Sunday 21 March 2010

ছাত্র ও যুবলীগের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড়

ছাত্র ও যুবলীগের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড় : বেশিরভাগই থানায় রেকর্ড হয় না : সন্ত্রাসীরাও দলীয় ছত্রছায়ায় : পুলিশ র্যাবের কাছে দিনে চারশ’র বেশি অভিযোগ
ফকরুল আলম কাঞ্চন
ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে প্রতিদিন প্রায় ৪ শতাধিক অভিযোগ আসছে থানা পুলিশ ও র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্তাব্যক্তিদের কাছে। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী হওয়ার কারণে তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে ফৌজদারি অপরাধ করলেও স্থানীয় থানা-পুলিশ ‘ওপরের’ নির্দেশে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। থানা পুলিশের কর্মকর্তারা তাদের অসহায়ত্বের কথা জানান ভুক্তভোগীদের। অভিযোগকারীরা কর্তাব্যক্তিদের কাছে ধরনা দিয়ে বিফল হয়ে ফিরে যাচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রে থানায় অভিযোগ জানালেও রোষানলে পড়তে হয় ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডার বাহিনীর। আবার অনেক সময় অভিযোগ দিয়েও স্থানীয় প্রভাবশালীদের চাপে আপস করতে বাধ্য হচ্ছেন ভুক্তভোগীরা।
দেশের বিভিন্ন স্থানে যুবলীগ, আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের হুমকি, ধমকি, হামলা, দখলবাজি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, অবৈধ নিয়ন্ত্রণ এবং জবরধ্বস্তির মতো শত শত অভিযোগ আসছে স্থানীয় থানা পুলিশ এবং র্যাব কর্মকর্তাদের কাছে। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই থানা পুলিশ এসব অভিযোগ রেকর্ড করতে পারেন না। এ ব্যাপারে স্থানীয় থানার ওসি এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রায়ই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার আদেশ মানতে হয়। অনেক সময় থানার কর্মকর্তারা অভিযোগকারীদের মামলা না করতে পরামর্শ দেন। অভিযোগকারীকে আপসরফারও প্রস্তাব দেয় থানা পুলিশ। জানা যায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভিকটিম ক্ষমতাসীনদের ভয়ে থানায় অভিযোগ দায়ের করতে সাহস করেন না। অনেক সময় অভিযোগ দায়ের করলেও কাজ হয় না। এভাবে প্রতিদিনই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে নানা ধরনের অভিযোগ আসে। কিন্তু অপরাধীরা ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী হওয়ায় তা আমলে নেয়া হয় না। একটি সূত্র জানায়, প্রতিদিন গড়ে থানা পুলিশ এবং র্যাবের কাছে ভুক্তভোগীরা ৪ শতাধিক অভিযোগ করেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা আমলে নিতে পারছে না পুলিশ ও র্যাব। আবার অনেক সময় আমলে নিলেও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কার্যকর আইনি পদক্ষেপ নেয়া থেকে বিরত থাকছে রাজনৈতিক চাপে। এ ব্যাপারে পুলিশ সদর দফতরের এক সিনিয়র কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলে তিনি অভিযোগের কথা স্বীকার করলেও এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে চাননি। বেশিরভাগ অভিযোগই যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। ব্যতিক্রমও রয়েছে। স্থানীয় বখাটে মাস্তান চাঁদাবাজি, দখলবাজি করে রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে থাকছে। ক্ষমতাসীন দলের পৃষ্ঠপোষকতার কারণে ইচ্ছা থাকলেও পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না।
ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র ও যুব সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধেও রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। কোনোমতেই তাদের সামাল দেয়া যাচ্ছে না। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, জমি দখল, বাড়ি দখল, প্রতিপক্ষের ওপর হামলা এখন অতি সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও হামলা, দখল বা সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটছেই। আর এসব ঘটনায় মদত দিচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা। শুধু দখলবাজি, চাঁদাবাজিই নয়, শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতা সৃষ্টি, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি বাণিজ্য, হল দখল, কেন্টিন-ডাইনিং দখল, টেন্ডার সন্ত্রাসসহ এমন কোনো কর্মকাণ্ড নেই, যা ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা করছে না। শিক্ষাঙ্গনের পাশাপাশি পাড়া-মহল্লায় ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের দাপটে অসহায় স্থানীয়রা। ব্যবসা-বাণিজ্য, হাট-বাজার থেকে শুরু করে খেলার মাঠ পর্যন্ত তারা নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে। এসব নিয়ে প্রায়ই বিরোধ সৃষ্টি হচ্ছে। দখল এবং নিয়ন্ত্রণ নিতে গিয়ে প্রায়ই সংঘর্ষ, হামলা ও খুনের মতো ঘটনাও ঘটছে। শুধু যে প্রতিপক্ষের ওপর হামলার ঘটনা ঘটছে তা-ই নয়, ছাত্রলীগ, যুবলীগ এবং অঙ্গসংগঠনের বিভিন্ন দল এবং উপদলের মধ্যেও দখলবাজি নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। চাঁদার ভাগবাটোয়ারা, টেন্ডারবাজি নিয়ে খুন-খারাবি এখন প্রায়ই সংবাদপত্রের শিরোনাম হচ্ছে। ছাত্রলীগ-যুবলীগের পাশাপাশি ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রী ও মহিলারাও পিছিয়ে নেই। কয়েকদিন আগেই ইডেন কলেজে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষের খবর সংবাদপত্রে ফলাও করে প্রচার হয়েছে। ছাত্রলীগের একাংশের নেত্রীরা অপর অংশের বিরুদ্ধে ভর্তি বাণিজ্য, সিট দখল এবং ছাত্রীদের অনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত করার যে অভিযোগ করেছে তাতে সুধীমহল হতবাক। ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষের পর ইডেন কলেজে এখনও অস্থিরতা বিরাজ করছে। অনেক ছাত্রী নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কায় হল ছেড়ে চলে যাচ্ছে। সুষ্ঠু পরিবেশের দাবিতে ছাত্রীরা মানববন্ধন, মৌন মিছিল, অধ্যক্ষের কাছে স্মারকলিপি পেশসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছে। কিন্তু অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি।
বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের দখলদারিত্ব আর আধিপত্য বিস্তার নিয়ে কয়েকশ’ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণেও হামলা, মামলা, পাল্টা মামলা ও হত্যার ঘটনাও ঘটেছে। ছাত্র সংঘর্ষের কারণে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায় অর্ধশত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে হয়। এর মধ্যে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান একাধিকবারও বন্ধ হয়েছে। এ সরকারের আমলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তত ১৫ বার সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ক্ষমতাসীন ছাত্রলীগ কর্মীদের হাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী নির্যাতনের ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু তারপরও পরিস্থিতির উন্নতি নেই। এই দুই বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিক নিগৃহীত হয়েছে ছাত্রলীগ কর্মীদের হাতে। রাজশাহী, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ, রাজশাহী পলিটেকনিক্যাল, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ও বড় বড় কলেজ, ইনস্টিটিউটগুলোতে একাধিকবার সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এসব সংঘর্ষে প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহারও হয়েছে। গত ৭ জানুয়ারি রাজশাহী পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটে ছাত্রলীগের হাতে প্রাণ দিতে হয়েছে ছাত্রমৈত্রীর নেতা রেজানুল ইসলাম চৌধুরী সানিকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এফ রহমান হলে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষের সময় মারা যান মেধাবী ছাত্র আবু বকর। গত বছর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের হাতে ছাত্রশিবির হল শাখার সভাপতি শরিফুজ্জামান নোমানী মারা যান। কিছুদিন আগে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের হাতে মারা যান ফারুক হোসেন নামে এক ছাত্রলীগ কর্মী। গত ১৪ মার্চ অভ্যন্তরীণ কোন্দলে যশোর সদর উপজেলা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক রিপন হোসেন দাদা নিহত হন। তার আগে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে মারা যান ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রলীগ নেতা আবুল কালাম আসাদ, বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জে ছাত্রলীগ নেতা পলাশ জমাদ্দার। বিভিন্ন ঘটনায় আহত হয় হাজারেরও বেশি নেতাকর্মী।
গত ১১ মার্চ আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসীরা যশোরের সদর উপজেলার বালিয়া ভেকুটিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলম ও ইউসুফ আলীকে বেধড়ক পিটিয়েছে। হামলার শিকার হয়েছেন প্রধান শিক্ষক আবদুর কাদেরও। হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে গুরুতর জখম করা হয় আবদুল কাদেরকে। এমন বহু ঘটনা ঘটিয়েছে যুবলীগ-আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা।
http://www.amardeshonline.com/pages/details/2010/03/22/23876

1 comment: