Wednesday 17 March 2010

সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজের তালিকায় ছাত্রলীগের ২৬০ নেতা-কর্মী

Kalerkantho| ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৪ চৈত্র ১৪১৬, ১ রবিউস সানি ১৪৩১, ১৮ মার্চ ২০১০
পারভেজ খান
রাজধানীসহ সারা দেশে ছাত্রলীগ নামধারী সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজদের সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে পুলিশ। পুলিশের ভাষায়, ছাত্রলীগ এখন বেসামাল। ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারের মতো তাঁদেরও এখন বড় মাথাব্যথা 'ছাত্রলীগ'। সারা দেশ থেকে প্রতিদিন গড়ে ৩০০ অভিযোগ আসছে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। সারা দেশে অবৈধ অস্ত্রধারী, চাঁদাবাজ ও দখলবাজের গোপন তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে ২৬০-এর বেশি ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীর নাম। গতকাল বুধবার এই তালিকার এক নেতা ঢাকা কলেজের গালিবকে (ছাত্রলীগ, রিপন গ্রুপ) ৫৭ রাউন্ড গুলিসহ পুলিশ গ্রেপ্তার করে।
পুলিশ কর্মকর্তাদের মতে, সরকার ও দলের উচ্চপর্যায় থেকে কাউকে ছাড় না দেওয়ার কথা বলা হলেও স্থানীয় রাজনীতিবিদদের কারণে থানা পুলিশের পক্ষে তাদের ধরা সম্ভব হচ্ছে না। অথচ তাদের সামাল দিতে না পারলে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটবে। আর ব্যর্থতার অভিযোগে 'বলির পাঁঠা' হবে পুলিশ। গত কয়েক দিনে পুলিশের বিশেষ শাখা ও সদর দপ্তরের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
গোপন তালিকায় উঠে আসা ২৬০-এর বেশি নামের মধ্যে অন্তত ২০ জন রয়েছেন, যাঁরা নেতৃত্বপর্যায়ের। সংখ্যার দিক দিয়ে শীর্ষে রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এরপর ক্রমানুসারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা কলেজ, মিরপুর বাঙলা কলেজ ও শেরে বাংলানগর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।
থানা পুলিশের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডের ওপর নজর রাখে পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) এবং আরো একটি গোয়েন্দা সংস্থা। থানায় কী ঘটছে না ঘটছে, সে বিষয়ে একটি সংস্থা সাপ্তাহিক ছুটির দিনসহ প্রতিদিনই গোপন প্রতিবেদন দাখিল করে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন মহলের কাছে। এসব প্রতিবেদন নিয়ে আলোচনা হয় পুলিশের উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে। আবার এমন কিছু বিষয় থাকে, যেগুলো অতি গোপনীয় হওয়ায় খোলা আলোচনায় না তুলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশেষ শাখায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এটা পুলিশ ও ওই গোয়েন্দা সংস্থার রুটিন-কাজ।
গত জানুয়ারি পর্যন্ত এসব প্রতিবেদনে উঠে আসা গোপন তথ্য বিশ্লেষণ করে পুলিশের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, সারা দেশের প্রায় সব বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই ছাত্রলীগ দুই ভাগে বিভক্ত। এক গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ করেন সভাপতি, আরেক গ্রুপ সাধারণ সম্পাদক। আর এই দুই গ্রুপেরই দল চালানোর খরচ জোগাতে হয় স্থানীয় ব্যবসায়ীদের। এক কথায় চাঁদাবাজিই ছাত্রলীগ নেতাদের আয়ের একমাত্র উৎস। আর এর বাইরে বিভিন্ন জেলা, থানা ও ওয়ার্ড শাখার কমিটি তো রয়েছেই।
ওই কর্মকর্তাদের মতে, বেশি চাঁদাবাজি আর দখল-সন্ত্রাস হচ্ছে রাজধানী, বিভাগীয় শহর আর জেলা শহরগুলোতে। বিশেষ করে যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হোস্টেল বা হল আছে, সেসব এলাকায় চাঁদাবাজিও অনেক বেশি। এতে অতিষ্ঠ সেখানকার ব্যবসায়ীরা। পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগ করারও সাহস নেই তাঁদের। অনেকে থানায় মৌখিক অভিযোগ করেন। কেউ কেউ সাহস করে লিখিত দিলেও থানার ওসি সেটা গ্রহণ না করে বরং আপস করে চলার পরামর্শ দেন। এ ক্ষেত্রে পুলিশের বক্তব্য স্পষ্ট। ইচ্ছে থাকলেও তাদের কিছু করার নেই। কিছু করতে গেলে উল্টো তাদের ওপর নানা ঝামেলা এসে পড়বে। ঝয় আছে চাকরি হারানোরও। কারণ, এ ধরনের উদ্যোগ নিতে গিয়ে গত ১০ বছরে পুলিশের কমপক্ষে ২০০ কর্মকর্তা শাস্তি ভোগ করেছেন এবং করছেন বলে কর্মকর্তারা জানান।
কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, পুলিশ বিভাগে যে অসৎ কর্মকর্তা নেই, তা নয়। পুলিশ যে সব ক্ষেত্রে সঠিক দায়িত্ব পালন করছে, তাও নয়। আবার পুলিশ যে ভালো কিছুই করছে না, সেটাও বলা যাবে না। কিন্তু দেখা যায়, ভালো কিছু করতে গিয়েই বলির পাঁঠা হতে হয় পুলিশকে। এ প্রবণতা আজকের নয়, স্বাধীনতার পর থেকেই চলে আসছে_কখনো কমে, কখনো বাড়ে। গত বিএনপি সরকারের সময় দলীয় সন্ত্রাসীদের অপতৎপরতা চরমে উঠেছিল। বর্তমান সরকারের প্রথম সাত-আট মাস যা ছিল, সেটাকে না হয় সহনীয় ধরে নেওয়া যায়; কিন্তু বর্তমানে যা চলছে, তা সহ্যসীমার বাইরে। কিন্তু ব্যবস্থা নিতে গেলেই ওই পুলিশ সদস্যের পরিচয় গিয়ে দাঁড়াবে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের লোক হিসেবে। আবার ব্যবস্থা না নিলে সরকার পরিবর্তন হলে এ পুলিশের পরিচয় হবে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের লোক হিসেবে।
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে সাব স্টেশন নির্মাণের টেন্ডার নিয়ে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শফিক গ্রুপ ও দেলোয়ার গ্রুপ পরস্পরবিরোধী অবস্থান নেয়। পরে রিপন পোদ্দার নামে এক ছাত্রনেতার হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি বর্তমানে স্বাভাবিক হয়েছে। অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরও টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে পরস্পরবিরোধী অবস্থানে আছে ছাত্রলীগ মুহসীন হল শাখার সাবেক সভাপতি শফিক আর বরিশাল গ্রুপের মোশারফ। এক-এগারোর পর এই মোশারফ দেশের বাইরে পালিয়ে ছিল। আরেক গ্রুপের নেতা শফিক একসময় শিবির করত বলে জনশ্রুতি রয়েছে।
গোয়েন্দা পুলিশের তালিকাভুক্ত ২৬০ জনের অন্যতম এফ রহমান হলের ছাত্রলীগ সভাপতি ফারুক সম্প্রতি গ্রেপ্তার হয়েছে। তারও একটি চাঁদাবাজ গ্রুপ আছে। ফারুক গ্রেপ্তার হওয়ার কয়েক দিন আগে নীলক্ষেতে এক বিরিয়ানির দোকানে গিয়ে পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। চাঁদা না দেওয়ায় মারধর করে ৮০ বছরের এক বৃদ্ধকে। পরে দোকানমালিক ঘটনাটি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও থানাকে জানায়। এ রকম আরো অসংখ্য অভিযোগ আছে ফারুকের বিরুদ্ধে। কিন্তু পুলিশ তাকে সে সময় ওই অভিযোগে গ্রেপ্তার করেনি। পরে সে গ্রেপ্তার হয় এফ রহমান হলের সংঘর্ষের ঘটনায়।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ অবস্থা দেখে নিজেই ছাত্রলীগের সাবেক তিন নেতাকে (বর্তমানে আওয়ামী লীগের তিন সাংগঠনিক সম্পাদক) ছাত্রলীগকে গোছানোর দায়িত্ব দিয়েছেন। তাঁদেরই একজন বি এম মোজাম্মেল হক কালের কণ্ঠকে জানান, আজ কেন এ অবস্থা, সে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা হচ্ছে। খুব শিগগির আগের কমিটি ভেঙে দিয়ে নতুন কমিটি ঘোষণা করা হবে।
পুলিশের সাবেক আইজি আশরাফুল হুদা কালের কণ্ঠকে বলেন, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, সংঘর্ষ, বন্দুকযুদ্ধ, হল দখলসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ছাত্রলীগ যেভাবে জড়িয়ে পড়ছে, তা দুঃখজনক। বিএনপির শাসনামলে এ সমস্যা ছাত্রদলেও ছিল। অর্থাৎ যে দল যখন ক্ষমতায় থাকে, সেই দলের ছাত্র সংগঠনই এসব করে। বলা যায়, এটা ছাত্ররাজনীতির একটা কলঙ্কিত ঐতিহ্য। এ দূষিত অবস্থা থেকে বের হতে পারছে না তারা। এ জন্য দায়ী অসৎ রাজনীতিবিদ আর লেজুড়বৃত্তির মনোভাবসম্পন্ন কিছু পুলিশ কর্মকর্তা। তবে রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন এখানে বেশি। শুধু পুলিশকে দায়ী করে লাভ নেই। কারণ, যে পুলিশ সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মতিন চৌধুরীকে আঘাত করেছিল, পরে সেই পুলিশই লাঞ্ছিত করে মোহাম্মদ নাসিমকে। আসলে পুলিশকে দিয়ে করানো হয় এসব।
এই সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ছাত্রলীগের নামে যারা সন্ত্রাস করে, তাদের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে গ্রেপ্তারের কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু নিজেদের স্বার্থে প্রধানমন্ত্রীর এই সদিচ্ছাকে কাজে লাগাচ্ছেন না স্থানীয় নেতারা। আর পুলিশও ওই স্থানীয় নেতাদের কারণে সিদ্ধান্ত নিতে ভয় পাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী পুলিশের টাইম স্কেল দিয়েছেন, বেতন-বৈষম্য দূর করেছেন, জনবল বাড়াচ্ছেন। এগুলো নিঃসন্দেহে ভালো দিক। কিন্তু এই জনবলের পাশাপাশি মনোবলও বাড়ানো দরকার বলে অভিমত দেন আশরাফুল হুদা।
ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ে নাম-পরিচয় প্রকাশ করে কথা বলতে রাজি নন কোনো পুলিশ কর্মকর্তাই। তাঁদের কথা, চেয়ারে বসে সেটা সম্ভব নয়।
এর পরও কথা বলার জন্য যোগাযোগ করা হয় পুলিশের আইজি নূর মোহাম্মদ এবং র‌্যাবের ডিজি হাসান মাহমুদ খন্দকারের সঙ্গে। দুজনের একই কথা। সন্ত্রাসী যে-ই হোক, সে সন্ত্রাসীই। পুলিশের দৃষ্টিতে তাদের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই। কাউকে ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে যাওয়ার কারণে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছাত্রলীগ নেতারাও গ্রেপ্তার হচ্ছে বলে তাঁরা জানান।

No comments:

Post a Comment