Thursday 25 March 2010

যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া শুরু

তথ্য সংগ্রহই প্রথম কাজ'

কাজী আব্দুল হান্নান | shamokal শুত্রুবার | ২৬ মার্চ ২০১০ | ১২ চৈত্র ১৪১৬ | ৯ রবিউস সানি ১৪৩১
বহু প্রতীক্ষিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ শুরু করতে সরকারের প্রধান করণীয় স্বাধীনতা দিবসের আগের দিন সম্পন্ন হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন, অপরাধ তদন্তের জন্য তদন্তকারী সংস্থা নিয়োগ এবং রাষ্ট্রের পক্ষে আইনজীবীর দায়িত্ব পালনে প্রসিকিউশন টিম ঘোষণার পর স্বাভাবিকভাবেই সবাই জানতে চান, কবে কখন কীভাবে বিচার কাজ শুরু হচ্ছে। এ সম্পর্কে নবগঠিত তদন্তকারী সংস্থার অন্যতম সদস্য অবসরপ্রাপ্ত মেজর এএসএম শামসুল আরেফিন সমকালকে বলেন, বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এত বছর পর এতবড় একটা কাজ শুরুর যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তা সম্পন্ন করা অতি সহজ কোনো ব্যাপার নয়। একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। সবার আন্তরিক সহযোগিতা ছাড়া যা সম্ভব নয়। প্রথমেই দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা
তথ্য সংগ্রহ করা হবে। তথ্য একত্রীকরণের পর তা বাছাই করে নামতে হবে তথ্য যাচাইয়ের কাজে। এরজন্য টিম গঠন করে প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করার পর শুরু হবে আসল তদন্ত। এ তদন্তের ভিত্তিতে জড়িতদের বিষয়ে কীভাবে কী করা যায়_ সে বিষয়ে প্রসিকিউশনের সঙ্গে বসে পরবর্তী সিদ্ধান্ত হবে।
প্রসিকিউশন টিমের প্রধান দেশের অন্যতম প্রবীণ অভিজ্ঞ আইনজীবী রাজশাহীর অ্যাডভোকেট গোলাম আরিফ টিপু জানান, রোববার ঢাকায় পেঁৗছে টিমের অন্য সদস্যদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করতে আগ্রহী তিনি। গতরাতে তিনিও সমকালকে বলেন, সবার কাছ থেকে আগে তথ্য সংগ্রহ করে এরপর তদন্তের পথে অগ্রসর হতে হবে। তদন্তের পর ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ যাবে। অভিযোগের পর শুরু হবে বিচারের প্রক্রিয়া।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তা একান্তই বাংলাদেশি আইনে। গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ ও আন্তর্জাতিক আইনের অধীন অন্যান্য অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তির আটক বিচার ও শাস্তির বিধানের লক্ষ্যে ১৯৭৩ সালে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনাল) অ্যাক্ট ১৯৭৩ নামে আইনটি প্রনয়ন করা হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত জাতিগত নিপীড়ন, নির্যাতন, অগি্নসংযোগ, ধর্ষণ, আটক রাখা, গণহত্যার মতো বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচার করার জন্য এ আইনে ব্যবস্থা রয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বলে অভিহিত করা হলেও আসলে এর মধ্য দিয়ে শুরু হচ্ছে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালে এদেশে মানবতার বিরুদ্ধে যে অপরাধ করা হয়েছিল তার বিচারের উদ্যোগ। ট্রাইব্যুনালের বিচার পদ্ধতিসহ তদন্ত পরিচালনা সম্পর্কিত বিধিবিধানও এ আইনে নির্ধারণ করে দেওয়া আছে। আইনটির আওতায় অপরাধীর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড থেকে শুরু করে অপরাধের গুরুত্ব অনুযায়ী যে কোনো শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা এই ট্রাইব্যুনালকে দেওয়া আছে।
আইনটি এমনভাবে তৈরি যে এর আওতায় আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কোনো অপরাধের বিচারে বাংলাদেশের ফৌজদারি কার্যবিধি কিংবা সাক্ষ্য আইনের প্রয়োগ হবে না। এর বিচারপদ্ধতি হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য যে কোনো পদ্ধতিই অনুসরণ করার স্বাধীনতা ট্রাইব্যুনালের আছে। এমনকি আইনটির যে কোনো বিধান প্রয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অন্যকোনো আইন বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। অপরাধ প্রমাণের জন্য দেশে প্রচলিত সাক্ষ্য আইন এবং ফৌজদারি কার্যবিধির মধ্যে আবদ্ধ না রেখে আইনেই ট্র্রাইব্যুনালের ক্ষমতা উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। সাক্ষীর ব্যক্তিগত সাক্ষ্যের পাশাপাশি ছবি, সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদ থেকে শুরু করে আনুষঙ্গিক দলিলপত্রকেও সাক্ষ্য হিসেবে বিবেচনা করতে পারবে ট্রাইব্যুনাল। এগুলো সংগ্রহ করার জন্যই তদন্তকারী সংস্থা সর্বসাধারণের কাছ থেকে তথ্য চেয়ে সর্বপ্রথম একটি গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করবে। তদন্তের প্রয়োজনে যে কাউকে জিজ্ঞাসাবাদ করার ক্ষমতা রয়েছে তদন্তকারী সংস্থার যে কোনো সদস্যের। কেউ কোনো অজুহাতে জিজ্ঞাসাবাদের জবাব এড়িয়ে যেতে পারবেন না, কিংবা প্রশ্ন তুলতে পারবেন না। সেক্ষেত্রে তদন্তকারীর অভিযোগের ভিত্তিতে যে কোনো প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট তাকে সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদণ্ড বা জরিমানা করতে পারবেন।
বিচার কাজের শুরু হবে তদন্তকারী সংস্থার দাখিল করা আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্র থেকে। এ ধরনের অভিযোগ পাওয়ার পর আদালত বিচার শুরুর তারিখ নির্ধারণ করবেন। নির্দিষ্ট তারিখের তিন সপ্তাহ আগে আসামির বিরুদ্ধে মামলায় প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে যেসব দলিলপত্রের ওপর ভিত্তি করা হবে তার এবং সাক্ষীদের একটি তালিকা আদালতে দাখিল করা হবে। এর কপি আসামিরাও পাবেন। আসামিদের গ্রেফতার করতে ওয়ারেন্ট দেওয়া, হাজতে আটক রাখা কিংবা ডিটেনশনে রাখার নির্দেশ দেওয়ার এখতিয়ার এই ট্রাইব্যুনালের রয়েছে।
'আন্তর্জাতিক অপরাধসমূহ (ট্রাইব্যুনালস্) অ্যাক্ট, ১৯৭৩'-এ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে আইনটি প্রণয়ন করা হলেও আইনটির ব্যবহার বাংলাদেশে আজও হয়নি। আইনটির প্রয়োগে অভিজ্ঞ কোনো আইনজীবী কিংবা বিচারকও দেশে নেই। এই বাস্তবতায় বিশ্বের এ ধরনের বিভিন্ন ট্রাইব্যুনালের ইতিহাসকে বিবেচনায় রেখে সরকার অগ্রসর হয়েছে।
কাজটি যে কত কঠিন অন্যান্য দেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পরিসংখ্যান থেকে তার ধারণা পাওয়া যেতে পারে। ১৮৮৬ সালে জেনেভা কনভেনশনে যুদ্ধাপরাধীর সংজ্ঞা নির্ধারণের পর আরও কয়েকটি কনভেনশনের মাধ্যমে এদের বিচারের আন্তর্জাতিক উদ্যোগ গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯২০ সালে যুদ্ধাপরাধের ৪৫টি মামলায় 'লাইপজিগ ট্রায়ালে' মাত্র ১২ জনের বিচার হয়। এতে ৬ জনের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল ট্রাইব্যুনাল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে দুটি বড় ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। যুগান্তকারী আদালত বসেছিল জার্মানির নুরেমবার্গে। ১৯৪৫ সালে গঠন করা এ নুরেমবার্গ ট্রায়ালের পাশাপাশি জাপানের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে গঠিত হয় 'টোকিও ট্রাইব্যুনাল'। যুদ্ধাপরাধ, শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের তিনটি শ্রেণীতে এসব ট্রাইব্যুনালে অপরাধের বিচার করা হয়। নুরেমবার্গ ট্রায়ালে ১৭৭ জনের বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছিল। দু'বছরের বেশি সময় ধরে বিচার চলে এবং বিচারে ২৫ জনের মৃত্যুদণ্ড এবং ২০ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে মাত্র ১০ জনের ফাঁসি হয়েছিল। যদিও দু'জন আত্মহত্যা করে। টোকিও ট্রাইব্যুনালে প্রায় আড়াই বছরে ২৭ জন অপরাধীর বিচার হয়। জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী তোজো এবং জেনারেল ইয়ামাসিতাসহ মোট সাতজনের মৃত্যুদণ্ড হয়।
প্রায় অভিন্ন অবস্থা লক্ষ্য করা গেছে ১৯৯৩ সালের সাবেক যুগোশ্লাভিয়ার জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল এবং ১৯৯৪ সালের রুয়ান্ডা ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইব্যুনালের স্ট্যাটুটের আওতায় গঠিত ট্রাইব্যুনালে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের এসব ইতিহাস সামনে রেখেই বাংলাদেশকে সতর্ক পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে। বিশেষ করে বিশ্বে মৃত্যুদণ্ডের বিপক্ষে জনমত গড়ে উঠছে এমনই এক সময়ে। তারপরও আন্তর্জাতিক অপরাধ হিসেবে স্বীকৃত মানবতার বিরুদ্ধে ইতিহাসের এক জঘন্য নারকীয় ঘটনার বিচারে ন্যায়বিচারের সাধারণ নীতি অনুসরণ করার এখতিয়ার এই ট্রাইব্যুনালের রয়েছে।

No comments:

Post a Comment