিদ্ধান্ত নেয় নাই কিম্বা ১৫ মার্চের চিঠির জবাবের বিষয়েও কিছু জানায় নাই।

এবং অবশেষে বর্তমান সরকারের ঢাকা জেলা প্রশাসক সাহেব বললেন, ‘আমরা আজকে জানিয়েছি’। ‘আজকে’ মানে ১ জুন ২০১০ তারিখে। অর্থাৎ দাঙ্গা পুলিশ পাঠিয়ে পত্রিকার প্রেস বন্ধ করে দেয়া এবং কোনো গ্রেফতারি পরোয়ানা ছাড়া বেআইনিভাবে পত্রিকা অফিসে ঢুকে, সাংবাদিকদের পিটিয়ে পরে সম্পাদককে ধরে নিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে তারা জানালেন যে, ‘মাহমুদুর রহমান আবেদন করেছিলেন তাকে আমরা প্রকাশক নিযুক্ত করতে পারি নি।’ ‘অফিসিয়ালি’ কোনো চিঠি প্রশাসন পত্রিকা কর্তৃপক্ষকে পৌঁছায় নি। অর্থাৎ সরকারের উচ্চস্তর থেকে পাওয়া হুকুম তামিল করতে স্রেফ বন্দুক আর লাঠির জোরে বলা হলো যে, পত্রিকার প্রকাশক নাই!

জাতীয় সংসদে তথ্যমন্ত্রী ২ জুন জানিয়েছেন, ‘পত্রিকার ডিক্লারেশন বন্ধ করার দায়িত্ব ডিসির’। মন্ত্রী ঠিক বলেছেন। (এতটুকু বললে ঠিকই ছিল। উনিশ শো তিয়াত্তর সালের প্রিন্টিং প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অ্যাক্ট অনুযায়ী ডিক্লারেশন ও রেজিস্ট্রেশনের দায়িত্ব ডিসি মানে ডেপুটি কমিশনার মানে জেলা প্রশাসকের ওপরেই বর্তায়। কিন্তু মন্ত্রী তার আগে বলেছেন, এই দায়িত্ব সরকারের না। তারপর বললেন দায়িত্ব ডিসির। মন্ত্রী কি কোনো বেসরকারি জেলা প্রশাসনের কথা জানেন নাকি? অথবা মন্ত্রী যদি ধরে নেন জেলা প্রশাসন সরকারের বাইরে তবে বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য সেটা ভয়ের কথা)। আইন অনুযায়ী পত্রিকার প্রকাশনার ঘোষণা মানে ডিক্লারেশনসহ ইত্যাদি তদারকির দায়িত্ব হচ্ছে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসনের।

কিন্তু প্রকাশক বদলের জন্য গত বছরের সেপ্টেম্বরে দৈনিক আমার দেশের করা আবেদনের প্রেক্ষিতে যখন চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর থেকে, গোয়েন্দা বিভাগ থেকে অনাপত্তি দেয়া হলো, তার পরও যখন ঢাকা জেলা প্রশাসন অনাপত্তি দিচ্ছিলো না, তখন পত্রিকাটির পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হলে প্রশাসন জানিয়েছিল বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বিবেচনাধীন আছে, সেখান থেকে ছাড় দেয়া হচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দৈনিকটির ওই আবেদন বিবেচনাধীন থাকার কথা ঢাকা জেলা প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা সংবাদমাধ্যমের কাছেও স্বীকার করেছেন, নাম প্রকাশ না করার শর্তে। তো, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কি ঢাকা জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব নিয়েছেন? তিনি কি এ দায়িত্ব সম্পাদনের নজির রাখা শুরু করলেন আমার দেশকে দিয়ে?
সারা দেশ এখন আদালতের ভূমিকার দিকে তাকিয়ে আছে। আশা করি আদালত ফ্যাসিবাদী সরকারকে সংবিধান ও আইনের মধ্যে উপযুক্ত জবাব দেবেন।
(সূত্র, নয়া দিগন্ত,০৪/০৬/১০)

No comments:

Post a Comment