Friday 23 April 2010

ভীতিকর পরিস্থিতিতে ঢাবি শিক্ষকরা : প্রশাসন বিভক্ত, কট্টরপন্থী অংশ ভিন্নমত দমনে লিপ্ত, নির্যাতিত হচ্ছেন শিক্ষকরা

আসাদুজ্জামান সাগর ও খোমেনী ইহসান
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভীতিকর পরিস্থিতির শিকার হয়ে আতঙ্কে দিন কাটছে শিক্ষকদের। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা তাদের ব্যক্তিগত, একাডেমিক ও নাগরিক সম্পর্কের ওপর নজরদারি করছে। এমন ঘটনার শিকার হয়ে শিক্ষকরা মনে করছেন পরিস্থিতি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালীন ৯ মাস ও এক/এগারোর দু’বছরের জরুরি অবস্থার মতোই শ্বাসরুদ্ধকর। ওই সময় শিক্ষকদের যেভাবে অপমানিত ও আহত করা হতো, এখনও তারই পুনরাবৃত্তি ঘটছে। কিছু শিক্ষক পরিস্থিতিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে জার্মানি ও ইতালিতে বিরাজিত ফ্যাসিবাদী পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করছেন। তাদের মতে, ওই সময় দুটি দেশে এক দল ও এক মত চাপিয়ে দেয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিকদের গোয়েন্দা নজরদারিতে এনে ভিন্নমতাবলম্বীদের চিহ্নিত করে গোপন পুলিশ বাহিনী দিয়ে বেছে বেছে দমন করা হতো।
অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশিবার ভিন্নমতাবলম্বী শিক্ষকরা লাঠিপেটা, চপেটাঘাত ও লাঞ্ছনার শিকার হচ্ছেন। ছাত্রলীগ ক্যাডার, আওয়ামীপন্থী শিক্ষক কেউই শিক্ষকদের গায়ে হাত তুলতে বাদ রাখছেন না। এমনকি ভিন্নমতাবলম্বী হওয়ায় শ্রেণীকক্ষে পাঠদানের সময় বিভাগে-হলে কাজ করতে গিয়ে বিব্রতকর কুিসত বাক্যবাণের টিজিংয়েরও শিকার হতে হচ্ছে। ফলে ভিন্নমতাবলম্বী শিক্ষকদের জন্য ক্যাম্পাস কারাগারে পরিণত হয়েছে। এ পরিস্থিতির উত্তরণে প্রশাসন থেকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে না বলেও অভিযোগ উঠেছে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সরকারপন্থী কিছু ‘জ্যেষ্ঠ শিক্ষক’ ভিন্নমতাবলম্বী শিক্ষকদের একটি তালিকা করে। তালিকাটি সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলসহ সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সংস্থাগুলোতে পাঠায় কট্টরপন্থী হিসেবে পরিচিত ওই ‘জ্যেষ্ঠ শিক্ষক’রা। তারা তালিকাভুক্ত শিক্ষকদের কর্মকাণ্ডের ওপর গোয়েন্দা নজরদারি চালানোর সুপারিশ করে। এছাড়াও তারা তালিকাভুক্ত শিক্ষকদের সামাজিক ক্ষমতার উত্স হ্রাস করতে ব্যবস্থা গ্রহণেরও দাবি জানায়।
সূত্র জানায়, এই তালিকা পাঠানোর পরও সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দেয়া হয়নি। কিন্তু ভিন্নমতাবলম্বী শিক্ষকরা বিভিন্ন গোলটেবিল বৈঠক, বেসরকারি টেলিভিশনের টকশো, সেমিনার ও আলোচনা সভায় বিডিআর বিদ্রোহ, ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ বন্ধ, ভারতের স্বার্থে এশিয়ান হাইওয়ের রুট নির্ধারণ, সমুদ্রসীমা বিরোধ ও ভারত-বাংলাদেশ চুক্তিসহ বিভিন্ন জাতীয় ইস্যুতে সরকারের সমালোচনা করে বক্তব্য রাখলে এবং সংবাদপত্রে কলাম লিখলে সরকারের নীতিনির্ধারক মহল তালিকাটি আমলে নেয়। এরপর তালিকাটিকে ‘প্রফেশনাল মেথডে’ চূড়ান্ত করতে গোয়েন্দা সংস্থাকে দায়িত্ব দেয়া হয়। তালিকাটি ১১ এপ্রিল থেকে ১৪ এপ্রিলের মধ্যে চূড়ান্ত করা হয়।
জানা গেছে, তালিকা চূড়ান্ত করতে কট্টর সরকারপন্থী হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের একজন শীর্ষ কর্মকর্তার সঙ্গে একটি গোয়েন্দা সংস্থা যোগাযোগ করে। ওই শীর্ষ কর্মকর্তা তালিকাটি দেখে ভিন্নমতাবলম্বী শিক্ষকদের প্রভাব ও গুরুত্ব অনুসারে তাদের হলুদ কালিতে চিহ্নিত করেন। তার মতামতের ভিত্তিতে ভিন্নমতাবলম্বী ২শ’ শিক্ষকের তালিকা চূড়ান্ত করা হয়। তালিকাভুক্ত শিক্ষকদের নাম-ঠিকানাসহ জীবনবৃত্তান্তও ওই শীর্ষ কর্মকর্তা গোয়েন্দা সংস্থাটিকে সরবরাহ করেন। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিযুক্তির জন্য শিক্ষকদের দাখিলকৃত কাগজপত্রের সহায়তা নেয়া হয়। পরে তালিকাটি গোয়েন্দা সংস্থা সংশ্লিষ্ট উচ্চপর্যায়ে পাঠিয়ে দেয়।
সূত্র নিশ্চিত করেছে, এরই মধ্যে তালিকা মোতাবেক শিক্ষকদের তিনটি পর্যায়ে ভাগ করে নজরদারির আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। এরমধ্যে প্রথম পর্যায়ে আছেন ৩৪ জন ভিন্নমতাবলম্বী জ্যেষ্ঠ শিক্ষক। ‘অত্যন্ত প্রভাবশালী’ হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখা হয়েছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে শ’খানেক অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপককে বিপজ্জনক হিসেবে চিহ্নিত করে বিশেষ নজরদারিতে রাখা হয়েছে। তৃতীয় পর্যায়ে চারদলীয় জোট সরকারের আমলে যোগদানকারী প্রভাবশালী প্রভাষকদের রাখা হয়েছে।
এদিকে গত বুধ, বৃহস্পতি ও শুক্রবার সরেজমিনে দেখা গেছে, স্বাভাবিক সময়ের চেয়েও ক্যাম্পাসে সাদা পোশাকধারী গোয়েন্দার উপস্থিতি বেশি। দর্শনার্থীর বেশ ধরে তারা মধুর কেন্টিন, টিএসসি, কলাভবন, বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাব, ফুলার রোড ও গিয়াসউদ্দিন আবাসিক এলাকায় নজরদারি করছে। সাদা পোশাকধারী হলেও ক্যাম্পাসে নিয়মিত যাতায়াতকারীরা অপরিচিত মুখ হিসেবে তাদের গোয়েন্দা হিসেবেই চিহ্নিত করেছে। এব্যাপারে ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির এক সম্পাদক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা নিয়মিত গোয়েন্দাগিরি করে, তাদের আমরা সবাই চিনি।’ তার মতে, ডিজিএফআই, এনএসআই, সিআইডি, ডিবি, এসবির ৩০-৩৫ জন গোয়েন্দা ক্যাম্পাসে নিয়মিত দায়িত্ব পালন করে। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে মধুর কেন্টিনসহ বিভিন্ন জায়গায় দেখা যাচ্ছে অনেক অপরিচিত ব্যক্তি আড্ডা দিচ্ছে। বিভিন্নজনের সঙ্গে পরিচিত হয়ে টুকটাক খোঁজ-খবর নিচ্ছে। এদিকে গিয়াস উদ্দিন আবাসিক এলাকার নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ইদানীং এ এলাকায় কিছু অপরিচিত ব্যক্তির আনাগোনা বেড়েছে। তারা বেশিরভাগ সময় আসেন গিয়াস উদ্দিন আবাসিক এলাকার মসজিদে জামাত শুরু হওয়ার সময়।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, ক্যাম্পাসে শিক্ষকদের নজরদারির জন্য বিভিন্ন সংস্থার অর্ধশতাধিক গোয়েন্দা সদস্য নতুন করে কাজ শুরু করেছে। পাশাপাশি শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী, সাংবাদিক ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। কোন ধরনের তথ্য সংগ্রহ করে জিজ্ঞেস করলে সূত্র জানায়, নজরদারির তালিকাভুক্ত শিক্ষকদের আদ্যোপান্তই জানার চেষ্টা করা হয়। বিশেষ করে ক্লাসে লেকচার দেয়ার সময় শিক্ষকরা কী পড়ান ও বলেন, বিভাগীয় কার্যালয়ে তাদের সঙ্গে কোন ধরনের ব্যক্তি সাক্ষাত্ করেন, তারা ক্যাম্পাসের বাইরে কোথায় যান, তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে কত টাকা আছে, মাসিক আয় ও ব্যয়ের মধ্যে পার্থক্য আছে কিনা, বাড়ি-গাড়ি আছে কিনা, শিক্ষক লাউঞ্জ ও বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে বসে তারা সরকারের সমালোচনা করেন কিনা ইত্যাদি বিষয়ে গোয়েন্দারা নজর রাখে। এসব বিষয়ের কোনো ক্ষেত্রে নজরদারি সম্ভব না হলে সোর্সের সহায়তা নেয়া হয়। প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ভিন্নমতাবলম্বী শিক্ষকদের ব্যাপারে কি কি ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে, তা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সুপারিশ আকারে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন মহলে পাঠিয়ে দেয়। আর সুপারিশের ভিত্তিতে বিভিন্ন ব্যবস্থা নেয়া হয়। এর মধ্যে এশিয়ান হাইওয়ে এবং ট্রানজিট নিয়ে সরকারের সমালোচনা করে বক্তব্য প্রদানকারী ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের এক শিক্ষকের বেসরকারি টেলিভিশন টকশো ও সভা-সেমিনারে বক্তব্যদানে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে।
শিক্ষক নির্যাতন : এদিকে সরকারপন্থী শিক্ষক এবং ছাত্রলীগ ক্যাডারদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিন্নমতাবলম্বী শিক্ষকরা। এসব নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কোনো ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয় না। দু’একটি ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করে সাময়িক বহিষ্কারের ঘোষণা দেয়া হলেও পরে গোপনে তা তুলে নেয়া হয়। তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, গত ১৪ মাসে বেশ কয়েকজন শিক্ষক নির্যাতিত ও লাঞ্ছিত হয়েছেন। এসব ঘটনার বিচার চেয়েও বিচার পাচ্ছেন না শিক্ষকরা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নির্যাতকদের পক্ষাবলম্বন করে বেশিরভাগ ঘটনা এড়িয়ে যাচ্ছে। এরমধ্যে ১৪ এপ্রিল স্যার এএফ রহমান হলের আবাসিক শিক্ষক আসাদুজ্জামানকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে ছাত্রলীগ বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সহ-সভাপতি রেজা সেকান্দার। কিন্তু এ ঘটনার প্রতিকার করতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এর আগে গত ৭ মার্চ চারুকলা অনুষদে শিল্পকলার ইতিহাস বিভাগের চেয়ারম্যান ও আওয়ামীপন্থী নীল দলের প্রভাবশালী শিক্ষক সহযোগী অধ্যাপক নাহিদ আখতার আরেক সহযোগী অধ্যাপক শেখ মনির উদ্দিনকে থাপ্পড় মারেন এবং নারী শিক্ষক সাবরিনা শাহনাজকে ‘শুয়রের বাচ্চা, কুত্তার বাচ্চা’ বলে গালাগাল করেন। এর আগে ২০০৯ সালের অক্টোবর মাসে ভুয়া পরীক্ষা দিতে সহায়তা না করায় হিসাববিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মাজহারুল আনোয়ারকে লাঞ্ছিত করে সূর্যসেন হলের ছাত্রলীগ সভাপতি সাঈদ মজুমদার। কিন্তু এ ঘটনায়ও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এর আগে সিনেট নির্বাচনের সময় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের হাতে লাঞ্ছিত হন সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের সাবেক প্রভোস্ট অধ্যাপক নূরুল ইসলামসহ দুই শিক্ষক। বস্তুনিষ্ঠ কারণ ছাড়াই মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. বোরহান উদ্দিন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক মাহমুদ ওসমান ইমাম ও শামসুন্নাহার হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ইউএবি রাজিয়া আক্তার বানুকে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা অবরুদ্ধ করে রেখে অশোভন আচরণ করে পদত্যাগে বাধ্য করেছে। এছাড়াও প্রায়ই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অকথ্য গালাগালের শিকার হন ফজলুল হক হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক মোজাম্মেল হক ও স্যার এএফ রহমান হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক আবদুস সাত্তার।
শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ক্লাস-পরীক্ষাসহ একাডেমিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে গত ১৬ মাসে আওয়ামী লীগপন্থী শিক্ষক এবং ছাত্রলীগ কর্মীদের অকথ্য গালাগাল ও টিজিংয়ের শিকার হয়েছেন অর্ধশত শিক্ষক। নিপীড়িত এসব শিক্ষক শ্রেণীকক্ষে পাঠদানের সময় কোনো বিষয়ে কথা বলতে গেলে মাঝে মাঝে বর্তমান সরকারের নীতির আলোচনা করা দরকার হয়। এসময় সরকারের নীতিকে বেঠিক বা জাতীয় স্বার্থবিরোধী বললে শিক্ষার্থীদের সামনেই ‘বিএনপির দালাল’ এমন গালি ও নাজেহালের শিকার হতে হয়। শিক্ষকদের এভাবে নির্যাতিত হওয়ার ঘটনাকে প্রফেসর ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী অত্যন্ত দুঃখজনক আখ্যায়িত করে এ ধরনের সংস্কৃতি থেকে সবাইকে বের হওয়ার আহ্বান জানান। উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ বলেন, মূল্যবোধের অবক্ষয় ও ক্ষমতার দাপটের কারণে শিক্ষকরা নির্যাতিত হচ্ছেন।
এদিকে শিক্ষকদের ওপর গোয়েন্দা নজরদারি ও নির্যাতনের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়জুড়েই সমালোচনার ঝড় উঠেছে। তারা বলছেন, মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস ও জরুরি অবস্থার দু’বছর ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন ভীতিকর পরিস্থিতি কখনই আসেনি। এ পরিস্থিতিকে ’৫২, ’৬৯, ’৭১, ’৯০ ও ২০০৭ সালে ভাষা, স্বাধীনতা, মুক্তি ও গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামকারী শিক্ষক সমাজের জন্য চরম অবমাননাকর বলে আখ্যায়িত করেছেন সরকারপন্থী ও ভিন্নমতাবলম্বী সব মতের শিক্ষক। এ ব্যাপারে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ’৭৩-এর অধ্যাদেশ অনুযায়ী শিক্ষকরা যে কোনো মতাদর্শের অনুসারী হতে পারেন। আমার বোধগম্য নয় রাষ্ট্র কেন শিক্ষকদের বিরুদ্ধে নজরদারি করবে। ওই সংবাদ সত্য হয়ে থাকলে গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারি এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্মকর্তাদের ওই কাজে সহায়তা নিন্দনীয় কাজ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক বজলুল হক বলেন, শিক্ষকদের প্রতি গোয়েন্দা নজরদারির বিষয়টিকে আমি অবশ্যই খারাপভাবে দেখছি। পুরো বিষয়টি শিক্ষকদের মধ্যে ধূম্রজাল সৃষ্টি করছে। শিক্ষকরা কেন নজরদারিতে থাকবেন? এটা অবিশ্বাস্য মনে হওয়ার মতো। তিনি বলেন, এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিবাদ জানানো হবে। এজন্য গতকাল রাতে শিক্ষক সমিতির সভায় সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা।
বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক তাজমেরী এসএ ইসলাম বলেন, শিক্ষকরা ভীতিকর অবস্থায় রয়েছেন। আমরা প্রতিবাদ জানিয়ে একাডেমিক কাউন্সিলে ভিসির কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেছেন, এর সঙ্গে প্রশাসনের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। এটা হাস্যকর সংবাদ বলেও ভিসি মন্তব্য করেছেন।
নীল দলের আহ্বায়ক অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাদের শিক্ষকতা পেশায় স্বাধীন। কোনো এক সময় আমাকেও গোয়েন্দা নজরদারি করা হতো। শিক্ষকদের প্রতি গোয়েন্দা নজরদারি অত্যন্ত নিন্দনীয় কাজ। তবে যুদ্ধাপরাধী বা রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কাজে যদি কোনো শিক্ষক জড়িত থাকেন, তবে তাকে রাষ্ট্র গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখতে পারে।
অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। এখানে যে কোনো শিক্ষক যে কোনো মত ও দলের অনুসারী হতে পারেন। এজন্য গোয়েন্দা সংস্থাকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের তথ্য সরবরাহ করা এ প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের কাজ নয়। কেউ যদি এ ধরনের তথ্য চেয়ে থাকে, তা সিন্ডিকেটের অনুমোদন নিতে হয়। তিনি বলেন, আমি জানি না কারা শিক্ষকদের তথ্য সরবরাহ করছে এবং কেন গোয়েন্দা সংস্থা শিক্ষকদের ওপর নজরদারি করছে। এ সংবাদ সত্য হয়ে থাকলে সরকারের এ ধরনের কাজ বেআইনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খবরদারির অধিকার কারও নেই। সরকারের এ কাজের উদ্দেশ্য হতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্যমান্য জ্ঞানি ব্যক্তিদের মধ্যে ভীতি ও ত্রাস সৃষ্টি করা, যাতে কেউ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিবাদী হয়ে উঠতে না পারে। তার মতে, এ ঘটনা দ্বারা সরকারের আসল উদ্দেশ্য ফাঁস হয়ে গেছে।
জানা গেছে, গোয়েন্দা নজরদারি নিয়ে বিক্ষুব্ধ শিক্ষকদের সামলাতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকারদলীয় প্রশাসন দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। উদারপন্থীরা এ ঘটনাকে নিন্দা জানিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে চাচ্ছে। কিন্তু কট্টরপন্থী অংশ গোয়েন্দা নজরদারির ব্যাপারে অনড় অবস্থান নিয়েছে। এ অংশকে আওয়ামীপন্থী শিক্ষকরাও প্রকাশ্যে সমর্থন করছেন। গোয়েন্দা নজরদারি ইস্যুতে প্রশাসনের এই বিভক্তি বুধবার অনুষ্ঠিত একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় প্রকাশিত হয়ে যায়। সভায় বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক তাজমেরী এসএ ইসলাম শিক্ষকদের ওপর গোয়েন্দা নজরদারি এবং তালিকা হওয়ার ব্যাপারে ভিসির দৃষ্টি আকর্ষণ করে এ ব্যাপারে ব্যাখ্যা দাবি করেন। তিনি সভায় গোয়েন্দা নজরদারির ব্যাপারে নিন্দা প্রস্তাব উত্থাপন করলে ভিসি তা গ্রহণ করেন। কিন্তু এসময় আওয়ামীপন্থী নীল দলের আহ্বায়ক অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে বেশ ক’জন শিক্ষক একাডেমিক সভা ছেড়ে চলে যান। জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম শীর্ষ এক কর্মকর্তার ইন্ধনে গোয়েন্দা নজরদারি নিয়ে ভিসির অবস্থানকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে।
গোয়েন্দা নজরদারির ব্যাপারে প্রো-ভিসি অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদ আমার দেশকে বলেন, ক্যাম্পাসে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কি করে, এ ব্যাপারে আমাদের অবহিত করা হয় না। আমরা শিক্ষকদের ওপর গোয়েন্দা নজরদারির কোনো তথ্য জানি না। তিনি বলেন, গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আমার ওপর নজরদারি করে কিনা, তাও তো আমি জানি না। শিক্ষকদের তালিকা করতে গোয়েন্দা সংস্থাকে সহায়তার তথ্য তিনি অস্বীকার করে বলেন, আমাদের সঙ্গে কেউ যোগাযোগ করেনি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তালিকা করতে সহায়তা করার তথ্য ভিত্তিহীন। অপরদিকে ভিসি অধ্যাপক আআমস আরেফিন সিদ্দিক একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় শিক্ষকদের গোয়েন্দা নজরদারির বিষয়টিকে হাস্যকর ও ভিত্তিহীন বলে আখ্যায়িত করেছেন।

http://www.amardeshonline.com/pages/details/2010/04/24/28909

No comments:

Post a Comment