Thursday 22 July 2010

যুক্তরাজ্য মানবাধিকার অ্যাসোসিয়েশন প্রেসিডেন্টের সাক্ষাত্কার : বাংলাদেশে গণতন্ত্রের লেবাসে স্বৈরশাসন চলছে

ইলিয়াস খান
বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন যুক্তরাজ্য মানবাধিকার অ্যাসোসিয়েশন। সংগঠনের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত মহিদুর রহমান এক সাক্ষাত্কারে আমার দেশকে বলেন, ‘মানবাধিকার লঙ্ঘনের দিক থেকে বাংলাদেশ ইতিহাসের নিকৃষ্টতম সময় অতিক্রম করছে। একটি স্বাধীন-সার্বভৌম গণতান্ত্রিক দেশ এভাবে চলতে পারে না। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। অবিলম্বে বিচারবহির্ভূত হত্যা, বিনা কারণে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের জেলে পাঠানোসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বন্ধ না করলে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে নালিশ করা হবে।’
সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরকালে দেয়া সাক্ষাত্কারে তিনি গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা, মাহমুদুর রহমানের গ্রেফতার, চৌধুরী আলমের নিখোঁজ হওয়া, পুলিশ ও র্যাবের নিরাপত্তা হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেন।
আলোচনায় প্রথমেই আসে গণমাধ্যম প্রসঙ্গ। দৈনিক আমার দেশ এবং বেসরকারি টিভি চ্যানেল ‘চ্যানেল ওয়ান’ বন্ধ করে দেয়া এবং আমার দেশ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের গ্রেফতারে তিনি তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন। বলেন, এটি কোনো গণতান্ত্রিক সরকারের আচরণ হতে পারে না। গণমাধ্যম হচ্ছে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। গণমাধ্যমের সমালোচনা ধরে সরকার নিজেদের শোধরানোর চেষ্টা করবে। যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে তা-ই হয়। কিন্তু বাংলাদেশে বর্তমান সরকার তা হতে দিচ্ছে না। যেসব গণমাধ্যমে সরকারের সমালোচনা হচ্ছে কিংবা যেখানে সরকারের বশংবদ লোক নেই, সেগুলোকে বন্ধ করে দিচ্ছে অথবা টুঁটি চেপে ধরছে। এটা তো হতে পারে না। এটা তো গণতন্ত্র নয়।
আলোচনায় আসে আমার দেশ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের গ্রেফতার প্রসঙ্গ। তীব্র ক্ষোভ ঝরে পড়ে তার জবানিতে। বলেন, মাহমুদুর রহমান দেশের নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠস্বর। তিনি তার ক্ষুরধার লেখনীতে তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কুশীলব এবং এ সরকারের আনুকূল্যে ক্ষমতায় আসা বর্তমান সরকারের নানা অন্যায়-অত্যাচারের চিত্র তুলে ধরেছেন। এটাই তার অপরাধ(!)। এ অপরাধে তাকে জেলে পোরা হয়েছে। তাকে বারবার রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন চালানো হচ্ছে। এটি কোনো সভ্য দেশে ঘটতে পারে না। মাহমুদুর রহমানের গ্রেফতারের ঘটনা সারা বিশ্বে বাংলাদেশের মাথা হেঁট করে দিয়েছে। তিনি বলেন, বিগত মইনুদ্দীন-ফখরুদ্দীন সরকারও তাকে আটকানোর নানা ফন্দিফিকির এঁটেছিল কিন্তু পারেনি। বর্তমান সরকার আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তাকে গ্রেফতার করে নির্যাতন চালাচ্ছে। এই গ্রেফতারের আমি তীব্র নিন্দা জানাই এবং অবিলম্বে মাহমুদুর রহমানের মুক্তি দাবি করছি।
বর্তমান সরকারের দেড় বছরের শাসনামল সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?— এ প্রশ্নের জবাবে মহিদুর রহমান বলেন, এই দেড় বছরের শাসনামলে বাংলাদেশ সন্ত্রাসের জনপদে পরিণত হয়েছে। র্যাব-পুলিশের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি সরকারি দলের ক্যাডাররা দেশে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। মানুষ হত্যার হোলিখেলায় তারা মেতে উঠেছে। মানুষকে প্রতিবাদ করারও সুযোগ দেয়া হচ্ছে না। সাংবাদিকরা প্রতিবাদ জানালে হয় হত্যা, না হয় নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। এটা কোনো সভ্য দেশে চলতে পারে না।
তিনি নিরাপত্তা হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদের সময় অবর্ণনীয় নির্যাতনে নিহত ব্যক্তির মৃত্যুকে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে কিংবা আত্মহত্যা করেছে বলে এই হত্যাকাণ্ডকে জায়েজ করার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বিডিআর সদস্যদের ‘অস্বাভাবিক মৃত্যু’ বলে প্রচারিত মৃত্যুকে হত্যাকাণ্ড হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, আরও কত বিডিআর সদস্যের এ ধরনের করুণ মৃত্যু হবে কে জানে? বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত এই মানবাধিকার কর্মী বলেন, শুধু পুরুষদেরই নয়, জেলখানায় মহিলা কয়েদিদের ওপরও অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। তাদের ধর্ষণ পর্যন্ত করা হয়। প্রসঙ্গক্রমে তিনি ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দীনের অবৈধ সরকারের আমলের মানবাধিকার লঙ্ঘনের নানা ঘটনাও উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ১৯৭২ থেকে ’৭৫ সাল পর্যন্ত দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের যে মহোত্সব চলেছে, তা আবার ফিরে আসে মইনুদ্দীন-ফখরুদ্দীন সরকারের আমলে। বর্তমান সরকারও এর ধারাবাহিকতা রক্ষা করছে। সন্ত্রাসীদের কারণে বাংলাদেশের মেয়েরা নির্বিঘ্নে স্কুল-কলেজে যেতে পারে না। ইভটিজিংয়ের শিকার হয়ে এ পর্যন্ত ১৪টি মেয়ে আত্মহত্যা করেছে। অনেকে লেখাপড়া বাদ দিয়েছে। কোনো সভ্য দেশে এটা চিন্তাও করা যায় না। কিন্তু এসব বখাটের বিরুদ্ধে সরকার কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। কারণ পরিচয় খুঁজতে গিয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় এরা সরকারি দলের সমর্থক ছাত্রলীগের নেতাকর্মী। তিনি বলেন, চাঁদাবাজি ঠিকাদারির ভাগবাটোয়ারা নিয়ে প্রতিদিন কোথাও না কোথাও সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতাকর্মীরা। পরস্পর পরস্পরকে হত্যা করছে। এদের দমন করার লোক দেখানো ঘোষণা দিলেও সরকার কার্যত কিছুই করছে না। কারণ নেতারাও চাঁদার ভাগ পেয়ে থাকে। ঢাকা সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর চৌধুরী আলমের নিখোঁজ হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শুনেছি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সাদা পোশাকধারী সদস্যরা তাকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে। এখন তার কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। দেশে তো আইন আছে। তিনি কোনো অপরাধ করে থাকলে আদালতে তার বিচার হবে। উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া তো চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন। সরকারকে এখনই জানাতে হবে চৌধুরী আলম কোথায় কীভাবে আছেন। নিরাপত্তা হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনার তিনি তীব্র নিন্দা জানান। বলেন, নিরাপত্তা হেফাজতে এখন মৃত্যুর মিছিল চলছে। আমি জানতে পেরেছি গত ছয় মাসে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার হাতে ৬১ জন নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে র্যাব কর্তৃক ২৯ জন, পুলিশ কর্তৃক ২৫ জন এবং র্যাব-পুলিশের যৌথ অভিযানে ৪ জন নিহত হয়েছেন। এই ৬১ জনের মধ্যে ১৩ জন আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার হেফাজতে থাকাকালে মারা গেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ক্রসফায়ারে ৫২ জন মারা গেছেন। যেখানে র্যাব কর্তৃক ২৭ জন, পুলিশ কর্তৃক ১৮ জন, র্যাব-পুলিশের যৌথ অভিযানে ৪ জন এবং ৩ জন র্যাব-কোস্টগার্ডের যৌথ অভিযানে নিহত হয়েছেন। এ সময় মোট ১২ জন আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার নির্যাতনে নিহত হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এদের মধ্যে র্যাব হেফাজতে ২ জন এবং পুলিশের নির্যাতনে ১০ জন নিহত হয়েছেন। এছাড়া র্যাব-পুলিশ কর্তৃক নির্যাতিত হওয়ার সংখ্যা অগণিত। গত ৬ মাসে জেলহাজতেও ৩৮ জন মারা যান। এদের মধ্যে ২ জন মারা যান কোর্টহাজতে এবং ২ জন র্যাব হেফাজতে। এ সংখ্যাই বলে দেয় বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি এখন কেমন। বর্তমান সরকারকে গণতন্ত্রের লেবাসধারী স্বৈরাচারী সরকার বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ সরকার মূলত ওয়ান-ইলেভেন সরকারের মতোই। তাদের কার্যক্রম দেখে মনে হয়, দেশে একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের পাঁয়তারা চলছে। কিন্তু আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষ তা হতে দেবে না। বাংলাদেশের ভবিষ্যত্ কী?— এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি আশাবাদী মানুষ। অতীতেও গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে স্বৈরতন্ত্র এসেছে। গণমাধ্যমের টুঁটি চেপে ধরা হয়েছে। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। এ সরকারেরও হবে না। আমি একটি কথা বলেই শেষ করব, ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হচ্ছে, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না। সাক্ষাত্কার শেষের আগে তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে জানতে চাই। তিনি জানান, ১৯৭৫ সালে তিনি লন্ডন যান। সেখানে নর্থ আমেরিকা ইউনিভার্সিটি থেকে মার্কেটিংয়ে এমবিএ ডিগ্রি লাভ করেন। প্রবাসী বাংলাদেশীদের কল্যাণ কামনায় বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত হন। তিনি ব্রিটিশ হোম সেক্রেটারির স্ট্যান্ডিং অ্যাডভাইজরি কাউন্সিল অন রেস রিলেশনের সদস্য ছিলেন। তিনি বিবাহিত এবং দুই সন্তানের গর্বিত পিতা। তিনি বাংলাদেশ সেন্টার ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্টেরও প্রেসিডেন্ট। ১৯৫৭ সালে জন্ম মৌলভীবাজারে।

http://www.amardeshonline.com/pages/details/2010/07/23/35832

No comments:

Post a Comment