Thursday 22 April 2010

স্বাধীনতাবিরোধীসহ বিএনপির বিতর্কিতরা এখন আ.লীগে

ওয়াসেক বিল্লাহ্ ও নেয়ামত উল্যাহ | Prothom-alo তারিখ: ২০-০৪-২০১০

মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সক্রিয় সহযোগিতা করেছিলেন ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলার চাচড়া ইউনিয়নের গোলাম মাওলা। মুক্তিযুদ্ধের পর দালাল আইনে জেলও খাটেন তিনি। এত দিন তিনি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। ভোলা-৩ আসনে উপনির্বাচনের আগে তিনি এবার আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন।
গোলাম মাওলার মতো লালমোহন ও তজুমদ্দিন উপজেলা বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মী সম্প্রতি বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন। তাঁদের অনেকের বিরুদ্ধে আছে বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের অভিযোগ ছিল। ২০০৪ সালে তোফায়েল আহমেদের গাড়িবহরে হামলার ঘটনায় ছিলেন—এমন ব্যক্তিরাও আছেন এঁদের মধ্যে।
চিহ্নিত স্বাধীনতাবিরোধীর দলে যোগ দেওয়াকে ভালো চোখে দেখছেন না আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মী। তজুমদ্দিন উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক থানা কমান্ডার আবুল কাসেম প্রথম আলোকে বলেন, ‘গোলাম মাওলা ডাইরেক্ট রাজাকার আছিল।’
গোলাম মাওলা বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের পর পটুয়াখালী জেলে ছিলাম। কোনো অভিযোগ প্রমাণ না হওয়ায় পরে জেল থেকে বের হয়েছি।...আমি দলে যোগ দেওয়ায় অনেকে এলাকায় নেতৃত্ব হারাবেন। এ কারণে তাঁরা নানা কথা বলছেন।’
তবে স্থানীয় রাজনীতিকদের অনেকেই বলছেন, জোট সরকারের আমলে নানা অপকর্ম করা এই ব্যক্তিরা বাঁচার জন্য এখন আওয়ামী লীগে ভিড়েছেন। আর ‘ভোটের রাজনীতির’ কারণে আওয়ামী লীগও তাঁদের দলে ঠাঁই দিয়েছে।
তবে আওয়ামী লীগের প্রার্থী নূরনবী চৌধুরী প্রথম আলোর কাছে দাবি করছেন, বিএনপির প্রার্থী হাফিজউদ্দিন আহমেদের অপরাজনীতির কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে বিএনপি থেকে প্রতিদিনই বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মী আওয়ামী লীগে যোগ দিচ্ছেন।
যাঁরা যোগ দিলেন: মলংচড়া ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক সভাপতি আবদুল হাই চৌধুরী, একই ইউনিয়নের ওয়ার্ড বিএনপির সাবেক নেতা নূর মোহাম্মদ ও মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম, চাচড়া ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক দুই যুগ্ম আহ্বায়ক গোলাম মাওলা, মাহমুদউল্লাহ প্রমুখ ১১ এপ্রিল তজুমদ্দিনে তোফায়েল আহমেদের উপস্থিতিতে এক জনসভায় আওয়ামী লীগে যোগ দেন।
এর মধ্যে গোলাম মাওলার বিরুদ্ধে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা, আবদুল হাই চৌধুরীর বিরুদ্ধে নদী দখল করে মাছ ধরা, নূর মোহাম্মদ ও জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে টেস্ট রিলিফ (টিআর) ও কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির (কাবিখা) চাল-গম আত্মসাত্ এবং এলাকায় চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগ আছে। কয়েক বছর ধরে তাঁদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করে আসছিল আওয়ামী লীগ।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তজুমদ্দিন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওহিদুল্লাহ জসিম বলেছেন, যাঁরা দলে যোগ দিয়েছেন, তাঁরা ভোট বাড়াবেন। তবে স্বাধীনতাবিরোধী ও বিতর্কিত ব্যক্তিদের দলে নেওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি মন্তব্য করতে রাজি হননি।
এখন অবশ্য বিএনপি বলছে, যাঁরা আওয়ামী লীগে গেছেন, তাঁরা বিতর্কিত। তজুমদ্দিন উপজেলা বিএনপির সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, মাহমুদউল্লাহ্, আবদুল হাইরা সব সময় সুবিধাবাদী। ক্ষণে ক্ষণে তাঁরা দল পাল্টান। আর গোলাম মাওলা চিহ্নিত স্বাধীনতাবিরোধী। এঁদের চলে যাওয়ায় বিএনপির কোনো ক্ষতি হবে না।
তোফায়েলের ওপর হামলাকারী: ২০০৪ সালে লালমোহনে আওয়ামী লীগের নেতা তোফায়েল আহমেদের ওপর হামলা ও তাঁর গাড়ি ভাঙচুর করেছিল বিএনপির ক্যাডাররা। ওই হামলায় অন্যান্যের সঙ্গে লালমোহন বিএনপির তৎকালীন নেতা জহিরুল ইসলাম মাসুদ পাটোয়ারি, জাকির হাওলাদার, বাবুল পাটোয়ারি প্রমুখ যুক্ত ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে যৌথ বাহিনীর সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান চলাকালে এরা সবাই ছিলেন পলাতক। সম্প্রতি এই তিনজনই যোগ দিয়েছেন আওয়ামী লীগে।
অবশ্য জহিরুল ইসলাম দাবি করেছেন, ‘তোফায়েল আহমেদের ওপর আমার নেতৃত্বে হামলা হয়নি। যারা বলেছে তারা ভুল বলেছে।’
লালমোহন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলী রেজা মিয়া বলেন, ‘ওই ঘটনায় মাসুদ পাটোয়ারির সম্পৃক্ততা ছিল। কিন্তু আমরা মামলা করতে গেলে তখন থানা মামলা নেয়নি।’ এঁদের দলে নেওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, মাসুদ পাটোয়ারি অনেক দিন ধরে হাফিজউদ্দিনের (বিএনপির প্রার্থী) বিরোধিতা করে আসছেন। এ কারণেই তাঁকে দলে নেওয়া হয়েছে।
কালমা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোতাহার হোসেন মৃধার বিরুদ্ধে বিগত জোট সরকারের আমলে দুর্নীতির অভিযোগ আছে। তাঁর ভাই বজলু মৃধাকে দিয়ে ত্রাণের চাল বিক্রির অভিযোগও আছে। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে চাল বিক্রির সময় যৌথ বাহিনীর কাছে হাতেনাতে ধরাও পড়েন মোতাহার হোসেনের ভাই বজলু মৃধা। এই মোতাহার হোসেনও যোগ দিয়েছেন আওয়ামী লীগে।
মোতাহার হোসেন বলেন, এলাকার উন্নয়নের স্বার্থে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন। তিনি কোনো দুর্নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নন বলেও দাবি করেন।
ধলিগৌরনগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোজাম্মেল হক তাঁর নির্বাচনের আগে খুব একটা সচ্ছল ছিলেন না। বিগত জোট সরকারের আমলে বিএনপির প্রভাব খাটিয়ে ও দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হন। তিনি রাজধানীতে বাড়ি করেছেন, লালমোহন বাজারেও করেছেন আরেকটি বাড়ি। যৌথ বাহিনীর অভিযান চলাকালে তিনি বেশ কিছুদিন আত্মগোপন করেন। তিনিও এখন আওয়ামী লীগে।
মোজাম্মেল হক বলেন, ‘ঢাকায় বাড়ি করতে কয় টাকা লাগে? আর লালমোহনে তো করেছি একটি একতলা বাড়ি।’ তিনিও দাবি করেন, এলাকার উন্নয়নের স্বার্থে তিনি ক্ষমতাসীন দলে যোগ দিয়েছেন।
ধলিগৌরনগর ইউনিয়নের বেলায়েত হোসেন ভূঁইয়া, পশ্চিম চরউমেদের আবদুল খালেক, মোস্তফা মিয়া ও কালমা ইউনিয়নের ইয়াকুব আলী বিএনপি থেকে এখন আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন। এঁদের বিরুদ্ধেও রয়েছে নানা অভিযোগ।
উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক বাবুল পঞ্চায়েত বলেন, ‘এরা ব্যাপক দুর্নীতি করেছে। দল থেকে চলে যাওয়ায় বিএনপির লাভই হয়েছে। আমরা ভোটারদের বলি, এরা আগেও লুটপাট করেছে, এখন আবার লুটপাট করার জন্য আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছে। এদের কথা যেন কেউ না শোনে।’

http://www.prothom-alo.com/detail/date/2010-04-20/news/57664

No comments:

Post a Comment