Sunday, 18 July 2010
আন্দোলন সংগ্রামের ৪৭ দিন
মাহাবুবুর রহমান
আপিল বিভাগের রায়ের মাধ্যমে অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি পেয়েছে দৈনিক আমার দেশের সহস্রাধিক সাংবাদিক-কর্মচারী। দীর্ঘ আকাঙ্ক্ষার পর লাখ লাখ পাঠক আজ হাতে পাবেন তাদের প্রিয় পত্রিকা দৈনিক আমার দেশ। আর এজন্য পত্রিকাটির সাংবাদিক-কর্মচারী ও পাঠকদের লড়াই করতে হয়েছে দেড় মাস। মানুষের অধিকার নিয়ে ছুটেচলা সাংবাদিকরা রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন দীর্ঘ ৪৭ দিন।
এ সময় তারা মানববন্ধন, প্রতিবাদ সমাবেশ, অনশন ও সংহতি সমাবেশসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছেন। এমনকি আদালতে ন্যায়বিচার পাওয়ার দাবি নিয়ে আমার দেশ পরিবারের সদস্যরা হাইকোর্টের সামনেও একাধিকবার মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন। এতে পাশে দাঁড়ান দেশের বিশিষ্ট সাংবাদিক, পেশাজীবী ও রাজনীতিকরা।
খ্যাতিমান সম্পাদক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, চিকিত্সক, প্রকৌশলী, শিক্ষকরা পৃথক বিবৃতি দিয়ে দেশপ্রেমের পতাকাবাহী দৈনিক আমার দেশ পড়ার আগ্রহ প্রকাশ করে অবিলম্বে পত্রিকাটি প্রকাশে সব বাধা তুলে নিতে সরকারের প্রতি একাধিকবার আহ্বান জানিয়েছেন।
বাংলাদেশের সংবাদপত্রের ইতিহাসে ১৯৭৫ সালের ১৬ জুন যেমন কালোদিবস হিসেবে চিহ্নিত, তেমনি ২০১০ সালের ১ জুনও একইভাবে কালোদিবস হিসেবে আগামী প্রজন্মের কাছে চিহ্নিত হবে। দুটি কালোদিবসই জুন মাসে সংঘটিত হয়েছে এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগই এ ন্যক্কারজনক ঘটনার জন্ম দিয়েছে।
এ সরকার আইনের তোয়াক্কা না করে দেশের জনপ্রিয় পত্রিকা দৈনিক আমার দেশ শুধু বেআইনিভাবে বন্ধই করেনি, বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম বিনা ওয়ারেন্টে একজন সম্পাদককে কর্তব্যরত অবস্থায় পত্রিকা কার্যালয় থেকে ফ্যাসিবাদী কায়দায় দাঙ্গা পুলিশ দিয়ে গভীর রাতে গ্রেফতার করে।
প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার শত শত সাংবাদিক, পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী ও আইনজীবীদের সামনে আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে ১ জুন রাত সাড়ে ৩টায় পুলিশ অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়।
পরদিন বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও স্যাটেলাইট চ্যানেল জানায়, দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার ডিক্লারেশন বাতিল করেছে সরকার এবং রাতেই পত্রিকা অফিস থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে। ঢাকার জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে পত্রিকাটির মুদ্রণ ছাড়পত্রবিষয়ক অনুমতি বাতিল করে পত্রিকার তেজগাঁওয়ের প্রেসে তালা লাগিয়ে দেয়া হয়। পত্রিকার রিপোর্টিং, বার্তাসহ বিভিন্ন বিভাগের কর্মীরা রাতের কাজ শেষ করে যখন পত্রিকাটি প্রকাশের অপেক্ষায় ছিলেন তখনই এ খবর বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে তারা অবগত হন। ওই রাতে বিভিন্ন গণমাধ্যমের সম্পাদক, সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনৈতিক নেতারা আমার দেশ কার্যালয়ে আসেন।
গ্রেফতারের আগের দিন বিকালে কারওয়ান বাজারে আমার দেশ কার্যালয়ে আয়োজিত জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে মাহমুদুর রহমান বলেন, সরকার আমার দেশ বন্ধের পাঁয়তারা করছে। সরকার পত্রিকার কণ্ঠরোধ করতে চায়। সরকারের আচরণকে ফ্যাসিবাদী উল্লেখ করে তিনি বলেন, ১৯৭৫ সালেও তারা চারটি বাদে সব পত্রিকা বন্ধ করে দিয়েছিল। এখন আবার সেই চেষ্টা শুরু করেছে।
হাইকোর্টের সামনে মানববন্ধন : সর্বশেষ দৈনিক আমার দেশের সাংবাদিক-কর্মচারীরা গত ১৪ জুলাই সকাল ৮টায় হাইকোর্টের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন।
পত্রিকাটির প্রকাশনা বাতিল সংক্রান্ত মামলা ও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের আশু মুক্তির ব্যাপারে উচ্চ আদালতের কাছে ন্যায়বিচার কামনা করে তারা এ কর্মসূচি পালন করেন।
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে) যৌথ উদ্যোগে এ কর্মসূচির আয়োজন করে। সকাল ৮টা ১৫ মিনিট থেকে ৯টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত কর্মসূচিতে বিএফইউজের সভাপতি রুুহুল আমিন গাজী, মহাসচিব এমএ আজিজ, ডিইউজের সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ বাকের হোসাইন, আমার দেশের ডেপুটি এডিটর সৈয়দ আবদাল আহমদ, প্রধান সহকারী সম্পাদক সঞ্জীব চৌধুরী, বাংলাদেশ পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক কবি হাসান হাফিজ, আমার দেশের বার্তা সম্পাদক মুজতাহিদ ফারুকী, সিটি এডিটর জাহেদ চৌধুরী, ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ফকরুল আলম কাঞ্চন, বিএফইউজের সাবেক সহকারী মহাসচিব এম আবদুল্লাহ, জাতীয় প্রেসক্লাবের নির্বাহী সদস্য কাদের গনি চৌধুরী, ডিইউজে আমার দেশ ইউনিট চিফ বাছির জামাল প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
মানববন্ধনে সংহতি প্রকাশ করেন সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের সদস্য সচিব ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. ওবায়দুল ইসলাম, বিশিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা চাষী নজরুল ইসলাম, বাংলাদেশ শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ সেলিম ভূঁইয়া, প্রকৌশলী হারুন-অর-রশিদ, প্রকৌশলী রিয়াজুল ইসলাম রিজু, অধ্যাপক ডা. গাজী আবদুল হক, শিক্ষক নেতা জাকির হোসেন প্রমুখ।
প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন : জনগণের ভাতের অধিকার নিশ্চিত করতে সরকারকে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার আহ্বান জানান দৈনিক আমার দেশের সাংবাদিক-কর্মচারীরা। ২২ জুন দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে আয়োজিত আমার দেশ পরিবারের মানববন্ধন কর্মসূচি থেকে এ দাবি জানানো হয়।
এতে আমার দেশ পরিবারের সদস্যদের বর্তমান পারিবারিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা এবং দুর্দশার চিত্র তুলে ধরে বক্তৃতা করেন পত্রিকাটির সিনিয়র সহকারী সম্পাদক কবি আবদুল হাই শিকদার, যুগ্ম বার্তা সম্পাদক মুহাম্মদ বাকের হোসাইন, সিনিয়র রিপোর্টার আহমেদ করিম প্রমুখ।
সংহতি জানিয়ে বক্তৃতা করেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব এমএ আজিজ ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি আবদুস শহীদ।
প্রেসক্লাব চত্বরে সমাবেশ : সাংবাদিক ও পেশাজীবীদের আয়োজিত সমাবেশে বক্তারা বলেন, আদালতকে প্রভাবিত করে আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ ও মাহমুদুর রহমানকে কারাগারে মারতে চায় সরকার। দেশের সাধারণ জনগণ এরই মধ্যে সরকারের এ অশুভ উদ্দেশ্য জেনে গেছে উল্লেখ করে তারা বলেন, জনরোষে পড়ার আগে আদালত ও আইনকে প্রভাবিত করার পথ থেকে সরে আসুন। অন্যথায় সাংবাদিক, পেশাজীবী ও সাধারণ জনতা রাজপথ ছাড়বে না।
দৈনিক আমার দেশ পুনঃপ্রকাশ ও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের মুক্তির দাবিতে ২৪ জুন বিকালে জাতীয় প্রেসক্লাব চত্বরে এ সমাবেশের আয়োজন করে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে)। সমাবেশ শেষে একটি বিক্ষোভ মিছিল প্রেসক্লাব থেকে শুরু হয়ে হাইকোর্ট মোড় হয়ে পুরানা পল্টন মোড় ঘুরে আবার প্রেসক্লাবে এসে শেষ হয়।
বিএফইউজের সভাপতি রুহুল আমিন গাজীর সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তৃতা করেন সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের সদস্য সচিব ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন, বিএফইউজের মহাসচিব এমএ আজিজ, চলচ্চিত্রকার চাষী নজরুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জাতীয়তাবাদী সমর্থিত সাদাদলের ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক প্রফেসর আমিনুর রহমান মজুমদার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক প্রফেসর ড. এবিএম ওবায়দুল ইসলাম, ফটো সাংবাদিক অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মীর আহমেদ মিরু, অ্যাগরিকালচারিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য সচিব হাসান জাফির তুহিন, সম্মিলিত পেশাজীবী ফোরামের সদস্য সচিব প্রকৌশলী শেখ আল আমিন, ন্যাশনাল ডক্টরস ফোরামের সভাপতি ডা. শফিকুর রহমান, অ্যাসোসিয়েশন অব ইঞ্জিনিয়ার্সের সদস্য সচিব প্রকৌশলী হারুন-অর-রশিদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর ডা. কাজী আবদুল মান্নান, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ বাকের হোসাইন, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক মহাসচিব ডা. গাজী আবদুল হক, শিকক্ষ-কর্মচারী ঐক্যজোটের সহকারী মহাসচিব জাকির হোসেন, জাতীয় প্রেসক্লাবের কার্যনির্বাহী সদস্য কাদের গনি চৌধুরী, বাংলাদেশ বিএফইউজের কার্যনির্বাহী সদস্য আহমেদ করিম, মফস্বল সাংবাদিক সমিতির সভাপতি দেলোয়ার হোসেন, চিকিত্ক নেতা ডা. বিপ্লবউজ্জামান, সাংবাদিক নেতা মোদাব্বের হোসেন প্রমুখ।
প্রেসক্লাবে সংহতি সমাবেশ : জাতীয় প্রেসক্লাবে ১২ জুন অনুষ্ঠিত আমার দেশ পরিবারের সঙ্গে সংহতি সমাবেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি সম্মান দেখিয়ে অবিলম্বে দৈনিক আমার দেশ পত্রিকা প্রকাশের সুযোগ করে দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান দেশের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, আইন ও শিক্ষাবিদরা।
পত্রিকাটির ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের মুক্তির দাবি করে তারা বলেন, আইন ও তথ্যপ্রবাহকে নিজের গতিতে চলতে না দিলে গণতন্ত্র বাধাগ্রস্ত হতে পারে। এটা গণতন্ত্রমনা রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য শুভ হবে না বলে তারা সরকারকে সতর্ক করে দেন। জাতীয় প্রেসক্লাব মিলনায়তনে দৈনিক আমার দেশ পরিবার আয়োজিত সংহতি সমাবেশ বেলা ১১টায় শুরু হয়ে বিকাল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত চলে। এতে সংহতি প্রকাশ করে বক্তৃতা করেন দেশের বিশিষ্ট গুণীজন। তারা আমার দেশ পুনঃপ্রকাশ এবং সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের অবিলম্বে মুক্তি দাবি করেন।
অনুষ্ঠানে আগত বিশিষ্টজনরা আমার দেশ পত্রিকা প্রকাশ ও মাহমুদুর রহমানের মুক্তির দাবি জানিয়ে বিশেষভাবে তৈরি সংহতি ব্যানারে স্বাক্ষর করেন।
সংগ্রামের প্রথম দশ দিন : এদিন জাতীয় দৈনিকগুলোতে দৈনিক আমার দেশের ডিক্লারেশন বাতিলের সংবাদ প্রকাশ হয়। পাশাপাশি সরকারি কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগ এনে এদিন দৈনিক আমার দেশের সাংবাদিকসহ শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে তেজগাঁও থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। পাশাপাশি এ মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে পুলিশ আদালতে সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন জানায়। তবে আদালত রিমান্ডের আবেদন মঞ্জুর না করে তাকে তিন দিনের মধ্যে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেন। মাহমুদুর রহমান কারাগারে যান। এ ঘটনায় দেশজুড়ে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ-মানববন্ধন কর্মসূচি শুরু হয়। একই ইস্যুতে জাতীয় সংসদে বিএনপি দু’বার ওয়াকআউট করে। সংসদ হয়ে ওঠে উত্তপ্ত।
এদিকে বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে যুক্তরাজ্য। চ্যানেল ওয়ানের পর দৈনিক আমার দেশ বন্ধ করে দেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এক প্রতিক্রিয়ায় ব্রিটিশ হাইকমিশনের একজন মুখপাত্র বলেন, ‘সংবাদমাধ্যম বন্ধ করে দেয়ার সাম্প্রতিক ঘটনায় আমরা খুবই উদ্বিগ্ন। এটি বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাকে প্রশ্নের সম্মুখীন করেছে। মিডিয়ার স্বাধীনতা কার্যকর ও টেকসই গণতন্ত্রের জন্য এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’
একই দিন মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’ এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদককে গ্রেফতার এবং পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং অবিলম্বে মাহমুদুর রহমানকে মুক্তিদান ও পত্রিকাটির প্রকাশনা শুরুর জোর দাবি জানায়।
৩ জুন : বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় দৈনিক আমার দেশ বন্ধ ঘোষণা নিয়ে সম্পাদকীয় ছাপা হয়। সরকারের পক্ষ থেকে এলজিআরডি মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম দাবি করেন, সংবাদ মাধ্যম বন্ধের চিন্তা সরকারের নেই। প্রকাশকের মামলার কারণে দৈনিক আমার দেশ বন্ধ হয়েছে। পাশাপাশি দৈনিক আমার দেশ চালু ও সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের মুক্তি দাবি করে বিভিন্ন সাংবাদিক, পেশাজীবী সংগঠন নানা কর্মসূচি পালন করে। এদিন জেলগেটে পুলিশ মাহমুদুর রহমানকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। একই মামলায় মাহমুদুর রহমানকে রিমান্ডে নিতে পুলিশ আবারও আবেদন জানায়। আদালত ৭ জুন শুনানির দিন ধার্য করেন এবং মাহমুদুর রহমানকে কারাগারে প্রথম শ্রেণীর সুবিধা না দিয়ে নির্জন কক্ষে স্থানান্তরের নির্দেশ দেন।
৪ জুন : মাহমুদুর রহমানের মুক্তি ও দৈনিক আমার দেশ-এর প্রকাশনা পুনর্বহালের দাবিতে দেশ-বিদেশে বিক্ষোভ সমাবেশ অব্যাহত থাকে।
৫ জুন : জাতীয় প্রেসক্লাবে মাহমুদুর রহমানের আইনজীবী ব্যারিস্টার নাসির উদ্দিন অসীম সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেন, জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের পর একই মামলায় মাহমুদুর রহমানকে রিমান্ডে নেয়ার আবেদন উদ্দেশ্যমূলক। একই দিন মাহমুদুর রহমানকে বেআইনিভাবে রিমান্ডে নেয়ার প্রতিবাদে সন্ধ্যায় আমার দেশ-এর সাংবাদিক-কর্মচারীরা তাত্ক্ষণিকভাবে প্রতিবাদ সমাবেশ ও বিক্ষোভ করেন। মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতারের সময় এবং গত বুধবার কোর্টে হাজিরার সময় পুলিশকে সরকারি কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগে এদিন তাকে চারদিনের রিমান্ডে নেয়া হয়। এ খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত সমাবেশে সাংবাদিকরা বলেন, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে আমার দেশ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদককে গ্রেফতার করে মিথ্যা ও সাজানো মামলায় সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। সমাবেশে সাংবাদিকরা আমার দেশ পত্রিকা পুনঃপ্রকাশ এবং মাহমুদুর রহমানের মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত রাজপথে থাকার দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
আমার দেশ-এর পাশে খ্যাতিমান সম্পাদকরা : জাতীয় দৈনিকের সম্পাদকরা এক ঐতিহাসিক যুক্ত বিবৃতিতে দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার প্রকাশনা বাতিলের সিদ্ধান্ত অবিলম্বে প্রত্যাহার এবং ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের মুক্তি দাবি করে বলেন, দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার প্রকাশনা বাতিল এবং ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতারের ঘটনা অনাকাঙ্ক্ষিত। বিবৃতিতে স্বাক্ষরদাতা সম্পাদকরা হলেন—ইনডিপেন্ডেন্ট সম্পাদক মাহবুবুল আলম, নিউজ টুডে সম্পাদক রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ, প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান, ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম, সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ার, দি অবজারভার সম্পাদক ইকবাল সোবহান চৌধুরী, বাসস-এর সাবেক প্রধান সম্পাদক ফয়েজ আহমদ, আমার দেশ-এর সাবেক সম্পাদক আতাউস সামাদ, সাপ্তাহিক মৌচাকে ঢিল সম্পাদক শফিক রেহমান, নতুন দিগন্ত সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ইনকিলাব সম্পাদক এএমএম বাহাউদ্দীন, নয়া দিগন্ত সম্পাদক আলমগীর মহিউদ্দিন, সংগ্রাম সম্পাদক আবুল আসাদ, ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস সম্পাদক মোয়াজ্জেম হোসেন, মানবজমিন প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী, এখন সম্পাদক শওকত মাহমুদ, নিউ এইজ সম্পাদক নূরুল কবীর, আমাদের সময় সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম খান, দিনকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী, যুগান্তর সম্পাদক সালমা ইসলাম এমপি, নিউ নেশন সম্পাদক মোস্তফা কামাল মজুমদার, বাংলা নিউজ ২৪ ডটকম প্রধান সম্পাদক আলমগীর হোসেন, দৈনিক ভোরের কাগজ সম্পাদক শ্যামল দত্ত, বিডিনিউজ ২৪ ডটকম সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী, বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক শাজাহান সরদার, সকালের খবর সম্পাদক রাশিদ উন নবী, শীর্ষ নিউজ ডটকম সম্পাদক একরামুল হক।
৬ জুন : দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের গ্রেফতারে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে চিঠি দিয়েছে মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’। চিঠিতে বন্দি অবস্থায় মাহমুদুর রহমানের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে গভীর আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়।
৭ জুন : দৈনিক আমার দেশ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে তথাকথিত জিজ্ঞাসাবাদের নামে রিমান্ডে নেয়ার সংবাদে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়াসহ বিরোধী দলের ৩৬ জন এমপি। এক বিবৃতিতে তারা সরকারের স্বৈরাচারী আচরণের তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়ে বলেন, সরকারের বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, ব্যর্থতা ও অপশাসনের সংবাদ সাহসের সঙ্গে বস্তুনিষ্ঠভাবে তুলে ধরার কারণে দৈনিক আমার দেশ ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। সে কারণেই পত্রিকাটি এবং এর সম্পাদক হিসেবে মাহমুদুর রহমান সরকারের ক্রোধের শিকার হয়েছেন।
একই দিন দৈনিক আমার দেশ-এর প্রকাশনা (ডিক্লারেশন) বাতিলের সরকারি আদেশ চ্যালেঞ্জ এবং মাহমুদুর রহমানকে পত্রিকাটির প্রকাশক ঘোষণার নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করা হয়। বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা ও বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চে আমার দেশ পাবলিকেশনস লিমিটেডের পক্ষে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আনোয়ার-উন-নবী মজুমদার এ রিট আবেদন করেন।
৮ জুন : দৈনিক আমার দেশ-এর প্রকাশনা পুনরায় চালু ও এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক প্রকৌশলী মাহমুদুর রহমানের মুক্তির দাবিতে জাতীয় প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণে গণঅনশন কর্মসূচি পালন করে সাংবাদিক ও পেশাজীবীরা। বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে) আয়োজিত এ কর্মসূচি সকাল ১০টায় শুরু হয়ে বিকাল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত চলে।
বিএফইউজে সভাপতি রুহুল আমিন গাজীর সভাপতিত্বে কর্মসূচিতে বক্তব্য রাখেন বিশিষ্ট সাংবাদিক শফিক রেহমান, আতাউস সামাদ, জাতীয় প্রেসক্লাব সভাপতি শওকত মাহমুদ ও সেক্রেটারি কামাল উদ্দিন সবুজ, ডিইউজে সভাপতি আবদুস শহিদ, এলাহী নেওয়াজ খান সাজু, ডিইউজের সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ বাকের হোসাইন, আমার দেশ-এর ডেপুটি এডিটর সৈয়দ আবদাল আহমদ, বার্তা সম্পাদক মুজতাহিদ ফারুকী, সিটি এডিটর জাহেদ চৌধুরী, ফকরুল আলম কাঞ্চন, আলাউদ্দিন আরিফ, বাংলাদেশ ফটোজার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মীর আহমেদ মীরু, ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আবু সালেহ আকন, ঢাকা সাব-এডিটরস কাউন্সিলের সভাপতি মুকুল তালুকদার, মনিরুজ্জামান মনির, কবি এরশাদ মজুমদার, কবি আবদুল হাই শিকদার, ফরিদপুর প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ইসলাম, বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন।
৯ জুন : আমার দেশ পত্রিকার প্রকাশনা (ডিক্লারেশন) বাতিলের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা রিট আবেদনের শুনানি হয়। বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা ও বিচারপতি শেখ হাসান আরিফের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চে শুনানি শেষ হয়। তবে আদেশ দেয়ার আগে আমার দেশ-এর আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক এবং সরকারপক্ষে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান তাদের অসমাপ্ত বক্তব্য রাখার আবেদন জানান।
১০ জুন : দৈনিক আমার দেশ-এর প্রকাশনা বাতিল ও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতারের প্রতিবাদে যৌথ বিবৃতি দিয়েছেন দেশের ১৫ জন বিশিষ্ট নাগরিক। বিবৃতিতে তারা বলেন, ‘বস্তুনিষ্ঠ ও সাহসী সাংবাদিকতায় অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার প্রকাশনা বাতিল ও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে অন্যায়ভাবে গ্রেফতারের ঘটনা সম্পূর্ণ অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনভিপ্রেত। পত্রিকাটির প্রকাশককে গোয়েন্দা দফতরে তুলে নিয়ে গিয়ে তাকে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের বিরুদ্ধে মামলা দিতে বাধ্য করা, পত্রিকাটির ডিক্লারেশন বাতিল, কোনো পরোয়ানা ছাড়াই সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার ও নির্যাতন কোনো নির্বাচিত সরকারের আমলে এক নজিরবিহীন ন্যক্কারজনক ঘটনা। পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ করে সরকার এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সাত শতাধিক সাংবাদিক-কর্মচারীকে বেকারত্বের দিকে ঠেলে দিয়েছে। একটি নির্বাচিত সরকার পরমতসহিষ্ণুতা, মত প্রকাশ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং জনগণের তথ্য জানার অধিকার পুরোপুরি অস্বীকার করে ভিন্নমতের কণ্ঠরোধের পথ বেছে নেয়ায় আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। আমরা মনে করি এ ঘটনা দেশে গণতন্ত্রচর্চা ও নির্বাচিত সরকারের ভাবমূর্তিও প্রশ্নবিদ্ধ করবে। আমরা দৈনিক আমার দেশ বন্ধ এবং এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদককে অন্যায়ভাবে গ্রেফতার ও নির্যাতনের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। আমরা অনতিবিলম্বে মাহমুদুর রহমানের মুক্তি, সাংবাদিক-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে
দায়ের করা মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার এবং আমার
দেশ-এর প্রকাশনা অব্যাহত রাখার সুযোগ দেয়ার দাবি জানাচ্ছি।’
বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন, বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুর রউফ, প্রফেসর ড. তালুকদার মনিরুজ্জামান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি মনিরুজ্জামান মিঞা ও ড. এমাজউদ্দীন আহমদ, ফরহাদ মজহার, প্রফেসর ড. মাহবুবউল্লাহ, প্রফেসর ইউএবি রাজিয়া আক্তার বানু, প্রফেসর ড. আবু আহমেদ, সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, প্রফেসর তাজমেরী এসএ ইসলাম, কবি আল মুজাহিদী, জেড এম তাহমিদা বেগম, প্রফেসর খন্দকার মুস্তাহিদুর রহমান এবং কবি আবদুল হাই শিকদার।
http://www.amardeshonline.com/pages/details/2010/07/19/35359
-------------------------------------------------------------------------
আমার দেশ বন্ধ ও মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার : আন্তর্জাতিক মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া
বশীর আহমেদ
দৈনিক আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ, পত্রিকাটির ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার এবং তার ওপর চালানো অমানুষিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া ঘনীভূত হয় আন্তর্জাতিক মহলে। মানবাধিকারসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে পত্রিকা বন্ধের বাংলাদেশ সরকারের সিদ্ধান্তে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে অবিলম্বে আমার দেশ-এর প্রকাশনা চালু, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের মুক্তি ও পুলিশি হেফাজতে তার ওপর চালানো নির্যাতনের তদন্ত দাবি করা হয়। সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে বলা হয়, সরকারি নির্দেশে পত্রিকা বন্ধের ঘটনা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর নির্লজ্জ হস্তক্ষেপ। সরকারের বিভিন্ন বেআইনি কর্মকাণ্ডের সমালোচনা, মানবাধিকারের পক্ষে অবস্থান এবং প্রধানমন্ত্রীর ছেলের দুর্নীতির খবর প্রকাশের কারণেই আমার দেশ-এর প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়া হয় বলে সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়।
হিউম্যান রাইটস্ ওয়াচ
অবিলম্বে দৈনিক আমার দেশ-এর প্রকাশনা চালু, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের মুক্তি ও পুলিশ হেফাজতে তার ওপর চালানো নির্যাতনের তদন্ত দাবি করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস্ ওয়াচ। গত ৮ জুলাই নিউইয়র্কে সংগঠনটির পক্ষ থেকে দেয়া এক বিবৃতিতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলা হয়, অবিলম্বে আমার দেশ-এর প্রিন্টিং লাইসেন্স পুনর্বহাল করে পত্রিকার প্রকাশনা পুনরায় চালুর ব্যবস্থা করুন। সরকারের উচিত অবিলম্বে মাহমুদুর রহমানকে মুক্তি দেয়া অথবা দ্রুত তার ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা। পুলিশ হেফাজতে মাহমুদুর রহমানের ওপর যে নির্মম নির্যাতনের অভিযোগ তিনি করেছেন তা অত্যন্ত গুরুতর। আদালতে মাহমুদুর রহমান বলেছেন, বাংলাদেশ পুলিশের সন্ত্রাস বিরোধী এলিট ফোর্সের সদস্যরা চোখ বেঁধে, জানালার সঙ্গে তার হাতে হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে তার ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে তাকে কোনো ধরনের খাবার ও পানি দেয়া হয়নি।
বিবৃতিতে হিউম্যান রাইটস্ ওয়াচের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক গবেষক তাজ থাপা বলেন, পত্রিকা বন্ধ করে তার সম্পাদককে জেলখানায় আটক রাখার ঘটনা প্রমাণ করছে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও স্বাধীন মত প্রকাশের ব্যাপারে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার ভীত হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, ভয়-ভীতি প্রদর্শন এবং গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে সহিংসতা গণতন্ত্রের মূলনীতির সম্পূর্ণ পরিপন্থী। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাবে বলে জোর প্রচারণা চালিয়েছিল।
দৈনিক আমার দেশ-এর প্রকাশনা বন্ধ এবং সাংবাদিকদের ওপর পুলিশি হামলার প্রসঙ্গ তুলে ধরে বিবৃতিতে তাজ থাপা বলেন, গত ২ জুন মধ্যরাতে শতাধিক পুলিশ জোর করে আমার দেশ কার্যালয়ে ঢুকে মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করে। তার বিরুদ্ধে ৩৪টিরও বেশি মামলা দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ২৮টিই হলো মানহানি মামলা। পুলিশ জোর করে পত্রিকার প্রেস বন্ধ করার পাশপাশি প্রকাশনার লাইসেন্স বন্ধ করে দেয়। একই সঙ্গে ওই রাতে ছাপানো পত্রিকার কপিগুলোও নিয়ে যায় পুলিশ। ওই রাতে কর্মরত অনেক সাংবাদিক সেদিনের পুলিশি হামলায় আহত হন।
বিবৃতিতে বলা হয়, সরকারের সমালোচনা করে সংবাদ প্রকাশের ফলে মাহমুদুর রহমান ও তার সহকর্মী সাংবাদিকরা বাংলাদেশ সরকারের চাপের মুখে ছিলেন। পত্রিকাটি সেই থেকে এখনও (বিবৃতি দেয়ার সময় পর্যন্ত) বন্ধ রয়েছে। এদিকে বাংলাদেশ সরকার তাদের এই পদক্ষেপের যৌক্তিকতা প্রমাণের জন্য মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ এনেছে। ইউরোপের মানবাধিকার বিষয়ক আদালতের রায়ের প্রসঙ্গ তুলে ধরে বিবৃতিতে বলা হয়, সংবাদপত্র বন্ধের ঘটনা নিশ্চিতভাবেই মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল। বিবৃতিতে তাজ থাপা আরও বলেন, সরকারের দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার সম্পর্কে গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে প্রশ্ন তোলাটা যে কোনো গণতন্ত্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সংবাদপত্র বন্ধ বা পুলিশ পাঠিয়ে হামলা না চালিয়ে বরং সরকারের উচিত সমালোচনাগুলো থেকে কীভাবে বেরিয়ে আসা যায়, সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়া। সম্পাদকের বিরুদ্ধে প্রতারণার মিথ্যা অভিযোগ এনে সংবাদপত্র বন্ধ করার যৌক্তিকতা প্রমাণ করা যায় না।
বাংলাদেশের বিচার বিভাগের প্রতি আহ্বান জানিয়ে হিউম্যান রাইটস্ ওয়াচের পক্ষ থেকে বলা হয়, অবিলম্বে আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে মুক্তি দিন অথবা দ্রুত তার ন্যায় বিচার নিশ্চিত করুন। একই সঙ্গে মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের ব্যাপারে যেসব তথ্য জোগাড় করা হয়েছে, সেগুলোর যথার্থতা পুরোপুরি সঠিকভাবে যাচাই করুন।
আমার দেশ-এর প্রকাশক মোহাম্মদ হাসমত আলী সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে বলেছেন, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা তাকে তুলে নিয়ে জোর করে দুটি সাদা কাগজে স্বাক্ষর নিয়েছে। অন্যদিকে সরকারি কর্তৃপক্ষ বলছে, হাসমত আলী দুটি বিবৃতিতে সই দিয়েছেন। এর ভিত্তিতেই মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
মানবাধিকার রক্ষা এবং নির্যাতনবিরোধী আন্তর্জাতিক কনভেনশন আইসিসিপিআর অনুমোদন করেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ সরকারের উচিত মাহমুদুর রহমানের ওপর চালানো নির্যাতনের স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত নিশ্চিত করা। বাংলাদেশ সরকারকে স্পষ্ট করতে হবে সে দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নির্যাতনের যুগের অবসান হয়েছে।
ফ্রন্ট লাইন
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন ফ্রন্ট লাইন আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ এবং এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতারে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে অবিলম্বে পত্রিকা চালু এবং মাহমুদুর রহমানের মুক্তি দাবি করে। সংগঠনের পক্ষ থেকে বলা হয় রিমান্ডের নামে মাহমুদুর রহমানের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের আশঙ্কা রয়েছে। গত ১০ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে লেখা চিঠিতে সংগঠনের পরিচালক মেরি লাউলর এই দাবি জানান। প্রধানমন্ত্রীর কাছে লেখা চিঠিতে বলা হয়, সরকারের সমালোচনা, গণমাধ্যমের ওপর দমন নীতি, নানা ধরনের নির্যাতন, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ সর্বোপরি প্রধানমন্ত্রীর ছেলের আর্থিক দুর্নীতির খবর প্রকাশের কারণে মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার ও আমার দেশ পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ করা হয়েছে বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে ফ্রন্ট লাইন। চিঠিতে মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে দায়ের করা বিভিন্ন মামলার বিবরণ তুলে ধরে সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হয়, আমরা মনে করি মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে দৈনিক আমার দেশ এবং পত্রিকাটির ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান সোচ্চার হওয়ায় এই ধরনের মামলা দেয়া হয়েছে। আমরা এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই। সরকারের কাছে আমাদের দাবি, অবিলম্বে মাহমুদুর রহমানকে মুক্তি দেয়া হোক।
সিপিজে
বিশ্বব্যাপী সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ও স্বার্থ রক্ষকারী প্রতিষ্ঠান কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট (সিপিজে) দৈনিক আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ করে দেয়ার সরকারি সিদ্ধান্তকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মন্তব্য করে। সংগঠনের পক্ষ থেকে এক প্রতিক্রিয়ায় বলা হয়, কেন পুলিশ দিয়ে আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ করা হয়েছে তার পুনঃব্যাখ্যা বাংলাদেশ সরকারকে দিতে হবে। প্রকাশনা ত্রুটির নামে মধ্যরাতে দুই শতাধিক পুলিশ দিয়ে একটি সংবাদপত্র বন্ধ করার ঘটনা সরকারের চরম বাড়াবাড়ি ছাড়া আর কিছুই নয়। এই ঘটনা প্রমাণ করেছে সরকার বিরোধী সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করাই এই ধরনের পদক্ষেপের মূল লক্ষ্য। সরকারের উচিত অবিলম্বে এই বেআইনি সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা।
রিপোর্টার্স উইথআউট বর্ডারস
আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ ও এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতারে তীব্র নিন্দা জানায় রিপোর্টার্স উইথআউট বর্ডারস। সংগঠনের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, মিথ্যা অভিযোগের ভিত্তিতে মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার এবং আমার দেশ পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ করা হয়েছে। আমরা এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই। গভীর রাতে পত্রিকা অফিসে অভিযান চালানো, সাংবাদিকদের মারধর এবং একজন সম্পাদককে গ্রেফতারের ঘটনা প্রমাণ করে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়। অবিলম্বে আমার দেশ পত্রিকার প্রকাশনা চালু এবং মাহমুদুর রহমানের মুক্তির জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আমরা আহ্বান জানাই।
যুক্তরাষ্ট্র
আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ এবং এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতারের ঘটনায় প্রতিক্রিয়া জানিয়ে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের একজন মুখপাত্র বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান গণমাধ্যম পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র সরকার সংবাদপত্র ও মত প্রকাশের স্বাধীনতায় অঙ্গীকারাবদ্ধ। আমরা মনে করি গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। ওই মুখপাত্র আরও বলেন, মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলেছেন।
যুক্তরাজ্য
আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ ও মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতারের ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানায় ব্রিটেন। ঢাকাস্থ ব্রিটিশ হাইকমিশনের একজন মুখপাত্র এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, সরকারের এই পদক্ষেপের ফলে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আমরা এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই। গণমাধ্যম বন্ধ করে দেয়ার এই ঘটনায় উদ্বিগ্ন ব্রিটেন। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কার্যকর ও টেকসই গণতন্ত্রের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
http://www.amardeshonline.com/pages/details/2010/07/19/35306
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment