Wednesday 17 March 2010

মন্তব্য প্রতিবেদন : এই না হলে দিনবদলের সরকার!

মাহমুদুর রহমান
২০০৮ সালের ২৩ নভেম্বর ডিজিটাল নির্বাচনের আগে আমার দেশ পত্রিকায় ‘নবরূপে বাকশাল’ শিরোনামে মন্তব্য প্রতিবেদন লিখেছিলাম। সেই লেখাটির শেষ কয়েকটি লাইন উদ্ধৃত করলে মহাজোট সরকারের ১৫ মাস শাসনকালের চরিত্রটি জনগণের বুঝতে সুবিধা হতে পারে। লিখেছিলাম, ‘দক্ষিণ এশিয়ার বাস্তবতায় মার্কিন-ভারত অক্ষশক্তির কাছে এখন বাংলাদেশের গণতন্ত্র কিংবা নাগরিকের মৌলিক অধিকার কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়। প্রয়োজন হচ্ছে যে কোনো মূল্যে সর্বাবস্থায় মাথা নাড়াতে প্রস্তুত একটি পুতুল সরকার প্রতিষ্ঠা। কাজেই দুঃসংবাদ হচ্ছে, এবারের একদলীয় সরকারের ১৯৭৫ সালের তুলনায় দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার আশঙ্কাই অধিক। জরুুরি আইনকে ব্যবহার করে একটি পাতানো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার মাধ্যমে এই অনৈতিক এবং দেশের স্বার্থবিরোধী প্রক্রিয়াকে আওয়ামী লীগের মতো বৈধতা দান করবে কিনা সেই সিদ্ধান্ত চারদলীয় জোটের একান্ত নিজস্ব ব্যাপার। তবে দেশপ্রেমিক, স্বাধীনতাকামী জনগণকে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য দীর্ঘস্থায়ী প্রতিরোধ সংগ্রামের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে এবং তা এখনই।’
বিগত ১৫ মাসে প্রমাণিত হয়েছে যে, আমার আশঙ্কা অনুযায়ী এদেশে গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে প্রকৃতই একটি চরম ফ্যাসিবাদী সরকার দেশ চালাচ্ছে। এ সময়কালে নাগরিকের মৌলিক অধিকার যেভাবে হরণ করা হয়েছে তার তুলনা কেবল ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ এবং এক-এগারো’র সরকারের শাসনের সঙ্গে হতে পারে। গত সপ্তাহে ব্যবসায়িক কাজে লন্ডন যাওয়ার দিনেই আমার যে লেখাটি ছাপা হয়েছিল, সেখানেই সরকারের নানারকম অত্যাচারের উল্লেখ থাকায় আজ আর তার পুনরাবৃত্তি থেকে বিরত থাকছি। আমাদের পশ্চিমা মুরুব্বিরা যে নিজেদের স্বার্থে বাংলাদেশে প্রতিদিনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়কে উপেক্ষা করার নীতি গ্রহণ করেছে, তারও উল্লেখ গত লেখাতে রয়েছে। অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে প্রকাশিত সাম্প্রতিক বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদনে বাংলাদেশের ভয়ঙ্কর অবস্থার কিঞ্চিত্ চিত্র স্থান পেয়েছে। এজন্য তাদের ধন্যবাদ। ক’দিন আগেই এই সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী এবং তাদের স্থানীয় তাঁবেদাররা বিএনপিকে সংসদে ফেরানোর জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিল। এদের সম্মিলিত প্রচারণায় মনে হচ্ছিল বিএনপির সংসদে যোগদান না করাটাই বুঝি বাংলাদেশের উন্নয়নে একমাত্র বাধা। বিদেশিদের চাপেই হোক কিংবা সদস্যপদ রক্ষার খাতিরেই হোক, শেষ পর্যন্ত বিএনপি সংসদে ফিরেছে। সাকল্যে আড়াই ডজন সংসদ সদস্যসংখ্যার বিরোধী দল সংসদে ফেরায় দেশ ও জনগণের কী উপকার সাধিত হয়েছে, সেই মূল্যায়নে আমার কোনো গরজ নেই। তবে মরহুম রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে গালিগালাজ করার যে নোংরা সংস্কৃতি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে চালু করেছিলেন, তার জবাবে অপর মরহুম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানও যে এখন একইভাবে আক্রান্ত হচ্ছেন, এটি প্রকৃতিরই এক ধরনের প্রতিশোধ। বিএনপির সংসদে ফেরার ফলে শেখ হাসিনার নিক্ষিপ্ত ইটের বদলে অন্তত বিএনপির পাটকেল মারার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে সেই সত্য অস্বীকারের উপায় নেই। ঠেলায় পড়ে মাননীয় স্পিকার আবদুল হামিদকেও অবশেষে বিবেকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে তার প্রয়াত নেতার চরিত্রহনন ঠেকানোর জন্য নানা ধরনের কৌশলের আশ্রয় নিতে হচ্ছে। বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যদের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী এবং তার চাটুকাররা যখন অসংসদীয় ভাষায় মরহুম জিয়া ও তার লাশ নিয়ে খিস্তিখেউড় করেছেন, তখন টেলিভিশনের পর্দায় স্পিকারকে বেশ স্মিতমুখেই উপভোগ করতে দেখা গেছে। শেখ মুজিবের একদলীয়, স্বৈরশাসনকে শেষ পর্যন্ত বিএনপির সংসদ সদস্যরা সমালোচনা করার সাহস সঞ্চয় করাতেই এখন স্পিকারের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে। জনাব আবদুল হামিদ উপায়ান্তর না পেয়ে সংসদের মর্যাদা এবং রাজনৈতিক শিষ্টাচারের মূল্য উপলব্ধি করতে বাধ্য হয়েছেন এবং সংসদ সদস্যদের মুখের লাগাম টেনে ধরার জন্য মাইক বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
তবে বিরোধী দল ও ভিন্নমতাবলম্বীদের শায়েস্তা করার নিত্যনতুন কৌশল আবিষ্কারে বাংলাদেশে অন্তত আওয়ামী লীগের জুড়ি নেই। অবস্থার চাপে অনেকটা নিরুপায় হয়েই স্পিকার যেহেতু সংসদে জিয়াউর রহমানের চরিত্রহনন প্রকল্প বাস্তবায়নে আগের মতো সহায়তা করতে পারছেন না, সেই মহান দলীয় দায়িত্ব পূরণে এগিয়ে এসেছেন ডেপুটি স্পিকার শওকত আলী। তার সভাপতিত্বকালীন সরকারি দলের সদস্যবৃন্দ চুটিয়ে গাল দেয়ার সুযোগ পাচ্ছেন স্বাধীনতার এই মহান ঘোষককে। যুক্তি হলো, ডেপুটি স্পিকার তো আর অসংসদীয় বক্তব্য প্রদানের জন্য মাইক বন্ধের সিদ্ধান্ত নেননি। সুতরাং স্পিকার যে ভদ্রলোকের চুক্তি করেছেন সেটি মেনে চলার তার তরফ থেকে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। শেখ হাসিনা বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার মনোনীত করার প্রতিশ্রুতি থেকে কেন সরে এসেছিলেন, শওকত আলীর ভূমিকা দেখার পরও যদি বাংলাদেশের জনগণ সেটি মালুম করতে না পেরে থাকে, তাহলে সেই ব্যর্থতার দায় তাদেরই। মরহুম জিয়াউর রহমানের প্রতি ক্ষমতাসীনদের প্রচণ্ড আক্রোশ এবং তার অব্যাহত চরিত্রহননের উদ্দেশ্য বোঝা দরকার। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ মুজিবুর রহমান এবং জিয়াউর রহমান দুই বিপরীতমুখী ধারার রাজনীতির অবিসংবাদিত প্রতীক। জিয়াউর রহমানকে ঘিরেই এ দেশে স্বতন্ত্র জাতিসত্তা ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী এবং উপনিবেশবাদবিরোধী, আত্মমর্যাদাশীল জনগোষ্ঠীর রাজনীতি আবর্তিত হয়। এই রাজনীতির চর্চা যতদিন এদেশে অব্যাহত থাকবে ততদিন আঞ্চলিক পরাশক্তি ভারতের বাংলাদেশকে আশ্রিত রাষ্ট্রে পরিণত করার দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন যে কোনোভাবেই সম্ভব হবে না, এই সত্যটি আওয়ামী লীগ এবং তাদের বিদেশি মিত্রশক্তি জানে বলেই জিয়াউর রহমানের সত্, দেশপ্রেমিক এবং বীরত্বপূর্ণ ভাবমূর্তি তাদের সকল আক্রমণের নিশানা। দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হলো, জিয়াউর রহমানের আদর্শ ধারণ করে বিএনপি নামক যে দলটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তারা এই মহান ব্যক্তিত্বের দেশপ্রেম, বীরত্ব, সততা এবং রাজনৈতিক দর্শনকে নিজেদের মধ্যে আত্মস্থ তো করেইনি, উপরন্তু জনগণের মধ্যে প্রচার করা থেকেও বিস্ময়করভাবে বিরত থেকেছে। বিএনপির সংসদে ফেরার সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাত্র কিছুদিন আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কয়েকজন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আমার মধ্যাহ্নের আহার গ্রহণের বিরল সুযোগ হয়েছিল। সেখানে শুনছিলাম এক-এগারোর সমর্থনকারী রাষ্ট্রদূতরা কেমন সমস্বরে একপেশেভাবে সংসদ বর্জনের জন্য বিএনপির নীতিনির্ধারকদের দোষারোপ করছিলেন। সেই মধ্যাহ্নভোজে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিও উপস্থিত ছিলেন। আশা করি, সংসদে আওয়ামী লীগের অশালীন ও কুরুচিপূর্ণ ভূমিকার পর রাষ্ট্রদূতদের সেদিনের সমালোচনার যথোপযুক্ত জবাব এতদিনে বিএনপির নেতারা দিতে পেরেছেন। অবশ্য এটাও সত্য যে, পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলো তাদের দ্বিমুখী নীতির জন্য সারাবিশ্বেই বিশেষভাবে পরিচিত এবং নিন্দিত। বাংলাদেশ সেক্যুলার রাজনীতির কট্টর সমর্থক এই একচোখা কূটনীতিকরা যে যুক্তি বুঝতে চাইবেন না, সেটাই স্বাভাবিক।
মইনউদ্দিনের জেলখানায় বন্দি অবস্থায় শেখ হাসিনার খাদ্যে ‘স্লো পয়জনিং’ তত্ত্ব এতদিন আমরা তার ব্যক্তিগত চিকিত্সক ডা. মোদাচ্ছের আলী এবং সংসদ উপনেতা সাজেদা চৌধুরীর কাছ থেকে শুনেছি। গত বৃহস্পতিবার সংসদে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী তাকে স্লো পয়জনিং করে হত্যার প্রচেষ্টার অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। এই দাবির পর বিষয়টিকে কেবল রাজনৈতিক প্রচারণা হিসেবে দেখার আর সুযোগ নেই। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট শেখ হাসিনার জনসভায় বোমা হামলার মামলায় বহুসংখ্যক ব্যক্তিকে তদন্তের নামে দীর্ঘদিন ধরে বিনাবিচারে আটক রাখা হয়েছে, বারবার রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন চালানো হচ্ছে, বিভিন্ন সুশীল(?) মিডিয়ায় প্রচারণা চালিয়ে কোনোরকম সাক্ষ্যপ্রমাণ ছাড়াই এই মামলায় বিরোধীদলীয় নেতৃবৃন্দকে জড়ানোর অপচেষ্টা চলছে এবং সর্বশেষ একটি মুখোশধারী দলবাজ সংগঠনের অনুষ্ঠানে প্রধান অভিযুক্ত আসামি মুফতি হান্নানের কথিত জবানবন্দির সিডি তদন্তকারী কর্তৃপক্ষের সহায়তায় প্রদর্শিত হয়েছে, যার মাধ্যমে তারেক রহমানকেও বোমা হামলার ষড়যন্ত্রে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের দাবি অনুযায়ী, ২১ আগস্ট বোমা হামলার মূল লক্ষ্য ছিলেন শেখ হাসিনা, যদিও মহান আল্লাহতায়ালার মেহেরবানিতে কানের কিছু সমস্যা তৈরি হওয়া ছাড়া তিনি অক্ষত থাকতে পেরেছেন। আইন কী বলবে জানি না, তবে খাদ্যে বিষপ্রয়োগ এবং বোমা হামলা উভয়ই আমার দৃষ্টিতে হত্যাপ্রচেষ্টা। একটি হত্যাপ্রচেষ্টার রহস্য উদ্ঘাটনে সরকার অতিমাত্রায় সচেষ্ট হলেও অপর হত্যাপ্রচেষ্টার ব্যাপারে এতটা চুপচাপ কেন, সংসদে শেখ হাসিনার দাবির পর এই প্রশ্ন জনমনে উত্থাপিত হতে বাধ্য। তত্কালীন সরকারপ্রধান ড. ফখরুদ্দীন, সেনাপ্রধান জেনারেল মইন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জেনারেল এমএ মতিনসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এই হত্যাপ্রচেষ্টার অভিযোগের দায় এড়াতে পারেন না। কাজেই সরকার এবং নীতিনির্ধারকদের বিশ্বস্ততা প্রমাণের জন্য অনতিবিলম্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিষপ্রয়োগে হত্যাপ্রচেষ্টার অভিযোগে মামলা দায়ের হওয়া উচিত। আর ক্ষমতাসীনরা তাদের ডিজিটাল নির্বাচনী আঁতাতের বাধ্যবাধকতায় যদি তাদের জরুরি মিত্রদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হয়, তাহলে বিরোধী দলের কাছ থেকে জনগণ প্রত্যাশা করবে যে অন্তত তারা ঘোষণা করবে ভবিষ্যতে কখনও বিএনপি রাষ্ট্র পরিচালনার সুযোগ লাভ করলে একজন জাতীয় নেতাকে হত্যার হীন প্রচেষ্টার সঙ্গে জড়িতদের অবশ্যই বিচার করা হবে।
নিজমুখে স্লো পয়জনিংয়ের মতো গুরুতর অভিযোগ আনার দিনেই সংসদে শেখ হাসিনা আরও দাবি করেছেন, বিএনপি তাদের শাসনামলে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ বাজারে ছেড়ে দিয়ে নাকি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য অস্থিতিশীল করে তুলেছে। এই অভিযোগের জবাব দেয়ার দায়িত্ব প্রধান বিরোধী দলের নীতিনির্ধারকদের। তবে অর্থনীতিবিদ না হলেও প্রায় তিন দশক ধরে অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক বাজার ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিজ্ঞতা থেকে শেখ হাসিনার এই নতুন তত্ত্ব প্রসঙ্গে আমার মনে কয়েকটি প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে। বাজারে টাকার সরবরাহ বাড়লে মুদ্রাস্ফীতি যে বৃদ্ধি পাবে এটা অত্যন্ত খাঁটি কথা। প্রশ্ন হলো, বিএনপি কোন পদ্ধতিতে টাকা ছাড়ছে? তারা কি রাতের আঁধারে লোকের হাতে হাতে নগদ টাকা বিলি করছে? নাকি দুর্নীতিলব্ধ টাকা দিয়ে সব নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি বাজার থেকে কিনে নিয়ে কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে মূল্যবৃদ্ধি ঘটাচ্ছে? যদি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস ক্রয় করেই থাকে, তাহলে সেই বিপুল পরিমাণ পণ্য কোথায় গুদামজাত করছে? এত গুদাম বাংলাদেশে কোথায়? শেষ প্রশ্ন হলো, সরকারের বিভিন্ন সংস্থা বিএনপির এই অপতত্পরতা উদ্ঘাটন অথবা আটকাতে পারছে না কেন? এসব প্রশ্নের উত্তর দেয়া ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর এ-জাতীয় বায়বীয় অভিযোগ উত্থাপন সরকারের ব্যর্থতা ঢাকার দুর্বল প্রচেষ্টা ও দেশের দারিদ্র্যক্লিষ্ট জনগণের সঙ্গে তামাশা হিসেবেই বিবেচিত হবে। স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলটি দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই ১৯৭২ সাল থেকেই এদেশের জনগণের দারিদ্র্য এবং সরলতাকে পুঁজি করে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে অব্যাহতভাবে প্রতারণা করেই চলেছে।
এবার ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে আসা যাক। পেট্রোবাংলা কর্তৃক শেভরনকে বিনা টেন্ডারে ৩৭০ কোটি টাকার কাজ প্রদানসংক্রান্ত দুর্নীতির খবর আমার দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার অপরাধে বিগত তিন মাস ধরে রাষ্ট্রযন্ত্র এবং ক্ষমতাসীন দলের সবধরনের নির্মম নির্যাতনের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছি। এ প্রসঙ্গে ‘সততায় পারবেন না, প্রধানমন্ত্রী’ এবং ‘দুদক নামের পুতুল’ শিরোনামে দুটি মন্তব্য প্রতিবেদনও লিখেছি। দেরিতে হলেও উচ্চআদালতের সংবিধান প্রদত্ত মানবাধিকার রক্ষায় যথাযথ ভূমিকার কারণে আমার বিদেশযাত্রা আটকাতে না পেরে, সরকার তার সর্বশেষ অস্ত্রটি নিক্ষেপ করেছে। এ মাসের ৮ তারিখে আদালতের রায় নিয়ে লন্ডনযাত্রার একদিন পর ১০ তারিখে সরকারের আজ্ঞাবহ দুদক পত্রবাহক মারফত একটি অভিযোগপত্র আমার বাসায় প্রেরণ করে। সর্বৈব মিথ্যা, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং এখতিয়ারবহির্ভূত বিচিত্রসব অভিযোগ সংবলিত সেই পত্রে আমাকে ১৬ তারিখে দুদক কার্যালয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। পত্রের অভিযোগগুলো সবই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ১৭ জানুয়ারি তারিখের তদন্ত-প্রতিবেদনে যে কল্পকাহিনী বয়ান করা হয়েছে, তারই পুনরুল্লেখমাত্র। প্রতিটি অভিযোগের জবাব এই আমার দেশ-এর পাতাতে আমি আগেই দিয়েছি। সরকার হয়তো ধারণা করে নিয়েছিল, বিদেশে অবস্থানরত সময়ে দুদকের আনুষ্ঠানিক নোটিশ পেলে আমি আর দেশে না ফিরে এই সরকারের বাকি সময়টা প্রবাসী জীবনযাপন করার সিদ্ধান্ত নেব। বর্তমান সরকারপ্রধানসহ অন্যান্য কর্তাব্যক্তি জরুুরি সরকারের আমলে যেভাবে বিদেশে পালিয়ে ছিলেন, সম্ভবত আমাকেও তারা একই ধাতুর তৈরি ভেবে নিয়েছেন। তাদের বোঝা উচিত ছিল দুর্নীতি না করলে বুকের পাটা একটু চওড়াই হয়ে থাকে। প্রসঙ্গক্রমে মনে পড়ে গেল, যে কোম্পানিতে চাকরি করার বিনিময়ে প্রাপ্ত বেতনাদি নিয়ে দুদক আমার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা সাজাতে গলদঘর্ম হচ্ছে, সেই একই প্রতিষ্ঠান থেকেই বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী পরিবারের সদস্যবৃন্দ এবং সরকারের অন্যান্য কর্তাব্যক্তির অর্থকড়িসহ নানারকম সুবিধা চাকরিরত অবস্থায় স্বচক্ষে নিতে দেখেছি। সময়-সুযোগমত সেসব কাহিনী জনগণকে জানানো যাবে। এক-এগারোর সময় এসব কাহিনী তথ্যপ্রমাণসহ বিশেষ স্থানে জানিয়ে সামরিক জান্তার বিশ্বাসভাজন হওয়া অত্যন্ত সহজ ছিল। কিন্তু বর্তমান সরকারের মতো এতটা নিচে নামতে রুচিতে বেধেছিল। যা-ই হোক, দুদকের চিঠি দেয়ার সংবাদ পাওয়ার পর আমি না পালিয়ে বরং প্রত্যাবর্তনের নির্ধারিত দিনের একদিন আগেই অর্থাত্ ১৪ মার্চ দেশে ফিরেছি এবং দুদকের নোটিশের যথাযথ জবাবও ইতোমধ্যে প্রেরণ করেছি। সরকারের আজ্ঞাবহ দুদকের কর্তাব্যক্তিদের জন্য আমি একপ্রকার করুণাই বোধ করি। এদের অবস্থা এতটাই নতজানু যে, তথাকথিত স্বাধীন প্রতিষ্ঠানের ভড়ং দেখানোর সাহসও আর অবশিষ্ট নেই। শেখ হাসিনার একসময়ের সচিব যেদিন চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন, সেদিনই প্রকৃতপক্ষে দুদকের কফিনে শেষ পেরেকটি মারা হয়ে গেছে। বিভিন্ন উত্স থেকে শুনতে পাই যে, বিশেষ সংস্থায় কর্মরত বিদেশি তাঁবেদার গোষ্ঠীই নাকি সেই এক-এগারোর সময়কালীন অবস্থার মতোই পেছন থেকে দুদক চালিয়ে থাকে। একসময়ের দেশপ্রেমিকদের আত্মা কত সহজেই না শয়তানের কাছে বিক্রি হয়ে গেল! বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি এখন বিদেশি শক্তির স্বার্থে বিদেশি শক্তির দ্বারাই পরিচালিত হচ্ছে। এই বৈরী পরিস্থিতিতে যারাই জনগণ ও রাষ্ট্রের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করবে, তাদেরই অবধারিত নির্যাতনের শিকার হতে হবে। এই বাস্তবতা মেনে নিয়েই আমি এক-এগারোর পর আমার কর্তব্য স্থির করেছিলাম। আল্লাহ যতদিন হায়াত দিয়েছেন, ততদিন সাম্রাজ্যবাদী এবং আধিপত্যবাদী শক্তির বিরোধিতা করে যাব সর্বশক্তি দিয়ে। বাংলাদেশকে নিয়ে কাছের ও দূরের পরাশক্তির সব যড়যন্ত্র মোকাবিলা করে তাদের প্রতিরোধের জন্য জনগণের কাছে ডাক দিয়ে যাব। সাধ্যমত চেষ্টা করব তাদের সচেতন করে তুলতে।
http://www.amardeshonline.com/pages/details/2010/03/18/23323

No comments:

Post a Comment