Sunday 18 April 2010

অনুষ্ঠান বর্জন করলেন আপিল বিভাগের বিচারপতিরা

সমকাল প্রতিবেদক | ঢাকা | ১৯ এপ্রিল ২০১০
হাইকোর্টে নতুন নিয়োগ পাওয়া ১৭ বিচারপতির ১৫ জন গতকাল রোববার শপথ নিয়েছেন। প্রধান বিচারপতির চিঠি না পাওয়ায় দু'জন শপথ নিতে পারেননি। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে আপিল বিভাগের বিচারপতিরা যোগ দেননি। আপিল বিভাগের বিচারপতিদের শপথ অনুষ্ঠান বর্জনের মাধ্যমে প্রধান বিচারপতির আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করাকে দেশের বিচার বিভাগের জন্য নজিরবিহীন ঘটনা বলে মনে করা হচ্ছে।
আপিল বিভাগের বিচারপতিদের শপথ অনুষ্ঠানে যোগ না দেওয়া কিংবা নবনিযুক্ত দু'জনকে শপথ না পড়ানোর কোনো কারণের ব্যাখ্যা সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার দফতর থেকে পাওয়া যায়নি। এমনকি প্রধান বিচারপতির এ সিদ্ধান্তের কারণ সম্পর্কে রাষ্ট্রপতিকে অবহিত করার উদ্দেশ্যে কোনো চিঠিও গতকাল বিকেল পর্যন্ত আইন মন্ত্রণালয়ে পেঁৗছেনি। এ পরিস্থিতিতে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ আশা প্রকাশ করে বলেছেন, এ ধরনের কোনো চিঠি রাষ্ট্রপতিকে দেওয়ার জন্য মন্ত্রণালয়ে না আসায় ধারণা করা যায়, প্রধান বিচারপতির ভিন্নতর কোনো সিদ্ধান্ত নেই। সে ক্ষেত্রে যে কোনো দিন তিনি অবশিষ্ট দু'জনকে শপথ গ্রহণের জন্য ডাকতে পারেন। অন্যদিকে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন দু'জনকে বাদ দিয়ে ১৫ বিচারপতিকে শপথ করানোয় প্রধান বিচারপতির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি
সাংবাদিকদের
বলেন, প্রধান বিচারপতি বিতর্কিত ব্যক্তিদের শপথ না দিয়ে বিচার বিভাগের মর্যাদা ও সুপ্রিম কোর্টের ভাবমূর্তি রক্ষা করেছেন। প্রধান বিচারপতির ভূমিকা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। নবনিযুক্ত দু'জন বিচারপতির নিয়োগ বাতিল করার দাবি জানিয়ে খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ভবিষ্যতে এদের শপথবাক্য পাঠ করানো হলে আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে কঠিন কর্মসূচির মাধ্যমে আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।
প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম গতকাল রোববার সুপ্রিম কোর্টের জাজেস লাউঞ্জে নবনিযুক্তদের শপথ পড়ান। শপথ অনুষ্ঠানে আপিল বিভাগের বিচারপতিরা বরাবরই হাইকোর্টের অন্যান্য বিচারপতির সঙ্গে উপস্থিত থাকেন। নবনিযুক্তরা সুপ্রিম কোর্টেরই অন্যতম বিভাগ হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে শপথ নেওয়ায় উভয় বিভাগের বিচারপতিদের উপস্থিতি রেওয়াজ হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত। আপিল বিভাগের বিচারপতিদের গতকাল শপথ অনুষ্ঠানে অনুপস্থিতিকে 'বিরল ঘটনা' হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। তার মতে, অতীতে শপথ অনুষ্ঠানে আপিল বিভাগের বিচারপতিদের বিরত থাকার ঘটনা ঘটেনি।
রাষ্ট্রপতি মোঃ জিল্লুর রহমান গত ১১ এপ্রিল অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে ১৭ জনকে দু'বছরের জন্য নিয়োগ দেন। বিচারপতি হিসেবে যে ১৫ জন শপথ নিয়েছেন তারা হলেন মোঃ ফারুক (এম ফারুক), মোঃ শওকত হোসেন, এফ আর এম নাজমুল আহসান, কৃষ্ণা দেবনাথ, এ এন এম বশিরউল্লাহ, আবদুর রব, ড. কাজী রেজাউল হক, আবু জাফর সিদ্দিকী, এ কে এম জহিরুল হক, জাহাঙ্গীর হোসেন, শেখ মোঃ জাকির হোসেন, মোঃ হাবিবুল গণি, গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুর, শেখ হাসান আরিফ ও জে বি এম হাসান।
শপথের পর সকাল সাড়ে ১১টা থেকে নবনিযুক্তরা সিনিয়র বিচারপতিদের সঙ্গে আদালত কক্ষে বিচারকার্য পরিচালনা করেন। এর আগে প্রধান বিচারপতির নির্দেশে হাইকোর্টের ১৫ বেঞ্চ পুনর্গঠন করে কয়েকটির বিচারিক এখতিয়ারও পরিবর্তন করা হয়। দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন বিভিন্ন আদালত কক্ষে গিয়ে নবনিযুক্ত বিচারপতিদের সংবর্ধনা জানান।
এবার ১৭ বিচারপতি নিয়োগের পর থেকে অ্যাডভোকেট রুহুল কুদ্দুস এবং মোঃ খসরুজ্জামানকে 'বিতর্কিত' দাবি করে তাদের নিয়োগের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয় সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির একাংশ। সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন নবনিযুক্ত দু'জনকে শপথ না পড়াতে একাধিকবার সংবাদ সম্মেলন করে প্রধান বিচারপতির প্রতি অনুরোধ জানান। যদিও সমিতির সরকারপন্থি আইনজীবীরা এটাকে সভাপতির ব্যক্তিগত দাবি বলে অভিহিত করেন। তাদের মতে, সমিতির সভাপতি দলীয় সংবাদপত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে অসত্য, বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বক্তব্য দিচ্ছেন।
কথিত 'বিতর্কিত' আইনজীবীদের অতিরিক্ত বিচারপতি নিয়োগ দেওয়ার প্রতিবাদে মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির এক জরুরি সাধারণ সভা আহ্বান করা হয়েছিল। সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন কালো পতাকা উত্তোলন কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেন। সংশ্লিষ্ট দু'জন শপথ নিলে সমিতির পক্ষ থেকে তাদের সংবর্ধনা না জানানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
এমনই এক পরিস্থিতিতে শপথ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে শপথ নেওয়ার জন্য অ্যাডভোকেট রুহুল কুদ্দুস এবং ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোঃ খসরুজ্জামানকে শনিবার সুপ্রিম কোর্ট থেকে চিঠি পাঠানো হয়নি। সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রারের স্বাক্ষর করা চিঠিতে বলা হয়, অনিবার্য কারণবশত প্রধান বিচারপতি নবনিযুক্ত অতিরিক্ত ১৫ বিচারপতিকে শপথবাক্য পাঠ করাবেন।
শপথ অনুষ্ঠানে আপিল বিভাগের বিচারপতিরা গতকাল কেন উপস্থিত থাকেননি, সে সম্পর্কে জানতে রেজিস্ট্রারের দফতরে যোগাযোগ করে কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। যদিও আপিল বিভাগের বিচারপতিদের সঙ্গে পেশাগত কারণে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করেন_ এমন কয়েকজন সরকার সমর্থক আইনজীবীর কাছ থেকে জানা গেছে, 'কারও নিয়োগ বাতিল করে গেজেট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি যাদের নিয়োগ করেছেন, তাদের সবাইকে শপথ পড়ানো প্রধান বিচারপতির সাংবিধানিক দায়িত্ব। অথচ শপথ পরিচালনার প্রশ্নে রাষ্ট্রপতির ইচ্ছাকে প্রাধান্য না দিয়ে প্রধান বিচারপতি ব্যতিক্রম ঘটাতে পারেন কি-না এ নিয়ে আপিল বিভাগের বিচারপতিদের ভিন্নমত রয়েছে। প্রধান বিচারপতির সঙ্গে এ নিয়ে মতপার্থক্য থাকায় তারা শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দেননি।' নতুন নিয়োগ পাওয়া ১৭ বিচারপতির মধ্যে দু'জনকে বাদ দিয়ে ১৫ জনকে শপথ পড়ানোর ঘটনাকে তারা নজিরবিহীন বলে আখ্যায়িত করেন।
অতীতের দৃষ্টান্ত
যদিও এর আগে '৯৪ সালে বিএনপির শাসনামলে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির আহ্বানে সাড়া দিয়ে রাষ্ট্রপতির নিয়োগ করা বিচারপতিদের শপথ না পড়ানোর নজির বাংলাদেশে আছে। নিয়োগপ্রাপ্তদের শপথ না পড়িয়ে প্রধান বিচারপতি হিসেবে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ তৎকালীন রাষ্ট্রপতিকে কারণ জানিয়ে চিঠি পাঠিয়েছিলেন। পরে আইনজীবীদের প্রতিবাদ এবং সরকারের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি সে নিয়োগ বাতিল করে নতুন নিয়োগ দিয়েছিলেন। এছাড়া রাষ্ট্রপতি নিয়োগ প্রদানের পরও পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি বি এ সিদ্দিকী ১৯৭১ সালে বঙ্গবল্পুব্দর আহ্বানে সাড়া দিয়ে গভর্নর হিসেবে টিক্কা খানকে শপথ না পড়িয়ে যে নজির সৃষ্টি করেন, তা এ দেশে বিচার বিভাগ ও গণতন্ত্রের ইতিহাসে দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। বিচারপতি বি এ সিদ্দিকী এর মাধ্যমে তার শপথ লঙ্ঘন করেছিলেন বলে আজ পর্যন্ত কেউ দাবি করেননি।
আইনমন্ত্রী যা বলেন
বিকেলে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি সমকালকে জানান, দু'জনকে শপথ না পড়ানোর কারণ সম্পর্কে তাকে কিছুই জানানো হয়নি। মন্ত্রী জানান, প্রধান বিচারপতি যদি কারও বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন তাহলে তার কারণ জানিয়ে তিনি রাষ্ট্রপতিকে চিঠি লিখবেন। এর আগে প্রধান বিচারপতির সিদ্ধান্ত কিংবা কারণ সম্পর্কে কিছু জানা সম্ভব নয়।
তিনি আরও বলেন, যে দু'জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হচ্ছে তাদের একজন রাকসুর নির্বাচিত সম্পাদক ছিলেন। ১৯৮৮ সালের একটি হত্যা মামলায় তাকে আসামি করা হয়। কিন্তু হত্যাকাণ্ডের সময় অন্যান্য নেতার সঙ্গে তিনি নাকি প্রভোস্টের কক্ষে মিটিং করছিলেন। বাইশ বছর আগের এ হত্যা মামলা এখনও অনিষ্পন্ন অবস্থায় পড়ে থাকাই প্রমাণ করে, মামলাটি কতটা রাজনৈতিক। এখনও যাকে অপরাধী হিসেবে আদালত অভিযুক্ত করেননি এবং যার বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার হয়ে গেছে, তাকে বিচারপতি নিয়োগে আইনত কোনো বাধাই নেই। অপর একজনকে প্রধান বিচারপতির দরজায় লাথি মারার মামলার আসামি বলা হচ্ছে। কিন্তু যে ছবি সংবাদপত্রে প্রকাশ করা হচ্ছে, তেমন কোনো দরজার অস্তিত্ব প্রধান বিচারপতির কক্ষের সামনে খুঁজে পাওয়া যায় না। তাছাড়া এ মামলার এজাহারে কিংবা পুলিশ যাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছে, তাতে তার নাম নেই। আইনমন্ত্রী বলেন, মামলার সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে জানার জন্য প্রধান বিচারপতি তাদের শপথ পড়ানোর বিষয়টি মুলতবি রেখেছেন, এমনটাও ধরে নেওয়া যেতে পারে।
অ্যাটর্নি জেনারেলের প্রতিক্রিয়া
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ১৭ বিচারপতির মধ্যে দু'জন শপথ নেননি। তাদের নিয়োগের গেজেট বাতিল করা হয়নি। অচিরেই তারা অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে শপথ নেবেন বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, রাজনৈতিক কারণে অনেকের বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে। অ্যাডভোকেট রুহুল কুদ্দুস বাবুর বিরুদ্ধে খারাপ কোনো অভিযোগ নেই। তিনি ছাত্রজীবনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীনতার সপক্ষের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। জামায়াত-শিবির তাকে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে দিয়েছে। বাবুর মতো দক্ষ আইনজীবীকে বিচারপতির পদ হারাতে হবে, এটা তো হতে পারে না।
জাতীয় আইনজীবী পরিষদ
সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে হাইকোর্টে নবনিযুক্ত দুই বিচারপতিকে শপথবাক্য না পড়ানোর ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করা হয়েছে। সংগঠনের সভাপতি অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না এবং সাধারণ সম্পাদক আবদুস সালাম এক যৌথ বিবৃতিতে এ ঘটনাকে নজিরবিহীন বলে উল্লেখ করেন। তারা বলেন, প্রধান বিচারপতির অনুমোদনসাপেক্ষ নিয়োগপ্রাপ্ত ১৭ বিচারপতিকে শপথবাক্য পাঠ করানো প্রধান বিচারপতির সাংবিধানিক দায়িত্ব।

-----------------------------------------------------------------------------------

সরকারের সঙ্গে বিচার বিভাগের দূরত্ব বাড়ছে


আহমেদ দীপু | Kalerkantho| ঢাকা, সোমবার, ৬ বৈশাখ ১৪১৭, ৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০১০

হাইকোর্টের বিচারপতি নিয়োগ এবং বিচারিক আদালতের বিচারকদের পদায়ন ও বদলি নিয়ে সরকারের সঙ্গে বিচার বিভাগের দূরত্ব বাড়ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা প্রকাশ্যে চলে আসছে।
সরকার সম্প্রতি হাইকোর্টে ১৭ জন বিচারপতি নিয়োগ দেওয়ার পর প্রধান বিচারপতি গতকাল ১৫ জনকে শপথ করিয়েছেন। বিচারিক আদালতের ১০৫ জন কর্মকর্তার প্রেষণ বাতিলের বিষয়ে প্রধান বিচারপতি গত মাসে আইন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিলেও এখন পর্যন্ত তা কার্যকর করা হয়নি। বিচারিক আদালতের কর্মকর্তাদের বদলি ও পদায়নের বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয় থেকে প্রস্তাব পাঠানো হলে প্রায় সময়ই সুপ্রিম কোর্ট তা নাকচ করে দেওয়ায় নতুন করে প্রস্তাব পাঠাতে হয়। এভাবেই ফাইল চালাচালি হতে থাকে। এ ধরনের ঘটনাগুলো দুটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দূরত্বের বিষয়টি স্পষ্ট করে তুলেছে।
সংবিধান অনুযায়ী প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি হাইকোর্টের বিচারক নিয়োগ দিয়ে থাকেন। একইভাবে বিচারিক আদালতের বিচারকদের নিয়োগ, বদলি এবং পদায়নের বিষয়টিও সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শের মাধ্যমেই করে থাকে আইন মন্ত্রণালয়। কিন্তু রাজনৈতিক সরকার নানা পর্যায়ের তদবিরের চাপে উচ্চ আদালতের বিচারপতি নিয়োগ থেকে শুরু করে বিচারিক আদালতের বিচারকদের বদলি, পদায়ন এবং প্রেষণ বাতিলের ক্ষেত্রে নিয়ম-কানুনগুলো যথাযথভাবে অনুসরণ করে অনেক সময় কাজ করতে পারে না। এ কারণে সরকার ও উচ্চ আদালতের সঙ্গে দূরত্ব তৈরির সুযোগ সৃষ্টি হয়। অতীতেও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে।
তবে এবার নতুন বিচারপতি নিয়োগ, আপিল বিভাগের বিচারপতিদের নতুন বিচারপতিদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে না যাওয়া এবং প্রেষণ বাতিলের মতো বড় ঘটনা কাছাকাছি সময়ের মধ্যে ঘটে যাওয়ায় বিষয়টি প্রকাশ্যে চলে এসেছে।
আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ গতকাল রবিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রধান বিচারপতির সামনে যেসব কর্মকর্তা এ ধরনের ফাইল উপস্থাপন করেন তাঁদের কারণে ভুল বোঝাবুঝির সুযোগ তৈরি হয়। এটা এ দূরত্ব তৈরিতে সহায়তা করে।
গত ১১ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান ১৭ অতিরিক্ত বিচারককে তাঁদের শপথ গ্রহণের দিন থেকে দুই বছরের জন্য নিয়োগ দেন। তাঁদের মধ্যে দুজনের নিয়োগ নিয়ে বিরোধীদলীয় আইনজীবীদের পক্ষ থেকে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। মো. রুহুল কুদ্দুসের বিরুদ্ধে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র থাকাবস্থায় হত্যার অভিযোগ এবং মো. খসরুজ্জামানের বিরুদ্ধে প্রধান বিচারপতি ও অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় ভাঙচুরের অভিযোগ উঠেছে। নতুন বিচারপতিদের নিয়োগসংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারির পর থেকেই বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে দুজনের বিষয়ে খবর প্রকাশিত হয়। গতকাল এই দুজনকে বাদ দিয়ে বাকি ১৫ জনের শপথ করান প্রধান বিচারপতি। এই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানেও যাননি আপিল বিভাগের বিচারপতিরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিচার বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, এখানে দুটি বিষয় সামনে চলে এসেছে। এক হচ্ছে, রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেওয়ার পর প্রধান বিচারপতি দুজনকে শপথ করাননি। প্রথম দিন শপথ করাননি মানে কোনো দিন করাবেন না_এমন নয়। পরেও শপথ করাতে পারেন। আবার সরকারের সঙ্গে আলোচনা করেও তিনি দুজনকে শপথ গ্রহণ করানো থেকে বিরত থাকতে পারেন। দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, সরকার কিভাবে বিতর্কিত দুজনকে উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগ দেয়।
এ প্রসঙ্গে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, বিএনপির গত মেয়াদে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদ প্রধান বিচারপতি থাকাবস্থায় এ ধরনের একটি ঘটনা ঘটেছিল। ওই সময় নিয়োগপ্রাপ্ত একাধিক বিচারপতির বিষয়ে বার কাউন্সিল থেকে আপত্তি জানানো হয়েছিল। যে কজনের বিষয়ে আপত্তি ছিল তৎকালীন প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনা করে তাঁদের নিয়োগ বাতিল করান এবং বাকিদের নিয়োগসংক্রান্ত নতুন প্রজ্ঞাপন জারির পর তাঁদের শপথ গ্রহণ করান। তিনি বলেন, এ ধরনের একটি রীতি প্রচলিত আছে।
মন্ত্রী বলেন, 'প্রধান বিচারপতি কেন দুজনকে বাদ দিয়ে ১৭ জনের মধ্যে ১৫ জন বিচারপতিকে শপথ করালেন সে বিষয়ে আমি এখন পর্যন্ত কিছুই জানি না। দুই বিচারপতির শপথ গ্রহণ না করানোর বিষয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে প্রধান বিচারপতি আলোচনা করেছেন কি না, তাও আমি বলতে পারব না। তবে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে আপিল বিভাগের বিচারপতিরা উপস্থিত ছিলেন না_এটা শুনেছি।'
অন্য একটি সূত্রে জানা গেছে, ১৭ জন অতিরিক্ত বিচারপতি নিয়োগ দেওয়ার আগে এতে প্রধান বিচারপতির সুপারিশ ছিল। তাঁর সুপারিশের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেওয়ার পর তাঁদের শপথ না পড়ানোয় সরকারের সঙ্গে বিচার বিভাগের দূরত্ব তৈরি হবে বলে অনেকে মনে করেন। আবার এই নতুন দুই বিচারপতিকে শপথ না পড়ানোয় এ অনুষ্ঠানে আপিল বিভাগের বিচারপতিরা যোগ দেননি_এমনও হতে পারে বলে আভাস পাওয়া গেছে।
গত ২৩ মার্চ সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ফজলুল করিম বিচারিক আদালতের ১০৫ কর্মকর্তার প্রেষণ বাতিল করে বিচারকর্মে যোগ দেওয়ার জন্য আইন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেন। এই চিঠির সঙ্গে তিনি ১০৫ কর্মকর্তার নামের একটি তালিকাও দেন। স্বাধীন বিচার বিভাগের স্বকীয়তা বজায় রাখা এবং বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি দূর করার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে তিনি প্রেষণ বাতিলের চিঠি দেন। বর্তমানে আইন মন্ত্রণালয়, সংসদ সচিবালয়, দুর্নীতি দমন কমিশন, নির্বাচন কমিশন, সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার অফিস, বিচার প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, আইন কমিশন, জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তর-অধিদপ্তরে মোট ১০৭ জন কর্মকর্তা প্রেষণে কাজ করছেন। তাঁদের মধ্যে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বিচার বিভাগের সচিব এবং সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রারকে বাদ রেখে বাকি ১০৫ জনের প্রেষণ বাতিল করার কথা প্রধান বিচারপতির চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। এই চিঠি নিয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের মাসিক সমন্বয় সভায় আলোচনা হয়। এ সময় ১০৫ জনের প্রেষণ বাতিল করা হলে কী ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হবে সে বিষয়টি তুলে ধরা হয়। প্রেষণ বাতিল করা হলে বিচার বিভাগের জন্য নির্ধারিত পদগুলো প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা দখল করে নেবেন_এ ধরনের আলোচনাও হয়। কাজেই ঢালাওভাবে ১০৫ জনের প্রেষণ বাতিল না করে যেসব কর্মকর্তা আড়াই বছর যাবৎ এ ধরনের (প্রেষণ) পদে আছেন তাঁদেরটি বাতিল করা যেতে পারে বলে কয়েকজন মত দেন। এতেও বিরোধিতা করেন সভায় উপস্থিত কয়েকজন কর্মকর্তা।
সব শেষে প্রেষণের মেয়াদ তিন বছর হলে তাঁকে বিচারিক কাজে ফিরে যেতে হবে_এই মর্মে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ বিষয়ে একটি প্রস্তাব সুপ্রিম কোর্টে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ। তিনি কালের কণ্ঠকে জানান, যাঁদের প্রেষণের মেয়াদ তিন বছর হয়েছে তাঁদের বদলি করা যেতে পারে। সবাইকে একসঙ্গে বদলি করা হলে সুপ্রিম কোর্ট এবং আইন মন্ত্রণালয় উভয় দিকেই কাজের সমস্যা হবে। এই বিবেচনাতেই আইন মন্ত্রণালয় থেকে সুপ্রিম কোর্টের কাছে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

No comments:

Post a Comment